পাইন
গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে কুমার ঘোষ মশাই আয়েশে চোখ ঝিমুচ্ছিলেন ।তাঁকে ঘিরে
টিনা-মীনা-করণ সহ এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীর ভিড় ।ষাট ছুঁই ছুঁই কুমার নিয়মিত জিম
পরিচর্চিত,পার্লার লালিত সুগঠিত দেহভঙ্গিমায় এখনো টান টান লেডিকিলার
।শ্মশ্রুগুঁম্ফহীন মুখমণ্ডল, ব্যাকব্রাশ চুল , কানের দুপাশের জুলপিতে সামান্য
সাদার ছোঁয়া, নীল জিনসের সঙ্গে কালো টি সার্ট । কুমার বিখ্যাত ঠিকাদার। তার থেকেও
বিখ্যাত তাঁর বদান্যতা ,উদার চিত্ত, পরোপকারী ব্যক্তিত্ব। উষ্ণ স্নেহ বিতরণে তাঁর
জুড়ি নেই । টাকা ছড়ান ফুলঝুরির মতো। তাঁর হৃদয় আকাশের মতো উদার ,দৃষ্টি সমুদ্রের
মতো গভীর , স্নেহ অগাধ, অপার ।এই স্নেহে যে একবার ডুবেছে , সে আর পার পায়নি।
মধুস্নেহ ও ঘৃতস্নেহ যুগপৎ দুই স্নেহের অপার ভাণ্ডার তাঁর। তবে যত্রতত্র স্নেহের
প্রদর্শনীও তাঁর পছন্দ নয়। নদী যখন অগাধ জলধির কাছে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ব্যাকুল
ভাবে ছুটে আসে,তখনই দাতা কর্ণ কুমার স্যার পরম আশ্লেষে করুণ-কাতর হয়ে উঠেন। তখন
তিনি বিপদভঞ্জন ও বটে । পরদুঃখে কাতর কুমার মশায় গোটা জীবনই দান করেছেন আর্তসেবায়।
জীবন
তাঁকে সবই দিয়েছে ,কেবল বিদ্যা ছাড়া । স্কুল ফাইনাল বেশ হইচই করেই পার হওয়া গেল
,গোল বাঁধল হায়ার সেকেন্ডারির বেলায় । মাধ্যম বিলেতি ভাষা , আর বিপদ ঘটল তাতে
।যদিও কিনারা হয়, তো পার হওয়া বেশ দুষ্কর হয়ে উঠল । নিন্দুকেরা বলে বাপের অঢেল
পয়সার জোরে কলেজ পেল কুমার । নতুবা-- ?
শত্রুর
মুখে ছাই দিয়ে কুমার গ্র্যাজুয়েট হল । পাথরকুঁচি গাঁয়ে সেদিন খানা পিনা নাচ-গান
কাকে বলে দেখল গ্রামবাসী ।
ছেলে
পড়াশুনা নিয়ে অন্য ভাইদের মতো উৎসাহী নয় , তাই পৈত্রিক ব্যবসায় ( ঠিকাদার )বাপের
পাশে শহরে জায়গা হল কুমারের । বছর ঘুরতে না ঘুরতে লক্ষ্মীর কোলচাটা ধন হয়ে উঠল
কুমার । তখন তাঁর ধূলো মুঠি সোনা মুঠি । দেদার ইয়ার বন্ধু , পান , পানীয় ,খানা –পিনা ফুর্তি । কুমার হয়ে উঠে দিল দরিয়া । নিত্য
নতুন বান্ধবী ,কিংবা বন্ধুনী । ওখানেও নিন্দুকদের ফুটকি টিপ্পুনী ,’কি জানি কীভাবে
...’ । মোদ্দা কথা কুমারের সব কাজেই ব্যাঁকা নজর
প্রতিবেশির ।
কুমারের ভাগ্যের আকাশে নক্ষত্ররা দল বেঁধে স্নান করতে নামে । প্রায় কুড়িয়ে পাওয়ার মতো ক্ষমতাসীন দলের টিকিট নিয়ে ভোট জিতে বিধান সভায় আসে কুমার । ধন্য ধন্য রব উঠে চারদিকে । কুমার ভাবলো নাহ্ , জনতার জন্য এইবার কাজ করা উচিত । এই কাজের অছিলায় মুখ্যমন্ত্রীর নজরে তো আসা যাবে । আবার ধন্য ধন্য রব উঠলো , জিও লাল । পাথরকুঁচির শান।
ধূলো উড়িয়ে কুমারের রথ যায় ফুলকুমারীর ঘরের সামনে দিয়ে । ধুলোয় ডেকে যায় ছোট কুঁড়ের ঘর। তবু দীঘল কেশ এলিয়ে ফুল বাড়ির সামনে রোদ পোহায় । হাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ সার্টিফিকেট , বাবা চাষা মানুষ অনেক স্বপ্ন নিয়ে মেয়েকে পড়িয়েছে । প্রতি বছর পাশ ,গ্রামে মুখ উজ্জ্বল বাপের । কিন্তু চাকুরির বাজারে ফুল নিত্যদিন নিষ্ফলা । সরকারী চাকুরী পেতে রেস্ত লাগে । আছে তোর বাপের ? ফুল মনিপুরী মেয়ে । রাজা বভ্রূবাহনের রক্ত শরীরে , যোগ্যতায় চাকুরী হাসিল করবে । বাপ ভাইদের হাড় মাস করা কামাই বেচে নয়কো । বন্ধুরা বলে আর হয়েছে তোর চাকুরী ?
কুমারের ভাগ্যের আকাশে নক্ষত্ররা দল বেঁধে স্নান করতে নামে । প্রায় কুড়িয়ে পাওয়ার মতো ক্ষমতাসীন দলের টিকিট নিয়ে ভোট জিতে বিধান সভায় আসে কুমার । ধন্য ধন্য রব উঠে চারদিকে । কুমার ভাবলো নাহ্ , জনতার জন্য এইবার কাজ করা উচিত । এই কাজের অছিলায় মুখ্যমন্ত্রীর নজরে তো আসা যাবে । আবার ধন্য ধন্য রব উঠলো , জিও লাল । পাথরকুঁচির শান।
ধূলো উড়িয়ে কুমারের রথ যায় ফুলকুমারীর ঘরের সামনে দিয়ে । ধুলোয় ডেকে যায় ছোট কুঁড়ের ঘর। তবু দীঘল কেশ এলিয়ে ফুল বাড়ির সামনে রোদ পোহায় । হাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ সার্টিফিকেট , বাবা চাষা মানুষ অনেক স্বপ্ন নিয়ে মেয়েকে পড়িয়েছে । প্রতি বছর পাশ ,গ্রামে মুখ উজ্জ্বল বাপের । কিন্তু চাকুরির বাজারে ফুল নিত্যদিন নিষ্ফলা । সরকারী চাকুরী পেতে রেস্ত লাগে । আছে তোর বাপের ? ফুল মনিপুরী মেয়ে । রাজা বভ্রূবাহনের রক্ত শরীরে , যোগ্যতায় চাকুরী হাসিল করবে । বাপ ভাইদের হাড় মাস করা কামাই বেচে নয়কো । বন্ধুরা বলে আর হয়েছে তোর চাকুরী ?
সেই
বছর-ই কুমার মন্ত্রী হল । দেদার ক্ষমতা, আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ । দাতা কর্ণ হতে সাধ
গেল কুমারের । কেউ বেকার থাকবে না পাথরকুঁচিতে । ফুলও নয়।
ফুলের অ্যাপ্লিকেশন কুমারের হাতে ।
ফুলের অ্যাপ্লিকেশন কুমারের হাতে ।
কুমারের
সামনে ফুল । পাহাড়ি সরলতা ও সৌরভ অঙ্গে মাখা । বাঘের সামনে যেন হরিণী । ফুল ত্রস্ত
। ক্ষুধার্ত নেকড়ের লেলিহান নজরের সামনে কুঁকড়ে গেল ফুল ।
পালিয়ে
এলো রীতিমতো ।
কিন্তু
খিদের পেট যে ! বাড়িতে হাড় জিরজিরে ভাই বোনদের সামনে কত যে অসহায় ফুল ! তবু ফুল
গেল না । আত্মসন্মান বেঁচে চাই না কিছুই। ফুলেরা চিরদিন-ই একরোখা ।
*
পাথরকুঁচি ছোট্ট গ্রাম । সুখ দুঃখে প্রতিজন প্রতিজনের । ফুলের চাকুরী পাওয়ার খবর বাতাসে বয়ে এলো । দীর্ণ জীর্ণ কুঁড়ে ঘরের সামনে থামলো রাজার রথ । কুমারের প্রেরিত প্রতিনিধির হাতে ফুল ফোটার বার্তা । শহরের হোটেল রিসেপসনিষ্ট এর পাকা চাকুরী কুমারের সুপারিশে । ভালো মাসমাইনে । ঘরে ছুটে এলো খুশির হাওয়া । নাহ্ , লোকটির মিছে বদনাম । কই ফুল তো ঘরে বসেই কাজ পেল । না কোন দক্ষিনা না কোন ...
বেশ কাটল প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে । গোটা টাকাটাই মায়ের হাতে তুলে দিল ফুল । মায়ের কুঁচকানো কপালে হেমন্তের মধুর হাসি । নতুন কাপড় , নতুন মোবাইল । ছোটদের বায়না টিভি চাই রে দিদি । ফুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুপাক নেচে নিল । পৃথিবীতে ভালো লোকের অভাব নেই । কুমার সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে এলো ফুলের মাথা ।
*
শীত পড়ব পড়ব করছে । এই শনিবারে ফুল বাড়ি যেতে পারেনি । হোটেলে সরকারী পার্টি আছে । ফুলের প্রচুর দায়িত্ব । ম্যানেজার খুঁটিনাটি কাজ বুঝিয়ে দিল ফুলকে । সেদিনই জানলো ফুল কুমার আসবে মুখ্য অতিথি রূপে । অজানা আনন্দের ঢেউ খেলে গেল ,যেমন ধানের শীর্ষে বাতাস খেলে যায় । এই অবসরে একবার ধন্যবাদ তো জানাতে ভুল করবে না ফুল। কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কি-ই বা দিতে পারে ।
এত বড়
একজন মন্ত্রী । তাঁকে কি মনে রেখেছে ?
প্রচুর
গেস্ট ,হৈ চৈ । কাছে যাওয়ার সুযোগ-ই পেল না ফুল । ডিনার হয়ে গেল । দূর থেকে ফুল
নীরবে কৃতজ্ঞতা জানালো সন্মানীয় বহু মূল্যবান মন্ত্রী মহাশয়কে । সব অতিথি চলে গেল
। মন্ত্রী ও তাঁর কাছের লোকজন ছাড়া ।
হোটেলের
নিভৃত কক্ষে কুমার ফুলের মুখোমুখি । বিছানায় পড়ে আছে ক্ষত বিক্ষত পাপড়িগুলো । তাজা
নবীন ফুলের কোমল পাপড়ি শক্ত হাতের পেষনে থেঁতলে গেছে । স্যাঁতা পড়া ভেজা মুখটা
কাঁপছে তির তির করে । ঘরে বড় রকমের ঝড়ের শেষের ধ্বংস চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ।
কুমারের মুখে সিগারেট , ফুলের নত চোখে জল । শরীরের উপর প্রচন্ড ঘেন্না জন্মালো
ফুলের । পাহাড়ের সৌন্দর্য কলংকিত করলো এক মাতাল শূকর ।
কোথায়
যাবে ফুল ? ভাইবোনদের উল্লাসে ভরা চিৎকার এখনো কানে বাজছে , দিদি টিভিটা কী সুন্দর
রে । দেখ কেমন দেয়ালে মুখ টিপে হাসছে । ওমা দীপিকা পাড়ুকোন যে এক্কেবারে তোর মতন
রে । হ্যাঁরে দিদি সামনের মাসে বেতন পেলে একটা জিনিস দিবি ...
পাথরকুঁচি
গ্রামে ফুলকুমারীর কাঁচা ঘর পাকা হতে দেখল লোকে । কত আধুনিক জিনিস পত্রে ভরে গেল
ঘর । আলোয় পূর্ণ হল গৃহের প্রতিটি কোন । শুধু ফুলের জীবনের সৌরভ চিরতরে মুছে গেল ।
প্রতিটি রাত বিক্রি হয় সস্তা দরে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন