নারীর ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র ও সৃজনশীলতা
নারী পুরুষের
সমানাধিকার, নারীবাদী আন্দোলন প্রভৃতি ব্যাপারগুলি গুরুত্ব তখনই পাবে যদি আমাদের
পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে অসংখ্য কচি মেয়েকে আমরা ‘বিয়ে’ নামক বলি থেকে আটকাতে
পারি। গ্রামের স্কুলের শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদে এই ভয়ংকর দুর্দশাগ্রস্ত দিকটা প্রতি
মুহূর্তে চোখে পড়ে। সপ্তম কি অষ্টম শ্রেনীতে একটি কিশোরী যেই ঋতুমতী হল, অমনই শুরু
হয়ে যায় তার বিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। হ্যাঁ আজকাল খবরে পড়ি ‘নাবালিকা নিজেই বিয়ের
বিরুদ্ধে সরব, আইনের সাহায্য নিয়েছে; কিন্তু সে তো সামান্য। আর এই সমস্যার শিকড়
বহু গভীরে বলেই মনে করি। কারণ এরা স্কুল থেকে ডেকে পাঠালেও কন্যাশ্রীর টাকা নেয়
না। আরো বড় ব্যাপার হল বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ম্যারেজ সার্টিফিকেট জাল করে নিয়ে এসে
কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা নেওয়ার প্রচেষ্টা। আঠারো- উনিশ পর্যন্ত মেয়েকে ‘বুড়ি’
করার বদলে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেওয়াকেই বাবা-মা’রা শ্রেয় বলে মনে করে।
আজকে আমার
দেখা একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। অষ্টম শ্রেনীর একদল হাসিখুশি মেয়ের মধ্যে ছিল
রেজিনা খাতুন। চোখে ছিল অনেক আশা, স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা। ছাত্রীটি ছিল পড়াশোনায়
যথেষ্ট ভালো এবং উজ্জ্বল। কিন্তু একটি অদ্ভুত জিনিস দেখতাম পড়াশোনায় ভালো হলেও
মেয়েটি মাঝে মাঝেই পড়াশোনা করে আসে না। একদিন খুব রাগ হল। প্রচন্ড বকাবকি করে
জানতে চাইলাম, কেন এই বেয়াড়াপনা! মেয়েটির বই নেই শুনে অবাক হয়ে গেলাম! তাহলে কি
ভাবে প্রায়দিনই নিখুঁত পড়াশোনা করে আসে। লিখে নিয়ে পড়াশোনা করার প্রবল আগ্রহ
মনটাকে ব্যাথায় ভরিয়ে দিয়েছিল। তাকে একটি বই কিনে দিয়ে বলেছিলাম, “ভালো রেসাল্ট
করতে হবে এটি শর্ত।“ মেয়েটি কথা রেখেছিল। তৃতীয় স্থান অধিকার করে নবম শ্রেনীতে
উঠছিল।
কিন্তু এইবার তার
চোখের ছায়া আরো গভীর হতে থাকল। মন ভারী ও উদাসী হতে থাকল। কথাবার্তা বলে জানা গেল-
‘মা- বাবা বাড়িতে বিয়ের চেষ্টা করছে।‘ আমাদের তো অবস্থা ভালো নয়, এর একটা বোন আছে।
আমার আর পড়া হবে না ম্যাডাম।‘ পড়াশোনায় এত ভালো মেয়ের জীবনটা এইভাবে নষ্ট হয়ে
যাবে! কিন্তু অর্থাভাবে যে মেয়ে বই কিনতে পারে না, তাকে বই দিতে পারি, বিয়ে দেওয়া
আটকাবো কি ভাবে? সেখানেও তো সেই প্রধান কারণ অর্থনৈতিক সমস্যা। মাধ্যমিক পরীক্ষার
দিন এগোতে থাকল অন্যদিকে পাত্রপক্ষের আসা যাওয়া, দেখা শোনা, দর দস্তুরও এগোতে
থাকল। মাঝখানে মেয়েটির চোখের জল হল সার। দাঁতে দাঁত চাপা জেদে সে মাধ্যমিকের ফর্ম
ফিল-আপ, প্রস্তুতি চালাতে লাগল। আর তার জেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবা মায়েরও জেদের
পারদ চড়তে থাকল যাতে ঘরের মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে না পারে।
অবশেষে মাধ্যমিক পরীক্ষার শুরুর দিন তার বিয়ের তারিখ ধার্য হয়েছিল। বিয়ের আসরে
উপস্থিত হয়ে সে অসুস্থ বোধ করার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হয়েছিল। বোধহয় সেই দিনই
তার মনের মৃত্যু ঘটে। তারপর সুস্থ হয়ে তার বিয়ে সংসার হয় একরকম জোর করেই। এখন সে
তার সন্তানকে মানুষ করার স্বপ্ন চোখে নিয়ে বেঁচে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন