পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬

মুনিয়া



এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে অনু। সব কিছু করছে, খাচ্ছে দাচ্ছে অফিসে যাচ্ছে-- কিন্তু আসলে যেন কিছু করছে না। বাইরের লোক কিছু বুঝবে না, তার বুকের ভেতর একটা ভীষণ টাল মাটাল চলছে। অথচ দু দিন আগেও সে এক সুন্দর মানুষ ছিল। এইতো গেলো বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করতে কোলাঘাট। খুব হৈ হৈ , মজা, ছবি, জোকস সব চললো। এরা সব তার অফিসের বন্ধু। চারটে মেয়ে দুটি ছেলে। বয়স তাদের সবার তিরিশের কোঠায়। বিয়ে ফিয়ে করে হিল্লে বানিয়ে ফেলেছে। শুধু অনুর এখনো গতি হলো না। বিয়ে করবে ভাবেই না সে। বাবা মা অসুস্থ। সে একমাত্র মেয়ে। সেইই সব বাড়ীর। যদিও মা বার বার বলেন, চোখের জল ফেলেন, কিন্তু সে অনড়।
"তোকে কে দেখবে? আমরা না থাকলে?" মা কঁকিয়ে ওঠেন।



" যিনি দেখার তিনি দেখবেন। মা , শুনে রাখো ,ভাগ্য খারাপ হবার হলে বর ছুঁড়ে ফেলে দেবে। বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করো না।" মা গজ গজ করতে থাকেন দুঃখে হতাশায়। বাবা পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন, দু চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পড়ে নিরূপায় জল।

*
বাজার দোকান মাস কাবারী থাকে অনুর। গোকুল কাকু র মুদি দোকানে জিনিসের লিস্টি দিয়ে রাখে। তিনি ঠিক লোক দিয়ে পৌঁছে দেন। পাড়ার লোক অনুদের ভালোবাসে। মেয়ে টা খেটে চলেছে মুখ বুজে। বিয়ে করলো না, উগ্রতা নেই, সাজে না তেমন, ঠিক সময়ে বাড়ী ফেরে।লোক ঠিক বোঝে। দেখা হলে হাসি মুখে বলে," কেমন আছো মা?" এমনি করে চলে যায় দিন। বেশ নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতো। ঢেউ নেই। আবেগ নেই।আবার সমস্যাও নেই। বেশ ছিল অনু। 

কিন্তু এখন আর ভালো নেই। কেউ বুঝবে না যে সে ভালো নেই। গোকুল কাকা ডেকে বলবেন,"অনু রে, দাঁতের মাজন লিখিস নি মা? চাল টা কত কিলো লিখিস নি?" অনু তাড়াতাড়ি ঠিক করে দেয় লিস্ট। কাকা সস্নেহে বলেন," কাজের চাপ বেশী নাকি রে মা?" সে মৃদু হাসে। নাঃ। কাজের চাপ নয়। মনের চাপ। এই সেদিনও যে অফিস ছিল তার কাছে খোলা মাঠের মতো, এখন সেখানে সন্তর্পনে ঢোকে। নিজের কিউবিকলে বসে সন্তর্পনে তাকায়। বজ্জাত টা কোথায় গেল? না। নেই কোথাও কেউ। মনে হয় আসেনি আজ। এই এক হয়েছে জ্বালা। নতুন এসেছে ছেলেটা। এসেই একটা হৈ হৈ ভাব ফেলে দিয়েছে। বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। জ্ঞান দিতে ব্যস্ত। সে দিক। যা খুশী করুক। অনুর কাজ অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টএ। ওর কারো সঙ্গে পাঙ্গা নেবার নেই। ছেলেটা আছেও সেলস বিভাগে। কার কী দরকার পড়েছে অন্যের ব্যাপারে থাকার? বলে, নিজের কাজ ই শেষ হয় না! 

কিন্তু ঐ বজ্জাত টা কেবল ইতিউতি খুঁজে অনুর কাছে চলে আসবে, দিনের মধ্যে দশ বার। খুব অবাক হলেও সে ভাবতো, যাক গে নতুন এসেছে। কী আর করা যাবে! ছোট অফিসে এমনিতেই লোক পরিচিত হয় তাড়াতাড়ি। নাম শুনলো কল্যাণ। মনে মনে মুখ  বেঁকালো অনু-- কল্যাণ! একটা নাম হলো? ছেলেটা অদ্ভুত। এসে একটা চেয়ার টেনে বসে বলবে," এতো ঘাড় গুঁজে কাজ করো কেন? ঘাড়ে বাত হবে। চলো চা খাই।" অনু একটা কড়া চাউনি দিয়ে আবার কাজে মন দিলো। কল্যাণ একটু পরে আবার ঘুরে এসে বললো ," জল আছে তোমার কাছে? আমি একটু জল খাবো?"

" মানে?" অনু হাঁ হয়ে গেলো। সারা ডিপার্টমেন্ট ঘুরে অনুর কাছে জল চাইতে এলো! কি অদ্ভুত! রাগে চিড়বির করতে লাগলো শরীর। ভেবেছে কী অনু ফালতু? একটা কড়া চাউনি দিতে গিয়ে দেখে, এক জোড়া নরম চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। শির শির করে উঠলো শরীর। অনেকদিন আগে একটা ছোট্ট বেড়াল ছানা কে দেখেছিল, পাঁচিলের কোনায় আটকে গেছিল, নামতে পারছিল না। অনু নামিয়ে দেয়। বেড়াল ছানা টা ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।  পরম নির্ভরতার সঙ্গে। ঠিক সেই রকম যেন এক সমর্পণ ঐ তাকানোতে? যাঃ। কী সব ভাবছে। নিজেকে শাসন করলো অনু। কিন্তু বোতল টা এগিয়ে দিল কল্যাণের দিকে।

তারপর থেকে এই চলেছে। অনু অফিসে পৌঁছনো মাত্র কোথা থেকে লাফিয়ে চলে আসে সে। তারপরে দু মিনিট হলেও বক বক করে চলে যাবে। আবার আসবে। জল খাবে। অনু পরে ভেবেছে সে ই বা কেন খারাপ দেখছে ! খোলা মনে যদি কেউ মেশে, তবে দোষের কী আছে? এই সব ভাবতে ভাবতেই একদিন নিজেকে দেখে চমকে ওঠে অনু ! সে হাসছে আড্ডা দিচ্ছে। আবার জোকস আদান প্রদান করছে। জল নিয়ে আসছে ভুল না করে। কাজের ফাঁকে অপেক্ষা করছে, কখন কল্যাণ আসবে? এমন তো হবার কথা নয়। এমন হবার কথা তো ছিল না? তবে? অনু নিজেকে কড়া শাসন করে। মার ওষুধ নিয়ে বাড়ী যেতে যেতে ফোনে মেসেজ আসে ,এক মজাদার জোকস। নিজের মনে হেসে ওঠে অনু। ওষুধের দোকানী জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়, সে বাঁ হাত নেড়ে বলে কিছু না। কিছু না। 

আজ দু মাস হয়ে গেলো। কল্যাণ তার জীবনে ঢুকে পড়েছে। সে একটা অপেক্ষা টের পায় বুকের মধ্যে। অনেক দিনের খরার পরে বৃষ্টির অপেক্ষা যেমন, অথবা 
সেই পথ হারা পথিক যখন খুঁজে পায় ঠিকানা! খুব ভালো লাগে তার এই নতুন অনু কে। মা ও বলেন ," তুই কী সুন্দর হাসিস রে মা  ভালো লাগে।" সে ভাবে, সে বিয়ে তো কোনোদিন করবে না ঠিক ই। কিন্তু কাউকে ভালোতো বেসে যেতেই পারে। দোষ কী তাতে? কল্যাণ না জানলেই তো হলো? কাউকে বুঝতে দেবে না সে যে তার বুকের মরুভূমির ভিতর এক নতুন নদীর জন্ম হয়েছে। সে ঐ নদীর ঘাটে বসবে পা দুলিয়ে। বক বক করবে আপন মনে। ইচ্ছে হলে নগ্ন হয়ে ডুব দেবে নদীতে। 

অফিসে আজ একটা উৎসব উৎসব ভাব। টার্গেট ফুলফিল হলে পার্টি হয়। সবাই বেশ খুশী খুশী ভাবে ঘুরছে। এম.ডি  মিঃ বাসু এসে বললেন," আপনারা সকলে বিকেলে আসবেন ফ্রেশ হয়ে। গান বাজনা, খাওয়া হবে। বাড়ীর লোক দেরও আনবেন। এখন বাড়ী চলে যান। বিকেল ঠিক পাঁচটায় আসবেন।" কল্যাণ দৌড়ে অনুর কাছে এসে বললো ," চলে এসো পাঁচটাতে।" অনু মিষ্টি করে হাসলো। 

*
বিকেলে আজ একটু সাজলো অনু। মেরুন শাড়ী। টিপ। চুল খুলে দিলো। মা বললেন" বাঃ"। অনু লজ্জা পেল। তার বাড়ী যে পার্টিতে যাবার লোক নেই কেউ। তাকে একলাই যেতে হবে। তাড়াতাড়ি আটো স্টান্ডের দিকে পা বাড়ালো।গম গম করছে ছোট অফিসটা। বেলুন, ফুল দিয়ে সাজানো। লোক জন এসে গেছে। কল্যাণ কই? অকারণে শাড়ী টা টেনে টুনে ঠিক করতে লাগলো। তুহিনা ,প্রিয়া হেসে গড়াগড়ি--" ওরে তুই শাড়ী পরলি কেন রে? কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে রে তোকে!" ধ্যাৎ। এই মেয়ে গুলোর সবেতেই হাসি। কিন্তু কল্যাণ কই? হঠাৎ তার মাথার পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো " অনু"!

চমকে তাকিয়ে দেখলো কল্যাণ। সঙ্গে চাঁপা ফুলের মতোএক সিঁদুর পরা বৌ। কল্যাণ অদ্ভুত চোখে তাকালো," আরে আমি তো চিনতেই পারিনি। কিরকম বদলে গেছো তুমি!" তার মনে হলো কেউ কোথাও নেই। অফিস নেই । কিছু নেই। এক পাহাড় ঘেরা প্রান্তরে সে দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় যেন কিছু বেজে যাচ্ছে, একটানা। সে আর কল্যাণ -- হেঁটে যাচ্ছে। কল্যাণ বলছে সে বদলে গেছে। গেছে তো বটেই। নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো চারিদিকে। হাসছে কল্যাণ , বলছে," অনু আলাপ করিয়ে দি, আমার মিসেস মৌমিতা। আর মৌ, এই সেই অনু। যার হাতের জল না খেলে আমার দিন ভালো যায় না।"



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন