পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

জয়তী রায়


              নং
----------------------------------------
*
 নিমাই গয়া গিয়ে কেমন থমকে  গেলেন। কি এক অনুভূতি হচ্ছে। কেন? তিনি পিতৃ শ্রাদ্ধ করতে গিয়ে  দর্শণ করলেন বিষ্ণু পাদ পদ্ম। প্রনাম করে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে গেলো।  যেন দেখলেন এক অসীম জলরাশি তার ওপরে সেই পাদ পদ্ম ---
       অশ্রুধারা বহে দুই শ্রীপদ্ম নয়নে

          লোমহর্ষ কম্প হইলো চরণ দর্শনে।
                   
সমস্ত বিদ্যার অহংকার ভাসিয়ে দিয়ে  আকুল কেঁদে উঠলেন নিমাই পন্ডিত।  যে তিনি যুব সমাজের নায়ক: যে তিনি দল গড়ে খোল বাজিয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে দেন: যে তিনি কাজী দমনে দলবল নিয়ে তার বাড়ি গিয়ে উঠেছিলেন , তাঁর সমাজ সংস্কারের খোলসের মধ্যে লুকিয়ে ছিল যে ভক্তির সাগর তা ফুলে ফেঁপে বেরিয়ে এলো আজ। 
   খুব অন্যমনস্কের মতো পিতৃ তর্পণ করে রাস্তায় বেরিয়ে এসে চমকে গেলেন। সামনে আবার সেই বৃদ্ধ বৈষ্ণব ঈশ্বর পুরী! নিমাই আর ঈশ্বর পুরী! মুখোমুখি দুজন। একজন যুবক। অন্যজন বৃদ্ধ। একজন উদ্ধত অহংকারী পন্ডিত  একজন পরম বৈষ্ণব। তাকিয়ে রইলেন নিমাই। মিটি মিটি হাসছেন ঈশ্বর পুরী। শিষ্য যদি চৈতন্য মহাপ্রভু হন তাকে গুরু খুঁজে নিতে বাধ্য। নিমাই বুঝলেন সময় হয়েছে দীক্ষা নেবার। গুরু শিষ্য দুজন দুজনকে চিনলেন। পুরী কৃষ্ণের দশ অক্ষর  মন্ত্র " গোপালা কৃষ্ণ" উচ্চারণ করলেন নিমাই পন্ডিতের কানে। 
   শুধু একটি নাম  এমন অঘটন ঘটাতে পারে? নাকি তাঁর ভেতরেই ছিল এক পরম ভক্ত।  কোথায় গেল সেই  গোঁয়ার দাম্ভিক পন্ডিত নিমাই? তার জায়গায় এতো চোখের জলে ভেসে যাওয়া এক ভক্ত নিমাই।  নিমাই নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না ঠিক কি হলো? কেন এমন উথাল পাথাল করছে মনের ভেতর? কেন স্বেদ কম্পন অনুভূত হচ্ছে শরীরে? নিমাই নিজেকেই চিনতে পারছেন না। তাঁর ঘর, স্ত্রী, মা সব থেকেও যেন নিঃস্ব তিনি। 
*
গয়া থেকে  নবদ্বীপে ফিরে এলেন নিমাই পন্ডিত। একটা অদ্ভুত পরিবর্তন টের পাচ্ছেন নিজের ভেতরে। প্রথাগত পূজো তার পছন্দ ছিল না কোনো কালে। বরং খুব রেগেই যেতেন ব্রাহ্মণদের সারাক্ষন পৈতে সামলানো, ছোয়াঁ বাঁচানো , ভগবানকে একদম নিজের সম্পত্তি মনে করে আগলে বেড়ানো দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন। আরে মূর্খ ব্রাহ্মণ! এরা এটাও বোঝেনা এর ফলে মানুষ সরে যাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে? মানুষ যদি না থাকে তবে ওমন ভগবান দিয়ে কাজ নেই!
              গয়া থেকে ফিরে আসার পরে সর্বক্ষণ কৃষ্ণনাম। পড়াতে বসে ছাত্রদের টীকার বদলে বলছেন কৃষ্ণকথা। যুবসমাজ বরাবর নিমাইয়ের কথা শোনে,নিমাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে  আজ তারাও কৃষ্ণকথা কইতে শুরু করলো। 
   " পঢ়িলাম শুনিলাঙ এতো কাল ধরি। 
       কৃষ্ণের কীর্তন করো পরিপূর্ণ করি।। 

             দীক্ষা মন্ত্র লাভ করেই এতো পরিবর্তন? এমন হয় নাকি? কিন্তু হলো। তেজের আগুন থেকে ফুটে উঠলো প্রেমের কমল। অন্তর থেকে  নিমাই অনুভব করলেন শুষ্ক জ্ঞান দিয়ে ঈশ্বর লাভ সম্ভব নয়। জ্ঞান ,যোগ নয়, এমনকি " মুক্তি" বলেও কিছু নেই, একমাত্র সাধনা হলো " হরিনাম" নির্বিচার ভালোবাসা।  
              

        রাত ভোর সংকীর্তন চলতে লাগলো। জমায়েত হচ্ছে  এখানে সেখানে।  

            মধ্যমণি সেই নিমাই। চোখ দিয়ে জল, মুখে ভাব সারাক্ষন কৃষ্ণনাম। কোনো অং বং টং মন্ত্র পাঠ নয়, কোনো ছোয়াঁ বাঁচানো নয়, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল সবাইকে বুকে টেনে কৃষ্ণ নামে নেচে গেয়ে মাতোয়ারা হয়ে গেলেন একেবারে। নিচু জাত বলে যারা দূরে ছিল এতদিন , আজ দলে দলে চলে আসতে লাগলো। ১৪৮৬ সালে চৈতন্যদেবের জন্ম। সেই সময় ব্রাহ্মণদের রমরমা এতো বেশী যে মানুষ ভয়ে ভয়ে থাকতো। নিয়ম আচার ব্রত উপবাস ছাড়া পূজো হয় , শুধু নাম জপ করে মন গঙ্গা স্নান করতে পারে, সংকীর্তনের তালে তালে নেচে শরীর ভালো থাকে, সবচেয়ে বড়ো কথা সমাজ এক সূত্রে  বাঁধা থাকে, এসব তথ্য ছিল একেবারে নতুন। 
     সমাজের যাঁরা আচার বিনা নিয়ম বিনা জ্ঞান বিনা ভগবান কে ডাকা নিষিদ্ধ মনে করে, সেই দলটি আবার ক্ষেপে গেলো। একি অদ্ভুত কান্ড! সবচেয়ে বড়ো কথা, নিমাই সবাইকে বুকে টেনে নিচ্ছেন। জাতের বাধা, কৌলিন্যের বাধা কোনো কিছুই ভগবানকে ভালোবাসার অন্তরায় হতে পারে না। এমনকি মুসলমানকেও শিষ্য করে নিচ্ছেন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু উপদেশ নীতিকথা ধার দিয়েও গেলেন না। এই ছুঁয়োনা, করোনা এই সব নিয়মকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ভক্তি আর শরণাগতি --এই তাঁর মূলমন্ত্র। 
   সে এক দৃশ্য বটে। হরে কৃষ্ণ নাম সঙ্গে নিয়ে মানুষ সব কিছু ভুলে রাস্তা দিয়ে কীর্তন করতে করতে যাচ্ছে। তখন শাসক ছিল মুসলমান কাজী। সে একেবারে ক্ষেপে উঠলো। হিন্দুর দল চুপচাপ পূজো করবে, সে ঠিক আছে। সারা দেশ জুড়ে নেচে বেড়াবে নাকি? বন্ধ করো। বন্ধ করো সব,আদেশ করলো কাজী। আর বন্ধ করা! সাগরের জলের মতো ভক্তি তরঙ্গ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো কাজী কে সে এক দেখার মতো দৃশ্য ----
        " মধ্যে নৃত্য করি যাইবেন যবন হরিদাস
                এক সম্প্রদায় গাইবেন তান পাশ।
     আহা! শুধু কৃষ্ণ নাম গো। হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে,,,,,, 
      শ্রীবাস পন্ডিত, হরিদাস ঠাকুর,নিত্যানন্দ মহাপ্রভু থেকে নবদ্বীপের চোর পর্যন্ত নামের জোয়ারে ভেসে গেলেন-" কৃষ্ণের কীর্তন করে নীচ রাড় বাড়।" অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এতদিন কাজী ভাবতেন হিন্দুরা দল পাকাচ্ছে। কিন্তু আজ যখন মহাপ্রভুকে বিরাট কীর্তন দলের সঙ্গে দেখলেন, দেখলেন কৃষ্ণ নামের সঙ্গে সঙ্গে এই যুবকের ভাব। তাঁর পতন চোখের জল, তিনি বুঝলেন কোনো রাজনৈতিক হিন্দু জাগরণ নয়। কাজীকেও বুকে জড়িয়ে ধরলেন মহাপ্রভু। গলায় মালা, চন্দন সুবাসিত শরীর, চোখে জল, মুখে নাম--- মুগ্ধ কাজী নিজেই ভেসে গেলেন প্রেমে
          --------------------------------------
                ৪নং
--------------------------------------------
        শ্রীবাস মহাপ্রভুর প্রিয় শিষ্য। তাঁর ঘরেই রাত ভোর সংকীর্তন করেন চৈতন্যদেব। ততদিনে তিনি সিদ্বান্ত নিয়েছেন আর সংসার নয়। সন্ন্যাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভেতরে যে আকুলতা কাজ করছে সংসারে থেকে নিজেকে ঠকানো হয়ে যাবে মনে হয়। তিনি তখন এক মহা ভাবে মগ্ন। কৃষ্ণ সঙ্গ ছাড়া আর কিছু সত্য নয়। মহাপ্রভুর এই ভাবটি কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বের মূল কথা।  কৃষ্ণ  সমস্ত বেদের প্রতিপাদ্য, তিনি মুখ্য ব্রহ্ম, তাঁর কথা না জানলে সমস্ত জ্ঞান মিথ্যা হয়ে যায় 
চৈতন্য নিজের অন্তরে উপলব্ধি করেন এই কৃষ্ণ ভগবান কে পাবার জন্য যাগ যজ্ঞ ধ্যান জ্ঞান দিয়ে দরকার নেই।ভক্তি আনতে হবে অন্তরে। প্রেম জাগাতে হবে। তবে ভগবান আপনি ধরা দেবেন
    ধর্মের এই সহজ ব্যাখ্যায় চমকে উঠলো আপামর। দেখো, সকলে ভালোবাসার বশ। শ্রী চৈতন্যের ভালোবাসার ডাকে ঘুরে গেলো জনসাধারণ। মৃদু হাসলেন মহাপ্রভু। 
     " নগরে হিন্দুর ধর্ম  বাড়িল অপা
          
     
        হরি হরি ধ্বনি বই শুনি নাহি আর
     ------------------

                     ধর্ম যদি উদ্ধার না করে তবে সে ধর্ম কিসের? চৈতন্য অনেক ভাবলেন। তাঁর নিজের মনে তখন ----" অচিন্ত্য অদ্ভুত কৃষ্ণ চৈতন্য বিহার/ / চিত্র ভাব গুণ চিত্র ব্যবহার।" গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বের গূঢ় রহস্য সাধারণ মানুষের বোঝার কথা নয়। আগে তাদের সঙ্গে ভগবানের সখ্যতা স্থাপন করতে হবে। ভগবান মানে একজন দূরের কোনো বস্তু নয়, তিনি আলাদাও নন। ভক্তের সাথী তিনি। অনেকটাই এই উদ্দেশ্যে সফল হয়েছেন তিনি আপামর বাংলাদেশ ভাসছে নাম জোয়ারে। ভগবান ভক্তি আর ভক্ত হচ্ছে ঘুড়ির মতো, সুতোর একদিকে ভক্ত অন্যপ্রান্তে ভগবান আর মাঝে ভক্তি রূপ সুতো। এই ভক্তি বোধ জাগিয়ে লোকসাধারণের মধ্যে নবজাগরণ আনলেন সার্থক ভাবে , কিন্তু তাঁর নিজের এমন অবস্থা কেন?
*
 আবার সেই প্রিয় গঙ্গা তীর। আবার গভীর চিন্তা মগ্ন মহাপ্রভু। সদ্য সন্ন্যাস নেওয়া মুন্ডিত মস্তক বসে আছেন যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে। ভেতরে এক অস্থিরতা, এক আলোড়ন। সমাজ আজ এক সূত্রে বাঁধা হয়েছে। মুসলমান অগ্রগতিও অনেকটাই আয়ত্বে এসেছে। কিন্তু তাঁর মন এতো ব্যাকুল কেন? কোথায় যেন বাজে বাঁশি ? সংকীর্তনের ছায়ায় দীন হীন নীচ ধনী একসঙ্গে বসে আছে আজ, তবে তাঁর কেন পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে? চোখ ভেঙে নেমে আসে জল! " হা কৃষ্ণ ,কোথা কৃষ্ণ" করতে করতে  বাহ্য জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েন। সামনে বয়ে চলা জলধারা যমুনা নাকি? সমাজ উদ্ধার, দেশ উদ্ধার সব কেমন তুচ্ছ মনে হয়। বৃন্দাবন যেতে হবে তাঁকে। সেখানে আছে কালো কিশোর। চতুর চূড়ামনি কৃষ্ণ। তাঁর প্রেমিক। চলো বৃন্দাবন। চলো প্রেমের কুঞ্জে। রাধা ভাবে আবিষ্ট শরীর আর তাঁর বশে নেই। অন্তরঙ্গ ভক্তরা সদা সতর্ক। মহাপ্রভু  উঠে দাঁড়ালেন। সদা সহচর নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে গিয়ে বললেন," চলো বৃন্দাবন।
নিত্যানন্দ বললেন," চলুন প্রভু। আপত্তি নেই। কিন্তু মনে আছে মাতৃ আজ্ঞা?"
চমকে উঠলেন চৈতন্য। মাতৃআজ্ঞা? না। ভোলেন নি। তিনি হৃদয়হীন সন্ন্যাসী নন। মা বলেছিলেন তাঁর নিমাই যেন সন্ন্যাস নিয়ে পুরী ধামে থাকে। আসতে যেতে বহুলোক পুরী ধামে যায়। তবে মা একটু খবর পাবেন। শ্বাস ফেললেন মহাপ্রভু। বৃন্দাবন যেতেই হবে তাঁকে। তারপরে কৃষ্ণ প্রেম বুকে নিয়ে চলে যাবেন নীলাচল। 
---------------------------------------------------
                  শেষ পর্ব
---------------------------------------------------
                কৃষ্ণ পুরুষোত্তম। জগতগুরু। একমাত্র পুরুষ। সমস্ত ভক্ত তাঁর রাধা। রাধা হলো সেই সাধনার নাম যে সাধনা সর্বস্ব বিলিয়ে দেয় ভগবানের পায়ে। সম্পূর্ণ শরণাগত হওয়া হলো রাধা ভাব।  সেই অর্থে শুধু মহাপ্রভু নন সমস্ত কৃষ্ণ ভক্তই রাধা ভাবে সমৃদ্ধ। 
              বৃন্দাবন গিয়ে মহা বিপদে পড়লেন নিত্যানন্দ। এমন বিপদ নতুন নয় আর তাঁর কাছে। শ্রী চৈতন্যের যখন চব্বিশ বছর বয়স তখন তিনি সন্ন্যাস নিয়েছেন। আর তারপর থেকে যখন তখন তিনি বাহ্যজ্ঞান শুন্য হয়ে পড়েন। সেই সমাজ সংস্কারক তেজী একরোখা যুবকটির জায়গা নিয়েছে কোমল কৃষ্ণ প্রাণা ভক্ত। শুধু কৃষ্ণের জন্য বুকফাটা বিলাপ। এক পরম সাধনা। অকারণ কান্না নয়। ভক্ত আর ভগবানের মিলনের মাঝখানে যে বাধা টুকু থাকে তা অতিক্রম করার প্রয়াস হলো অভিসার, আর অভিসারের রাস্তাটুকুর কষ্ট দুঃখ হলো বিলাপ। তাই প্রভুকে আর একা ছাড়তে ভরসা করেন না অন্তরঙ্গ পর্ষদরা। 
     মায়ের আদেশে বৃন্দাবন ছেড়ে পুরী চলে এসে শান্তি নেই মহাপ্রভুর --" জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই" ---পুরীতে জগন্নাথ দেব আছেন বটে, কিন্তু যমুনা কই? কদম তলা কই? কই সে বাঁশির মধুর সুর?অস্থির হয়ে ওঠেন মহাপ্রভু। জগন্নাথ দেবের মধ্যে রয়েছেন সেই শ্যামল সুন্দর চিত চোরা তাঁর কৃষ্ণ। কিন্তু চারিদিকের আবহাওয়ায় নেই সেই মধুর ভাব। পরিবর্তে ব্রাহ্মণ দের আচার সর্বস্ব পূজা নিয়ম কানুনের পাহাড় দেখে মহাপ্রভু দিশাহারা হয়ে গেলেন যেন। 
     জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা চলছে। অগণিত ভক্ত, ঢাক ঢোল কাসরের আওয়াজ আর সঙ্গে সঙ্গে -- জয় জগন্নাথ জয় মহাপ্রভু নীলাচল নাথ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। মহাসমারোহে এগিয়ে চলেছে জগন্নাথ দেবের রথ। ভিড়ের মাঝে  মহাপ্রভু দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ দিয়ে  জল পড়ছে অনর্গল। হঠাৎ তিনি সংস্কৃতে বিরহের শ্লোক পাঠ করতে লাগলেন। সুন্দর সরল প্রেমের শ্লোক--"প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমিকের দেখা হয়েছে, কিন্তু যেখানে দেখা হয়েছে সেই জায়গা প্রেমিকার পছন্দ নয়। এমন এক জায়গা যেখানে পূজো আছে প্রেম নেই।"  অন্তরঙ্গ পার্ষদ ব্যাকুল হয়ে হাত চেপে ধরলেন মহাপ্রভুর গম্ভীর হয়ে উঠলো উড়িয়া ব্রাহ্মণ দের মুখ। মহাপ্রভুকে থামবে কে? মুদিত নয়ন, মুন্ডিত মস্তক, সূর্যের আলোয় ঝকঝকে এক দিব্যকান্তি শরীর, গলায় মালা ---- মূর্তিমান কৃষ্ণ যেন -- আক্ষেপ করেই চলেছেন ---" হে কৃষ্ণ জগদ্বন্ধু, হে বনমালী, চলো আমরা সেই খানে ফিরে যাই। রেবা নদীর তীরে বেতসী লতার কুঞ্জ বন , চৈত্র পূর্ণিমাতে চলো সেখানে ফিরে যাই।
    জগন্নাথের রথের সামনে এক পাগল করা দৈবী ভাবের মধ্যে কেমন অনাচার? কেমন সন্ন্যাসী যিনি বলেন যে প্রেমহীন নীলাচল পুরীতে তিনি থাকতে চান না? আর এই সন্ন্যাসী এমন প্রাণ মন দিয়ে কাঁদছেন, ডাকছেন, গাইছেন যে সমস্ত ভক্তকুল মনে করছে জগন্নাথ দেব আর রথে উপবিষ্ট নেই। নেমে এসেছেন সন্ন্যাসীর কাছে
    মহা রাগ ধরে গেলো পুরীর পাণ্ডাদের। তো সমূহ বিপদ উপস্থিত হলো  নীলাচলে!  এতো দিনের তৈরী করা সংস্কার, নিয়ম সব ভেসে যাবে নাকি ওই প্রেমের জোয়ারে? ছিঃ ছিঃ। ব্যাটা আবার মুসলমান নিয়ে ঘোরে। পুরীর মন্দিরে মুসলমান ঢোকাই নিষেধ। আর এই গৌড়ীয় সন্ন্যাসীর সঙ্গে থাকে রূপ সনাতন যবন হরিদাস। রসাতলে যাবে নাকি সব? আরো দেখা যাচ্ছে এই নবীন সন্ন্যাসী যেখানেই যায় মানুষ মন্ত্র মুগ্ধের মতো পেছন পেছন যায়। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই নাকি লাগেনা শুধু প্রাণ দিয়ে ডাকলেই নাকি ভগবান দর্শন দেবেন। তাহলে পান্ডাদের কোনো কাজ নেই? আরে! পান্ডা টপকে জগন্নাথের কাছে পৌঁছনো যাবে শুধু নাম স্মরণ করে? অবাক কান্ড হলো, লোক শুনছে, বিশ্বাসও করছে। মহা চিন্তায় পড়ে গেলো পুরীর শক্তিশালী পান্ডা সমাজ। যাদের ভয়ে পুরীর রাজা পর্যন্ত সতর্ক থাকেন, তাঁদের কিনা পরোয়া করেন না চৈতন্য নামের সন্ন্যাসী? রাতের অন্ধকারে পান্ডা সমাজ বসলো গভীর আলোচনায়। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা আয় হয় মন্দির থেকে, সেগুলো রক্ষা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। তাড়াতে হবে পুরিধাম থেকে চৈতন্যদেব কে। কিন্তু উপায়? অগণিত ভক্ত মহাপ্রভুর। পনের বছর ধরে আছেন। অর্ধেক মানুষ  গৌড়ীয় ধর্মকে আপন করে নিচ্ছে। তবে? করণীয় কি? পাণ্ডাদের মাথা গুলো কাছাকাছি সরে আসে। রাতের অন্ধকার আরো ঘন হয়ে ওঠে। দূরে সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে কেঁদে ওঠে অলুক্ষুনে শেয়াল। চমকে ওঠে ভক্ত বৃন্দ। মহাপ্রভু ঘরে নেই। কোথায় গেলেন তিনি? শরীর ভালো নেই তাঁর। মন ছুটে গেছে বৃন্দাবনে। শ্রী রাধিকার বিরহ, তাঁর শরণাগতি, কৃষ্ণের প্রতি প্রেম মহাপ্রভুর প্রতি রোমকূপে ফুটে উঠেছে। আজকাল প্রায়ই তাঁর জ্ঞান থাকে না। বিছানায় শুলেও ঘুমোন না। তাঁর কৃষ্ণ যদি কিছু চেয়ে বসেন রাতে? এক পাশ ফিরে জেগে শুয়ে থাকেন। অন্য পাশে কৃষ্ণ শুয়ে আছে। যদি ঘুম ভেঙে যায় প্রিয়তমের। এক পাশ ফিরে শুতে শুতে ঘা হয়ে গেছে মহাপ্রভুর। এমত অবস্থায় এই নিশুতি রাতে কোথায় গেলেন তিনি? ব্যাকুল ভক্ত বৃন্দ খুঁজতে বেরিয়ে যায়
*
 সাগর কখনো অন্ধকার হয়না। গভীর রাতে একাকী সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে একথাই ভাবছিলেন মহাপ্রভু। ঢেউয়ের পরে ঢেউ তাদের মাথায় জ্বলছে আলো। ঠিক যেন তাঁর প্রেমিক চূড়ামনির মাথার মুকুট। হা কৃষ্ণ। কোথা কৃষ্ণ। হৃদয় তাঁর আচ্ছন্ন কৃষ্ণ প্রেমে, চির বিরহ কাতর রাধাভাবে তিনি ডুবে আছেন। পাণ্ডাদের ক্রোধের কথা কিছুই তিনি জানেন না। তিনি তো থাকতেও চান না, পুরী ধামে। মায়ের ইচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে তিনি বৃন্দাবনে থাকতে পারলেন না। জগন্নাথ দেবের মধ্যে কৃষ্ণ থাকলেও তিনি ফিরে পেতে চান সেই বৃন্দাবনের মিলন কুঞ্জ গুলির স্মৃতি ----
       " সেই তুমি সেই আমি সে নব সঙ্গম
                তথাপি আমার মন হরে বৃন্দাবন
           ইঁহা লোকারণ্য হাতী ঘোড়া রথধ্বনী
                    তাঁহা পুষ্পবন  ভৃঙ্গ পিক নাদ শুনি।
    তাঁহা গোপগণ সঙ্গে মুরলী বদন। 
         ব্রজে তোমার সঙ্গে যেই সুখ আস্বাদন
             সে সুখ সমুদ্রের ইঁহা নাহি এক কণ।
চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস নিয়েছেন। তারপর ছয় বছর শুধু প্রচার আর প্রচার। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম কে। আজ আর কাজ নয়। তাঁর কাজ শেষ। মানুষ তাঁর নিত্যকর্মের মধ্যে ভগবান কে নিয়ে আসতে পেরেছে। এবার মন চলো নিজ ধামে। এখন কত বয়স তাঁর? পঁয়তাল্লিশ হবে। ঊনত্রিশ বছর বয়স থেকে পুরীতে আছেন। আর নয়। আর নয়। সাগরের জলের মধ্যে  বেজে উঠলো মধুর বাঁশির সুর। প্রিয়তম কৃষ্ণ আর দূরে নেই। এইবার এসেছে সেই মহামিলনের মুহূর্ত। দূর থেকে  কারা আসছে ডাকতে ডাকতে। নির্জন বালিয়াড়ি, দুরন্ত সমুদ্র, এমন মোহময় রাত -- নাঃ। আর ফিরবেন না তিনি। পান্ডার দল ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তিনি চলে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে তাঁর ভক্তবৃন্দ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ধ্বজা মাথা উঁচু করে থাকুক, তিনি চলে যাবেন তাঁর প্রেমিক কৃষ্ণের কাছে।  ধীরে ধীরে  জলের দিকে এগোলেন মহাপ্রভু। সাগরের জল দুহাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলেন শ্ৰী চৈতন্য মহাপ্রভুকে। তিনি চলে যেতে  চাইছিলেন বৃন্দাবন ধামে। সাগর যেন তার কোলে  মহাপ্রভুকে শুইয়ে  সেখানেই পৌঁছে দিতে গেলো। নির্জন বালিয়াড়ি শুন্য বুকে লোনা জলে ভেসে জেগে রইলো একলা।
---------------------------      -------------------------------------
     বিঃদ্রঃ--///--মহাপ্রভুকে পুরী ধামে মার্ডার করা হয়েছিলো বলে অনেকে মনে করেন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন