পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২২

মিনাক্ষী ঘোষ

                         


কোল্হাপুর ডায়েরী ৭

ঠিক হোলো রবিবার সকালে সকলে বোসদার বাড়িতে মিট করবে। সেখান থেকে একসাথে প্রত্যেকে নিজের নিজের গাড়ীতে রওনা হবে পান্হালার উদ্দেশে। ওখানে গিয়েই হবে ব্রেকফাষ্ট আর লাঞ্চ।
মিমি স্ন্যাক্স কিছু প্যাক করে নিয়েছিল। সাড়ে আটটা নাগাদ সপরিবারে  পৌঁছে গেল বোসদার ওখানে। মিমিদের সাথে সাথেই ভটচাযদা আর বৌদি এসে পৌঁছলেন। ভটচাযদা একটি নামী টেক্সটাইল কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার। খুব  সুরসিক নিপাট একজন ভদ্রলোক। কম কথা বললেও সেন্স অব হিউমার প্রবল। আর ভটচাযবৌদিতো ভীষণ আমুদে মানুষ। একাই হৈ চৈ করে মাতিয়ে রাখেন সারাক্ষণ। জীবনের কঠিন যণ্ত্রণাকেও কিভাবে  নিজের প্রাণশক্তি দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় এঁকে না দেখলে মিমি কোনদিন বুঝতেই পারতোনা।
জীবনের চলার পথে প্রতিনিয়ত জানবার শেখবার যে অপরিমেয় রত্নভান্ডার ছড়িয়ে রয়েছে জীবনবোধের পাতায় পাতায় মিমি কেবল তার সন্ধান করে গেছে
পরম শিক্ষার্থীর ঔৎসুক্যে। এই তার সঞ্চয়। মনের মণিকোঠায় এদের সযত্নে সাজিয়ে রাখে মিমি।নিজের সাথে একলা হবার অবকাশে নেড়েচেড়ে দ্যাখে তার অভিজ্ঞতা ঝুলি ভরে ওঠা সেইসব  দুর্লভ রত্নরাজি।
দেখতে দেখতে বিশ্বাসদা মিত্রদা বৌদিদের নিয়ে এসে পড়লেন কলকল করতে করতে। নেক্সট জেনারেশন বলতে মিমির দুই ছেলেমেয়ে বোসবদির ছেলে ছেলের বৌ। মেয়ে গেলনা ওর কিছু জরুরী কাজ পড়ে গেছিলো তাই।
সকলে মিলে বেরোতে বেরোতে সাড়ে ন'টা বেজে গেল। বোসদার ছেলে পুপু প্রস্তাব দিলো ওদের গাড়িতে মিমির দুউ ছেলেমেয়ে যাবে। পরিবর্তে বোসদা বৌদি যাবে মিমিদের গাড়িতে।।
কোল্হাপুর মিউনিসিপ্যালিটির পাশ দিয়ে খানিকটা পথ গেলে ডানদিকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে পান্হালার দিকে। শহর ছেড়ে বেরিয়ে খানিকটা যাবার পরেই শুরু হলো পাহাড়ী পথ পরিক্রমা।
দেখতে দেখতে পথের দু'ধারের বাড়িঘর ক্রমশ অপসৃয়মান সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে ঘন সবুজ অরণ্যানী।পূরো পথটাই খাড়া উপরে উঠে যাচ্ছে পান্হালার দিকে। বেশ খানিকটা যাবার পরে একটা রাস্তা ডানদিকে
চলে গেছে জ্যোতিবা পাহাড়ের দিকে। আর সোজা রাস্তাটা একেবারে পান্হালা। পথে বেশ কিছু  ক্ষীণতোয়া জলধারা নজরে পড়লো। সলজ্জ কিশোরীর মতো গাছগাছালির ফাঁকে নিজেকে আড়াল করে ভীরু পদক্ষেপে নীচে নেমে আসছে।
এই কুড়ি বাইশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে লাগলো
প্রায় একঘন্টা।সবার আগে চলেছে মিত্রদার গাড়ি। আর মিমিদের গাড়ি সবার শেষে। আর সকলের কাছে এই পথটা পরিচিত হলেও সূর্যর কাছে নতূন তাই তার গাড়ির গতিও ধীর।গাড়ির কাচের ফাঁক দিয়ে মিমি আস্বাদন করতে করতে চলেছে পাহাড়ি পথের অনুপম প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য। অরণ্যানীর নিবিড়তা ক্রমশ কমে এলে পাহাড়ের
গায়ে প্রতিভাত হতে লাগলো ছোট ছোট বসতি। এইভাবে
পথের বিলাস পেরিয়ে একসময় পৌঁছে গেল পান্হালার দ্বারপ্রান্তে। এখানে ফোর্টে প্রবেশ করার আগে টিকিট কাটতে হয়। ড্রাইভারের টিকিট মকুব। তাই মিমিদের কাটতে হলো তিনটে টিকিট।
প্রবেশপথের  বহিরঙ্গটা গম্বূজাকৃতির অর্ধচন্দ্রাকারে বেষ্টিত।  সামনের অংশে মারাঠা সম্রাট শিবাজীর একটি মুক্ত কৃপাণ হস্তে অশ্বারূঢ় প্রস্তরমূর্তি।
সহ্যাদ্রি পর্বতগাত্রে নির্মিত এই ফোর্টটি সমতল থেকে চারশো মিটার উঁচু। অসংখ্য সুরঙ্গ এই দুর্গের নীচে নির্মিত। এরমধ্যে একটি সুড়ঙ্গ এক মিটারের ও বেশী লম্বা।দুর্গের প্রাকার ত্রিভুজাকৃতির। এর ব্যাপ্তি সাত মিটারের ও কিছু বেশী।দুর্গের প্রাচীরগূলি একদম ঋজু খাড়া পাহাড়ের
গায়ে দন্ডায়মান।
অধিকাংশ স্থাপত্য বিজাপুরী স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত।
কিছু কিছু স্থাপত্যে ময়ূরের  মোটিফ বাহমনী সাম্রাজ্যের স্থাপত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
কিছু কিছু স্তম্ভের গায়ে পদ্মের কারুকাজ রাজা দ্বিতীয় ভোজের সময় স্মারক। দুর্গের কিছু কিছু স্তম্ভ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর্চের আদলে নির্মিত দরওয়াজা দিয়ে একে একে প্রবেশ করলো মিমিদের সবক'টি গাড়ি। পান্হালার ভেতরে অনেক হোটেল রেস্তোঁরা ও খাবারের সুবন্দোবস্ত রয়েছে। এতক্ষণ টানা জার্নি করে সকলের খিদেও পেয়েছে প্রচন্ড।ফোর্টের সামনেই  একটি হোটেলে সকলের গাড়ি  দাঁড়ালো এক এক করে। খানিকটা গার্ডেন রেস্তোরাঁ মতো। তবে থাকবার সুবন্দোবস্ত ও আছে। ভটচাজ বৌদি  বিশ্বাস বৌদি মিত্র বৌদি সকলেই এত মিশুকে যে কিছুক্ষণের মধ্যে মিমির জড়তা একেবারেই কেটে গেল। কোল্হাপুরী মিসাল খেতে খেতে পান্হালা সম্পর্কে ভটচাজবৌদির কাছে মিমি শুনছিলো অজানা নতুন আরো অনেক গল্পকথা।

ক্রমশঃ





রবিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২২

মিনাক্ষী ঘোষ

                      


কোল্হাপুর ডায়েরী ৬
কোল্হাপুর শহরটা আড়ে দৈর্ঘ্যে খুব বড় নয়। মিঃ বোসের বাড়িও খুব কাছেই। ঠিকানা ও ডিরেকশন মিলিয়ে
বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধে হলোনা। এই অঞ্চলটা কোল্হাপুরের অন্যতম পশ এরিয়া। অনেক
ধনী লোকের  বাস এই অঞ্চলে। প্রায় সব বাংলো ধরণের বাড়ি।কোল্হাপুরে এসে মিমির আরো একটা
জিনিস নজরে পড়লো এখানে সব বাড়িতেই সবুজের খুব আধিক্য। বাংলোতে তো বটেই ছোট ফ্ল্যাটেও লোকে একটু হলেও সবুজ চারা রোপণ করে। উপত্যকা শহর হওয়ায় এখানে আবহাওয়া সারা বছর নাতিশীতোষ্ণ।
আরো একটা জিনিস মিমি লক্ষ্য করেছে প্রায় সব বাড়িতেই পোষ্য রয়েছে। বোঝা যায় এখানে সারমেয় প্রীতি
নিতান্ত অবহেলিত নয়।
কোল্হাপুর মহারাষ্ট্রের শ্যুগার বেল্ট হওয়ায় এখানে  পার ক্যাপিটা ইনকাম অনেক বেশী। বেশির ভাগ  লোকের অনেক খেতি জমি রয়েছে। মূলত আখের ফলন হয়। আখের চাষ খুব লাভজনক। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পয়সা উপার্জনের চিন্তা না থাকায় এখানকার জীবনযাত্রা
অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় অনেক শ্লথ ।
বৌদির বাড়িতে পৌঁছে দেখলো সেখানে আরো বেশ কিছু বাঙালি পরিবারের সমাগম। একে একে সকলের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন বোসদা ও বৌদি।
আলাপ হলো ওনার পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গেও
ওনাদের পরিবারে ওনার ছেলে ছেলের বউ ও অবিবাহিতা মেয়ে রয়েছে। অনেকটা মিমির মতোই ছেলে বড় মেয়ে ছোট। ছেলে সদ্য বিবাহিত। ছেলের বউটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মিশুকে স্বভাবের। মেয়েকেও ভারি মিষ্টি দেখতে। সকলেই খুব সহজ সরল আর আন্তরিক।
এই পরিবারটির সাথে ক্রমে ক্রমে হৃদ্যতা আরো বেড়েছে। সম্পর্কটা আর অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।বরং নিকটাত্মীয়ের রূপ নিয়েছে।
ওখানে পরিচয় হোলো আরো কিছু সম্ভ্রান্ত বাঙালী পরিবারের সাথে। প্রায় সবাই ওখানে অনেক বছর ধরে আছেন। মিশে গেছেন ওখানকার রীতিনীতি সংস্কৃতির সাথে। কোল্হাপুরের সংস্কৃতির নিজস্ব একটা স্বাতন্ত্র্য
আছে।মিমি ধীরে ধীরে তার পরিচয় পেয়েছে।
সেদিনের ঘরোয়া আড্ডায় ঠিক হোলো আগামী রবিবার সকলে মিলে পান্হালা যাওয়া হবে। বাঙালীরা সাধারনত আড্ডাপ্রবণ জাতি।প্রবাসে এই সম্মিলিত আড্ডার মেজাজটাই আলাদা। এর স্বাদও মিমির কাছে নতুনত্বের।
পান্হালা কোল্হাপুর শহর থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ছোট্ট পাহাড়ী শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা 3177 কিলো মিটার।মহারাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা
ক্ষুদ্রতম শহর এইটি।প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পান্হালার গুরুত্ব অপরিসীম।
বর্তমানে কোল্হাপুর মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের অন্তর্গত হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণে মহারাষ্ট্র সরকার যথেষ্ট যত্নশীল এর মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু পান্হালা দুর্গটি মারাঠা সাম্রাজ্যের ও ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তার বাল্যকাল ব্যতিরেকে পাঁচশত দিনের অধিক এই দুর্গে জীবন অতিবাহিত করেছেন।১৭৮২ থেকে১৮২৭ পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পান্হালা।
কোল্হাপুর শহরের উত্তর পশ্চিমে কুড়ি কিলোমিটার দূরে সহ্যাদ্রি পর্বতের  বহির্স্তরে সমতল থেকে ৪০০মিটার উচ্চতায় পান্হালা দুর্গটি অবস্থিত।দাক্ষিনাত্যের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দুর্গ হলো এইটি।
কূটনৈতিক কৌশলগত দিক থেকে ও এর গুরুত্ব অপরিসীম।এই দুর্গের প্রাকার থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার প্রধান সড়ক যোগাযোগ পথগুলি নিরীক্ষণ
করা যেত। শুধু তাই নয়, এই দুর্গের প্রাকার থেকে সমগ্র উপত্যকাটি দৃষ্টিগোচর হয়।
১১৭৮ থেকে ১২০৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত এই দূর্গটি প্রথমে শীলহার রাজ ভোজের প্রসাশনিক কেন্দ্রস্থল ছিলো।  ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে এটি কর্ণাটকের বিজাপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।  পরে মুঘলসম্রাট ঔরঙ্গজেব এটি করায়ত্ত করেন।এই দুর্গের উন্নতিসাধন প্রকল্পে মূলত আদিলশাহীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।  ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে শিবাজী এটি দখল করেন।  পরে ১৬৮৯ খ্রীষ্টাব্দে
আওরঙ্গজেব পুনরায় এই দুর্গটি অধিকার করেন। তার অনেক পরে মহারাণী তারাবাঈয়ের অনুগামী রামচন্দ্র এটিকে নিজ অধিকারভুক্ত করেন ও কোল্হাপুরের  প্রশাসনিক আওতায় পান্হালাকে  নিয়ে আসা হয়।
১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে এই দুর্গটি ব্রিটিশদের অধীনস্থ হয়।
ক্রমশঃ



 

মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২২

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়


 স্বাভাবিকতা ফেরার অপেক্ষায়

— — —


‘গোপাল দা… একটা লিকার, চিনি ছাড়া।’ বলে কোমর থেকে ছোট আসনটা খুলে কাঠের বেঞ্চে পাতল সন্তু, তারপর সাবধানে বসল। উপস্থিত সকলেই একবার তাকিয়ে দেখে নিল ওকে, স্বাভাবিক। এমন কাছা-গলায় কাউকে দেখলে ভিড়ের মাঝেও মানুষ চোখ আটকে যায়। এলাকার ছেলে… কারো কারো মুখও চেনা। গোপাল একটা কেটলির মুখে  ছাঁকনি রেখে সস প্যান থেকে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল, ‘একাই বেরোলে?’

- কেন?

- এই সময়ে একা বেরোতে নেই কিনা…

- চা খেতে এলেও ল্যাজ নিয়ে আসতে হবে?

-

- থাকে, নেমন্তন্ন করতে সঙ্গে যায়। 

- কবে যেন ঘাটে ওঠা? তোমাদের তো দশ দিনে…

- হুম… পরশু ঘাট। 

- দেখতে দেখতে আট দিন হয়ে গেল! 

সন্তু কোন উত্তর দিল না, বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিয়ে ঠোঁটে ঠেকাল। ছ্যাঁকা মাঝে মাঝে ফিরিয়ে আনে, মাঝে মাঝে অন্য কথা মনে করিয়ে দেয়। সন্তু সরাসরি মুখে নেয় না গরম কিছু, আগে ঠোঁটে নেয়। ছ্যাঁকার ক্ষমতা বুঝে তারপর জিভ ঠেকায়। অসাবধানে বা তাড়াহুড়োয় আগে জিভ পুড়েছে অনেকবার। এখন সচেতন থাকে। গোপাল একটা প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল, এই ‘আট দিন হয়ে গেল’ বলার পর যেমন আসে। তাকিয়ে ছিল সন্তুর দিকে। উপস্থিত আরো দু-তিনজন তাকিয়ে ছিল– এই কিছু বলবে, এক চুমুক বা দু চুমুক পর। সন্তু অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। প্রথম দু চুমুক সামলে খেলেও বাকিটা দ্রুত শেষ করে একটা পাঁচ টাকার কয়েন কেকের বয়ামের ওপর ঠক করে রেখে দিয়ে চলে গেল। সন্তু চলে যাওয়ার পর গোপালকে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছিল জানো? শুনলাম পোস্টমর্টেম হয়েছে।’ 


— — —


- চা টা খেয়ে নিন বাবা। ঠান্ডা হয়ে যাবে। 

- অ্যাঁ?
- এখানে রাখলাম, চাপা দিয়ে। 
- ওহ… আচ্ছা। 
- বিস্কুট দেব দুটো?
- সন্তু ফেরেনি না? 
- না।
- ফোন করেছিল?
- না
- সেকি!
- এসে যাবে, রাণাঘাট অবধি যাওয়া… আসা। বিকেল হয়ে যাবে। 
- কী দরকার ছিল… ফোনেই সেরে নিতে পারত!
- ওর এক বন্ধু গেছে সঙ্গে। 
- ওই তো সব বন্ধু… বন্ধু! 
- আজ একটু দেরি হয়ে গেল… আপনি চা-টা খেয়ে নিন। আমি চান করে এসে ভাত বাড়ছি। 
- হুম, এসো। 


শ্যামলবাবু কতটা স্বাভাবিক আছেন, আর কতটা শোকে মুহ্যমান– মাঝে মাঝে যেন কেউ না কেউ এসে একবার টোকা মেরে দেখে যাচ্ছে। ঘটনাচক্রে একটার পর একটা ঘটে চলেছে। ডমিনো এফেক্টের মত। অমন কিছু ঘটলে, যেভাবে তা পর পর আরো যা কিছু ঘটিয়ে নেয়। অল্প বয়সে ঠাকুমার মৃত্যুদিন দেখেছেন, কলেজে পড়তে পড়তে বাবা চলে গেল ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায়। মা গেল দীর্ঘ রোগভোগের পর, বিছানায় থেকে থেকে বেড-সোর হয়ে গেছিল। মনে মনে মুক্তি চাইছিল সবাই। চেনা আর কাছের মানুষের চলে যাওয়া নতুন কিছু না। মামাতো ভাই, শালা, ভগ্নিপতী… এদের সঙ্গে শ্মশানে গিয়ে শ্যামলবাবুই কাঁধে হাত রেখে দাঁড়্রিয়ে থেকেছেন। এ এক অভ্যেসের মত। পাড়ার সবাইও যেন জানে… এই লোকটা এইসব কাজ ভালো বোঝে। অথচ অবসর নেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এই পারিবারিক অশৌচ, ধূপের গন্ধ, মালা, ফ্রেমে বাঁধানো ছবি– এসব উনি মেনে নিতে পারছেন না। কেমন একটা লাগছে। ‘এ অস্বস্তির কথা কাকে জানাব? কে বুঝবে?’... ভাবতে ভাবতে চশমা পরে আবার খবরের কাগজের দিকে মনটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। সেখানেও কারো অনন্তলোকে চলে যাওয়ার কথা স্মরণ করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে পরলোকগতর পরিবার… ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধু, নাতি-নাতনীরা। সধবা মহিলা, হাসছেন না… হাসতে বলা হয়েছে, তাই হাসার চেষ্টা করছেন। 


     শ্রেয়সীর স্নানে যাওয়া হল না। শ্বশুরমশাইকে চা দিয়ে গামছাটা নিতে বারান্দার দিকে এগিয়েছিল… হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। জামাই বাবু… বিরক্তিকর কৌতূহলী মানুষ একটা। কিছু বলাও যায় না… শ্রেয়সীর বাবার অপারেশনের সময়ে অনেক করেছেন। আর্থিক সাহায্য তো বটেই, রীতিমত পুত্রের দায়িত্ব পালন। দিদির একটা অহঙ্কার তো ছিলই, আরো বেড়ে গেছে জামাইবাবুর আধিপত্যের কারণে।

দিদির বিয়ে হয়ছিল সম্বন্ধ করে, বয়সের পার্থক্যটা কোনো বিষয়ই হল না দেখাশুনোর সময়। দিদির মুখ দেখেই বোঝা যেত– শুধু অপছন্দ নয়, বিয়ের পরেও অস্বচ্ছন্দ। আর এখন আলাদাই হাবভাব। শ্রেয়সীকে একটু সুযোগেই শুনিয়ে দেয় ‘নিজে পছন্দ করে বিয়ে করার এই ফল’। শ্রেয়সীর বর অরূপের আর্থিক অবস্থা সব সময়ে একরকম যায় না… এটা ওদের কাছে একরকম দারিদ্রই। একটু ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে দেখে শ্রেয়সীকে। জামাইবাবু তো মাঝে মাঝেই ঘুরিয়ে তুলনা টেনে কথা বলেন। একটা মিচকে কায়দা আছে– কোথাও একটা বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলবেন, এখন থাক। তোমাদের এখন একটু সামলে চলতে হবে… এরপর দুজন থেকে তিনজন হবে।  

 প্রথমে ভেবেছিল ফোনটা তুলবে না, কিন্তু দু-তিনবার ফোন বাজতে ফোনটা তুলল শ্রেয়সী। ওপার থেকে ভেসে হল জামাইবাবুর কণ্ঠস্বর– “মেসোমশাই ঠিক আছেন তো?”

শ্রেয়সী অল্প কথায় সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল… বলতে পারছিল না ‘স্নান করতে যাব’। সবাইকে এই কথাটা বলতে পারে না… জামাইবাবুকে তো আরোই নয়। শ্বশুরমশাইকে খেতে দিতে যাচ্ছে বললে ফোনটা কাটার আগে যথারীতি জামাইবাবু জিজ্ঞেস করে বসলেন– “পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে তেমন দুশ্চিন্তার তো কিছু নেই বলো?” 


     শ্যামলবাবু তখনো খবরের কাগজের দিকে তাকিয়েই বসে আছেন। কারো ভুলে কিছু নিরীহ মানুষের হত্যা হয়ে যাওয়ার খবর। স্বপক্ষে আর কোনো যুক্তি না থাকলে, কত সহজে বলে দেওয়া যায় ‘ভুল হয়ে গেছে!’। চায়ের কাপটা তখনও ঢাকা দেওয়াই। একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। 

এই ঘরে উনি অরুণার ছবি টাঙাতে দেবেন না। অরুণা হাসিমুখে সারাদিন ঘরের একটা নির্দিষ্ট দিক থেকে তাঁকে দেখে যাচ্ছে, কথা বলছে না, সাড়াও দিচ্ছে না… ভাবলেই কেমন লাগে!

‘কেন এভাবে পরলোকগত আত্মীয়ের ছবি বাঁধিয়ে রাখে? আমি তো মায়ের ছবিও ঘরে রাখতে পারি নি!’


— — —


- দেখা হল? 
- হুম
- কিছু বলল?
- কী আর বলবে নতুন করে!
- কিছু জিজ্ঞেস করছিল না?
- শুরু করেছিল… সে তো করবেই, এমন একটা টপিক। 
- কী বললে?
- এই ঢুকতে ঢুকতে এত প্রশ্ন করো না তো! এত প্রশ্ন করো না! অসহ্য লাগে! 


শ্রেয়সীকে পাশ কাটিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল সপ্তর্ষি। শ্রেয়সী না পাওয়া উত্তরের অনিশ্চয়তা নিয়েই তাকিয়ে রইল সেই চলে যাওয়ার দিকে। ইচ্ছে করছিল আরো জোরে চেঁচিয়ে বলতে– ‘চিন্তাটা একা তোমার না, তোমাদের পরিবারের নয়… আমিও এর মাঝে জড়িয়ে পড়েছি। আমাকেও জবাব দিতে হয়ে। সারাদিন জবাব দিয়ে যেতে হচ্ছে কাউকে না কাউকে!’ কিন্তু জোরে কথাও বলতে পারছে না এখন। শুধু শ্বশুরমশাই বা অশৌচ বাড়ির শোকের কথা ভেবে নয়… পরিস্থিতির জন্য, কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি জানলা আর কানগুলোর জন্য। এমন অবস্থা যে নিজের মা-বাবাকেও কিছু বলতে পারছে না মন খুলে। তারাও দূরত্ব রাখছে। একদিন এসে আতপ চাল, ফল-মিষ্টি, এসব দেওয়ার কর্তব্য করে গেছে। আবার ঘাটের দিন বাবা একা আসবে। দুই বোন, কোনো ভাই নেই। বাবাকেই ঠেকা দিয়ে যেতে হবে। জামাইবাবু আসতে চাইছে, শ্রেয়সী বাবাকে বলেছে… কাটিয়ে দিতে। মনে হয়, বাবা বুঝেছে ব্যাপারটা।

    মাথা থেকে চিন্তা যায় না। এত কিছুর জন্য… এসবের জন্য কে-ই বা প্রস্তুত থাকে? এমন কিছু তো প্রত্যাশিত নয়! এই অবেলায় হবিষ্যি করা… গ্যাস-ওভেনেই ম্যানেজ করতে হচ্ছে মালসার বদলে কাঁসার পাত্র বসিয়ে। ওভেনের আঁচে মালসা ফেটে যেতে পারে… ভয় ধরিয়ে দিয়ে গেছে পাড়ার লোকজন। দ্বিতীয় কোনো মহিলা নেই যে শ্রেয়সীকে সাহায্য করে। সন্ধের সময়ে ঠিক আসবে কেউ… একবার রান্নাঘরে আর একবার শোয়ার ঘরে উঁকি দিয়ে যেতে। 


- ট্রেনে ভিড় ছিল?

- কীসের ট্রেন?
- রানাঘাট যাওয়ার… আবার কোন ট্রেন?
- ও… ফোনেই বলে দিয়েছি। যাইনি। ইচ্ছে করছিল না। 
- সে কী! বাবা তো জানতে পারবে!
- জানলে জানবে। অত পারছি না। 
- তাহলে… 
- তাহলে কী?
- সারাদিন…
- অন্য কাজ ছিল।
-
- তারককে জিজ্ঞেস করে নিও… ও ছিল। 
- জিজ্ঞেস করার কিছু নেই… কিন্তু না জিজ্ঞেস করলে বলবে না?
-
- টাকার ব্যাপার?
- না। 
-
- থানায় গেছিলাম। তারক ছিল সঙ্গে। সেখান থেকে একজন লইয়ারের কাছে গেলাম। 
- কী বলছ কী এসব?!
- আসতে কথা বলো… বাবা শুনতে পাবে। জেগে থাকে রাতে। 
- থানা থেকে ডেকেছিল আবার?!
- ফোন করেছিল… ট্রিটমেন্টের কাগজপত্র, ওষুধের প্রেস্ক্রিপশন, রিপোর্ট, ওষুধের বিল… এইসবের অরিজিনাল দেখিয়ে, এক কপি করে জেরক্স দিয়ে যেতে। 
- তুমি সব নিয়ে গেলে, বলোনি তো? কীভাবে নিলে? ওই চটের ব্যাগটায়?
- হুম, তারক জেরক্স করেই রেখেছিল কাল সন্ধেবেলা। 
- আবার জিজ্ঞাসাবাদ করল? আবার ডাকবে? বাড়িতে আসবে?
- তেমন কিছু বলেনি, বলছে রুটিন এনকোয়ারি। এগুলো করতেই হয়। 
- আর লইয়ার?
- ওটা তারক বলল, এইরকম ক্ষেত্রে যদি ফার্দার কিছু এনকোয়ারি হয়, একটা কনসাল্টেশন করে রাখতে। 
- কার কাছে গেলে?
- বারীন মুখার্জী… নাম আছে। পলিটিকাল কানেকশনও আছে। খুবই ভদ্র।
- ফীজও তো বেশি পড়বে!
- এখনই ফীজের কথা আসছে কেন? জাস্ট কথা বলতে গেছিলাম… সিচুয়েশনটা…
- আমি কি বাবা আর জামাইবাবুর সঙ্গে কথা বলব?
- না না… একেবারেই না! এখনই কিছু বলতে হবে না। এমনিতেই তো জানে যা ঘটে চলেছে। তেমন খারাপ সময় এলে এটাও জানবে! 
কিচ্ছু হবে না…দেখো?
-
- কী হল… আর একটু খেয়ে নাও? রাতে তো খই আর মিষ্টি খেয়ে থাকতে হবে! 

সপ্তর্ষি খাবারের বাকিটা রেখে চলে গেল হাত ধুতে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে চলে গেল ছাদের সিঁড়ি ধরে ওপরে… খট করে একটা শব্দ হল ছাদের দরজা খোলার। শ্রেয়সীরও সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। বর উঠে গেছে বলে, ও উঠে যেতে পারল না। ইচ্ছে করে না এই আতপচালের ভাত আর ডাল সেদ্ধ খেতে। এরপর আবার সব তুলে, ধুয়ে-মুছে শ্বশুরমশাই কী করছে দেখতে যেতে হবে। ননদ অথবা পিসিশ্বাশুড়ি এসে পড়বে এখনই। এমনভাবে এটা-ওটা করতে লেকচার দেবে… অসহ্য! ‘নিজেরা এসে করে দিয়ে যা না, যখন এত দরদ!’ 

     ছাদে তখন সন্ধের আঁধার নেমে এসেছে। আগে এই অঞ্চলটা অন্যরকম ছিল। সন্ধেবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলে অন্যরকম লাগত আকাশ আর চারপাশের সিলোয়েটটা। এখন চারপাশে পুরনো একতলা-দোতলা বাড়িগুলো ভেঙে ভেঙে ফ্ল্যাট উঠে গেছে। গাছগুলোও সব মৃত। গাছেদের সৎকার হয় না, শ্রাদ্ধ-শান্তি হয় না। তাদের মৃত্যুদের অশৌচ পালনের কেউ নেই। হত্যা হলে রুটিন এনকোয়ারিও হয় না। ‘রুটিন এনকোয়ারি নাকি’, কথাগুলো নিজের মনেই বলে ফিক করে হেসে ফেলল সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষিকে মা ছোটোবেলায় বলত ‘সোনটু’। আদরের সোনা আর সোনাই ক্রমে ‘সোনটু’। তারপর সোনটু থেকে ‘সন্তু’। এমন হেমন্তকালের সন্ধেবেলা সন্তু ছাদে একা একা খেলত শচীনের ছবি দেওয়া প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট আর বল নিয়ে। দিদিকে গান শেখাতে আসতেন গানের মাস্টার অসিৎবাবু। ঠাকুমা শাঁখ বাজিয়ে সন্ধে দিত ঠাকুরঘরে। ছাদের তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বেলে যেত। ঠাকুমার পর মা। তুলশীতলায় সন্ধের অন্ধকার জমে গাঢ় হয়ে আছে… ভুসি অন্ধকার। আর সন্তু ছাদে একা… হঠাৎ বদলে যাওয়া সিলওয়েটের মাঝে একেবারে একা। মা-ও নেই। হাতের সিগারেটটা কাঁপা কাঁপা হাতে মুখে নিয়ে একটা শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সন্তু। চোয়াল শক্ত করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তুলসীমঞ্চটা পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে বসে পড়ল হাঁটু ভাঁজ করে। হাত দিয়ে মুখ চেপে যতটা সম্ভব কান্নাটা চেপে রইল। কান্না মুক্তির পথ খুঁজে নিল নিঃশব্দে। অন্য বাড়ি থেকে কেউ উঁকি দিয়ে দেখলে ভাববে ‘এই ভর সন্ধেবেলা ছাদে একা একা বসে ছেলেটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কেন ওভাবে? কী হল আবার?!’



- চুলটা ঠিক করে নাও।
- ঘাটের আগে চিরুনি ঠেকাতে নেই… জানো না?
- তুমি এত কিছু সিরিয়াসলি মানছ?
- তোমার দিদি, পিসি, কাকিমা… সব তো দুবেলা দেখে যাচ্ছে। শোকের থেকে তদারকি বেশি। 
- মানুষের স্বভাব। নিজের ছেলের বউকে মানতে বলুক না! 
- নিজেদের সম্মান যদি রাখতে না জানে… পাবেও না।

সন্তুর এইসব শুনতে ভালো লাগছিল না। আসলে সন্তুর আর কিছুই বলতে বা শুনতে ইচ্ছে করছিল না। মার প্রসঙ্গ বার বার আসে সারাদিন। কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করেই। ইচ্ছে করেই খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে। শোক আর কজনের, কেনই বা হবে? সন্তুর বাবা বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না, যারা আসে… ঘরে এসে জিজ্ঞেস করে যায়। যা ওঁকে জিজ্ঞেস করতে পারে না, সন্তুকে জিজ্ঞেস করে। যা সন্তুকে জিজ্ঞেস করে না, শ্রেয়সীকে জিজ্ঞেস করে। এখন সারাদিন পর শুয়ে এইসবের কিছু আর ভালো লাগে না। বাবা বারণ করেছিল, তাও মাটিতেই শুচ্ছে সন্তু, দুটো কম্বল পেতে। শ্রেয়সীও সন্তুর পাশেই শুচ্ছে। সন্তুর দিদি আর ভগ্নিপতি বাজিয়ে দেখে, ইচ্ছে করেই নিয়ম অত না মানতে বলে… দেখার জন্য, যে চট করে রাজী হয়ে যায় কী না। শ্রেয়সী এগুলো বুঝতে পারে। কিছু বলতে পারে না। দু’বছর হল বিয়ে হয়েছে… এর মধ্যেই সংসারে এত বড়ো অঘটন। শাশুড়ির মৃত্যুও অস্বাভাবিক হতে পারে, শুধু বউমার নয়– এই ইঙ্গিতটাই যথেষ্ট।

   এই কদিন নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়েই শুচ্ছে ওরা। শ্রেয়সী কোনো সময়েই কোনো ঘর অন্ধকার রাখতে চাইছে না। এই অল্প আলো চোখে পড়লেও সন্তুর অস্বস্তি হয় মাঝে মাঝে, তখন চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে শোয়ে। সেই চাদরের ভেতর চোখ বন্ধ করেই আসতে আসতে শ্রেয়সীর আরো কাছে ঘেঁষে গেল সন্তু। শ্রেয়সীর কাঁধে আলতো করে ঠোঁটটা চেপে পেটের ওপর হাত রাখতে শ্রেয়সী ওপাশ ফিরে শুয়ে বলল– ‘পেটটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে, বোধহয় পিরিয়ড শুরু হয়ে গেল!’ সন্তু ঠোঁটটা তুলে অস্ফুটে শুধু বলল, ‘কী?’ ‘পিরিয়ড শুরু হয়ে গেছে, একটা এক্সট্রা প্যাকেট ছিল প্যাডের… পরে শুলাম। কাপড়ে, চাদরে দাগ লাগলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।’ একই ভাবে ওপাশ ফিরেই কথাগুলো বলেল শ্রেয়সী। ততক্ষণে সন্তুর মনের অভ্যেস আর আদর মেশানো ভাবটা কেটে গেছে। ‘মিচ’ করে একটা শব্দ করে উঠে বসল। তারপর ধুতির কোঁচাটা ঠিক করে নিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, হাতে মোবাইল ফোনটা নিয়ে। 

       বাথরুম থেকে ফেরার পথে দেখল বাবার ঘরেও অল্প পাওয়ারের নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে। সন্তু আসতে আসতে পর্দার আড়াল থেকে ঘরের ভেতরটা দেখল, যাতে বাবা বুঝতে না পারে।  বাবা খাটে বসে আছে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। যেন দেওয়ালের দিক থেকে কেউ বাবাকে দেখছে। অথচ দেওয়ালে কোনো ছবি বা ক্যালেন্ডার নেই। বাবা বলেই দিয়েছে… মায়ের ছবি ঘরে টাঙাতে দেবে না। 

শ্যামলবাবু ঠিক বুঝতে পারলেন, কিন্তু বুঝতে দিলেন না যে তিনি বুঝতে পেরেছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিৎ হয়ে শুলেন বিছানায়, চোখ বন্ধ করে। ছেলেকে নিশ্চিন্ত করা সম্ভব নয়… কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়ানোরও অর্থ হয় না। উনি নিজেও কি ভেবেছিলেন কখনো… যে অরুণা এভাবে চলে যাবে? শেষকালে পোস্টমর্টেম করতে হবে ওর? 


— — — 


“আরে এই যে, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? মেসোমশাই বললেন দোকানে গেছ… এই সময়ে এভাবে দোকান-বাজার না গেলেই নয়?”

শ্রেয়সীকে দরজার সামনে দিয়ে যেতে দেখেই কথাগুলো বলে উঠলেন শ্রেয়সীর জামাইবাবু। যেন এতক্ষণ ওঁৎ পেতে বসেছিলেন, কখন ফিরবে ছোটো শালী। এই লোকটারই এসবের মাঝে আসা বাকি ছিল। রগড় দেখতে এসেছে! শ্বশুরমশাই এত কিছু বোঝেন না, বুঝলেও প্রকাশ করেন না। শ্রেয়সীর দিকে এমন ভাবে তাকালেন, বোঝাই যায় অতিথিকে এক কাপ চা করে দিতে বলছেন… সঙ্গে নিজে পেলেও ভালো হয়। ‘হ্যাঁ বাবা… আপনারা কথা বলুন। নিয়ে আসছি।’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল শ্রেয়সী। 

     এই জামাইবাবু লোকটাকে আজকাল আর সহ্য হয় না। বছর দশকের আগের সব কিছু এখন মনে পড়লে অন্য রকম লাগে। একেবারেই অন্যরকম। দিদির যখন বিয়ে হয়, শ্রেয়সী সবে মাধ্যমিক দিয়েছে। দিদির থেকে এতটা বয়সে বড়ো… দিদির মনে মনে ভালো লাগছে না। স্টেডি রিলেশন থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল দিদিকে, ছেলের পদবী বাবার পছন্দ ছিল না বলে। দিদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বা পালিয়ে কিছু করতে পারেনি, ছেলেটাও চায়নি। সম্ভবতঃ আর্থিক অসঙ্গতিও ছিল। আর এই জামাইবাবুকে দেখে মনে হত ‘কাকু কাকু’। অথচ খুব আলাপী বা মিশুকে না হলেও, লোকটার ব্যবহারে একটা স্নিগ্ধতা ছিল, কেমন একটা অভিভাবকোচিত আন্তরিকতা ছিল… বিশেষ করে শ্রেয়সী সেটা অনুভব করত।

      দিদির তখনো বাচ্চা হয়নি… কোথাও বেড়াতে গেলে, বা ডিনারে গেলে জামাইবাবু শ্রেয়সীকেও যেতে বলত সঙ্গে। দিদিকে বলত, ‘ও যাবে কি না একবার জিজ্ঞেস করে দেখো।’ প্রথম প্রথম দিদিও রাজী হয়ে যেত… শীতকালে বা স্কুলের ছুটি থাকলে কাছাকাছি ঘুরতে যাওয়া, একসঙ্গে বেরানো… ছবি তোলা– এগুলোই স্বাভাবিক মনে হত। কিন্তু শ্রেয়সী যখন কলেজে, সেই সময় থেকেই দিদি বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারগুলো চেপে যেত। জামাইবাবুর সঙ্গে পরে কথা হলে বুঝতে পারত যে দিদি মিথ্যে বলেছে। কখনো– কোথাও গেছে অথচ জানায়নি, আবার কখনো– জামাইবাবুকে বলেছে ‘অনেক রিকোয়েস্ট করলাম… কিছুতেই রাজী হল না। কলেজে পড়ছে এখন, বুঝতেই পারছ।’

জামাইবাবুকে নাকি দিদি অকারণে সন্দেহ করত। বয়সে বেশি বড়ো তাই খুশি নয়। বিয়ের আগে যাকে ভালোবাসত, তাকেও ভুলতে পারেনি।  ‘এভাবে জোর করে সুখী থাকার চেষ্টা দিনের পর দিন করা যায়?’... বলে ফুঁপিয়ে উঠে একদিন আসতে আসতে মাথাটা ঝুঁকিয়ে শ্রেয়সীর কোলে পেতে দিল জামাইবাবু। গা শিরশির করে উঠেছিল শ্রেয়সীর। মা তখন চান করছে, বাথরুমে জলের শব্দ। বাবা বাইরে। আসতে আসতে ডান হাতটা জামাইবাবুর মাথায় রাখল। কোল ঢেকে রাখা পাজামা ভিজে যাচ্ছিল, কোলের ত্বক অবধি পৌঁছে যাচ্ছিল নোনা জল। 

     এভাবেই কয়েকবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। চুমু খেয়েছিল কপালে। জামাইবাবু সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল ওর জন্য। নিকোটিনের গন্ধমুক্ত নিঃশ্বাস, প্রমাণ দিয়েছিল ঠোঁটে-ঠোঁট রেখে। শ্রেয়সীর কখনো মনে হয়নি পাপ। কখনো মনে হয়নি দিদির ঘর ভাঙছে। নিজেই বলেছিল–  ‘দিদি চায় না যখন… আর আপনাদের ফ্যামিলি আউটিং-এ আমাকে এভাবে ডাকবেন না। আপনার অস্বস্তি আর অশান্তি বাড়বে। আমারও ওসব ভালো লাগবে না। মা-বাবাকে দিদি যদি এইসব বলে…’ 

আসলে, জামাইবাবুও জানত শ্রেয়সী আর ওর দিদি… দুজন একেবারে অন্যরকম মানুষ। যেন ভুল করে দিদির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে, শ্রেয়সীই বেশি ঠিক ছিল। শ্রেয়সীরও মনে হত… দিদির জন্য হোক বা ওদের পরিবারের জন্য, অথবা নিজের জন্যই– এই মানুষটাকে ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না, আগলে রাখতে হবে। এখন ভাবলে হাসি পায়, একটা কুড়ি-একুশ বছর বয়সের অনার্স পড়া মেয়ে… সে চলেছিল ‘আগলে রাখতে’। 

      শ্রেয়সী মাস্টার্স করতে ঢোকার একমাসের মধ্যেই খবর এলো, দিদির প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ। দিদির শাশুড়ি আর মায়ের সে কী উচ্ছ্বাস আর আনন্দ! হওয়াই স্বাভাবিক। খবরটা শুনে শ্রেয়সীরও আনন্দ হল। কিন্তু বুকের মধ্যে কী একটা এমন খামচে ধরল, যে আনন্দটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারত না সেভাবে। জামাইবাবুর ফোন তুলত না। দেখা হলে এড়িয়ে যেত। একদিন হাত ধরে টানাটানি করল– বলতেই হবে কী হয়েছে। জোর করে হাত ছিটকে চলে গেছিল শ্রেয়সী। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। কদিন পর জানালো সপ্তর্ষির কথা। খুব স্পষ্ট ভাবেই জানাল… ‘এবারে একটা স্টেডি রিলেশনের কথা ভাবছি, বুঝলেন। ছেলেটা মধ্যবিত্ত পরিবারের, তেমন কিছু করেও না… কিন্তু খুব সৎ। আর আপনারও দিদিকেই বেশি সময় দিতে হবে। এখন তো শুধু দিদি নয়… আরো একজন ছোট্টো মানুষকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে!’ জামাইবাবুর চোখটা ধক করে জ্বলে উঠেছিল সপ্তর্ষির কথা শুনে। আর দিদি? টুসু পেটে আসতেই কেমন রাজরানির মত চেহারা হয়ে গেল দিদির। মুখ-চোখের ভাবই বদলে গেল। সেই যে ছোটো বোনকে সুযোগ পেলে আরো ছোটো করা শুরু করল মিষ্টি মিষ্টি হেসে… তা আর বন্ধই হল না। বোকা মেয়ে… কোনোদিনই জানবে না তার সন্তানের পিতা সেই কবে অন্য কারো কাছে নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করে দিয়েছে! 


   ‘ক্রাইসিসের সময়ে পার্সনাল ডিফারেন্স পুষে রাখতে নেই… বুঝলে?’ 

চায়ের জল ফুটছিল, আর একটু হলে তেতো হয়ে যেত হয়ত। জামাইবাবুর গলায় আওয়াজে চমকে ফিরে এলো শ্রেয়সী। এখন আর দুজনের মাঝে কোনো নাটুকেপণা অবশিষ্ট নেই। অতিথির প্রতিটা যতটা সৌজন্যবোধ রাখা কর্তব্য, ততটাই রেখে বলল– ‘এ মা, আপনি আবার উঠে এলেন কেন? গল্প করুন… আমি এখনই আসছি চা নিয়ে!’ 

- তোমার সঙ্গেই কথা ছিল… 
- ও… কী নিয়ে?
- তুমিও বুঝতে পারছ। সপ্তর্ষি কিন্তু প্যানিক করছে… 
- কে বলল আপনাকে? ও কেন প্যানিক করবে? প্যানিক করার মত ঘটেছে টা কী?
- ডোন্ট অ্যাক্ট লাইক আ ফুল। খুব ভালোই বুঝতে পারছ প্যানিক কেন করে মানুষ এমন অবস্থায়। 
-
- তোমাদের সমস্যাটা কোথায়? আমি বুঝতে পারছি না। একটা পরিস্থিতি এসেছে… সকলে মিলে একটু প্ল্যান করে, প্রিকশান নিয়ে চললে সিচুয়েশনটা ওভারকাম করা সহজ হয়। 
- দেখুন, বাবা হয়ত আর পাঁচজনের কথা শুনে ভয় পাচ্ছেন। আমরা কেউ ভয় পাচ্ছি না। আমাদের কোনো ফল্ট নেই। যেমন যেমন ফর্ম্যালিটি করার, করা হচ্ছে। 
- তুমি চাইলে, সপ্তর্ষিকে নিয়ে কিন্তু আমি ভালো…
- জানাব… পরিস্থিতি সেদিকে গেলে তো জানতেই পারবেন। কাজটা মিটুক আগে। 
- ভুল ভাবছ। সব সময়ে অমন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ব্যাপার হয় না। ইন্টেরোগেশনের নামে কত দিন, কত মাস চলবে… একটু হোল্ড থাকলে ব্যাপারটা সেটল করে নিতে প্রবলেমটা কোথায়? 
- আপনিও তো গার্ডিয়ানের মতন। ওকে বলে দেখুন। 
- বলছি… পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা তুমি নিজে দেখেছ?

চা কাপে ঢালা, প্রস্তুতি… এসবের মাঝে কথাবার্তা চলছিল। প্রশ্নটা শুনে, চায়ে চিনি মেশানো থামিয়ে জামাইবাবুর দিকে একবার তাকাল শ্রেয়সী। তারপর হেসে কাপ দুটো ট্রেতে নিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে দিকে এগিয়ে গেল। দু-পা ফেলে থেমে বলল, ‘ইন্টেরগেশনটা পুলিশকেই করতে দিন না জামাইবাবু।’ তারপর এগিয়ে গেল শ্যামলবাবুর বিছানার পাশে রাখা টেবিলটার দিকে। শ্যামলবাবু তখন ঘরের একপাশে রাখা শোকেসটার দিকে তাকিয়ে। ওখানে একটা ঝিনুকের তৈরি গণেশ সাজিয়ে রাখা… প্রায় তেইশ বছর আগে পুরী থেকে অরুণা কিনে এনেছিল। 



— — — 


- তুই এখন এইসব কথা কেন তুলছিস?
- আমি তুলছি না… তুলছে অনেকেই। আমি শুধু সামনাসামনি জানাচ্ছি। র‍্যাদার, জানাতে বাধ্য হচ্ছি। আমার একটা শ্বশুরবাড়ি আছে। সেখানে অনেকের অনেকরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। 
- তা এখন আমাকে ঠিক কী করতে হবে?
- দ্যাখ ভাই, তোকে আবার বারণ করছি… একদম আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলবি না!


শ্যামলবাবুর বয়স হয়েছে, এমনিতেই অশান্তি সহ্য করতে পারেন না। শরীর উত্তেজনা নিতে পারে না, সামনে কেউ চেঁচামেচি করলে একটা সময়ের পর হাত কাঁপে। চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করে। ইনভলিউন্টারি মাসল টুইচিং। ছেলে-মেয়ে দুজনকেই শান্ত করার জন্য কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, ‘তোরা এখন এইসব নিয়ে কথা বলছিস? কাজটা অন্ততঃ শান্তিতে মিটতে দে! নিজেদের মধ্যে এমন করলে তো লোকে হাসবে!’ এই অবধি বলতেই গলাটা এক পর্দা চড়িয়েছিলেন, বেশিক্ষণ টানতে পারলেন না। থেমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখের চশমাটা কপালে তুলে ভুরুর মাঝে ডান হাতের  আঙুল দুটো দিয়ে টিপে বসে রইলেন চোখ বন্ধ করে। সন্তু কিছু না বললেও, ওর দিদি চুপ থাকল না। কান্না মেশানো গলায় থেমে থেমে বাবার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল– 

‘আমার অবস্থাটা ভাবো তো একবার? কোনটা করিনি আমি? তারপরও লোকের কথা শুনতে ভালো লাগে? মানুষটা তো সাতে-পাঁচে কিচ্ছুতে থাকে না… কোনোদিনও একটা টাকা চায়নি, কোনো অধিকারের কথা বলেনি। তাকে কেন এসব শুনতে হবে বলতে পারো? ‘

শ্যামলবাবু একই রকম ভাবে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। সন্তু কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না, দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাবার দিকে তাকিয়ে। দিদি একটু থেমে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল– 

‘পুলিশকে সমীরণেরও নম্বর দিয়েছিস… বেশ করেছিস। পুলিশ ওর অফিসে অবধি গেছিল, দেখা করতে… বুঝতে পারছিস? অফিস অবধি! ও ডিজার্ভ করে এগুলো? আমরা ডিজার্ভ করি?’

সন্তু যতটা সম্ভব শান্ত ভাবে বলার চেষ্টা করল ‘পুলিশ যা ইনফরমেশন চেয়েছে, দিতেই হয়েছে। আমার কিছু করার নেই। আর সমীরণদার এত চাপের কী আছে? বলে দেবে অফিসে ছিল…’

‘বলে দেবে অফিসে ছিল! ওয়াও… ফুরিয়ে গেল। সো ইজি! আমাদের নিয়ে কেন টানাটানি ভাই? যা-ই ঘটে থাকুক তা তো এই বাড়িতে ঘটেছে!’ দিদির শেষ কথাগুলো শুনে সন্তু বাবার দিকে তাকাল। শ্যামলবাবুও চোখ তুলে তাকালেন মেয়ের দিকে। দুজনেরই চোখে একটাই প্রশ্ন– 

‘যা-ই ঘটে থাকুক’ মানে?


শ্রেয়সী পাশের ঘরে চুপ করে বসে আছে, হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে। পাশের ঘরের কথা সবই শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু যাবে না ও ঘরে। ভাই-বোনের নিজেদের মধ্যে কথা, তার ওপর বাবা আছেন। ননদকে বিয়ের আগে থেকেই একটু নিজেরটা বুঝে নেওয়া বলেই চিনেছে শ্রেয়সী। এখানেও এক জামাইবাবুর গল্প আছে, সপ্তর্ষির জামাইবাবু… সেই গল্পটা অন্যরকম। সপ্তর্ষির বাবার জাঁকজমক করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। অথচ মেয়ে পাত্র পছন্দের ব্যাপারে একেবারেই কম্প্রোমাইজ করতে রাজী নয়। তেমন কিছু উচ্চশিক্ষিতা না হলেও অনার্স গ্র্যাজুয়েট… আর দেখতে রীতিমত সুন্দরী, অস্বীকার করে লাভ নেই। অবশেষে সমীরণদার বাড়ির সঙ্গে যখন কথা চলছে, দিদি নাকি কোনোভাবে সমীরণদার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে… এটা সপ্তর্ষির থেকে শোনা। সমীরণদা বাড়িতে জানিয়েই দিল যে বিয়ে করলে দিদিকেই করবে। বাড়ি থেকে যে সামান্য দাবি থাকে তাও ছিল না। এমনকি রিসেপশনটাও দুই পরিবারের একসঙ্গে। বিয়ের দিনে সামান্য অনুষ্ঠান হয়েছিল… শুধু নিজেদের আত্মীয়দের ডেকে। সপ্তর্ষির তখন কোনো রোজকারই ছিল না, কিছুই দিতে পারেনি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, বিয়ের পর থেকে সমীরণদার একটা আলাদা জায়গা হয়ে যায়। উনি সুবিধেবাদী বা দখল করা মানুষ নন। সত্যি বলতে খুবই সোজা মনের মানুষ। অফিস আর ঘর নিয়ে থাকেন, ছবি তুলতে ভালোবাসেন, মাঝে মাঝে পাহাড়ে-জঙ্গলে চলে যান। অন্যরকম মানুষ। কিন্তু সপ্তর্ষির দিদি তা নয়। তার একটা কর্তৃত্ব ফলানোর অবসেশন আছে। আর ওটা আরো বেড়েছে সপ্তর্ষির বিয়ে হওয়ার পর থেকে। অন্ততঃ শ্রেয়সীর সেরকম-ই মনে হয়। দিদি শ্রেয়সীকে দেখতে পারে না। ইনসিকিওরিটি? সংকীর্ণতা?… শ্রেয়সী প্রথম প্রথম চুপ করে থাকত, সপ্তর্ষিকেও জানাত না। এখন একটু একটু উত্তর দেয়। অশান্তি না করে যতটা শক্ত থাকা যায়। মানুষ চলে গেলে তাকে নিয়ে বলতে নেই, কিন্তু শ্রেয়সীর খালি মনে হয়– ননদের এই বাড়াবাড়ির জন্য তার শাশুড়িই দায়ী। উনিই মেয়েকে এত ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন। নিজে পারতেন না, চাইতেন মেয়ে সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখুক। সপ্তর্ষিকেও। মায়ের তো এমন কিছু গয়নাগাটিও নেই, বাবারও এমন কিছু টাকা অবশিষ্ট নেই ব্যাংকে… সামান্য মাসিক সুদ আর পেনশনেই চলে। তাহলে, কী এক্সপেক্ট করে… কী নিয়ে ক্রিয়েটিভ অশান্তিটা করছে? মায়ের এভাবে চলে যাওয়া নিয়ে যে ক্রাইসিস, জটিলতা… এটাকে ইস্যু করে একটা ঝামেলা করতে চাইছে… ইচ্ছে করেই করছে এটা… বুঝতে পারছে শ্রেয়সী, কিন্তু তাও ও যাবে না। নেহাৎ নাগালের বাইরে পরিস্থিতি না হলে যাবে না। আর সেরকম হলে সোজা সমীরণদাকে ফোন করবে… দরকার হলে নিজের বাড়িতেও।

‘অশান্তিই যদি হতে হয়, ভালো ভাবে হোক। তোমার বাপ-মাকে তুমি দেখতে না এসে। দেখত তোমাদের এই অযোগ্য ভাইটাই। যতটুকু ক্ষমতা, সেই দিয়েই চেষ্টা করেছে। তোমরা শুধু এসে খুঁত ধরতে পারো।বলে কি না ‘যা ঘটার এই বাড়িতেই ঘটেছে!’... কিছু না বলে বলে এই অবস্থায় পৌঁছেছে! নিজের বাবাকে পর্যন্ত রেস্পেক্ট করতে শেখেনি। ভাইটা কাছা-গলায় দাঁড়িয়ে… তাকে চার্জ করছে! বিচ!’

মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে মনকে অন্যদিকে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিল শ্রেয়সী, ঠোঁট কামড়ে। টপ করে এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে ভিজিয়ে দিল ফোনের পর্দা।  


— — — 


পুরোহিত যা বলে, কেমন আচ্ছন্নের মত পর পর সেগুলো করে যায় মানুষ। সন্তু আগেও দেখেছে, নিজের বেলাও বুঝতে পারছে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে, অর্ধেক কানেও যাচ্ছে না, বিড়বিড় করে বলছে যতটা শুনতে বা বুঝতে পারছে। বাস মিস করার মত পিছিয়ে পড়ছে, পুরোহিত চলে যাচ্ছে পরের ধাপে। শুধু যা যা আচার করে যেতে বলছে করে যাচ্ছে। মাটি দিয়ে জায়গা করে। ভাত, তিল এসব মিশিয়ে আলাদা আলাদা ছোটো ছোটো পিণ্ড। অতৃপ্ত অপঘাতে মৃতদের জন্য আলাদা পিণ্ড। মাঝে গঙ্গাজল ছিটিয়ে যাওয়া তুষে করে। ভুল হচ্ছে, আবার পুরোহিত দেখিয়ে দিচ্ছে… আবার করছে। কাকগুলো বসে আছে। উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে, আবার ঘুরে আসছে। কাজ মিটে গেলে ওরা ভাতগুলো খায়। ওদের অভ্যেস আছে। রোজ কেউ না কেউ এসে এখানে ঘাটের কাজ করে। রোজ। অবাক লাগে সন্তুর, এখানে রোজ ঘাটের কাজ হয়– এই কথাটা বুঝতে পারার পর। পাশে সরঞ্জাম কিছু রাখাই থাকে, যাতে কেউ এলে অসুবিধে না হয়। এখানকার লোকেরা ড্রামে করে গঙ্গাজল অবধি তুলে রেখে দেয়, যাতে পাঁক ঘেঁটে পার্টিকে নামতে না হয়। পার্টি… ঘাটের কাজ করতে আসা আলাদা আলাদা পার্টি। 


দিদি আসেনি। আসবে না জানত। শ্রেয়সীর বাবা এসেছেন, এই শরীর নিয়েও। শ্যামলবাবুকে আসতে দেওয়া হয়নি, সন্তুর পিসি গতকাল রাত থেকেই বাড়িতে আছে… যাতে বাবাকে একা না থাকতে হয়। পিসির থাকাও সমস্যা, নিজে কিছু করবে না… শ্রেয়সীকে দিয়ে করাবে। ঘরে ফিরে দেখবে সব যেমন কে তেমন, শ্রেয়সীকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে। জামাইবাবু নাকি বেলার দিকে আসবে, আগামীকাল কীভাবে কী হবে সব ঠিক করতে। পাড়ার একটা মন্দিরেই নমো নমো করে সেরে ফেলা হবে। যাদের না বললেই নয়, সেই কজনকেই বলা হয়েছে। মন সায় দেয় না অত করার, করতে হয়। আর এক্ষেত্রে তো ব্যাপারটাই একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। 

     নাপিতটা সব চুল-দাড়ি কামিয়ে ফেলল। অশৌচের ভার যেন অনেকটা হাল্কা হয়ে যায় ঘাট-কামানের পর। সাময়িক হলেও, কেমন ফ্রেশ লাগছিল সন্তুর। মাথায় গঙ্গা-জল ছিটিয়ে আড়ালে গিয়ে পোশাক পালটে ফেলল। শ্রেয়সীও তাই করল, শ্রেয়সীর বাবা আর পুরোহিত বলে দিচ্ছেন… কার পর কী করতে হবে। কোনো মহিলা সঙ্গে আসেনি নিয়ম নির্দেশ দেওয়ার মত। ঠিক যখন পুরোহিতকে দক্ষিনাটা গুণে দিচ্ছে সন্তু, তখন একটা পুলিশের জিপ ঘাটের কাছে এসে থামল। পুলিশের জিপ দেখতে পেয়েই শ্রেয়সী ওর বাবার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। সন্তুই পাশে ছিল, সন্তুর থেকে দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়াল শ্রেয়সী। পুরোহিত বা অন্য কেউ সেই নিয়ে সচেতন বলে মনে হল না। অন্য পরিবার আসছে। আবার তাদের জন্য আচার-পদ্ধতির আয়োজন হচ্ছে। একজন মহিলা মাদুলী বাঁধা হাতে আঙুল দিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক দেখিয়ে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন কাউকে… সে আয়োজন করছে, সেই মত গুছিয়ে রাখছে জিনিসপত্র। আর এক পরিবারের কাজ শেষ, একজন প্রৌঢ়া মহিলা খয়েরী পার সাদা কাপড় পরা, আর এক মহিলার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে যাচ্ছেন, সান্ত্বনার চেষ্টা দেখছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে দু-তিনজন। সকলেরই মাথার চুল ভিজে, রোদে চিকচিক করছে। মানুষের এইসব দিকেই চোখ চলে যায়। পুলিশের জিপ না অন্য কোনো গাড়ি এসে থামল, চট করে দেখে না। সন্তু আড়চোখে দেখল, প্রতিক্রিয়া দেখাল না। দুজন কনস্টেবল নেমে এলো আগে, তারপর একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামলেন। চোখের চশমা খুলে বুক-পকেটে ঢুকিয়ে নেমে এলেন সিঁড়ি দিয়ে, পায়ের জুতো খুলে ঢুকলেন ওই জায়গায়… যেখানে আয়োজন চলছে। সম্ভবতঃ ওই পরিবারের কেউ… পুলিশে চাকরি করে। 

আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি সব কিছু মিটিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নিল সন্তুরা। এই প্রথম সন্তুর মনে হল… পুলিশের ভয়ে পালাচ্ছে। শ্রেয়সীর বাবাও নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছেন ব্যাপারটা, কিছু বললেন না… বলবেনই বা কী? ট্যাক্সিতে উঠে কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বাবার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল শ্রেয়সী। সন্তু একবার তাকাল শ্রেয়সীর দিকে, শ্রেয়সীর বাবা একবার তাকালেন সন্তুর দিকে। তারপর দুজনেই জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। শ্রেয়সীর বাবার একটা হাত তাঁর কোলের ওপর রাখা মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। 


— — — 


‘দেখুন, আমাদেরও তো একটা প্রটোকল মেনে চলতে হয়… আপনারা যেমন কোঅপারেট করবেন, তেমনই এগোবে। আপনারা মানে আপনাদের কথা বলছি না। আপনাদের থেকে এখনো অবধি যা চেয়েছি, সমস্যা হয়নি। তবে সব ক্ষেত্রে তো একরকম হয় না। সহজ ব্যাপারও এমন জটিল করে দেয়। আমরা খোঁজ খবর নিয়েছি… খোঁজ খবর নিয়েছি, যা জানার দরকার মনে হয়েছে… আমাদের কাছে আছে। আপনারা যা-ই বলুন, আমরা কাজটা ঠিকঠাকই করি। আপনারা মানে আপনারা নন… এই জেনারালি আর কি! কেউ কোনো অভিযোগ তো করেনি। জিডি বা এফআইআর এর ব্যাপারও নেই। আমাদের তো অনেকরকম দেখতে হয়… আমরা বুঝি। একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে। অনেক বাড়িতেই এমন হয়। বুড়ো মানুষ একা থাকতেন, বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেছেন। সাত দিন পর ডিকম্পোজ করতে করতে… যাকগে ছাড়ুন। তা এগুলো কি আর সবই ফাউল প্লে সাসপেক্ট করা যায়? লোকজন ভর্তি বাড়িতেও হতে পারে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ। আসলে… আজকাল এতরকম ঝামেলা বেড়ে গেছে, হাসপাতাল নার্সিংহোমগুলোকে দোষও দেওয়া যায় না। কিছু এদিক ওদিক হলে আমরাই ঝাড় দেব গিয়ে… হে হে। সরি… যেটা বলছিলাম আর কি। এমন হয়েই থাকে… অ্যাঁ? দেখুন… কারো ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়া আমাদের কাজ নয়। আর এটা সে অর্থে কোনো ইনভেস্টিগেশন নয়… আবারো বলছি। নার্ভাস হবেন না, বা প্যানিক করবেন না শুধু শুধু। কোঅপারেট করুন। ওটাই আসল। আউট অফ স্টেশন কোথাও যাওয়ার হলে একটু লোকাল থানায় আগে ইনফর্ম করবেন। আর… আমার অ্যাডভাইস যদি নেন, এ এক-দুমাস আউট অফ স্টেশন না গেলেই ভালো… কেমন?’ 


     শ্যামলবাবুর ঘরেই একটা স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ারে বসে কথাগুলো বলছিলেন লোকাল থানার সাব-ইন্সপেক্টর। অন্যরা চুপ করে শুনছিল। শ্যামলবাবু কারো দিকে তাকাচ্ছিলেন না, মাথা নীচু করেই বসেছিলেন, ভুরুর মাঝখানটা দু-আঙুল দিয়ে টিপে ধরে। সন্তু আর শ্রেয়সী তাকিয়েছিল সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে। মাঝে মাঝে শোক আর মাঝে মাঝে সম্মতির শুকনো হাসি দেখিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিল। সাব-ইন্সপেক্টর কিন্তু এদের দুজনের থেকে বেশি লক্ষ করছিলেন শ্যামলবাবুকেই। কথাগুলো শেষ করে সামান্য বিরতি নিলেন। কাপ থেকে চায়ের শেষটুকু খেয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইলেন ‘কোথায় রাখব?’। শ্রেয়সী আঁচল টেনে ডান কাঁধটা ঢেকে তৎপরতার সঙ্গে এগিয়ে এসে সঙ্গে সঙ্গে কাপটা নিয়ে নিল। কিন্তু ঘরে থেকে গেল না। কাপ হাতেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। শ্যামলবাবু একবার মুখ তুলে চাইলেন, বলতে চাইছেন ‘আর কিছু?’, কিন্তু পারছেন না। একটা পাঁচ থেকে ছ সেকন্ডের নীরবতা… অল্প গতিতে ঘোরা ফ্যানের শব্দ। সাব-ইন্সপেক্টরই আবার শুরু করলেন– 

‘সবাই ভাবে আমি বেশি কথা বলি। কিন্তু আপনারা যদি একেবারেই কেউ কিছু না বলেন, তাহলে তো অটোমেটিকালি আমাকেই… তবে কথা কম বলা একদিক থেকে ভালোই। সময় মত চুপ থাকা আরো ভালো। এই প্রফেশনে থাকতে থাকতে দেখেছি, বোবার কোনো শত্রু নেই কথাটা অনেক ক্ষেত্রেই খুব এফেক্টিভ। ওই বিদেশী সিনেমার মত কায়দা করে না বললেও, আমাদেরও প্রটোকলে থাকে… ইচ্ছে করলে চুপ থাকতে পারো, কিন্তু কিছু বললে তা তোমার বিরুদ্ধে চলে গেলেও যেতে পারে। আমরা অত কায়দা করে বলি না, কিন্তু মিথ্যে বলব না… কথা বা হাবভাবের বেচাল মাঝে মাঝে সত্যিই মনে থেকে যায়। মানে, আপনারা বলে নয়… আমি সকলকেই এমন মাঝে মাঝে সাবধান করে দিই। ডিউটি করছি বলে তো আর এনিমি নই। নাকি?!’

সবাই চুপ দেখে শ্রেয়সীই বলো, ‘আর এক কাপ চা খাবেন?’। কেন বলল নিজেও যানে না, ভেতর ভেতর নার্ভাস লাগছে, এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাও সমস্যা… চলেও যেতে পারছে না। সাব-ইন্সপেক্টর সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ নো নো… আজ উঠি, অন দ্যি ওয়ে আরো কিছু কাজ আছে। আমাদের লাইফ, বোঝেনই তো। তবে ঐ যেগুলো বললাম, একটু মনে রাখবেন। কোঅপারেশন। কোঅপারেশন ঠিকঠাক হলে কোনো সমস্যাই নেই। আর অযথা একে তাকে জড়াবেন না। প্রবলেম সল্ভ করার নামে চারটে ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোকের নাম জড়িয়ে গেলে গাজন নষ্ট হয়ে যায়… তখন আমার বদলে ওপর তলার কারো হাতে দায়িত্ব চলে যাবে। যেটা আপনাদের মত নর্মাল কেসে একেবারেই আননেসেসারি। এটা কোনো কেসই না। কেমন? আনঅফিশিয়ালিই বলে যাচ্ছি… কাগজপত্র সব একবার দেখে নিয়ে আপনাদের দিয়ে একটা সই করালেই মিটে যাবে। মুশকিল কী জানেন… হাসপাতালের ল্যান্ডলাইন থেকে ওই বেনামী ফোনটা এমন এলো… নাহলে এগুলোও কিছু করতে হত না। কে যে করল ফোনটা… ট্রেসই করা যাচ্ছে না। এদিকে উনি যখন ছাদ থেকে পড়ে গেলেন… আপনারা কেউই সামনে ছিলেন না। কেউই জানেন না, কেউই দেখলেন না– কীভাবে পড়লেন। আশপাশের কেউও… এনিওয়ে… আজ চলি কেমন? কাজের বাড়ি, শোকের পরিবেশ… খারাপই লাগছে আমার, আপনাদের বিরক্ত করে গেলাম এভাবে। আচ্ছা… গুডনাইট তাহলে? 

সাব-ইন্সপেক্টর গট গট করে জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন। পাশের বাড়ির জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে চলে গেল কেউ। বাইকটা স্টার্ট দেওয়ার শব্দ হল, তারপর বাইকের যান্ত্রিক শব্দ মিলিয়ে গেল দূরের রাস্তায়। 


— — — 


- সাব ইনস্পেক্টর লোকটা কিন্তু এমনিতে ভদ্র… না?
- শুধু শুধু অভদ্রতা করবেই বা কেন?
- আপার হ্যান্ড নেওয়ার সুযোগ পেলে স্কুলের দারোয়ানও ছাড়ে না। বুঝেছ?
-
- লোকটা ভালো, একটু ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করো ওকে। চটিও না। 
- আমার তো মনে হয় লোকটা বেশ ধুরন্ধর। আমাদের রিয়্যাকশন স্টাডি করছিল। আমরা রিলিভড, না কনশাস, না কিছু লুকনোর চেষ্টা করছি…
- অতিরিক্ত ভাবছ তুমি, মাথার চুলগুলো গিয়ে ওভার-অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে ব্রেইন।
- উঁহু… সত্যিই আমার খুব একটা সুবিধের লাগে না ওকে। একটু বেশি চালাক মনে হয়। কেমন যেন ল্যাজে খেলাচ্ছে। 
-
- যাক গে… টেনশন করে তো কিছু হবে না। আর আমাদেরও পজিটিভ থাকতে হবে। একটা মানুষ যে হঠাৎ করে নেই হয়ে গেল… সেটাই…
- হুম… নিজের ক্রাইসিস এলে শোক-টোক সব ব্যাক সিটে চলে… সে যতই নিকট আত্মীয় হোক। স্ট্রেঞ্জ… না?
- বাবাকে লক্ষ করেছ?… পুলিশের কথাগুলো কেমন নির্লিপ্ত ভাবে শুনছিল। ঘরে থেকেও নেই... 
- তোমার তাই মনে হচ্ছে?
- ধাক্কা তো একটা লেগেছেই...
- উনিও কনসার্ন্ড। একটা শকের মধ্যে আছেন। বয়স হয়েছে… অনেক কিছুই বলতে পারছেন না। 


কথার মাঝেই একটা খুট করে শব্দ হল। ছিটকিনি নামানোর মত শব্দ। রাতের নিস্তব্ধতা বলেই স্পষ্ট শোনা গেল। সন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল, শ্রেয়সীও সজাগ হয়ে তাকাল সন্তুর দিকে। সন্তুর বাঁ হাতটা আঁকড়ে ধরল অজানা ভয়ে। অথচ এই সামান্য খুট শব্দে ভয় পাওয়ার কথা নয়। ‘ও কিছু না, আমি দেখে আসছি’ বলে সন্তু মোবাইল ফোনের আলোটা জ্বালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাবার ঘর অন্ধকার, আলো ফেলে দেখল বিছানায় কেউ নেই। বাথরুমেও কেউ নেই। একটা অন্য সম্ভাবনা মাথায় আসতেই… সন্তু আর দেরি না করে দ্রুত ছাদের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। ছাদের দরজা খোলা। বাবা একা দাঁড়িয়ে আছেন ছাদের পাঁচিল ধরে… আকাশের দিকে তাকিয়ে। মেঘলা লালচে আকাশ। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে ঘোলাটে চাঁদ। সন্তু ছাদে আসতেই উনি যেন বুঝতে পারলেন… পেছন ফিরে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর বললেন– ‘তোর মা সেদিন দুপুরে বলেছিল, কী একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করার আছে। কী নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিল বল তো?’

সন্তু অন্ধকারে বুঝতে পারল না, কথা বলার সময়ে শ্যামলবাবুর আবার চোখের পাতা কাঁপছে। ও মোবাইল ফোনের আলোটা নীচের দিকে করে নিয়েছিল। কেউ যদি আবার বুঝতে পারে এত রাতে এদের বাড়ির কেউ ছাদে এসেছে… আর একটা সমস্যা হবে। ইচ্ছে হল একটা ধমক দিক বাবাকে, এত কিছুর পরেও এত রাতে আবার ছাদে এসে কেন বিপদ ডাকছে। কিন্তু বাবার গলার আওয়াজটা শুনে আর পারল না কড়া ভাবে কিছু বলতে। যতটা সম্ভব গলা খাদে নামিয়ে বলল ‘শরীর খারাপ করবে… প্লিজ, এমন করো না, এসো… নীচে চলো।’ শ্যামলবাবু এগিয়ে এসে ছেলের বাড়ানো হাতটা ধরে ছাদের দরজার দিকে দু-পা এগোলেন। তারপর আবার ছেলের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন– ‘পুলিশের লোকটা একটা কথা ঠিক বলেছে… আমরা কেউই অরুণাকে সেদিন সেই সময়টা দেখতে পেলাম না। কী আশ্চর্য! আসলে… আমরা কেউই, তোর মাকে কখনো দেখতে পাইনি। দেখতেই পাইনি… না রে?’


সোমবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২২

শৌনক দত্ত

              





পঞ্চাশ দশকে পূর্ববঙ্গের কবিতা ও একজন অনালোচিত কবি




ধর্মীয় হঠকারিতার ফসল হিসেবে দেশবিভাগ (১৯৪৭) যখন মেনে নিতে হয় সবাইকেই, তখন হাজার বছরের অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা-সাহিত্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় স্থায়ী সীমানা-দেয়াল। ফলে পূর্ববঙ্গের কলকাতাবাসী কবি-লেখক-শিল্পীদের নাগরিকত্বের বদল ঘটে। তাঁরা চলে আসেন খন্ডিত ভূখন্ডে। আটচল্লিশে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন এই ভূখন্ডের কবি-শিল্পীদের স্বতন্ত্র স্বকীয়তা দান করে। এই স্বকীয়তাতেই ধরা পড়ে নতুন সংকটের চিত্র, নতুন স্বপ্নের বার্তা, নতুন শত্রুর পরিচয়, নতুন সম্ভাবনার মন্ত্র। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনে ভাস্বর এই সব বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ কবিতাই স্বাধীন বাংলাদেশ ভূখন্ডেরও আগে বাংলাদেশের মানুষ ও সংস্কৃতির বাতাবরণে মৌলিকত্ব নিয়ে হাজির হয়। ফলে বাংলাদেশের কবি ও কবিতা (সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রেও) বলতে বিবেচনায় নিতে হয় সাতচল্লিশের দেশভাগের কাল-পরিসর থেকে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলার নতুন কবিরা তাঁদের সৃষ্টির জন্য নতুন ভাষা ও নতনু দিশার সন্ধান শুরু করেন। কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার বিকল্প হিসেবে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার নতুন এক পরিমন্ডল। এখান থেকে চর্চিত-সৃজিত সামগ্রিক সাহিত্যকর্মই পরে বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই সময়ের কবিতায় একটি স্বাধীন দেশের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানো, নিজেদের কণ্ঠস্বরে নতুনত্বের প্রকাশ এবং নিজ দেশের মানুষের আবেগ চিত্রিত করা কবিদের দায়িত্ব হয়ে ওঠে। তাই নতুন এই পরিমন্ডলকে ঘিরে এই অঞ্চলের কবিরা পরিচিতি পান বাংলাদেশের কবি হিসেবে। তাঁদের রচিত কবিতাই বাংলাদেশের কবিতা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বাংলাদেশের কবিরা সাতচল্লিশের পর বা উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে যে কবিতাভাবনা ও কাব্যপ্রয়াস তুলে ধরা শুরু করেন পাঠকের সামনে, তার সবই ছিল নতুন ভাষা এবং নতুন ধ্যান পঞ্চাশের বাংলা কবিতায় তেমনভাবে আজীজুল হকের নাম আলোচিত নয়। মফস্বল শহরে বসে কবিতা চর্চা করে গেলেও তাঁর কবিতা বাংলা কবিতায় অন্যস্বর ও আঁখড়ের কথা বলে। 

বাংলাদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্খাই কবিতায় গণচেতনায় রূপান্তরিত হয়। এই গণচেতনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও পরিপূরক হয়ে ওঠে। এই সময় বাংলাদেশের কবিতার মহাসড়কে আবিভূর্ত হন বেশ কয়েকজন তরুণ কবি, যাঁরা পরেও দীর্ঘ সময় ধরে কোনো না কোনোভাবে নিজেদের কবিতায় গণচেতনার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (১৯৩৪-২০০১), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬), ফজল শাহাবুদ্দিন (১৯৩৬-২০১৪), আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) প্রমুখ। তাঁদের আবির্ভাব ঘটে মূলত ভাষা-আন্দোলন এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে। তবে এই কবিরাই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যেমন, তেমনি সত্তর-আশিনব্বইয়ের দশক তথা জীবনের শেষ পর্যন্ত অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কবিতার পাশাপাশি গণচেতনামূলক কবিতার চর্চা করে গেছেন। অবশ্য আল মাহমুদ ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রথম দিককার কাব্য-কবিতা বাদ দিলে তাঁকে আর বাংলাদেশের কবিতার মূলধারায় খুব একটা পাওয়া যায় না। তাঁর ব্যক্তিচেতনায় সংঘটিত বড় পরিবর্তনই সম্ভবত তাঁকে মূল পথ থেকে ভিন্ন পথগামী করেছে। যা-ই হোক, উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই যে গণচেতনামূলক কবিতা সৃষ্টির একমাত্র ভিত্তি, তা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যাবে না। কারণ, রাজনৈতিক সংকটের বাইরেও সাধারণ মানুষের জীবনে নানা রকম সংকট ও বঞ্চনা লুকিয়ে থাকে, যা সূক্ষ্মভাবে প্রতিনিয়ত সমাজচৈতন্যে প্রভাব ফেলে।

সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যদি কোনো কবি সেসব বিষয়কে তাঁর কবিতায় আশ্রয় দিতে চান, তবে তাতেও গণচেতনারই রূপায়ণ ঘটে। তাই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতিতে সময়ে-সময়ে, দশকে-দশকে বাংলাদেশের কবিতায় আবির্ভূত হতে থাকেন প্রতিশ্রুতিশীল কবিরা। কবিতায় তাঁদের ভাষার ব্যবহার, বিষয়ের ঐক্য, শব্দের নতুনতর বিন্যাস যেন সবকিছুর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে থাকে।পঞ্চাশের তরুণদের মতো অন্যান্য দশকেও স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন নতুন কবিরা। এই ধারা চলতে থাকে।একাত্তর হয়ে উত্তাল নব্বই পর্যন্ত। বাংলাদেশের কবিতা প্রধানত গণচেতনায় ঋদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে পঞ্চাশ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। পঞ্চাশের প্রধান কবিদের গণচেতনামূলক কবিতায় স্বকীয় শব্দের প্রায়োগিকতা অন্বেষণ করলে দেখা যায়। এই সময়ের কবিরা একই পরিস্থিতিতে কবিতা লিখেছেন, আবার তাতে মৌলিকতার স্বাক্ষরও রেখেছেন নিজস্ব প্রতিভাগুণে। শব্দের স্বকীয় ব্যবহারে তা হয়ে উঠেছে নিজস্ব কণ্ঠের পরিচায়ক। প্রতিটি কবির নির্বাচিত শব্দের ব্যবহারই তাঁকে স্বমহিমায় স্বীকৃতি প্রদান করেছে। 



নীলাভ কাচের প্লেটে হৃৎপিণ্ড রক্তাক্ত উজ্জ্বল

ছিঁড়ে এনে রাখলে টেবিলে

সূর্যোদয় হলো

সমুদ্রের জলে।

আজকের প্রগাঢ় সকালে

কী দেবো তোমাকে? কী দেবো, কী দেবো!

রক্তমুখী নীলা।

এর চেয়ে অন্যতর কী বা দিতে পারি।

উত্তোলিত প্রাসাদের নিচে

অবধ্বস্ত সে নগরী একদিন আবিষ্কৃত হবে।

রমণীর ধবল করোটি, ডানচক্ষু দৃষ্টির কবর,

অন্যতর চোখের কোটরে সুদুর্লভ মণি

রক্তমুখী নীলা,

যেন তার তীরবিদ্ধ গাঢ় নীল চোখ

এক ফোঁটা রক্ত জ্বেলে অন্ধকারে চেয়ে থাকে

কারো দিকে।

কার দিকে হে বিশ শতক?


(রক্তমুখী নীলা)



উপরের কবিতাটি লিখেছেন কবি আজীজুল হক (জন্ম ১৯৩০, মৃত্যু ২০০১)। যিনি প্রতিভার স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের এক প্রতিশ্রুতিশীল কাব্যশিল্পী। সমকালীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিষয়ে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব-দ্রোহ ও রক্তপাতের প্রেক্ষাপটে অনিবার্য মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তিনি শিল্পীত করেছেন তাঁর কবিতায়। আপন অস্তিত্বকে বোধ করে তা রক্ষার প্রগাঢ় আর্তনাদে মুখর থাকতে দেখা যায় তাঁকে। কখনো এ প্রসঙ্গেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। কবি আজীজুল হক ছিলেন আপন ইতিহাস-ঐতিহ্যে আস্থাশীল, মানবতায় পূর্ণ, প্রগতিধর্মে দীক্ষিত ও জীবনমুখীনতায় উচ্চকণ্ঠ। 


৫২তে ভাষার সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও পাকিস্তান বিরোধ অস্থির অভিঘাতী তরঙ্গ এদের মধ্যকার আবার কোনো কোনো কবিকে স্বাধিকারের চেতনা জাগরণের রসদও জুগিয়েছিল । এই রাজনৈতিক অভিঘাতী ৬০এর দশকে এ বাংলার নিজস্ব কাব্য সাহিত্যাঙ্গনকে আরো আধুনিকতা সংলগ্ন করে গড়ে তুলতে সহায়তা করে । আবার আধুনিকতা যদিও চেতনা ও মননশীলতার মধ্য দিয়ে মানবতাবাদকে শাণিত করে তোলে; তবুও সময় ও নগর বাস্তবতার সাথে এর রয়েছে পৌণঃপুনিক সম্পর্ক। এই বাংলার কবিতা তাই নগর ও চারপাশের বাস্তবতাকে অন্তরে বাহিরে ও চেতনায় তুলে নেবার মোক্ষম পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল ।

১৯৬০ সালে প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে কাব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার সাথে ঢাকা নগরীর পৌনঃপুনিক সম্পর্কের সাঁকো নির্মাণের পাশাপাশি এ বাংলার কাব্য সাহিত্যের সত্যিকার আধুনিকতার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন কবি শামসুর রাহমান । অপরদিকে, তিরিশি কাব্যজগত ধারাবাহিকতার উত্তর প্রজন্মের কবি শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থটি ওপার বাংলা কাব্যসাহিত্যে প্রায় পরিণত ও আধুনিকতা–উত্তর সম্পর্কসূত্র পুনঃনির্মাণ করেন । নিরঙ্কুশ আধুনিকতার বহিস্রোত ক্ষুব্ধ শামসুর রাহমানের কবিতা এ বাংলার নাগরিক মনস্বীতায় নতুনতর প্রসাদ সৃষ্টির পাশাপাশি, স্বাতন্ত্রে বৈচিত্র্য ভিন্নতায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এরপর ১৯৬৩ সালে -“রৌদ্র করোটি”তে কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে ৪৭পরবর্তী ওপার বাংলার সমস্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত, ধর্মীয়, জাতীয়তাবাদী ও প্রভাববাদী কাব্যবলয়কে পাশ কাটিয়ে বাংলা কবিতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধশালী স্তরে তুলে আনেন । অন্যভাবে বলা যায়, রৌদ্র করোটিতে নামকরণের ভেতরেই নিহিত আছে হয়তো আধুনিক বাংলা কবিতা করোটির ভেতর বাহিরে প্রতিভা, মেধা ও ব্যক্তি–স্বাতন্ত্রের ঝলকানির অবিস্মরণীয় এক সৃজন উপাখ্যান। অতঃপর, ১৯৬৭তে কবি শামসুর রাহমানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বিধ্বস্ত নিলীমা প্রকাশের পর আধুনিক বাংলা কবিতা ধারার এক পরিণত বিকিরণ প্রভা সমকালের বিচিত্র ল্যাম্পপোষ্ট তির্যকভাবে প্রতিফলিত হতে শুরু করে । বিশেষত কবিতার কাব্যসত্তাকে উচ্চকিত রেখেই বর্ণনাময়ী বক্তব্যে, স্বকীয় ভাব ও প্রতিভাবের ঋদ্ধ সমীকরণে তিনি বাংলা কবিতায় ডিসকোর্সের শাণিত ধারার প্রতি–নন্দনত্ব উপস্থাপন করেন । যা ছিল বাংলা কবিতার সর্বাঙ্গীন অবয়ব ও মনোজগতের প্রায় পরিপূর্ণ বিস্তৃতির মানসকল্প বিন্যাস । এভাবে শামসুর রাহমানের কাব্যজগৎ জুড়ে জেগে ওঠে নগর স্বদেশের বিপুলা এক মানচিত্র । 

এসব কিছুই মাথায় রেখেও বলতে পারি আজীজুল হকের -ঝিনুক মুহূর্ত সূর্যকে (১৯৬১),বিনষ্টের চিৎকার (১৯৭৬), ঘুমও সোনালী ঈগল (১৯৮৯)। তিনটি কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতাকে নতুন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছে, আমরা জেনেছি কবি হওয়ার জন‍্য প্রচুর বই পকাশ করা জরুরি নয়, জরুরি হচ্ছে চিন্তা ও চেতনার উন্নয়ন, উন্নত লেখা। তার প্রমাণ তিনি। এছাড়াও জানা যায় বন্ধু ও প্রকাশকরা শ্রেষ্ঠ কবিতা বা নির্বাচিত কবিতা প্রকাশের কথা বললে তিনি কখনও সম্মত হননি। নির্বাচিত বা শ্রেষ্ঠকে স্বীকার করতেন না। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ‍্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় তিনটি বই থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে আজীজুল হকের কবিতা। একটি মাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ অস্তিত্বচেতনা ও আমাদের কবিতা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে।

রাজধানীর মোহময় হাতছানিকে উপেক্ষা করে সারাজীবন যশোর শহরে অধ‍্যাপনা আর সাহিত‍্যসেবায় জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। যশোরের তরুণ কবিদের অনিবার্য অভিভাবক হয়ে সাহিত‍্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। আমরা এই কৃতি কবিকে যথার্থ মূল‍্যায়ন করতে পারিনি বা করিনি।

আজীজুল হকের কবিতায় একদিকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যসচেতন শিল্পদৃষ্টি প্রতিভাত অন্যদিকে, অস্তিত্ববোধ ও ভাবনাপ্রসূত কবিতার বিষয় ও উপকরণ-অনুষঙ্গ অভিনব মর্যাদায় সিদ্ধ হয়ে ওঠে। দুঃস্বপ্ন, মৃত্যু, অন্ধকার, রক্তপাত প্রভৃতি উপমা-প্রতীক সাম্রাজ্যবাদ ও অস্থির সময়কে যেমন নির্দেশ করে, তেমনি দীর্ঘদিনের পরাধীন বিপন্ন জাতিসত্তাকে সংহতি দানের চেষ্টায় তাঁকে সংগ্রামী হতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি কবিতায় নিয়ে আসেন দ্যুতিময় সব মুহূর্ত-প্রতীক। কখনো তীব্র কৌতুক ও ব্যাঙ্গবাণে তাঁকে সমকালীন পরিস্থিতিকে তীক্ষ্ণ করে তুলতেও দেখা যায়-


এক. 

আদিম সমুদ্র থেকে অন্তিমের স্থলভাগ জুড়ে

বিশাল পাহাড় এক অণুতম সূর্যকে ছুঁয়ে

পড়ে আছে, যেন

মহাকাল শিলীভূত, মসৃন পিচ্ছিল।

একদিন মানব সমাজ

ওই খানে যাবে, এখন যন্ত্রণা শুধু আজ, এখন কেবল

শব থেকে শবের সিঁড়িতে একটি আকাঙ্ক্ষা হেঁটে যায়

জীবনের নামে, এখন সে জীবনের নাম

স্বপ্ন আর রক্ত আর ঘাম। 

(যন্ত্রণা; ঝি.মু.সূ)


দুই. 

অতীতে প্রোথিত দেখি অর্ধাঙ্গ আমার

এবং দুচোখ

শামুকের ঠোঁটে বিদ্ধ নীলকান্ত মনি

যেন এক নিহত সময়

দুর্ঘটনার পিঠে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকে

হাজার বছর। 

(যন্ত্রণার মৃত্যুতে; ইচ্ছার নায়ক, ঝি.মু.সূ)


তিন. 

নীলাভ কাঁচের প্লেটে হৃৎপিণ্ড রক্তাক্ত উজ্জ্বল

ছিঁড়ে এনে রাখলে টেবিলে

সূর্যোদয় হলো

সমুদ্রের জলে।

আজকের গ্রগাঢ় সকালে

কী দেবো তোমাকে? কী দেবো, কী দেবো!

রক্তমুখী নীলা। 

(রক্তমুখী নীলা; ঝি.মু.সূ)


চার. 

অবশ্যই আমি সেই ব্যবহৃতা রমণীর সজ্ঞান প্রেমিক।

জীবনকে সুনিপুণ আলিঙ্গনে বেঁধে

চিরকাল বেঁচে থাকে নির্বিঘ্নে যেমন

মৃত্যুটা; তারো চেয়ে অধিক নিকটে আমি তার। 

(বিনষ্টের চিৎকার; বি.চি.)


পাঁচ. 

একালের কবিতা ফুলকে বাদ নিয়েছে।

আকাশে মেঘ, কালো মেঘ

সূর্য নেই।

যে ফুলের নাম সূর্যমুখী সে নামেই সে ফুটলো।

আগুন রঙ পাঁপড়ি কী ধূসর!

আগুন থেকে ছাই। 

(মেঘমুখী সূর্যমুখী; ঘু.ও সো. ঈ.)


ছয়. 

রাজার আশ্বাস-দুর্গসঙ্ঘের আড়াল আর

মহান নগর

পলাতক বন্ধুদের নির্বিঘ্ন আশ্রয়। 

(প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবিম্ব; ঘু.ও সো. ঈ.)


সাত. 

দারুন দু:স্বপ্ন ছাড়া গাঢ় কোন মধ্যরাত নেই

নীল নীল মৃত্যু ছাড়া স্বপ্নহীন দীর্ঘ ঘুম নেই

অনিদ্রার জ্বালা ছাড়া নিদ্রাস্নাত জাগরণ নেই। 

(ঘুম ও সোনালি ঈগল; ঘু.ও সো. ঈ.)

মিথ বা পৌরাণিক উপাদানের ব্যবহার আজীজুল হকের কবিতাকে সার্বজনীনতা দান করে। দ্বন্দ্বময় অস্তিত্ব-সচেতন কবিমানস থেকে ভারতীয়, গ্রিক প্রভৃতি পুরাণের উপাদানসমূহ তিনি সমকালীন জীবন-প্রসঙ্গে রূপায়ণ করেছেন-যা মানুষের চিরন্তন ভাবনার মাধ্যম ও রূপকল্প হিসাবে কাজ করেছে। বৃহত্তর জীবনকে কবি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাণ ব্যবহারসূত্রে সম্ভাবনাময় করে তুলেছেন। তাঁর কবিতা থেকে-

এক. 

সূর্যই আমাদের প্রথম নায়ক

চিরকাল আমাদের নায়কই সে আছে। 

(মেঘমুখী সুর্যমুখী; বি.চি.)


দুই. 

খুঁজে দেখ, সেইসব বিদ্ধস্ত ও প্রোথিত নগর

হিংস্র দাঁতের ফাঁকে আর্যদের হাসি,

দ্রাবিড়ের বিচূর্ণ করোটি। 

(হাড়; ঝি.মু.সূ)


তিন. 

মনে করো, ইভের সান্নিধ্য ছেড়ে আমি এক আদিম পুরুষ

সুপ্রাচীন ব্যাবিলনে নিগূঢ় চুম্বন রেখে বিবাহিত রূপসীর ঠোঁটে

নিখোঁজ হয়েছি। 

(প্রাক উত্তর পর্বের সঙ্গীত; ঝি.মু.সূ)


চার. 

অপহৃতা রমণীর মতো এক স্মৃতিগন্ধা অনার্য রূপসী

ঝিনুক-রহস্য চোখ তুলে

সেই প্রশ্ন সম্প্রতি ও করেছে আমাকে

বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। 

(রূপকথা; বুদ্ধ ও ড্রাগন, ঝি.মু.সূ)

সময় নিরন্তর হাঁটছে তার পায়ে ধুলো ওড়ে না। আক্ষেপে জুড়ে থাকে শুধু আজীজুল হককে আবিষ্কারের বিষয়টি। তাঁর কবিতা, তাঁর দর্শন যুগে যুগে আবিষ্কৃত হওয়ার মতো। কারণ তার কবিতার শরীরে আধুনিকতার আদলে আধুনিক জীবনেরই ধ্রুপদ বিন্যাস করা হয়েছে-যা খুললে উন্মোচিত হবে এক বিরাট ভুবন। আর তাঁর দর্শনও অভিনব। মানুষ সবকিছুই অস্তিত্বের প্রয়োজনে করে, এমনকি যে কবিতা লেখে তাও। এই হচ্ছে আজীজুল হকের দর্শন। এই দর্শনকে ঘাঁটলে কাব্যপ্রয়াসীরা পেতে পারেন অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর। কবিতা সময়ের সাথে বদলে যায়। নতুন কবিরা নতুনভাবে নির্মাণ করতে চান কবিতার শরীর। সেই সূত্রে কবিতা আধুনিকোত্তর যুগে প্রবেশ করেছে। কিন্তু নানা কারণে পঞ্চাশের কবিরা ইতিহাসে বিশেষভাবে থাকবেন। থাকবেন আজীজুল হকও। এই বিষয়টি এখনই বিরাটভাবে দৃশ্যমান না হলেও ভবিষ্যতে হবে। কারণ মহৎ কবিতা এক সময় না একসময় কথা বলে।

সংখ্যার দিক থেকে কবি আজীজুল হক লিখেছেন অল্প কিন্তু তাঁর সমগ্র রচনা শিল্পবিচারসূত্রে অনন্য এবং একথা বলা প্রয়োজন, তাঁর কাব্যকর্ম বাংলা কাব্যভূমির সমৃদ্ধি প্রসঙ্গে সসম্মানে বিবেচিত ও গৃহীত হতে বাধ্য।