নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সৃজনশীলতা
আমাদের পাপিয়া
সামন্ত ছিল একসময় পাড়ার ছোটো বড়, বুড়ো কচি কাঁচা পুরুষদের বুকের ধড়ফড়ানি আর
মহিলাদের আইডল। সুন্দরী, সুগায়িকা এবং হাস্যময়ী ছিল পাপিয়াদি। আমাদের ছোটোবেলার
দেখা চোখে হালকা হালকা মনে পড়ে পথচলতি মানুষ (মূলত পুরুশ)জন থেকে যে কটূক্তি উড়ে
আসত তার পরিণাম স্বরূপ সেই ব্যক্তিটিকে ‘কাকু’, ‘মামা’, ‘দাদু’ ‘জেঠু’, ‘ভাই’,
‘দাদা’ কিছু না কিছু সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়েই পাপিয়াদি হাল ছাড়ত। ফলস্বরূপ ‘পাপিয়া
সামন্ত খারাপ’ এটা বলার সুযোগ কারোরই বিশেষ একটা থাকত না। আপন করে নেওয়া কাকে বলে
পাপিয়া দি’কে দেখে শিখতে হত।
সেই পাপিয়াদি’র কলেজ পড়াশোনা শেষ হতে না
হতেই ধানবাদ নিবাসী উচ্চবংশ মর্যাদাসম্পন্ন, ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে। আমাদের পাড়াটা যেন অন্ধকার
হয়ে গেল। বিয়ের পরে অষ্টমঙ্গলায় গয়না, শাড়ি, সিঁদুর পরিহিত পাপিয়াদির সুখী
চেহারাটা সবাই দেখেছিল।
সময়ের স্রোতে
মানুষ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই আমিও আমার ছোটবেলা থেকে কিশোরীবেলায় পা
রেখেছি। তখন একদিন পাড়ার গলিতে দেখতে পেলাম পাপিয়াদিকে। শাঁখা সিঁদুর নেই, রুগ্ন
মলিন বেশ, চোখের নীচে কালি, গলায় কালশিটে দাগ, চাউনিতে মানসিক ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ।
শোনা গেল পাপিয়াদির স্বামী আর শাশুড়ির অমানবিক অত্যাচারের খবর। বিয়ের অল্প
কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী আর শাশুড়ির নানা অর্থনৈতিক আবদার পাপিয়াদিকে মেটাতে হয়
বাপের বাড়ির সাহায্যে। সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্র সব পাপিয়াদির মা বাবার কাছে
থেকে তারা আদায় করতে থাকে। কিন্তু এই চাহিদা যখন টাকা আর সোনার গয়নায় গিয়ে দাঁড়ায়
তখন পাপিয়াদির সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। সে প্রতিবাদী হলে তার কপালে জোটে গরম
খুন্তির ছ্যাকা, পিঠে সিগারেটের পোড়া দাগ, চড়, থাপ্পড়, রডের বাড়ি।
এহেন অত্যাচার
অসহ্য হওয়ায় পাপিয়াদি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বামী আর শাশুড়ির কাছে সে
ছিল সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তাই শ্বশুরবাড়ীর চিলে কোঠার ঘুপচিতে তাকে তালাবন্দী করে
রাখে বিচক্ষণ স্বামী। যাতে করে আত্মহত্যার সুযোগ তো দূরের কথা যেন পালাতেও না
পারে।
বহু যন্ত্রণা
কষ্ট সয়ে প্রতিবেশী এক মহিলার সহায়তায় রাতের অন্ধকারে গোপনে চোরের মত পাপিয়াদি
বাপের বাড়ি আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিবাহিতা মেয়েদের বাপের বাড়ি এসে থাকার মত
দুর্দশা আর কিছু হয় না। আত্মীয় পরিজনের বাঁকা দৃষ্টি, পাড়া প্রতিবেশীর কথার জ্বলন
সহ্য করতে করতে ক্ষোভ, অসহায়তা, ঘৃণায় কুঁকড়ে থাকা পাপিয়াদি মনে মনে বিদ্রোহী হয়ে।
তার গ্রাজুয়েশনের বিদ্যা দিয়ে সে টিউশনি শুরু করে। প্রথমে সমাজের তথাকথিত ভদ্র,
সভ্য, শিক্ষিতরা তাদের বাড়ির ছেলে মেয়েদের পাপিয়াদির মত ‘খারাপ মেয়ে’র কাছে পড়তে
দিত না। তাই অভাবী ও গরীব পরিবারের ছেলেমেয়েগুলো নিয়েই সে তার কাজ শুরু করে। ধীরে
ধীরে বহুদিনের চেষ্টায় এবং রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তির সহায়তায় ‘পাপিয়া কোচিং সেন্টার’
এখন আমাদের এলাকায় বেশ নাম করেছে। এখানে
গরীব ছেলেমেয়েরা খুব অল্প পয়সাতেই পড়ার সুযোগ পায়। আর আমাদের বহু চেনা
বিবাহবিচ্ছিন্না সেই পাপিয়াদি মাথা উঁচু করে হাসি মুখে এলাকা মাতিয়ে রাখে।
-0-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন