পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                                        





মধ্যবয়স/ নাচ / মেজাজের পারদ


________________________

 মধ্যবয়স। মরুভূমির মত। অতিক্রম করা মুশকিল। নতুন যৌবনের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকানো। চলে যায়... চলে যায়... বসন্তের দিন চলে যায়... ! 

 দীর্ঘ যাত্রাপথ। ধীরে ধীরে চলতে হয় বার্ধক্যের দিকে। শরীরে বাসা বাঁধে হরেক রোগ। ডাক্তার ভরসা। বেঁচে থেকে আর কি হবে... এমন বোধ। কেউ মনোযোগ দেয়না। কেউ বসে কথা শোনে না। 

কিছু কিছু সেলিব্রেটি,  আরো করুণ অবস্থায় পৌঁছে যান। বয়স ভুলে থাকার নানারকম প্ররোচনা কাজ করে তাদের চারিদিকে। জেনে বুঝে হলেও সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন, সাময়িক উত্তেজনার জন্য। এটা মহিলা পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায়। 

 বার্ধক্য গুটিগুটি এগিয়ে আসে। অবোধ মানব ব্যায়াম করে, পার্লার যায়, সাজুগুজু করে। খুব ভালো করে। তারপর দিনের শেষে একাকীত্বে ভুগতে থাকে। কুয়াশার মত ঘিরে ধরে একাকীত্বের বোধ। 

 *****

  মধ্যবয়সে বিষাদ, খুব স্বাভাবিক। আমি যেটা বারবার বলি...সেটা হল, সমস্ত কিছু স্বাভাবিক ভাবতে হবে। আমার কিছু ভালো লাগছে না... এটা কখনো অকারণ নয়। তুচ্ছ করার নয়। বিলাসিতা নয়। ভালো না লাগার পিছনে কারণ আছে। এবার দেখতে হবে সেই কারণ কতখানি গুরুতর? বা, কেন হল সে কারণ? কোনো মৃত্যুশোক? সন্তানের কঠিন ব্যবহার? পারিবারিক অসাফল্য? চূড়ান্ত অবমাননা? প্রতারণা? ক্যান্সার? মৃত্যুর পরোয়ানা? 

সেইসঙ্গে বয়সের প্রকাণ্ড ভার! 

হতাশ মানুষ ভাবে, আর পারা যায় না! সত্যিই তাই। আর পারা যায় না! মনের জমি ধূ ধূ করছে। শূণ্য। সে জমিতে একটি গাছ নেই, যার নিচে আশ্রয় নিতে পারে তাপিত মধ্যবয়স! সুতরাং... ! দারুণ দুঃসহ দিন। প্রতিদিন!

******

 তবে উপায়? আছে বইকি। বৃদ্ধ বয়স নিরাপদ করতে ব্যাংকে টাকা রাখি। ফিক্সড ডিপোজিট করি। আরো কি কি জানি করি।

 অথচ,  বৃদ্ধ হতে থাকে সময়ও। তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য চল্লিশ বছর বয়স থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে তৈরি করতে হয় মনের জমি। তাতে লাগাতে হবে কিছু গাছ। দিনে দিনে বেড়ে উঠুক। ডালপালা মেলে দিক। 

যৌবন থেকে বর্ধ্যকের দিকে যেতে যেতে সেই সব চেতনার বৃক্ষ আশ্রয় হোক আমার। দুঃখের ঝড়, বিষাদের বৃষ্টি... ওদের ডালপালা ভেদ করে পড়বে হয়ত দু এক ফোঁটা অশান্তি। কিন্তু, ক্ষতি হবে না বিশেষ। 

********

 মধ্য বয়সে অনেকেই লাফিং ক্লাবে যোগ দেন। সুগার প্রেসার ভালো থাকে। আমি বলি কি, নাচবেন একটু? কোমর দোলাবেন? লজ্জা পাবেন না। আদিমযুগ থেকেই নাচ একটি অদ্ভুত থেরাপি। মহিলার হাত ধরে নাচ মানেই অসভ্যতা নয়। ভালো থাকা। অসভ্যতা করে ভালো থাকা যায় না। কিন্তু, একটা সুন্দর মিউজিকের সঙ্গে পা মেলালেন, সঙ্গী হল বিপরীত লিঙ্গের কেউ, খুব খুব ভালো থাকা যায়। লিঙ্গ দেখবেন না। মানুষ দেখুন।

  আজকাল অনেক কফি হাউস হয়েছে। গম্ভীর মুখে কফি খায় তরুণ প্রজন্ম। এমন এক ভাব, যেন কোনোদিন তারা আর বুড়ো হবে না! কেন এমন? কেন গিটার বাজে না? কেন কোনো বয়স্ক সেখানে অনাহুত? কেন হাতে হাত মিলিয়ে পায়ের ছন্দে মেতে উঠবে না দুই প্রজন্ম? তরুণ আর মধ্যবয়স? 

 এতে মস্তিষ্ক সতেজ থাকে। অ্যালজাইমার দূরে যায়। বিষাদ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। আমি যার সঙ্গে সপ্তাহে দুই দিন নাচি, সেই মেয়েটি আর আমার ছেলে একই সালে জন্মেছে। ছেলে লন্ডনে। তাতে কি? সে মেয়ে আর আমি নাচি। শেষ হলে হালকা  হয় শরীর এবং মন। 

  সমাজ সুন্দর হয় সকলকে নিয়ে। তারুণ্যের মত সুস্থ বার্ধক্য প্রয়োজন। তাই, বৃদ্ধ মানুষের মন ভালো থাকা জরুরি। মেজাজের পারদের ওঠা নামা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে। প্রেসার সুগার কন্ট্রোলে আসবে।

 একটু নেচে ওঠো। বদলে যাবে দুনিয়ার রঙ। লজ্জা নয়। প্রয়োজন।




শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

                                                                 



                                            লিঙ্গভেদে বিমর্ষতার উপসর্গ


মন ব্যাপারটাই বেশ ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। বিজ্ঞানের হাতে ধরা দিয়েও দেয় না। তবে উপসর্গ অনুযায়ী কিছু কিছু নামকরণ করা হয়েছে। সব চেয়ে ব্যপক হারে যেটা দেখা যায় তা হল বিষন্নতা বা বিষাদ (Depression)। বাংলা প্রতিশব্দটা যা ইঙ্গিত করে তা হল বিমর্ষ মনমরা ভাব। কিন্তু Depression শব্দটির ব্যপ্তি আরও বেশি। মূলত বিষাদ ও মন খারাপের ইঙ্গিতবাহী হলেও এর রকম ফের আছে, যার উপসর্গ বিমর্ষতা থেকে অতিরিক্ত রাগ, বিরক্তি, অত্যধিক দুশ্চিন্তা, মুড পরিবর্তন ইত্যাদি নানা ধরণের হতে পারে। সাধারণ Depression-এর চেয়ে Manic Depression বা Bipolar Disorder বাগে আনা অনেক কঠিন। এ ক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে ক্রমাণ্বয়ে উচ্ছ্বাস ও বিমর্ষতার চক্র দেখা দেয়। মানুষ ও অবস্থা ভেদে এক একটি চক্র কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। এর চিকিৎসাও সহজ নয়। সাধারণত ডিপ্রেশনকে জীবনযাত্রা ও জীবনে ঘটা নানান ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ভাবা হয়। ভাবনাটা মোটেও ভুল নয়। তবে দুর্ঘটনা, দুর্ভাগ্য এগুলো মূল অভিযুক্ত হলেও বংশগতিরও কিছু ভূমিকা যে আছে তা এক রকম প্রমাণিত। প্রসঙ্গত, ভাগ্য শব্দটা যুক্তিবাদীদের কাছে যতই পরিত্যাজ্য হোক, রাষ্ট্রপতির সন্তান ও মুটের সন্তানের ভাগ্য তো এক হতে পারে না। আমার মনে হয়, সব ঘটনা পূর্ব নির্ধারিত নয়, ঘটনার পেছনে কার্য-কারণ সম্পর্কটা নির্দিষ্ট সূত্র নিয়ন্ত্রিত ও সম্ভাবনা নির্ভর। ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্যের পেছনে অসংখ্য পারমুটেশন, কম্বিনেশন, প্রোবাবিলিটির জটিল গণিত কাজ করছে। যদি এটার পর এটা হয়, তাহলে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা এত শতাংশ। যদি তা না হয় তাহলে অমনটা হতে পরে ..ইত্যাদি। সৃষ্টিকর্তা কেউ থেকে থাকলেও সব রকম সম্ভাবনা ও ফল নিখুঁতভাবে নিরূপণ করার ক্ষমতা তাঁরও নেই। ব্রাউনীয় গতির মতো এলোমেলোভাবে ছুটে চলেছে ঘটনা প্রবাহ, ছুটছি আমরা। কখন কার সঙ্গে ধাক্কা খাব এটা শুধু আমার গতিবিধির ওপর নয়, নির্ভর করছে যার সঙ্গে সংঘর্ষ হল তার গতিবিধির ওপরেও। আমরা নিজেদের জীবনে কিছু নিয়ম নিগড় দ্বারা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমাতে পারি, কিন্তু সম্পূর্ণ রোধ করতে পারি না। আমি ট্রাফিক নিয়ম মেনে রাস্তায় হাঁটি, কিন্তু যে বাসে চাপলাম সেটা দুর্ঘটনার কবলে পড়বে না, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। হিসাব মতো আইনস্টাইন যা মেনে নিতে পারেননি, অর্থাৎ ভগবানের জুয়া খেলা, সেটাই হয়ত সৃষ্টির নিয়তির নির্ধারক। ঈশ্বর জুয়াই খেলছেন এবং জুয়ার ফলাফলগুলো তাঁর তৈরি নিয়মের ফাঁদে, তাঁর হাতে নয়। আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী ভাগ্য গণনার পেছনে এই সম্ভাবনাটাকেই মাপতে চাওয়ার প্রচেষ্টা আছে, যা সঠিক পূর্বানুমানে ব্যর্থ হতেই পারে। যাইহোক, ডিপ্রেশন বা অন্যান্য কয়েক ধরণের মনরোগ যে মা বাবার দিক থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অপত্যে সঞ্চারিত হয়, একাধিক পরীক্ষা তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় একজন সাময়িক ভাবে হতাশ বা উদ্বিগ্ন হল, কিন্তু মানসিক ভারসাম্য হারাল না। অন্যদিকে একই রকম ঘটনায় আর একজন মানসিক ভারসাম্য হারাল, তার হতাশা তথা উদ্বেগ গভীর ডিপ্রেশনে পরিবর্তিত হল। পরিবারে মনরোগের ইতিহাস থাকলে এইভাবে ডিপ্রেশনের স্বীকার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তার মানে এই নয়, যে মা বা বাবার বংশে মনরোগের ইতিহাস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের সকলেই একই রকম আশঙ্কার আওতায় থাকবে।

লক্ষ্যনীয় স্ত্রী ও পুরুষ ভেদে মা বাবার জিন ও জীবনাচারণ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা ভিন্ন। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, শুধু জিন নয়, একজন ডিপ্রেশনের শিকার বা মনরোগীর সংস্পর্শে থাকলে মনরোগের জেনেটিক ইতিহাস না থাকলেও কোনও মানুষ বিশেষত শিশু বিমর্ষতা বা অস্বাভাবিক আচরণের শিকার হতে পারে। আবার ডিপ্রেশনের মতো মানসিক ব্যধিতেও স্ত্রী ও পুরুষের উপসর্গে তারতম্য দেখা যায়। সুতরাং মনরোগের লিঙ্গভেদে প্রভাব ও উপসর্গে পার্থক্য আলোচনায় চারটি দিক বিবেচ্য (১) বংশগতি, (২) অভিভাবকদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা, (৩) উপসর্গের ফারাক এবং (৪) মেয়েদের ডিপ্রেশনের বাড়তি ঝুঁকি।

(১) বংশগতি জীবনযাত্রা (Life style) ও ব্যক্তি-প্রবণতা (Personality traits) এগুলোকেই ডিপ্রেশনের প্রধান কারণ মনে করা হলেও বংশগতির একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। একটি সূত্র জানাচ্ছে, ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন অর্থাৎ বিষন্নতা যে পর্যায়ে গেলে মানুষ চিকিৎসার দ্বারস্থ হয়, তার পেছনে ৪০% ভূমিকা উত্তরাধিকারের ও ৬০% অবদান পরিবেশ পরিস্থিতিসহ অন্যান্য উপাদানের। মা বাবা ডিপ্রেশনের শিকার হলে সন্তাদের মধ্যে এই মনোরোগ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। নিজের ভাই-বোনেদের মধ্যে বড়সড় রকম ডিপ্রেশন থাকলে ঐ ব্যক্তির আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্যদের চেয়ে ১.৫ থেকে ৩ পর্যন্ত  বেশি হয়। যদিও এখনও গবেষণা সাপেক্ষ, তবে সেরোটোনিন ট্রান্সপোর্টার জিন (Serotonin Transporter Gene) বলে এক ধরণের জিনকে অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা (high anxiety levels) ও  গুরুত্ব লাভের বাসনা (novelty-seeking behaviour) এই উপসর্গের জন্য দায়ী করা হয়। Obsessive Compulsive Disorder যাতে রোগী কোনও একটি বিষয় কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে না পেরে একই কাজ বারবার করে যায়, সেই অসুখটির জন্যও সেরোটোনিন জিনকে দায়ী ভাবা হয়। আবার ডিপ্রেশনের এক বিশেষ ধরণ হল Bipolar Disorder, যেখানে মানুষ পর্যায়ক্রমে চূড়ান্ত বিমর্ষ এবং প্রচণ্ড উচ্ছল, বাচাল, অত্যুৎসাহী আবার অকারণে উগ্রচণ্ডা রাগী হয়ে ওঠে। পুনরাবৃত্ত ডিপ্ররেশনে আক্রান্ত ৮০০-র বেশি পরিবারের মধ্যে chromosome 3p25-26 পাওয়া গেছে। দেখা গেছে যারা এই উপসর্গের শিকার তাদের ৫০%-এর মধ্যে মা বাবার এই Bipolar Disorder(BPD) অসুখটি ছিল বা আছে। মা বা বাবার মধ্যে কোনও একজনের BPD থাকলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্যদের তুলনায় ২৫% বৃদ্ধি পায়, দুজনের থাকলে ৫০ ৭৫% বেশি হয়। ভাই বোনের মধ্যে  BPD থাকলে অন্যান্য যাদের অনুরূপ পারিবারিক ইতিহাস নেই তাদের চেয়ে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৮-১৮ গুণ বেশি হয়। এই অসুখটির উপসর্গও লিঙ্গ ভেদে খানিক আলাদা। মেয়েরা নিজেরা কষ্ট পায় বেশি, আর ছেলেরা অন্যদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। বংশগতির প্রভাব পরখ করতে সাধারণত সমরূপ যমজ বা একই ভ্রূণাণুজাত যমজ (monozygotic twins)দের বেছে নেওয়া হয়; কারণ সমরূপ সমতুল্যজুটির ভাই বা বোনেদের জিনগত বিন্যাস (genetic composition) ১০০% একই হয় যেখানে অসম যমজদের (non-identical twins) বেলায় তা হয় না। সুতরাং সমতুল্য যমজদের মধ্যে মানসিক অবস্থার তারতম্য দেখলে তা পরিবেশগত বা অন্যান্য বাহ্যিক কারণে হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।   

(২) অভিভাবকের প্রভাব দেখা গেছে, মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় এই ব্যপারে ঢের বেশি স্পর্শকাতর এবং মা বাবাই হোক বা অন্য কোনও অভিভাবক, তার অস্বাভাবিক জীবন যাত্রা অথবা কষ্ট পাওয়া পুত্রের চাইতে কন্যা শিশুদের মনে গভীরতর ছাপ ফেলে। কারণ কন্যারা মা বাবার প্রতি পুত্রদের চাইতে বেশি অনুভূতি প্রবণ হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে আপনজনেদের জন্য চিন্তা উদ্বেগ এগুলো বেশি কাজ করে। ছেলেদের মন বাহিরমুখী বলে ঘরের অশান্তি যতক্ষণ না তাদের সরাসরি বিপদে ফেলছে,ততক্ষণ ততটা বিচলিত হয় না। বাবা মায়ের প্রতি অত্যাচার করলেও মেয়ে সন্তানই কষ্ট পায় বেশি। ছেলেরা যে প্রতিবাদ করে না, তা নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব জগৎ আর বাইরের বন্ধুমহলের আকর্ষণ ঘরের সমস্যা থেকে তুলনায় নির্লিপ্ত থাকতে সাহায্য করে। 

(২) লিঙ্গভেদে উপসর্গের তারতম্য

বহিঃপ্রকাশিত ডিপ্রেশনকে (Clinical Depression) এক সময় মেয়েদের অসুখ মনে করা হোত। কিন্তু অধুনা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৬ মিলিয়ান পুরুষ ডিপ্রেশনের শিকার হচ্ছে। তবে পুরুষদের এই বিষন্নতা ব্যধিরও উপসর্গ বা তার বহিঃপ্রকাশ এমন যে তাকে সব সময় বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন বলে চিহ্নিত করা যায় না। ডিপ্রেশনের সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ হল নিজের সচরাচর আগ্রহের বিষয় বা কাজকর্মগুলোতে নিরুৎসাহী হয়ে পড়া, অবসাদ, ক্ষুদামান্দ্য, ঘুমের ব্যাঘাত এবং বিমর্ষতা। পুরুষদের মধ্যে এর সাথে লক্ষ্য করা যায় পলায়নমুখিতা, বিরক্তি, আক্রমণাত্মক ও হিংস্র ভাব। তবে আমেরিকার পরিসংখ্যান জানাচ্ছে জনসংখ্যার ১০% যেখানে গভীর ডিপ্রেশন (Major Depression)-এ ভোগে সেখানে এই অসুখটি  পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ বেশি সংখ্যায় দেখা যায়। আবার শীতকালে ডিপ্রেশনের প্রাদুর্ভাব বেশি হতে দেখা যায়। তখন সব সময় জড়সড় হয়ে শুয়ে সময় কাটিয়ে দিতে চায় মানুষ। অবসাদের কতগোলো সাধারণ উপসর্গ হল -১. বিষন্নতা, ২. আত্ম প্রতীতি (self esteem) নিম্নগামী হ‌ওয়া, ৩. অপদার্থতাবোধ, ৪. আত্মহননের ইচ্ছা, ৫. আনন্দ উপভোগে অনীহা, ৬. ক্লান্তি ও অবসাদ ইত্যাদি। অর্থাৎ বিষন্নতা শব্দটার সাথে খাপ খায় এমন সব উপসর্গ।   

লিঙ্গভেদে উপসর্গের তারতম্য:

পুরুষদের মধ্যে ডিপ্রেশনের বহিঃপ্রকাশ এমন হয় যে তাকে ডিপেশন বলে প্রাথমিকভাবে বোঝা মুশকিল। প্রথমত পুরুষরা নিজের ডিপ্রেশনটা স্বিকার করতে চায় না যেহেতু নিজেদের শক্তিশালী দেখানোর একটা সংস্কার কাজ করে। পুরুষপ্রধান সমাজ পুরুষকে অনেক সুবিধা দিলেও ভাবাবেগ বিশেষ করে কোমলতাজনিত দুর্বলতা যেমন চোখের জল ফেলা নিষ্ঠুরতা দেখে কাতর হওয়া ইত্যাদি প্রকাশ করতে নিরুৎসাহিতই করে। পুরুষরা সেজন্য পারতপক্ষে নিজেদের মানসিক সমস্যার বদলে শারীরিক উপসর্গগুলো যেমন ক্লান্তিবোধ, কর্মোদ্যমহীনতা এগুলোকেই তুলে ধরে। দুঃখ দুঃখ ভাবের চেয়ে অনেক সময়ই খিটখিটে বিরক্তি ও আক্রমণাত্মক ব্যবহার করায় ডাক্তারদেরও পুরুষদের ডিপ্রেশনকে চিনতে অসুবিধা হয়। "While the symptoms used to diagnose depression are the same regardless of gender, often the chief complaint can be different among men and women," মন্তব্যটি  Miller Family professor of psychiatry at the University of California–Los Angeles- Dr. Ian A. Cook-এর। ডিপ্রেশনের মূল উপসর্গগুলো কী ভাবে লিঙ্গভেদে বদলায় দেখা যাক

১. অবসাদ (Fatigue): ডিপ্রেশনের ফলে যে একাধিক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় তার ফলে ক্লান্তি ও অবসাদ বোধ (Fatigue) তথা psychomotor retardation দেখা যায়। এর প্রভাবে অঙ্গ সঞ্চালন, নড়চড়া, কথা বলা এবং চিন্তা প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে আসে। University of Alabama at Birmingham's School of Public Health-এর ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট Dr. Josh Klapow-র মতে পুরুষরা মহিলাদের চাইতে ক্লান্তি-অবসাদ ও অন্যান্য শারীরিক উপসর্গের কথা বেশি বলে থাকে। মেয়েরা যেখানে খুব কষ্ট হলেও এবং অবসাদের অনুভূতি তীব্র হলেও শারীরিক শ্রম করতে বাধ্য থাকে নিজের পরিবারের প্রয়োজনে সেখানে পুরুষরা অসুখের অজুহাতে অলসতা ও কর্ম বিমুখতাকে সহজে প্রশ্রয় দিতে পারে। 

২. অতি নিদ্রা বা নিদ্রাহীনতা (Sleep Disorder): কম ঘুম, ঘুমোতে দেরি হওয়া বা হলেও তাড়াতাড়ি ভেঙে যাওয়া অথবা উল্টো দিকে অতিরিক্ত ঘুম ডিপ্রেশনের খুব সাধারণ উপসর্গ। মনোবিদ Dr. Cook-এর মতে "[Some people] sleep 12 hours a day and still feel exhausted or toss and turn and wake up every two hours." এই উপসর্গটি নিয়েও পুরুষ রোগীদের বেশি অভিযোগ করতে দেখা যায় যদিও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দাবিতে মেয়েরা এমনিতেই কম ঘুমোনোর সুযোগ পায় ও পালনীয় কর্তব্যের জন্য উৎকণ্ঠা বশত নিশ্চিন্তে গভীরভাবে ঘুমোতে পারে না অনেকেই।

৩. পেটে ব্যথা ও মাথা ব্যথা (Stomach Ache and Headache): পেটের গোলযোগ- হয় কোষ্ঠকাঠিন্য নয় ডায়রিয়া বা আমাশা, বদহজম, পিঠে কোমরে ব্যথা এবং মাথা ব্যথা যে অনেক সময় ডিপ্রেশনের কারণে হয়ে থাকে তা বোঝা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের National Institute of Mental Health-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে সাধারণত পুরুষরা লক্ষণগুলোকে মানসিক সমস্যার কারণ বলে বুঝতে পারে না বা মানতে চায় না। কিন্তু NYU Langone Medical Center-এর মনস্তত্বের অধ্যাপক Dr. Norman Sussan-এর মতে ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষরা প্রকৃতই এই জাতীয় শারীরিক সমস্যায় ভোগে।

৪. বিরক্তিভাব  (Irritability): পুরুষ ডিপ্রেশনের রোগীদের মধ্যে ঝিমিয়ে থাকার পরিবর্তে পুরুষ মানুষ প্রায়ই দুঃখবোধের সাথে সাথে প্রচণ্ড বিরক্তি ও ধৈর্য্যচ্যূতির লক্ষণ দেখা যায় যাকে বলে Irritability। এর ফলে আচার ব্যবহারে যে উষ্মা এমনকি বদমেজাজ দেখা যায় তাকে বিমর্ষতার সাথে মেলানো মুশকিল, কারণ বিমর্ষতা বলতে আমরা চুপচাপ বিষন্ন হয়ে আত্মস্থ থাকা বুঝি। Dr. Cook-এর ভাষায় "If they talk about an emotional component, it could be sadness with irritability,"। তাছাড়া নেতিবাচক চিন্তা এই উপসর্গ আরও বাড়িয়ে তোলে। Dr. Klapow-এর মতে "Men will report feeling irritable because they are having negative thoughts constantly"

৫. মনঃসংযোগের অভাব (Attention Defficiency): ডিপ্রেশনের ফলে যে Psychomotor retardation হয় তা মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়া ও তথ্য প্রক্রিয়াকরণ (information processing) শ্লথ করে দেয়। এর ফলে মনঃসংযোগেরও অভাব ঘটে। Dr. Sussman-এর ব্যাখ্যা "I describe depression as a form of reversible brain failure, When you're depressed, it's like your CPU [central processing unit] isn't working properly." অন্যদিকে Dr. Klapow দায়ী করেছেন নেতিবাচক চিন্তাকে - "Depression fills one with negative thoughts, almost like an intrusion. You're slowed down and constantly thinking about negative things in your world. As a result it makes it very difficult to focus on anything."

৬. রাগ ও বৈরিভাব (Anger and hostility): রাগ আর বিরক্তি বা খিটখিটে ভাব কিন্তু এক নয়। Dr. Klapow-এর বর্ণনায় "Anger tends to be a stronger emotion. Irritability is a crankiness." Dr. Sussman রাগকেও নেতি বাচক চিন্তার ফসল হিসাবে সনাক্ত করেছেন। "A man who realizes something is wrong may need to compensate by demonstrating that he is still strong or capable"। অর্থাৎ নিজের ভুলগুলো ঢাকতে ও নিজেকে দৃঢ় প্রতিপন্ন করতে রাগ ও উগ্রতা প্রদর্শন করা পুরুষদের একটা প্রবণতা। পরিবার বন্ধুবর্গ যত তাকে স্বাভাবিক পরিমণ্ডলে ফেরাতে চায় মানুষটির ডিপ্রেশন জনিত বাস্তব বিমুখতা ও পলায়নবৃত্তি তাকে তত রাগত ও আক্রমণাত্মক করে তোলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষদের রাগ ও আক্রোশের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় তারই জীবনসঙ্গিনী যার ওপর সে সব চেয়ে বেশি নির্ভরশীল, কারণ সে জানে তার যন্ত্রণা ও ক্ষোভ দ্বারা নিজের নারীটিকেই সব চেয়ে বেশি প্রভাবিত করা যাবে। শুধু তাই নয় নিজেদের অহেতুক রাগ, বিরক্তি, ধৈর্যচূ্যতি ও মনঃসংযোগের অভাবের জন্য পরিস্থিতিজনিত মানসিক চাপ বা stress নিয়ে পুরুষরা মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি অভিযোগ করে কেন না এই কারণটার সামাজিক স্বীকৃতি আছে। Dr. Klapow-এর ভাষায় "Men might be more likely to report symptoms of depression as stress. It's not that they have more stress; it's that it's more socially acceptable to report it"। আবার Dr. Cook-এর ভাষায় "It's accurate to say that feeling stressed can be an indicator of having clinical depression but also be part of the cause," অর্থাৎ স্ট্রেস আর ডিপ্রেশন পরস্পরের কারণ আবার ফলও। দীর্ঘদিন চাপ বা স্ট্রেস থেকে ডিপ্রেশনের জন্ম নেওয়াটা নারী পুরুষ উ্ভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; ফারাক হল পুরুষরা নিজেদের মাসিক অসুস্থতার বদলে কেবল পরিবেশকে দায়ী করতেই বেশি পছন্দ করে।  

৭. উদ্বেগ (Anxiety): ডিপ্রেশনের সঙ্গে অযথা ও মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগের সম্পর্ক অতি ঘণিষ্ঠ। তবে এই উপসর্গটি মেয়েদের মধ্যে অনেক তীব্র যেখানে পুরুষরা কিছুটা নিষ্পৃহ হয়ে যায়। কিন্তু ডাঃ কুকের মতে মন খারাপের চেয়ে উদ্বেগ ব্যাখ্যা করা সহজ বলে পুরুষরাও উৎকণ্ঠাই প্রকাশ করে থাকে। যেহেতু চিরাচরিত মানসিকতায় আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে এখনও পুরুষদের ওপর উপার্জনের চাপটা সত্যিই বেশি, তাই কর্ম বা পেশার জগতে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে নিজের ও পরিবারের ওপর তার প্রভাব নিয়ে পুরুষরা দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেই থাকে; যদিও ঘটনা হল আপনজনেদের জন্য কারণে অকারণে উৎকণ্ঠা, অমঙ্গলের আশঙ্কায় ভোগা, নিরাপত্তার অভাবহীনতা সব মিলিয়ে যাকে বলা হয় Anxiety Disorder এগুলো মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি কাজ করে। বাচ্চা মেয়েরাও মা বাবা বাইরে গেলে দুর্ঘটনার শিকার হল কিনা ভেবে ভয়ানক অশান্তিতে ভুগে থাকে যেখানে ছেলেরা এইসব নিয়ে সাধারণত ততক্ষণ ভাবে না যতক্ষণ না ভাবাটা সত্যিই জরুরি হয়ে পড়ছে।   

৮. নেশার আশ্রয় (Substance abuse): ডিপ্রেশনের ফলে নেশার আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা পুরুষদের মধ্যে অনেক বেশি। মেয়েরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগলেও উৎকণ্ঠা বা উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত সুখভোগের পথ বেছে নেয় কম যেখানে পুরুদের মধ্যে যে কোনও মানসিক অবস্থাতে আত্মসুখ লাভ করতে চাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। তাই মানসিক যন্ত্রণার উপশমের জন্য মাদকের আশ্রয় নিতে ছেলেদের বেশি দেখা যায়। Dr. Cook বলেছেন "It can happen for both men and women, but using drugs or alcohol to mask uncomfortable feelings is a strategy many men will employ instead of seeking health care....There's a cultural bias of, 'I should be able to fix this myself and so I'll use what chemicals I have available to me to do that’." মানসিক অবসাদে মেয়েরা যেখানে আত্ম নিপীড়নের বা আত্মহননের পথ বেছে নেয় ছেলেরা সেখানে সুখানুভূতিপূর্ণ পলায়নের রাস্তার দিকে বেশি ঝোঁকে।

৯. যৌন সমস্যা  (Sexual dysfunction): ডিপ্রেশনের ফলে স্ত্রী পুরুষ উ্ভয়েরই যৌনতায় অনীহা জন্মাতে পারে। কিন্তু মেয়েদের অনীহা সঙ্গমে খুব একটা বাধা হয় না যেখানে পুরুষদের erectile dysfunction (ED) প্রকৃতই সমস্যা তৈরি করে এবং এমন এক সমস্যা যা পুরুষরা সচরাচর স্বীকার করতে চায় না। আবার Dr. Cook-এর ভাষায় "Performance problems can come from depression and make depression worse." অর্থাৎ নিজের যৌন অক্ষমতা টের পেলে পুরুষ মানুষের ডিপ্রেশন আরও বেড়ে যায়। তবে লিঙ্গত্থানের সমস্যার পেছনে একাধিক শারীরবৃত্তীয় কারণ তথা ওষুধের প্রভাব থাকতে পারে। তাই ED-কে ডিপ্রেশনের নিশ্চিত উপসর্গ বলে ধরে নেওয়াটা ঠিক নয়। বস্তুত Dr. Klapow-এর বক্তব্যটাই যুক্তিযুক্ত -"My strong recommendation...is that you can't go after one symptom; it's a group of symptoms."

বিষন্নতার সময় পুরুষরা নিজেদের যৌন অনীহাকে অক্ষমতা ভেবে লুকোতে চায়। আবার ম্যানিক ডিপ্রেশন বা বাই পোলার ডিজঅর্ডারের ম্যানিক স্তরে অত্যন্ত যৌন ক্ষুধা এমনকি বিকৃতিও দেখা দেয় পুরুষদের ক্ষেত্রে যা তার সঙ্গিনীর জীবন নরক করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। ম্যানিক রোগীর ইন্দ্রয় সুখ পর্যাপ্ত ও যেভাবে চাইছে না হলে সঙ্গিনীকে যৌন ও শারীরিক নির্যাতন করতেও ছাড়ে না। এভাবে দেখলে মনে হয় পৃথিবীর অনেক পুরুষই ম্যানিক স্তরের, তবে মানসিক ব্যধি তো ডিপ্রেশন ছাড়াও আরও নানা প্রকার হতে পারে, আর যৌন বিকারও ডিপ্রেশন ছাড়া অন্য কোনও মানসিক জটিলতা থেকেও উৎপন্ন হতে পারে। আবার কোন আচরণটাকে বিকার বলা হবে আর কোনটা স্বাভাবিকের সীমানায় রয়েছে তা অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভরশীল। তবে সঙ্গীকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার প্রবৃত্তিটা পুরুষ মানুষের মোটামুটি এক চেটিয়া। জানি, ইতিহাস খুলে কিছু রানী রাজকন্যার গল্প শুনিয়ে মেয়েদেরও যৌন বিকারের নজির তুলে ধরা যাবে। কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তই। আর নৃশংসতা, নোংরামি ও অবমাননার যে চূড়ান্ত রূপটা অতি পাতি পুরুষ মানুষরাও দেখিয়েছে, তা সামান্য কদিনের জন্য ক্ষমতা ভোগকারী রাণীরাও দেখাতে পারেননি।

১০. সিদ্ধান্তহীনতা (Indecision): ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা এক ব্যাপার নয়। সিদ্ধান্ত নিতে না পারা কারও কারও স্বভাবজাত ব্যপার। কিন্তু ডিপ্রেশন যে কোনও মানুষের মধ্যেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ এক ভীষণ পীড়াদায়ক অনুভূতি। কী করি কী করি, করি কি করি না এই ভাবতে ভাবতে মানুষ বাস্তবিক নিজের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। Dr. Klapow বলেছেন "It's an information-processing issue, and depression slows down your ability to decide” মানে মস্তিষ্ক নামক CPU-তে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজটি ঠিকঠাক না হওয়াতেই স্ত্রী পুরুষ কেউই চট করে ঠিক মতো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না। 

১১. আত্মহননের চিন্তা (Suicidal thoughts): ডিপ্রেশনের ফলে আত্মহননের চেষ্টা খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এই প্রবণতা মহিলাদের মধ্যে অনেক বেশি এবং মেয়েরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেও থাকে বেশি। এর অন্যতম কারণ হল অধিকাংশ সমাজে সামজিক অর্থনৈতিক ও পারিবারিক বৈষম্য ও নিপীড়ন বহু সমাজেই মেয়েদের বেঁচে থাকাটা এত কঠিন করে তোলে যে ভালো থাকার এমন কি বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই বিকশিত হতে পারে না। মরে যাওয়াটাই মুক্তিলাভের একমাত্র পথ মনে হয়। আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতিতে ছোট্ট সত্যবতীর মুখে একটা সংলাপ স্মরণ করতে হয়, সব মেয়েমানুষের এক রা, মরণ হলে বাঁচিমরণ হলে বাঁচি এই দর্শনে তারা আশৈশব বেড়ে ওঠে। স্বামীর আগে মাথায় সিঁদুর হাতে নোয়া শাঁখা নিয়ে যাওয়া মানে পূণ্যবতী, বিধবা হয়ে বেঁচে থাকাটা যেন অপরাধ এই ধরণের মগজ ধোলাই ভারতীয় সমাজে আত্মপীড়ন ও আত্মহননের মানসিকতা আদর্শ নারীত্বের যেন একটা শর্ত হিসাবে খাড়া করেছে। চীনে বিশেষত গ্রামের দিকে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বিপজ্জনক রকম বেশি। এমনকি আমেরিকার মতো তথাকথিত উন্নত সমাজেও আত্মহননের প্রচেষ্টার পরিসংখ্যানে মেয়েরাই এগিয়ে। প্রসঙ্গগত আমেরিকান সমাজও ভয়ানক রকম পুরুষতান্ত্রিক এবং সেখানেও মহিলাদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাববোধ এবং প্রতি মুহূর্তে পুরুষদের মনোরঞ্জনের তাগিদ খুব বেশি। তবে পরিসংখ্যান বলছে সেখানে আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় সাফল্যের হার মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে প্রায় চার গুণ বেশি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহননকারীদের মধ্যে ৭০-৮০% মানুষ পুরুষ। কারণ মেয়েরা যেখানে সময়সাপেক্ষ ও কষ্টদায়ক পদ্ধতি অবলম্বন করে পুরুষরা সেখানে দ্রুত ও অব্যর্থ মাধ্যম বেছে নেয়। যেমন বন্দুকের গুলি মাথায় বা বুকে লাগলে ডাক্তার দেখানোর সময় পাওয়া যায় না। আমাদের এখানেও সায়ানাইডের মতো বিষ, আগ্নেয়াঅস্ত্র এইসব সাধারণত মেয়েদের নাগালের বাইরে থাকে, যার ফলে গলায় দড়ি, শিরা কাটা,জলে ডোবা,গায়ে আগুন দেওয়ার মতো পদ্ধতিগুলো মেয়েদের বেছে নিতে হয় যা অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক হলেও সময় সাপেক্ষ বলে বাঁচিয়ে তোলার সময় পাওয়া যায়। তবে সেই সময় জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাঁচিয়ে দিলেও ডিপ্রেশনের কারণ দূর না করা গেলে তার আত্মঘাতী প্রবণতা কাটানো যায় না। তাছাড়া প্রাচ্যে মেয়েদের আত্মহত্যায় প্ররোচনাই দেওয়া হয়, বাঁচানোর চেষ্টা হয় কম। তাই ভারত উপমহাদেশ তথা চীনে আত্মহননসুমারিতে নারীরাই সংখ্যাগুরু।

১২.আত্মপ্রতীতির অভাব (Lack of Self Esteem): আত্মপ্রতীতি হল নিজের সম্পর্কে নিজের উচ্চ ধারণা, একপ্রকার মূল্যায়ন যা আত্মসম্মানের সঙ্গে জড়িত। আবার সমাজ তথা ধর্মকেই দায়ী করে বলতে হয় মেয়েরা উচ্চ আত্মপ্রতীতি পোষণ করার সুযোগ পায় কম। আর ডিপ্রেশনের শিকার হলে এই আত্ম মূল্যায়ন একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। নিজেকে অপদার্থ ও সম্মানের অযোগ্য মনে হয়। এমনটা যে ছেলেদেরও মনে হয় না তা নয়, তবে বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষরা নিজেদের অপদার্থ ভাবার বদলে লোকের কাছ থেকে বিশেষ করে নিজের পরিবারের বিশেষত জীবনসঙ্গিনীর কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান খাতির পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করে। ডিপ্রেশনের কোনও কোনও দশায় পুরুষদের এই মনোভাব তাকে রীতিমতো বদরাগী, অসহিষ্ণু ও আগ্রাসী করে তোলে।

অথচ শারীরবৃত্তীয় কারণে মেয়েদেরই যে বেশি খিট্খিটে হওয়ার কথা তা কয়েকটি ক্ষেত্র আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।

মেয়েদের ডিপ্রেশনের বিশেষ ক্ষেত্র

দেখা গেছে ৫ জনের মধ্যে ১ জন মহিলা জীবনের কোনও না কোনও সময় ডিপ্রেশনে ভুগেছে। তাদের ডিপ্রেসড্ হওয়ার প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ। যে কোনও বয়সেই হতে পারে তবে ডিপ্রেশন আক্রান্ত মহিলারা বেশির ভাগই ৪০-৫৯ বছরের। কিছু হরমোনের হেরফেরের কারণে ডিপ্রেশন আসতে পারে, তবে অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কারণ, বংশগতি ও জীবনধারা আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। যেমন

বয়ঃসন্ধিক্ষণ: বয়ঃসন্ধিক্ষণ পেরোলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ডিপ্রেশন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।একে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আগেই বাল্য থেকে কৈশোরে পৌঁছয়, তার ওপর রজনিবৃত্তি পর্যন্ত জীবনের মূল সময়টাই প্রাকৃতিক ও সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এমনিতেই যৌনতা ও পরিচয় সংকট, মা-বাবার সঙ্গে সংঘাত এবং পড়াশুনো ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে চাপ ছোট ছেলে মেয়েদের চাপ সৃষ্টি করেই থাকে; তার ওপর যৌন হামলা, অপরাধবোধ ও লিঙ্গবৈষম্যের কারণে মেয়েরা থাকে বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে। ছেলেরা আত্মরতি করলেও সেটা নিয়ে গোপনীয়তা পর্যন্ত বজায় রাখার প্রয়োজন অনুভব করে না, যেখানে মেয়েরা এই ধরণের কাজ করে ফেললেও তা নিয়ে রীতিমতো অপরাধবোধে ভুগতে পারে।

প্রাক ঋতু সমস্যা:  বেশির ভাগ মেয়েদের ক্ষেত্রেই ঋতু-পূর্ব উপসর্গ বা premenstrual syndrome (PMS)-এর মধ্যে পেটে ব্যথা, স্তনে অস্বস্তি, মাথা ব্যথার সাথে সাথে উদ্বেগ, বিরক্তি ও মন্দ মেজাজ (blue mood) এগুলো থাকে। হয়তো শারীরিক অস্বাচ্ছ্ন্দের কারণেও এই মানসিক অস্বস্তি যা অধিকাংশত সামান্য ও সাময়িক। কিন্তু এই সমস্যা সীমা ছাড়ালে তাকে premenstrual dysphoric disorder (PMDD) বলা হয় যার জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন। ডিপ্রেশনের সঙ্গে ঋতু-পূর্ব উপসর্গের শঠিক সম্পর্ক কী তা খুব স্পষ্ট নয়, তবে স্ত্রী হরমোন যেমন ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ইত্যাদির মাত্রা হেরফেরে মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন হয়ে থাকে যা ডিপেশনের কারণ অনুমান করা যায়। তাছাড়া প্রকৃতির করুণায় আর পুরুষশাসিত সমাজের বদান্যতায় এই সমস্যাগুলো আরও গুরুতর হয়ে ওঠে।

গর্ভধারণ: গর্ভসঞ্চের সময় মন মেজাজের পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। গর্ভসঞ্চার না হলেও মন খারাপ হলেও সর্বক্ষণ বমিভাব ও নানা ধরণের শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য এবং দুশ্চিন্তা ভাবি শিশুর সুস্থতা নিয়ে। সঙ্গে নানা স্বপ্ন। বাচ্চা পেটের ভেতর নড়াচড়া ঠিক মতো না করলে উদ্বেগ, করলেও কষ্ট। বিশ্রামের দরকার হলেও সাংসারিক কাজকর্ম থেকে রেহাই মেলে না অধিকাংশ সময়। তার ওপর যৌনাচারে অসুবিধা পুরুষ সঙ্গীকে অসহিষ্ণু করে তুলতে পারে। অনভিপ্ররেত গর্ভসঞ্চারের বা গর্ভপাতের বেলা তো বিষাদগ্রস্ত ও খিটখিটে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি। ডিপ্রেশনের পূর্ব রেকর্ড থাকলে বা আগের প্রসবোত্তর ডিপ্ররেশন থেকে থাকলে সমস্যা আরও বাড়ে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করে দিলে তো কথাই নেই।

প্রসবোত্তর সমস্যা:  অনেক নতুন মা-ই সন্তান প্রসবের পর দুঃখ, রাগ, বিরক্তি ও কথায় কথায় অশ্রুপ্রবণ হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে baby blues বলে যা খুব স্বাভাবিক এবং দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু এই উপসর্গ খুব বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লে চিকিৎসার দরকার হয়, বিশেষ করে যদি নিম্ন আত্মপ্রতীতি (Low self-esteem), উৎকণ্ঠা (Anxiety), অশান্তি (Agitation), বাচ্চার যত্ন নিতে অক্ষমতা, বাচ্চার ক্ষতি করার বাসনা, আত্মহত্যার চিন্তা এই জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়। ১০%-২৫% মহিলার মধ্যে এই অবস্থা দেখা যায়। হরমোন মাত্রার তারতম্যের জন্য যে মেজাজের ওঠা পড়া (mood fluctuation), অকারণ উদ্বেগ (anxiety disorder) ইত্যাদি হয়ে থাকে তার জন্য সমাজ বা সংসার কেউই সহযোগিতা করে না। আবার প্রসবের আগে ডিপ্রেশনে ভুগলে প্রসবে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে যা সদ্য প্রসবিনীর অবস্থা আরও খারাপ করে দেয়।

এই উপসর্গগুলো স্ত্রী ও পুরুষ ডিপ্রেশন রোগীর সাধারণ প্রবণতা। এর ব্যতিক্রম যে দেখা যায় না তা নয়। অনেক মহিলার মধ্যেই খিটখিটে ভাব, রাগ, অলসতা এইসব উপসর্গ দেখা যায়, আবার পুরুষরাও বিমর্ষতায় ঝিমিয়ে থাকে, উদ্বেগ ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগে থাকে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানসিক অবসাদের উত্তরাধিকার, মা-বাবার খারাপ সম্পর্ক দ্বারা কন্যা সন্তানের অধিকতর প্রভাবিত হওয়া এবং উপসর্গগুলো কীভাবে লিঙ্গভেদে বদলায়  এসব পর্যালোচনা করলে যেন পুরুষের আত্মকেন্দ্রিকতা ও মেয়েদের সহনশীলতা বা মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতাই প্রতিফলিত হয়।   


 


তথ্যসূত্র:  

  1. Kessler RC, Berglund P, Demler O, Jin R, Koretz D, Merikangas KR, Rush AJ, Walters EE, Wang PS. The epidemiology of major depressive disorder: results from the National Comorbidity Survey Replication (NCS-R). Journal of the American Medical Association. 2003; 289(3): 3095-3105.

  2. Rohan KJ, Lindsey KT, Roecklein KA, Lacy TJ. Cognitive-behavioral therapy, light therapy and their combination in treating seasonal affective disorder. Journal of Affective Disorders. 2004; 80: 273-283.

3. Tsuang MT, Bar JL, Stone WS, Faraone SV. Gene-environment interactions in mental disorders. World Psychiatry. 2004 Jun; 3(2): 73-83.

4. Schmidt PJ, Nieman LK, Danaceau MA, Adams LF, Rubinow DR. Differential behavioral effects of gonadal steroids in women with and in those without premenstrual syndrome. New England Journal of Medicine. 1998 Jan 22; 338(4): 209-216.

5. Rubinow DR, Schmidt PJ, Roca CA. Estrogen-serotonin interactions: Implications for affective regulation. Biological Psychiatry. 1998; 44(9): 839-850.

6. Ross LE, Steiner M. A Biopsychosocial approach to premenstrual dysphoric disorder. Psychiatric Clinics of North America. 2003; 26(3): 529-546.

7. Dreher JC, Schmidt PJ, Kohn P, Furman D, Rubinow D, Berman KF. Menstrual cycle phase modulates reward-related neural function in women. Proceedings of the National Academy of Sciences. 2007 Feb 13; 104(7): 2465-2470.

8. Munk-Olsen T, Laursen TM, Pederson CB, Mores O, Mortensen PB. New parents and mental disorders. Journal of the American Medical Association. 2006 Dec 6; 296(21): 2582-2589.

9. Chaudron LH, Szilagyi PG, Kitzman HJ, Wadkins HI, Conwell Y. Detection of postpartum depressive symptoms by screening at well-child visits. Pediatrics. 2004 Mar; 113(3 Pt 1): 551-558.

10. Freeman MP, Wright R, Watchman M, Wahl RA, Sisk DJ, Fraleigh L, Weibrecht JM. Postpartum depression assessments at well-baby visits: screening feasibility, prevalence and risk factors. Journal of Women's Health. 2005 Nov 10; 14(10): 929-935.

11. Freeman EW, Sammel MD, Lin H, Nelson DB. Associations of hormones and menopausal status with depressed mood in women with no history of depression. Archives of General Psychiatry. 2006 Apr; 63(4): 375-382.

12. Cohen L, Altshuler L, Harlow B, Nonacs R, Newport DJ, Viguera A, Suri R, Burt V, Hendrick AM, Loughead A, Vitonis AF, Stowe Z. Relapse of major depression during pregnancy in women who maintain or discontinue antidepressant treatment. Journal of the American Medical Association. 2006 Feb 1; 295(5): 499-507.

13. Bebbington PE, Dunn G, Jenkins R, Lewis G, Brugha T, Farrell M, Meltzer H. The influence of age and sex on the prevalence of depressive conditions: report from the National Survey of Psychiatric Morbidity. International Review of Psychiatry. 2003 Feb-May; 15(1-2): 74-83.

14. Nolen-Hoeksema S, Larson J, Grayson C. Explaining the gender difference in depressive symptoms. Journal of Personality and Social Psychology. 1999; 77(5): 1061-1072.

15. Regier DA, Rae DS, Narrow WE, Kaebler CT, Schatzberg AF. Prevalence of anxiety disorders and their comorbidity with mood and addictive disorders. British Journal of Psychiatry. 1998; 173(Suppl. 34): 24-28.

16. Devane CL, Chiao E, Franklin M, Kruep EJ. Anxiety disorders in the 21st century: status, challenges, opportunities, and comorbidity with depression. American Journal of Managed Care. 2005 Oct; 11(Suppl. 12): S344-353.

17. Kessler RC, Barker PR, Colpe LJ, Epstein JF, Gfroerer JC, Hiripi E, Howes MJ, Normand SL, Manderscheid RW, Walters EE, Zaslavsky AM. Screening for serious mental illness in the general population. Archives of General Psychiatry. 2003 Feb; 60(2): 184-189.

18. Conway KP, Compton W, Stinson FS, Grant BF. Lifetime comorbidity of DSM-IV mood and anxiety disorders and specific drug use disorders: results from the National Epidemiologic Survey on Alcohol and Related Conditions. Journal of Clinical Psychiatry. 2006 Feb; 67(2): 247-257.

19. Cassano P, Fava M. Depression and public health, an overview.Journal of Psychosomatic Research. 2002 Oct; 53(4): 849-857.

20. Katon W, Ciechanowski P. Impact of major depression on chronic medical illness. Journal of Psychosomatic Research. 2002 Oct; 53(4): 859-863.

21. Hankin BL, Abramson LY. Development of gender differences in depression: an elaborated cognitive vulnerability-transactional stress theory. Psychological Bulletin. 2001 Nov; 127(6): 773-796.

22. Calvete E, Cardenoso O. Gender differences in cognitive vulnerability to depression and behavior problems in adolescents.Journal of Abnormal Child Psychology. 2005 Apr; 33(2): 179-192.

23. Cyranowski J, Frank E, Young E, Shear K. Adolescent onset of the gender difference in lifetime rates of major depression. Archives of General Psychiatry. 2000 Jan; 57(1): 21-27.

25. Rush JA, Trivedi MH, Wisniewski SR, Stewart JW, Nierenberg AA, Thase ME, Ritz L, Biggs MM, Warden D, Luther JF, Shores-Wilson K, Niederehe G, Fava M. Bupropion-SR, Sertraline, or Venlafaxine-XR after failure of SSRIs for depression. New England Journal of Medicine. 2006 Mar 23; 354(12): 1231-1242.

26. Trivedi MH, Fava M, Wisniewski SR, Thase ME, Quitkin F, Warden D, Ritz L, Nierenberg AA, Lebowitz BD, Biggs MM, Luther JF, Shores-Wilson K, Rush JA. Medication augmentation after the failure of SSRIs for depression.New England Journal of Medicine. 2006 Mar 23; 354(12): 1243-1252.

27. Marcus SM, Flynn HA, Blow F, Barry K. A screening study of antidepressant treatments and mood symptoms in pregnancy.Archives of Women's Mental Health. 2005 May; 8(1): 25-27.

29. U.S. Food and Drug Administration (FDA). FDA Medwatch drug alert on Effexor and SSRIs, 2004 Jun 3. Available at(www.fda.gov/medwatch/safety/2004/safety04.htm#effexor) .

30. Weissman AM, Levy BT, Hartz AJ, Bentler S, Donohue M, Ellingrod VL, Wisner KL. Pooled analysis of antidepressant levels in lactating mothers, breast milk and nursing infants. American Journal of Psychiatry. 2004 Jun; 161(6): 1066-1078.

32. Hypericum Depression Trial Study Group. Effect of Hypericum perforatum (St. John's wort) in major depressive disorder: a randomized controlled trial. Journal of the American Medical Association. 2002 Apr 10; 287(14): 1807-1814.

34. Reynolds CF III, Dew MA, Pollock BG, Mulsant BH, Frank E, Miller MD, Houck PR, Mazumdar S, Butters MA, Stack JA, Schlernitzauer MA, Whyte EM, Gildengers A, Karp J, Lenze E, Szanto K, Bensasi S, Kupfer DJ. Maintenance treatment of major depression in old age. New England Journal of Medicine. 2006 Mar 16; 354(11): 1130-1138.

35. http://www.health.havard.edu/special_health_reports/understanding-depression

36. http://www.health.havard.edu/special_health_newsletters/Havard_Health_letter/2014/June

37. http://www.helpguid.org/mental/bipolar-disorder-symptoms-treatment.htm

38. http://www.helpguid.org/mental/depression_women.htm

39. http://www.helpguid.org/mental/depression_men_male.htm

40. http://www.helpguid.org/mental/depression_suicide_prevention.htm

41. http://www.suicide.org/international-suicide-hotlines,html

42. http://www.helpguid.org/mental/depression_signs_types_diagnosis_treatment.htm