স্বনির্ভরতা
এবং আজকের নারী
এই বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবেই
আমাকে লিখতে হচ্ছে কিছু কথা । ধারাবাহিক
লেখা যে কত কষ্টের এবং শ্রমসাধ্য তা বুঝতে পারছি এখন । একের পর এক মুখ এসে ভিড় করছে করছে চারপাশে । যাদের নিয়ে একসময় লিখতে
চেয়েছি কিছু কথা । পারিনি । পিছিয়ে এসেছি নানা কারণে । অথচ আমি তো আমার চারপাশে
দেখেছি আপোষহীন লড়াকু কত মহিলা যারা আত্মমর্যাদার প্রশ্নে ত্যাগ করেছে নিজের সংসার
, নিজের ভালোবাসা এমনকী নিজের জীবনও । প্রথমেই মনে পড়ছে চন্দনাদির কথা । যৌথ
পরিবার ছিল তাঁদের । বাবা কাকা জেঠা মিলে সাত সাতটা ভাই । এক বিশাল উঠোন । সেখানে
একান্নটা থালা পড়ত । একটু প্রাচীনপন্থী ধারণা ছিল । মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে খুব
বেশি আগ্রহ ছিলনা তাঁদের । ফলে কোন মেয়েই প্রাথমিকের পর আর হাই স্কুল যাওয়ার সুযোগ
পায়নি । চন্দনাদি ছিল খুব মেধাবী । মুখে মুখে চটপট অঙ্ক করে দিতে পারত । এসব গল্প
আমার শোনা । আমি তার বাল্যকাল দেখিনি । বুড়ো হয়ে যাওয়া চন্দনাদিকে দেখতাম । শিথিল
চামড়া তবু কি টানটান মেরুদণ্ড । মৃত্যুর আগের দিন অবধি এই শিরদাঁড়া বাঁকা হয়নি ।
ঋজুতা হারায় নি । মেধাবী হওয়া সত্তেও তার পড়াশোনা থেমে গিয়েছিল মাঝপথে । মাঝপথে
ঠিক নয় , পথের শুরুতেই । গ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিল হাই স্কুল । নদী পেরিয়ে , ফাঁকা
মাঠ পেরিয়ে শরবনের পাশ দিয়ে যে রাস্তা সেই রাস্তা পেরিয়ে । চন্দনা জেদ ধরেছিল –
আমি যাবই স্কুলে । বাবা কাকারা ধমকে উঠেছিল – অতদূর । কার সাথে যাবি শুনি ? কোন মেয়েকে দেখেছিস ইস্কুলে যেতে ?
-
কেউ না যাক , আমি যাব ।
- কে তোকে দিয়ে আসবে ওই দূরের স্কুলে ?
– কেন ছেলেদের সাথে যাব ?
ঘরের সবাই চমকে উঠেছিল তার কথায় – মেয়ের আস্পর্ধা তো কম নয় । বন্ধ হয়ে গেল চন্দনাদির পড়াশোনা । শুধু বন্ধই
হল না , অল্পবয়সে তের কি চৌদ্দ বছরে বিয়েও
হয়ে গেল তার । বিশাল অবস্থাপন্ন শ্বশুরবাড়ি ।চারদিকে ঐশ্বর্য । আঁটাকল তেলকল থেকে
আরম্ভ করে খান দশ বারো বিজনেস । তবু বিয়ের সাত বছরের মাথায় চন্দনাদি ফিরে এল বাপের বাড়িতে । বর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে । চন্দনাদি শুধু মৃদু
প্রতিবাদ করে বলছিল – তুমি তো একবারটি আমাকে জানাতে পারতে ?
-
কি লাভ হত শুনি তুই কি বাচ্চা বিয়োতে পারবি ? সে মুরাদ কি তোর আছে ?
-
এখনই তো সময় চলে যায়নি ।
-
তোকে তো তাড়িয়ে দিচ্ছি নে বাপু , থাক , আরাম করে রাজরাণীর
মতো থাক । বাড়ির কাজকম্ম দেখাশোনা কর ।
রাজরানী হয়ে থাকা আর চন্দনাদির হয়নি । শূন্য স্তব্ধতার
ভেতর সে জানত একটিই আশ্রয়- মা । তাই মায়ের কাছেই ফিরে এসেছিল । ততদিনে পরিবার ভেঙে
গেছে । বাবা ত্যগ করেছেন ইহলোকের মায়া ।ছিন্নবিচ্ছিন্ন পরিবারে আর্থিক অবস্থাও
নড়বরে । আজ জুটেছে কাল কি খাবে কালের ঘরে শনি । সেলাই দিদিমণি নয় এমনকী ভাইয়েদের
সংসারেও নয় , একান্ত নিভৃত আশ্রয়ে মা কে
নিয়েই শুরু হয়েছিল তার সংসার । মুড়ি ভেজে , ছোলা ভাজা মটর ভাজা বিক্রি করেই দিনাতিপাত করত । তবু
ঠোঁটের কোণে সবসময় লেগে থাকত এক চিলতে হাসি । আমি যখন একটু বড় হলাম । যখন অল্প
স্বল্প লিখতে শুরু করলাম । তখন মনে হল চন্দনাদিকে নিয়েও একটা গল্প হয় । সে গল্প
লেখা হয়নি । কিন্তু তাকে দেখার চেষ্টা করতাম । কখনও সরাসরি , কখনও আড়াল থেকে ।
কখনও শব্দের ভেতর থেকে বিযুক্ত নিঃশ্বাসের শব্দে । না , কখনোই কোন আফসোস দেখিনি
তার মধ্যে । ছোট খাটো যোগ বিয়োগ বা সরলের অঙ্কগুলো ঝটপট করে দিত এক নিমেষে । আমি
তাকিয়ে থাকতাম তার চোখদুটোর দিকে যেখানে হিরে মাণিক জ্বলত । হাসতে হাসতে বলত –
কতদিন আগে শিখেছি , এখনও মনে আছে , বল ।
-
তুমি আর পড়াশোনা করলে না কেন ?
-
কি হত , আমার কি
ল্যাজ গজাত ?
না , মানে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে ...... কথাগুলো
মুখের ভেতর এলেও বলতে পারিনি । আত্মমর্যাদা এবং স্বনির্ভরতার এত জ্বলন্ত নমুনাকে কি এসব কথা বলা মানায় ? আমি শুধু প্রণত ভঙ্গিমায় তার পায়ের কাছে এসে
দাঁড়াই । এই স্বনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসী নারী তো আবহমান সময়ের ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন