পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

বনবীথি পাত্র

রবীন্দ্রনাথ-বসন্তকাল এবং বাঙালী

বেশ কিছুদিন উত্তরভারত ভ্রমণের পর এবার ঘরে ফেরার ফেলা । চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে একে একে পিছনে সরে যাচ্ছে উচুঁউচুঁ পাহাড়ের সারি , পাহাড়ি সভ্যতা । আস্তে আস্তে নেমে আসছি সমতলে  প্রকৃতির রূপ-আবহাওয়া সব যেন পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে । পাহাড়-ঝর্ণা-তুষার শুভ্র হিমালয়ের শোভায় দুচোখ ভরে গিয়েছিল , তবু বাংলার যেন এক অমোঘ টান আছে রক্তে । সবুজ ধানক্ষেত-নদী-শালবন-মেঠো পথ-চেনা পাখির ডাক সব যেন বড়ো বেশি আপনার ।
যদিও শীত চলে গেছে , তবু ভোরের দিকে এখনো হালকা ঠাণ্ডার হিমেল আবেশ থেকে গেছে যেন । ভালোবেসে একটু উষ্ণতার পরশ গায়ে জড়িয়ে ট্রেনের জানলাটা খুলতেই চোখ যেন জুড়িয়ে গেলো ।
শীতের রুক্ষ-বিবর্ণতা মুছে দিয়ে নব কিশলয় আর ফুলের সম্ভারে  বসন্ত এসে গেছে । জরাজীর্ণ শুষ্ক প্রকৃতি একটু একটু করে যেন সেজে উঠেছে নব তারুণ্যের সাজে । শীতের জড়তার মাঝে যেন এর অপেক্ষাতেই পথ চেয়েছিলাম এতোদিন ।
"এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে , দেখা পেলেম ফাল্গুনে । "
বসন্তকাল আর রবীন্দ্রনাথ , বাঙালী হৃদয়ে কখন যেন অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে গেছে । রবীন্দ্রভাবনায় বসন্ত যেন ত্যাগের ঋতু । সমস্ত জীর্ণতা-দীনতা ত্যাগ করে , নতুন করে বেঁচে ওঠার ডাক দিয়ে যায় বসন্ত । সকল বাঁধন ছেড়ে যেন উচ্ছ্বলতায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতেই বসন্তের আগমন ।
"ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।
আমার আপন হারা প্রান
আমার বাধন ছেঁড়া প্রান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।
তোমার অশোকে কিংশুকে ,
অলক্ষ রঙ লাগলো আমার অকারণের সুখে ,
তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান ।"
রবীন্দ্রনাথকে বোধহয় শ্রেষ্ঠ বসন্তবিলাসী বাঙালি বললেও বেশি বলা হবে না । তাঁর সৃষ্টিতে তিনি বসন্তকে নানা রূপে তুলে ধরেছেন । তিনি বসন্তের ফুলে ফুলে ছাপিয়েছেন আপন কবিতার কূল। কবিগুরুর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে  "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" কবিতায় বসন্ত দিনের জাগরণের সুর তুলেছেন আপন ভঙ্গিমায় ।
"আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে ,
কোরো না বিড়ম্বিত তারে ।"
আবার কখনো বসন্তের রিক্ততা ধরা পড়েছে তাঁর ছন্দে ।
"ঝরা পাতা গো , আমি তোমারি দলে ।
অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে
ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র
আমার হিয়াতলে ।"
শীতের শেষে বসন্তের সূচনায় কবিগুরু কখনো আবার নব জীবন-যৌবনের উন্মাদনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। প্রকৃতির সবখানে চৈত্রের উতল দখিন হাওয়ায় নবজীবনের জয়গান বেজে ওঠায় কবিও একই চেতনায় উদ্বেলিত। শিরীষের হিন্দোল, ঝুমকোলতার সজীবতা , নব কিশলয়ে বাতাসের হিল্লোল , যে আনন্দ-উল্লাস , সবুজের এই আয়োজনে কবির মন উচ্ছ্বসিত ও গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছে । অন্যদিকে পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার রক্তরাগ, মল্লিকার সৌন্দর্য, আমের মুকুলের মাতাল করা সুবাস , দোলনচাঁপার শুভ্রতা, চম্পার পুলককবির সুপ্ত প্রাণমনকে চঞ্চল ও উতলা করে তুলেছে বারবার । শাখায় শাখায় বনে বনে ফুলে ফুলে দখিন হাওয়ার স্পর্শে প্রাণের আগমন । উতলা উত্তরীয় উড়িয়ে কবি তাই বারবার আহ্বান করেছেন বসন্তকে । প্রেমের অনুভূতি ও আবেগ এই উতল হাওয়ায় কবির মাঝে জাগ্রত। ফাগুন তাই কবির কাছে নবজীবনের সাতরঙের বিচ্ছুরণ, অকারণে চঞ্চলতা , প্রাণের দীপ্তি-কোলাহল , জীবনের জয়গান , ঝর্ণার নিরন্তর আনন্দধারা , জীবনের পল্লবিত সবুজছায়া ; যেন নবযৌবনের দৃপ্ত পদযাত্রা । তাই তো বিশ্বকবি বলেছেন ,
"ওরা অকারণে চঞ্চল
ডালে ডালে দোলে 
বায়ুহিল্লোলে নবপল্লবদল ॥
বাতাসে বাতাসে প্রাণভরা বাণী
শুনিতে পেয়েছে কখন কী জানি ,
মর্মরতানে দিকে দিকে আনে
কৈশোর কোলাহল ॥
ওরা কান পেতে শোনে গগনে-গগনে 
মেঘে মেঘে কানাকানি ,
বনে বনে জানাজানি ।
ওরা প্রাণঝরনার উচ্ছলধার
ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার ,
চিরতাপসিনী ধরণীর ওরা শ্যামশিখা হোমানল ॥"
তাঁর ‘রক্তকরবী’র প্রাকৃতিক পটভূমিও নির্মিত হয়েছে বসন্তের আবহাওয়ায় ও অনুষঙ্গে ।
বসন্তের এই রূপ দীর্ঘস্থায়ী নয় । তবু যতটুকু ক্ষণ থাকে , প্রাণবন্ত ভাবে ছুঁয়ে থাকে আমাদের , ভরিয়ে দেয় নব আশ্বাসে ।
"একটুকু ছোঁওয়া লাগে , 
একটুকু কথা শুনি--
তাই দিয়ে মনে মনে 
রচি মম ফাল্গুনী।
কিছু পলাশের নেশা, 
কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে 
রঙে রসে জাল বুনি॥
যেটুকু কাছেতে আসে 
ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিত মনের কোণে 
স্বপনের ছবি আঁকে
যেটুকু যায় রে দূরে   
ভাবনা কাঁপায় সুরে,
তাই নিয়ে যায় বেলা
নূপুরের তাল গুনি ॥"
রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বসন্ত আর বসন্ত ছাড়া বাঙালী যেন তাই অসম্পূর্ণ । 

ছবি : গুগুল

সুব্রত ব্যানার্জী

#এলোমেলো_চেষ্টা

 

অবিন্যস্ত চেরা সিঁথিতে
হৃদয়ের ট্রামলাইন
টার্মিনাসে পৌছানোর চেষ্টা
কিন্তু আমি পারছি না

বোকাবাক্সটা বোবা আজ
শুধু এলোমেলো কিছু ছবি
চোখে রঙীন চশমা পরে
রঙ চিনতে পারছি না

দেয়াল ধারে শেওলা জমে
মন টা ভারী পেছল
টিকটিকি টা উঠতে চাইছে উপরে
কিন্তু মন বাইতে পারছে না

বেশ তো আছি শুয়ে
একই খাটে পাশাপাশি
তবুও তো আমি না জানি কেন
তোমায় ছুঁতে পারছি না

নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি
বেঁচে আছি কি আদৌ আমি
হঠাৎ করে আলফাজ্ হীন 
উত্তর খুঁজেও পাচ্ছি না।

ছবি : গুগুল

মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০১৭

যুগান্তর মিত্র


"মনের মানুষ" কালিকাপ্রসাদ 
……………………………………………………………………………………

যুগান্তর মিত্র 

"মায়াজালে বন্দি হয়ে আর কতকাল থাকিব, 
মনে ভাবি সব ছাড়িয়া তোমারে খুঁজে নিবো।
আশা রাখি আলো পাবো ডুবে যাই অন্ধকারে।" 

কালিকাপ্রসাদের অন্যতম প্রিয় এক গান। শাহ আবদুল করিমের এই গানটি তিনি অত্যন্ত দরদ দিয়ে গাইতেন। অবশ্য কোন্ গানটাই-বা তিনি দরদ দিয়ে গাইতেন না? তাঁর লোকগানের দল দোহার। সাম্প্রতিককালে বাংলা লোকসঙ্গীত ও দোহার যেন মিলেমিশে গিয়েছিল। কালিকাপ্রসাদের আরও একটি প্রিয় গান ছিল ছিল ~ 

"গান গাই আমার মনেরে বোঝাই মনটা যে পাগলপারা
আর কিছু চাই না মনে গান ছাড়া …" 

বাস্তবিক তিনি গান ছাড়া আর কিছুই বুঝি চাইতেন না। সেই গানের এক অনুষ্ঠানে গাইতে যাচ্ছিলেন বীরভূমের সিউড়িতে। যাওয়ার পথে হুগলির গুড়াপে এক পথদুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাঁদের গাড়িটি। পাশের নয়ানজুলিতে পড়ে যায় গাড়িটি। কালিকাপ্রসাদ প্রাণ হারান। বাকি ৬ জন সদস্যও গুরুতর আহত হন। 

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কালিকাপ্রসাদের মৃত্যু হয়নি। এই ধরনের শিল্পীদের মৃত্যু হয় না। এঁরা বেঁচে থাকেন নিজের শিল্পে, সৃষ্টিতে, মানুষের মনমন্দিরে। 

বন্ধু সোমব্রত সরকার যথার্থই লিখেছেন, "তাঁর গায়কিতে ছিল ভক্তি ও দরদ।" কালিকাপ্রসাদের গায়কির এটি ছিল অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। দরদ দিয়ে, প্রাণ ঢেলে তিনি গাইতেন। লোকগান অনেকেই গেয়েছেন। কতিপয় গায়ক যথাযথ উচ্চারণে লোকসঙ্গীতে ব্যবহৃত শব্দের সঠিক উচ্চারণ করতে পারতেন। তিনি পারতেন। তাঁর উচ্চারণ ও গায়কীর মধ্যে আছে মাটির গন্ধ। সোমব্রত সরকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের থেকে কিছু অংশ তুলে দেওয়া যাক। 


"গুরু মুর্শিদের পদ কত যত্ন নিয়ে গাইতেন তিনি। তাঁর গায়কিতে ছিল ভক্তি ও দরদ। রাধারমণের গান ছিল প্রিয়। প্রিয় ছিল সিলেট তথা গোটা হাওর। হাসন রাজা, ফকির লালন শাহ, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ। তাঁর কথায় হাওরের গানের ঢেউ খেলত। বিচ্ছেদী, মনসার গান, মুসলিম বিয়ের গান, গুরুতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, রাসুলতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, ভাটিয়ালি সব তাঁর দরদে প্রাণ পেত। হাওর ও অসম ---- লোকায়ত গানের এই দুই অঞ্চল তাঁর সুরে বয়ে যেত। কালিকাপ্রসাদ, দোহার --- একই সত্তার ঘরবাড়ি। আজ চলে গেলেন। কুষ্টিয়া, রাজশাহী, যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ, নদিয়া, বীরভূম, বর্ধমান , মুর্শিদাবাদের বাউল ফকিরি গান তাঁর মতো বিশুদ্ধতা নিয়ে গাইতে পারত কজন।"


এমন একজন মানুষের চলে যাওয়া বড় বেদনার। বাংলারই শুধু নয়, সকল ক্ষেত্রের লোকসঙ্গীতেরই অপূরণীয় ক্ষতি হল। 

বাংলাদেশে গত ৩ মার্চ মুক্তি পেলো ভুবন মাঝি চলচ্চিত্রটি। এই সিনেমার সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ করেন কালিকাপ্রসাদ। তিনি সেখানকার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, এই প্রথম তিনি কোনো সিনেমার জন্য গান লিখলেন। (যদিও মনের মানুষ, জাতিস্মর প্রভৃতি সিনেমাতেও তিনি কাজ করেছেন।) বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলনের সময় তিনি গান লিখেছিলেন। আসলে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আলাদা একটা টান ছিল। 

আসামের শিলচরের মানুষ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ ও কালিকাপ্রসাদের জন্মবছর একই, ১৯৭১ । তাই কি বাংলার জন্য এত টান ছিল। এ বোধহয় নিতান্তই সরীকরণ। তিনি বাংলার লোকসঙ্গীতের পাল তোলা নৌকো ছিলেন। তাই দুই বাংলার প্রতি, সমগ্র পূর্বাঞ্চলের প্রতিই তাঁর স্বাভাবিক ভালোবাসা ছিল।

বাবা, কাকারা ছিলেন গানের জগতের মানুষ। সেই স্রোতধারা তিনিও তাঁর রক্তে বহন করে চলেছিলেন। শিলচর থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়তে। কিন্তু সেই স্রোতধারা বয়েই চলছিল ভেতরে ভেতরে। তাই গানের প্রতি অমোঘ টান উপেক্ষা করতে পারেননি। গড়ে তুলেছেন দোহার ব্যান্ড। লোক-আঙ্গিকের বিভিন্ন গান তিনি তুলে ধরলেন বাংলার মঞ্চে, সঙ্গীতের অঙ্গনে। শুধু তো গান গাওয়াই নয়, তিনি ছিলেন লোকসঙ্গীতের একজন মরমী গবেষকও। তাঁর মৃত্যু সেই গবেষণারও ক্ষতি করে দিয়ে গেলো। লোকসঙ্গীতের উপর তাঁর দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল অপরিসীম।


শিল্পীর মৃত্যু হয় না। তারা বেঁচে থাকেন তার সৃজনশীলতায়। কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যও সেভাবেই থেকে যাবেন। 

তাঁর প্রতি রইল সৃজনের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম।