হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা : রবীন্দ্রনাথের দাদুর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথের সমালোচনা
হৃৎপিণ্ড : আর কতো দূর হুলি ?
আমি : আরও দুই মাস, রাজকুমার ।
আমি এপর্যন্ত
চারবার জন্মেছি, যা আমার মনে আছে, বাকিগুলো তেমন মনে
রাখতে পারিনি, অ্যালঝিমারের রোগের দরুণ, আর চারবারই আমি পাঁচের নামতায় মারা গেছি, পঁচিশ থেকে
পঁচাত্তরের মধ্যে, মানুষ হয়ে জন্মাবার কথা বলছি, হয়তো তার আগে কীট পতঙ্গ জন্তু জানোয়ার হয়ে জন্মে থাকবো, সেসব স্মৃতি ধরে রাখতে পারিনি, কেননা কীট পতঙ্গ
জন্তু জানোয়ারের পূর্বজন্মের স্মৃতি হয় কি না জানি না, আগের জন্মে কালেজে পড়ার সময়ে ডারউইন সাহেবের বই পড়ে দেখেছি তাতে উনিও কিছু
লিখে যাননি ।
আমার এখনকার জন্ম
দিয়েই শুরু করি । আমি ছিলুম রাজকুমারের খাস-চাকর । উনি আমাকে হুকুম দিয়েছিলেন যেন
আমি ওনাকে অন্য লোকের সামনে হুজুর বলে সম্বোধন
করি । উনি যেখানে যেতেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, আমি না হলে ওনার
গোপন ফাই-ফরমাস খাটার লোক ছিল না, সকলকে বিশ্বাস
করতেন না, বলতেন ওরা সব হাফলিটারেট ইডিঅট ।
রাজকুমারের সঙ্গে
থাকতে থাকতে আমি ইংরেজি শিখে নিয়েছিলুম । উনি ফারসি আর ইংরেজিতে বেশ তুখোড় ছিলেন, সুতানুটি গোবিন্দপুরের বিলেতি সাহেব-মেমরাও ওনার ইংরেজি শুনে মাথা দোলাতো, নিজের চক্ষে দেখা । আফিম, চিনি, নুন, নীল, রেশম, কয়লার ব্যবসায় ওনাকে টক্কর দেবার মতন কোনো বাঙালি মাই-কা লাল ছিল না ।
একটা মজার কথা তোকে
বলি, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললেন, বাবর ওনার বাবরনামায় কতোকিছু লিখে গেছেন হিন্দুস্তান সম্পর্কে, উনি জানতেন না যে এদেশে কয়লা নামে এক রকমের পাথর মাটির তলায় পাওয়া যায় ; ওনারা কাঠকয়লার কথা জানতেন, গাছ পুড়িয়ে রান্নার
জন্যে কাঠকয়লা তৈরি করতেন । আমিই তো ইরেজদের কয়লার কথা বললাম, এই বাংলার মাটির তলায় অঢেল কয়লা পাওয়া যায়, বিশ্বাসই করতে
চায়নি ব্যাটারা ।
বললুম, হুজুর, আমি এর আগে একটা জন্মে হুলিকাঞ্চন গুপ্তা হয়ে বেনের
বাড়িতে জন্মেছিলুম, তখন আমরাই বাবর আর ইব্রাহিম লোদিকে মাল সাপলাই করতুম
। নেড়েরা কয়লার কথা জানতো না, যুদ্ধু করতে গিয়ে
ওদের কাঠ কয়লার দরকার পড়তো, সেগুলো আমরাই সাপলাই দিতুম, শুকনো আর কাঁচা মাংস, সেনাদের জন্যে মদ, আফিম সাপলাই দিতুম
। শ্মশান থেকে অঢেল কাঠ কয়লা পাওয়া যেতো, শ্মশানের পাশেই
আমাদের কাঠ কয়লার গুদোম খুলতে হয়েছিল ।
হৃৎপিণ্ড
কিম্বদন্তি হতে চাননি ।
রাজকুমার ইতিহাস
হতে চাননি ।
ওনার পা ব্যথা করলে
আমি অনেকক্ষণ পা-টিপে ঘুম পাড়াতুম ।
পুরুতের পরিবার কেন
ব্যবসাদার হয়ে গেল, সবাই জানতে চায় ।
পুরুত না হয়ে কেন
আমিন, মুৎসুদ্দি, সেরেস্তাদার, বানিয়ান, মহাজন, কোম্পানির দালাল, কমিশনখোর, গোমস্তা, আমলা, জাহাজের কারবারি হয়ে গেল, জানতে চায় ।
কেন আবার ! সমাজের
দেয়া চোট-জখম থেকে উচ্চাকাঙ্খার বোধ, সমাজ একঘরে করে
দেয়ায় গভীর চোট-জখম, পরিবারের সদস্যদের দেয়া আঘাত, স্বদেশবাসীর রক্ষণশীলতা । সুতানুটি-গোবিন্দপুরের কোনো বামুন রাজকুমারের বাড়ি
গেলে, তার জরিমানা ধার্য ছিল, সেই বামুন পুরুতদের
পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে নিজের ব্রাহ্মণ পিঁড়িতে ফিরতো, বিগট, বিগট, বিগট, বিগট ! কে এক পুরুষোত্তম পীর আলি খানের রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানি রাঁধার খাইখাই গন্ধ পেয়েছিল, ব্যাস, কিম্বদন্তি চালু ।
সুতানুটি-গোবিন্দপুরকে
মেট্রপলিস কে বানালো ?
মফসসলগুলোয় গথিক
স্হাপত্যের জমিদারবাড়িগুলো, যা ভেঙে-ভেঙে চুনবালিসুরকির চুরো হয়ে গেছে, কার বাড়ির নকল ?
দলপতির বিরুদ্ধতা
কে করল ? রেনিগেড, রেনিগেড, রেনিগেড । দলপতির বাড়ি থেকে নিজের বাড়ির দূরত্ব এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত
আট নয় দশ করতে করতে একশো কোশ সরে গেলো।
মেট্রপলিসের প্রথম
প্রেমিকবয় ।
হৃৎপিণ্ড :
প্রেমিকবয় হওয়া ভালো, নাকি গুচ্ছের অ্যাণ্ডাবাচ্চা পয়দা করে দেশের জনসংখ্যা
বাড়ানো ভালো, বল তুই ?
আর কেউ রাজকুমারের
পরিবারের পেডিগ্রির সমকক্ষ করে তুলতে পারেনি নিজের পরিবারকে ।
রাজকুমার ব্যবসার
কাজে বাইরে গিয়েছিলেন, সেই সুযোগে ওনার মাকে, যিনি রাজকুমারকে
ছোটোবেলা থেকে নিজের ছেলের মতন মানুষ করেছিলেন, তাঁকে যখন গঙ্গার
ধারে অন্তর্জলী যাত্রায় নিয়ে গিয়ে রাখা হল, বলেছিলেন, রাজকুমার বাড়িতে থাকলে তাঁকে এই জ্বালাযন্ত্রণা পোয়াতে হতো না, বাড়িতে নিজের ঘরেই মারা যেতাম ।
হৃৎপিণ্ড বলল, আমার সম্পর্কে তুই যেসব গুজব শুনিস, সবই সত্যি হুলি, তুই তো আমার খাস চাকর, সবই দেখিস । হ্যাঁ, নুনের মোলুঙ্গিদের
আমি চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতুম । নিলামে পড়ন্ত জমিদারদের জমিদারি কিনে নিতুম, কড়া জমিদার ছিলুম, গরিব হলেও নীলচাষিদের রেয়াত করতুম না, কিন্তু আমার আইনি পরামর্শতেই তো যশোরের রাজা বরোদাকান্ত রায়, বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখার্জি, কাসিমবাজারের
হরিনাথ রায়, পাইকপাড়া রাজ পরিবারের রানি কাত্যায়নি নিজেদের
জমিদারির নিলাম হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল। আমাকে কোম্পানির কমপ্রাডর বললে আপত্তি
করব না ।
রাজকুমার চুপ করে
গেলেন বেশ কিছুক্ষণের জন্যে ; সেই সুযোগে আমি
ওনাকে আমার আগামি জন্মে ঘটে যাওয়া দেশভাগ, বাংলাদেশে বাঙলা
ভাষার জন্যে লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ, লক্ষ-লক্ষ
উদ্বাস্তুর যশোর রোডে চ্যাঁচারির চালায় ঠাঁই, সেই যশোর রোডের
ছায়াকে কেটে ফেলার ঠিকেদারি, বাংলাদেশকে স্বাধীন
করার জন্যে ভারতীয় সেনার আক্রমণ, পাকিস্তানিদের
নব্বুই হাজারের বেশি সেনা ভারতের হাতে বন্দী, বাংলাদেশের গদ্দার
বাহিনী রাজাকর, আল বদর, তাদের ফাঁসি আর
পাকিস্তানের বিফল হয়ে যাওয়া রাষ্ট, সব গল্প শোনালুম ।
এখনকার বাংলাদেশে হিন্দুদের দেবী-দেবতার মন্দির ভেঙে ফেলার, বাঙালি মুসলমানদের গোঁপ কামিয়ে দাড়ি রাখার, হিন্দুদের
তাড়িয়ে-তাড়িয়ে পুরোদেশটাকে নেড়েভূমি করার ঘটনা বললুম ।
হৃৎপিণ্ড বলল, জানিস, কখনও ভাবিনি যে বাঙালিদের দেশটা পাকিস্তানের মতন একটা
ফেলমারা এলাকা হয়ে যাবে, ইউরোপিয়রা যাকে বলে ফেইলড স্টেট ।
আমি তো পঞ্চাশ-ষাট
বছর আগে কতো কমপ্রাডরকে দেখেছি, চীনের ঘুষ খেয়ে
দালালি করতো, রাশিয়ার ঘুষ খেয়ে দালালি করতো, তারাও তো বেনিয়ান, রেনিগেড, ভিনদেশের দালাল, সব ভোঁভাঁ, হামবড়াই ফুসকি, দেয়ালে লেখালিখি
ফুসকি, দলপতি ফুসকি, দল ফুসকি ।
আমিও যে একটা জন্মে
প্রেমিকবয় ছিলুম, তা আর রাজকুমারকে বললুম না, মনে হবে ওনার সমকক্ষ হবার চেষ্টা করছি, প্রেমিকবয় মানে
সেকেলে লোকেরা যাকে বলে দুশ্চরিত্র হওয়া, এই যেমন যারা
চিরকুমার আর শাকাহারি তারা নিজেদের মনে করে সাত্বিক, তারা যদি কাউকে
মদমাংস খেতে দেখে, বউ ভাড়ার কোঠায় যেতে দেখে, রেসের মাঠে যেতে, জুয়ার আড্ডায় যেতে, নাইট ক্লাবে গিয়ে
নাচতে, কিংবা বছরে বছরে প্রেমিকা বদলাতে দেখে, তাদের মনে করে তামসিক, সোজা বাংলায় চরিত্রহীন, আমি তা-ই ছিলুম ।
দুর্গাপুরের বড়ো রাস্তায় মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলুম, সেই যে জায়গাটা দুর্ঘটনার জন্যে তৈরি হয়েছে, ফি বছর দু’চারটে গাড়িতে মানুষ থেঁতো হয় ।
দুশ্চরিত্র জীবনে, আমার নাম হুলিই ছিল, পদবি ছিল শিট, পদবিটা আমার পছন্দ
ছিল না, শিট মানে তো গু, তাই আমি সবাইকে
নিজের পরিচয় দিতুম হোলি শেঠ নামে ; বাবা হুমকিপতি দলদাস ছিলেন, প্রচুর টাকাকড়ি
গ্যাঁড়াতে পেরেছিলেন, তোলাবাজি কমিশন
ঠিকেদারি দালালি ঘুষ সিণ্ডিকেট থেকে, বাড়ির ওয়াশিং রুমের
দেয়ালে যে আলমারি ছিল তা বাইরে থেকে দেখে টের পাওয়া যেতো না, রিমোট দিয়ে খুলতে হতো, সোনার বিস্কুটও সেখানেই রাখা থাকতো । আমি তখন বাঙালি
গেস্টাপো গুণ্ডা-ক্যাডারদের পুষতুম ।
আমার সম্পর্কে এক
মহিলা, যার সঙ্গে কিছু দিনের প্রেমিকবয় সম্পর্ক পাতিয়েছিলুম, কমপ্লিকেটেড, সে আমার সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখে রেখে প্রচুর কোকেন
নিয়ে বাথটবে চান করার সময়ে ডুবে মারা গিয়েছিল :
“হে ভগবান, কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নেই ।”
“হে ভগবান, হীরের আঙটি পরিয়ে আটকে রেখেছে ।”
“হে ভগবান, কিনারায় নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে ।”
“হে ভগবান, আমিই একমাত্র নই ।”
“হে ভগবান, ছেড়ে চলে যাওয়া যে সম্ভব হচ্ছে না ।”
“হে ভগবান, এ যে এক নম্বরের ফ্লার্ট ।”
“হে ভগবান, কাজকর্ম ব্যবসা দেখার এর আগ্রহ নেই ।”
“হে ভগবান এর যে কী
কাজ আর কী ব্যবসা তাও জানতে পারলাম না এতো দিনে ।”
“হে ভগবান, সম্পর্কের বনেদ কেবল যৌনতা ।”
“হে ভগবান, এ যে ঢ্যাঙা ফর্সা রূপবান জলের মতন টাকা খরচ করে ।”
“হে ভগবান, এর কাজের সঙ্গে কথার মিল নেই ।”
“হে ভগবান, এ মূল প্রশ্নের উত্তর দেয় না, এড়িয়ে যায় ।”
“হে ভগবান, এর বাড়ির চাকরানি এতো সুন্দরী যে চাকরানি বলে মনে হয় না ।”
“হে ভগবান, এ যে সব সময়েই নিখুঁত ।”
“হে ভগবান, এর সব সময়েই এতো তাড়া কেন যে ।”
“হে ভগবান, এ রোজই একটা ফুলের তোড়া পাঠায়, সঙ্গে হাল আমলের
গানের ক্যাসেট ।”
“হে ভগবান, এ প্রতিদিন নতুন পোশাক পরে থাকে, নতুন পারফিউম লাগায়
।”
এই সব ভাবতে ভাবতে
রাজকুমারের বন্ধুনি কবি ক্যারোলিন নরটনের কথা মনে পড়ছিল আমার, অপরূপ সুন্দরী, রাজকুমারকে ভালোবাসতেন । বজরায় ওয়াল্টজ, কোয়াড্রিলো, গ্যালপ নাচতেন দুজনে । ক্যারোলিনের বরের সঙ্গে
ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তালাক নয়, এমনিই ছাড়াছাড়ি, ক্যারলিন লর্ড মেলবোর্নের সঙ্গে ইশক ওয়ালা মোহব্বত করতো, তা ধরে ফেলেছিল ওর বর, ফলে ছাড়াছাড়ি, ছাড়াছাড়ির দরুন
ক্যারোলিনের টাকাকড়ির এমন খাঁকতি পড়েছিল যে রাজকুমার মণিমুক্তো বিলিয়ে দেন শুনে
আঁকড়ে ধরেছিল, রাজকুমারকে ফুসলিয়ে অনেক সোনাদানা আদায় করতে পেরেছিল
।
রাজকুমার মারা যেতে
মনের দুঃখে ক্যারোলিন একখানা কবিতা লিখেছিল, ‘আমার হৃদয় এক শুকনো
বাদাম’ শিরোনামে, তার গদ্য করলে এরকম
দাঁড়ায় :
আমার জীবন এক শুকনো বাদামের মতো
ফাঁকা খোলের ভেতরে
ঝুমঝুমির মতো বাজে
তুমি আমার বুকের ভাঁজ খুলে তার ভেতরে রাখতে পারবে না
তাজা কোনো জিনিস যা
সেখানে বাসা বাঁধতে পারে
আশা আর স্বপ্নে ভরা ছিল এক সময় যখন
জীবনের বসন্তগৌরব
আমার দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে
বিদায় নিয়েছে আজ সেখানে আনন্দ নেই দুঃখ নেই
আর শুকনো হৃদয় কখনও
উদ্বেলিত হবে না
আমার জীবন এক শুকনো বাদামের মতো
এক সময়ে প্রতিটি
স্পর্শে জেগে উঠতো
কিন্তু এখন তা কঠিন ও বন্ধ হয়ে গেছে
আমি তার হয়ে
ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারবো না
প্রতিটি কন্ঠস্বরের আলো আমার ভ্রুপল্লবকে
কাঁপাতে পারতো
প্রতিটি মৃদু
বাতাসে দুলে উঠতো গাছের ডাল
যে ডালে রোদের আলোয় দোল খেতো বাদামফল
এখন তা শীতে
আক্রান্ত, আমার মতো কঠিন আর দুঃখী
আমার হৃদয় এক শুকনো বাদামের মতো
যে দেখতো সে-ই
আকর্ষিত হতো এক সময়
কিন্তু যবে থেকে দুর্ভাগ্য আমাকে ভেঙেচুরে দিয়েছে
তেতো হয়ে গেছে
মুখের স্বাদ গন্ধ
তার চঞ্চল যৌবনের নতুন পরাগ
শেষ হয়ে গেছে আর
ফিরবে না কোনোদিন
আর আমি অনুভব করি আমার দুঃখী হৃদয়ের সত্য
রোদ নেই, হাসি নেই, যা আমাকে ঔজ্বল্য দেবে ।
চাকরদের মুখ তুলে
অতিথিদের দিকে তাকানো অনুচিত, তবু আমি ক্যারোলিন
নর্টন এলেই ওনার দিকে তাকিয়ে দেখতুম, কী ফর্সা গোলাপি
চেহারা, এখানের মেমরা কেউই ওনার মতন বুকের খাঁজ দেখানো পোশাক
পরে না, আমি আড়চোখে খাঁজের দিকে তাকাতুম, বুকের পুঁইমেটুলি দেখতুম ।
চাকরের দুর্বলতা
শোভা পায় না, আমি বেশ দুর্বল বোধ করতুম, ওনাকে চোখ বুজে কল্পনা করতুম চান করার সময়ে । জমিদার আর কোম্পানি বাহাদুর ছাড়া
মেমদের ছোঁয়াও অপরাধ, তবু আমি ছলছুতোয় ছুঁতুম ওনাকে, ফুলের তোড়া দেবার সময়ে, মদের গ্লাস এগিয়ে দেবার সময়ে ।
বিদেশিনীরা
রাজকুমারকে ভালোবাসতেন বলে, বিদেশে গিয়ে নানা রকমের মাংস খেতেন বলে, সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ওনাকে বামুনরা সমাজের বাইরে একঘরে করে দেবার তাল করেছিল, ওনার বাড়ির মেয়ে-বউরা যদি ওনাকে ছুঁয়ে ফেলতো, তাহলে তারা
গঙ্গাজলে চান করে পবিত্রতা ফিরে পেতো, রাজকুমার পবিত্রতার
কেয়ার করেননি, বাড়িতে বৈঠকখানাঘর তৈরি করে সেখানেই থাকতেন, বন্ধুবান্ধবরা আর ব্যবসার লোকরা, দেশি হোক বা বিদেশি, সেই ঘরেই দেখা করতো, আরাম কেদারায় বসে হুঁকো টানতো ।
রাজকুমার মারা
যাবার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিদিন ক্লিভল্যাণ্ডের ডাচেস এসে ওনার সঙ্গে সময়
কাটাতেন ।
হৃৎপিণ্ড বহুক্ষণ
চুপ করে ছিলেন, হয়তো সমুদ্রের ঢেউয়ের দোল খেতে খেতে শৈশবের কথা
ভাবছিলেন, সৎমায়ের আদর-যত্নের কথা ভাবছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, বুঝলি হুলি, তুই যেমন ম্যাজিকে
বিশ্বাস করিস, আমার বড়োছেলেও তেমন ম্যাজিকে বিশ্বাস করে, মঙ্গলকাব্যের কবিরা যেমন স্বপ্নাদেশ পেয়ে কবিতা লিখতেন, আমার বড়োছেলেও তেমন স্বপ্নাদেশ পায়, কোথা থেকে জ্ঞানের
কাগজ ওর হাতে উড়ে এসে পড়ে, আর ও নিরাকার ব্রহ্মের খোঁজে লীন হয়ে যায়, তখনই ব্রহ্ম ব্রহ্ম ব্রহ্ম জপতে থাকে, ব্যবসা লাটে উঠিয়ে দিলে ।
রাজকুমার রোমে গিয়ে
পোপের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, প্যারিসে গিয়ে রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা
করেছিলেন, লণ্ডনে থ্যাকারে আর চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে দেখা
করেছিলেন, প্যারিসে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে
আলোচনা করেছিলেন । এই দেখা করার কায়দা
ওনার কাছ থেকেই তো শিখেছিলেন ওনার ছোটো নাতি ।
আমি বললুম, হ্যাঁ, রাজকুমার, জানি, ব্রহ্ম ব্রহ্ম জপে জপে আলাদা স্বর্গে গেলেন । বিষয়সম্পত্তিকে উনি মনে করতেন বিষ, মন বিষিয়ে দেয়, অনেক লোককে জড়ো করেছেন ওনার অতিবামুন কাল্টে । ওনার সময় থেকেই দিকে দিকে
ভদ্রলোক বিয়োবার যুগ আরম্ভ হলো । বাঙালি আর ব্যবসাবাণিজ্য করবে না, কারখানা খুলবে না, শুধু ভদ্রলোক হয়ে কেরানিগিরি করবে । আপনার সময়ে উনিশ
শতকের আশির দশক আর নয়ের দশকটুকুই বাঙালির এগিয়ে যাবার সময় ছিল, কেরানি হবার আর সরকারি চাকুরে হবার দৌড়ঝাঁপ ছিল না, শুধু আপনার ছোটোছেলে ওই লাইনে চলে গিয়েছিলেন ।
হৃৎপিণ্ড বললেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হ্যাঁ, আধ্যাত্মিকতাই এখন
বাঙালির ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
আমি বললুম, এই আধ্যাত্মিকতা আপনার সময়ের আধ্যাত্মিকতা নয় । এই আধ্যাত্মিকতার কোনো
দার্শনিক বনেদ নেই । দিকে-দিকে আকাট গুরুদেবের ছড়াছড়ি, গেরুয়া পোশাক পরে মাফিয়ারা বোকাদের ঠকিয়ে বিরাট বিরাট দল তৈরি করে সরকারি
জমিজমা দখল করছে, আর সেখানে মন্দির গড়ে মেয়েদের ফুসলিয়ে ধর্ষণ করছে ।
প্রতিদিন তার বিজ্ঞাপনও বেরোচ্ছে কাগজে, বাড়ি-বাড়ি
হ্যাণ্ডবিল বিলি করছে তারা । এমন বাঙালি আর দেখতে পাবেন না যার হাতের আঙুলগুলোয়
গ্রহরত্নের গোটা পাঁচেক আঙটি নেই, গলায় কিংবা বাহুতে
মাদুলি নেই ।
হৃৎপিণ্ড বললেন, আমি সারাজীবন এই গুরু ব্যাপারটার বিরোধী ছিলাম, আমার কোনো গুরুর
দরকার হয়নি, নিজে ঠেকে শিখেছি, নিজে নিজের রাস্তা
গড়ে তুলেছি ।
আমি জিগ্যেস করলুম, রাজকুমার আপনি শনিদেবতার নাম শুনেছেন ?
হৃৎপিণ্ড বললেন, শুনেছি, কখনও শনিদেবতার পুজো হতে দেখিনি বা শুনিনি, আমার জমিদারিতে কতো চাষি থাকতো, বিপদে পড়তো, আমি তাদের চাপ দিয়ে পাওনা আদায় করতাম, তবুও তো তারা শনি
নামে কোনো দেবতার আশ্রয়প্রার্থী হয়নি ।
বললুম, আপনি জানেন না, মোড়ে-মোড়ে রিকশা স্ট্যাণ্ডে এখন শনি মন্দির, নাস্তিক মার্কসবাদীরা বসিয়ে দিয়ে চলে গেছে, এখন গান্ধিবাদীরা
তাদের কাছ থেকে ফি-হপ্তায় চাঁদা তোলে । রিকশাস্ট্যাণ্ডগুলোয় আর মোড়ে মোড়ে আরেকটা
পুজো হয়, বিশ্বকর্মা পুজো, আপনি জাহাজের মালিক
হয়ে যে পুজো করেননি, এখন কেউ রিকশা টানলে বা কোনো সাঁড়াশি নিয়ে কাজ করলেও
লাউডস্পিকার বাজিয়ে পুজো করে, ইয়ে দুনিয়া পিত্তল
দি, হো বেবি ডল ম্যায় সোনে দি, হো মেরে হুস্ন দে কোনে কোনে দি, বেবি ডল ম্যায় সোনে
দি, জয় বাবা বড়োঠাকুর, তুমি ঠাকুরদের
মধ্যে সবচে বড়ো, পেন্নাম হই ।
হৃৎপিণ্ড জানতে
চাইলেন, শরবতের বয়ামের দেয়ালে এসে, হ্যাঁরে, লাউডস্পিকার কি জিনিস, স্টিম ইঞ্জিনে চলে ?
বললুম, না রাজকুমার, বিজলিতে চলে, তার ভেতরে
একহাজারটা ষাঁড়ের গলার আওয়াজ লুকোনো থাকে, কেউ কোনো কথা
বাজালে কিংবা গান করলে, সেই ষাঁড়েরা মানুষের মাথার ওপরে চেঁচাতে চেঁচাতে উড়তে
থাকে। যে গান গায় বা বক্তৃতা দেয় তাকে তখন পাগলা ষাঁড় বলে মনে হয় ।
হুলি, তুই কি বলতে চাইছিস, ওগুলো আমার বড়ো ছেলের প্রভাবের কুফল ? জিগ্যেস করলেন হৃৎপিণ্ড ।
বললুম, একবার আধ্যাত্মিকতার গাড়ি চালিয়ে দিলে স্পেনের ধর্মধ্বজাধারীরা যে পথে সমাজকে
নিয়ে গিয়েছিল, সেই পথেই সমাজটা দৌড়োতে থাকে, গড়াতে থাকে, জানেন তো । স্পেন ওই ধ্বজাগুলো লাতিন আমেরিকায় নিয়ে
গিয়ে পুঁতেছে আর সেখানকার মানুষদের হতভাগ্য করে দিয়েছে, দক্ষিন আমেরিকা হয়ে গেছে উত্তর আমেরিকার চেয়ে গরিব ; এখন উত্তর আমেরিকা ভাবছে দক্ষিণ আমেরিকার লোকদের আসা বন্ধ করতে দেয়াল তুলবে ।
হৃৎপিণ্ড
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ফরম্যালিনের শরবত দুলে উঠল, বললেন, আমেরিকায় যাবো ভেবেছিলুম, কিন্তু তার আগেই মারা গেলুম রে ।
আমি আমার বাকি
কথাগুলো বললুম, আপনি বলুন না, এসব এলো কোথা থেকে, এই যে শীতলা পুজো, মনসা পুজো, কার্তিক পুজো, আরও কতো অজানা অচেনা দেবীদেবতার পুজো ? মাঝ রাস্তার ওপরে, লোকের বাড়িতে ঢোকার দরোজা বন্ধ করে, নর্দমার ওপরে
পাটাতন পেতে, খেলার মাঠে খুঁটি পুঁতে ? বাজারগুলোয় লাটে-লাটে মূর্তি বিক্রি হয়, দরাদরি হয় ।
কিন্তু আমার
বড়োছেলের প্রভাব তো কবেই মুছে গেছে, টিকে আছে শুধু আমার
নাতির গান, বললেন হৃৎপিণ্ড, আর সবায়ের নামে
লেজুড় হিসাবে নাথ আর ইন্দ্র জুড়ে দেবার রেওয়াজ ।
ঘণ্টাখানেক পরে
রাজকুমার বললেন, কার্ল মার্কস লিখে গেছেন যে চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের
কারণে বাঙালিদের পুঁজি ব্যবসাবাণিজ্য আর শিল্পোদ্যোগ থেকে জমিজমায় নিবেশের দিকে চলে গিয়েছিল ; আমি তা নিজের জীবন দিয়ে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছি । আমি
যেমন বেশ কয়েকটা জমিদারির মালিক ছিলাম, তেমনি
ব্যবসাবাণিজ্যও করেছি, ব্যাঙ্ক খুলেছি, জাহাজ চলাচল শুরু
করেছি, খবরের কাগজ শুরু করতে সাহায্য করেছি, মেডিকাল কলেজ শুরু করার চেষ্টা করেছি, বিলেতে যাতে
ভারতীয়রাও পার্লামেন্টে সিট পায় তার চেষ্টা করেছি, আরও কিছুকাল বেঁচে
থাকলে দেখতিস গঙ্গায় স্টিম ইঞ্জিনের স্টিমার চলতো, বর্ধমান থেকে
কলকাতা রেলগাড়ি চলতো, কলকাতায় জাহাজ তৈরির কারখানা বসাতাম, স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে যে-যে কারখানা বসানো যায় তার চেষ্টা করতাম ।
আমি বললুম, হুজুর, কার্ল মার্কস তো আর জানতো না যে বাঙালিবাবু আর বাঙালি
ভদ্রলোক নামে একরকমের জীব জন্মাবে যারা আস্তিক হয়েও দুর্গাপুজো-কালীপুজোয় পুরুতকে
নাচতে বলবে, নিজেরা ধুনুচি নাচ নাচবে, মিষ্টি দই খেয়ে ডায়াবেটিসে ভুগবে, আর বলবে যে এটা ধর্মবিশ্বাস
নয়, এটা হলো গণতন্ত্রে মানুষের কৌম আনন্দ ।
রাজকুমার বললেন, আমিই তো আমার পরিবারের পুরুতের বাংলা পদবিকে ইউরোপীয় করে তুলেছিলাম ; সেই পদবি নিজেদের নামে লেজুড় হিসেবে সেঁটে পরের প্রজন্মে সবায়ের কতো গর্ব
দেখেছিস তো ? উপযোগীতাবাদ, খোলা বাণিজ্য, প্রবুদ্ধ করে তোলার উদ্যোগ, স্বাধীনতাবোধ, একেশ্বরবাদে বিশ্বাস, এসব আমিই তো এনেছিলাম।
আমি শুনছিলুম
রাজকুমারের কথা, তার দুশো পঁচিশ বছর পরে দুনিয়ায় যা ঘটছে তা জানিয়ে
ওনাকে ওয়াকিবহাল করতে চাইলুম, বললুম, যে পথে আপনার জাহাজ গিয়েছিল, সেপথে এখন জোর
যুদ্ধু চলছে, মোচরমানরা দলাদলি করে কার ব্যাখ্যা কার চেয়ে বড়ো
প্রমাণ করার জন্যে নিজেদের মধ্যে লড়ে মরছে, মিশর আর পাশাদের
দেশ নয়, মিলিটারির দেশ, সেখানে
খ্রিস্টানদের গির্জায়, খ্রিস্টান ছাত্রছাত্রীদের বাসে বোমা মারছে মোচোরমান ধর্মের মানুষ, যতো বেশি পারে
খুনোখুনির রেশারেশি চলছে ।
আমার মনে পড়ল যে ‘অপর’ বলতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যে অর্থগুলো পুরোনো বাংলা
কাব্য থেকে যোগাড় করেছেন, তার মানে অন্য, ভিন্ন পৃথক, ইতর, অর্বাচীন ,নিকৃষ্ট, অশ্রেষ্ঠ, বিজাতীয়, অন্যজাতীয়, প্রতিকূল, বিরোধী, শত্রু ইত্যাদি ।
অথচ উনি লিখেছেন যে অপর বলতে আত্মীয় স্বজন মিত্রও বোঝাতো ।
শত্রুও আবার মিত্র
।
একই শব্দের যে এরকম
উলটো মানে হতে পারে তা ইংরেজি-শেখা বাঙালিরা ভুলে গেছে । ইংরেজি
শেখা বাঙালিরা নিজেদেরই ভুলে গেছে । মার্কস এঙ্গেলস লেনিন মাও তারা ইংরেজিতেই
পড়েছে, বাংলায় অনুবাদ করে চল্লিশ বছর আগে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে
বিক্রি হতো সেসব বই । যারা বিক্রি করতো তারা সকলেই পেল্লাই বাড়ি তুলে ফেলেছে, গাড়ি হাঁকাচ্ছে, আর বই বিক্রির স্টল খোলে না, অপমান বোধ করে ।
একটা জন্মে যখন আমি
সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলুম তখন জেনেছিলুম, ভারতীয় দর্শনের
সঙ্গে অপর ভাবনার কিছু মিল আছে । উপনিষদ বলছে, ব্যক্তির নিজস্ব বা
অহংবোধ বহু কিছুকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে । আত্মন বলতে যদিও নিজেকেই বোঝায়, কিন্তু শুধু এইটুকু বললে তার যথার্থ সংজ্ঞা নির্দেশিত হয় না । আত্মন এমন এক
অস্তিত্ব যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র পরিব্যপ্ত । এই জায়গা থেকে উপনিষদ চলে গেছে
অদ্বৈত দর্শনের দিকে ।
আশ্চর্য যে মানুষ
নিজেকে মাপে বড়ো করে আর অপরকে মাপে ছোটো করে । এক পক্ষের অপর তৈরি হয় অপর পক্ষের
অপরকে বাদ দিয়ে । অপরীকরণে তারাই সক্রিয় পক্ষ যাদের হাতে নির্ণায়ক ক্ষমতা থাকে ।
অপরীকরণে এক পক্ষ নিজ, আরেক পক্ষ অপর । এই নিজ যতোই ব্যক্তির সত্বা হোক, তার মূলে আছে সমাজ । মানুষ নিজের সমাজ, ও সম্প্রদায়ের
সংস্কার, বিদ্বেষ, ভীতি, পছন্দ-অপছন্দ, ক্ষোভ, আশা-নিরাশা, ধর্মচেতনা, ন্যায়-অন্যায়বোধ, ঘৃণা-লালসা, পুরোনো ইতিহাস, বন্ধুতা-শত্রুতা, রাজনীতি দ্বারা সব
সময়েই প্রভাবিত হয় । সমাজ মানুষকে যে-ছাঁচে গড়ে তোলে, সে তারই আকার নেয় । পরিবার, পরিবেশ, নানা রকমের মিডিয়া, সভা-সমিতি, সরকার, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সঙ্গঠন, শিক্ষাব্যবস্হা, রাজনৈতিক আর সামাজিক মতবাদ, হুজুগ, ধর্মীয় উন্মাদনা, এ-সবেরই কিছু-না-কিছু ছাপ পড়ে তার ওপর --
চেতনা-অবচেতনার নানা স্তরে তা ছড়িয়ে পড়ে ।
আমি তো শুদ্দুর, তাই বাদ দেয়া অপর ।