পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নীপবীথি ভৌমিক



#সেকালের বাঙালী বিয়ে

     “বিবাহ “ শব্দটি বি –পূর্বক বহ ধাতু এবং ঘঞ্‌ প্রত্যয় যোগে গঠিত ।যেহেতু বহ ধাতুর অর্থ বহন করা এবং বি উপসর্গের অর্থ বিশেষ রূপে , তাই “ বিবাহ” শব্দের অর্থ বহন করা এক পবিত্র সম্পর্ক । এক পবিত্র শ্লোকের ধারাপাত।  অক্ষরে অক্ষরে  জড়িয়ে আছে পরম বন্ধন কিন্তু , মনুষ্য সমাজে বিয়ের প্রচলন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতধারা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সময়ে কখনো বলা হয়েছে পরিবারের কারণেই বিবাহের প্রচলন , আবার কখনো বলা হয়েছে বিয়ের কারণেই পরিবারের ভাবনা যাইহোক , মত পার্থক্য তো থাকতেই পারে , এবং সেটাই স্বাভাবিক

    মনুষ্য সমাজে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে জীবজনিত কারণে বিবাহের মধ্য দিয়ে নারী পুরুষের সম্পর্ককে সামাজিক রূপ ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে আনেক পরে আদিম জন জাতির কাছে খাদ্য সংগ্রহ করাই ছিলো খুবই কঠিণ ব্যাপার মূলত , পশু খাদ্যই ভক্ষ্ণ করতো তারা  তাই পশু শিকারের উদ্দেশ্যে তাদের যেতে হতো দূর থেকে দূরান্তে এবং সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহায় ও রক্ষকহীন নারীকে একা পেয়ে অন্যকোনো পুরুষ বলপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে গেলে রক্তপাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো এরূপ পরিস্থিতি বর্জনের জন্যই মনুষ্য সমাজে বিয়ের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দান করা হয়েছে বিখ্যাত নৃতত্ববিদ ওয়ের্স্টারমার্কের মতে –“ পরিবার গঠন করে স্ত্রী ও পুরুষ একত্রে  বাস করা থেকেই বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে, বিবাহ প্রথা থেকে পরিবারের সূচনা হয়নি “   মহাভারতে বিবৃত শ্বেতকেতু উপাখ্যান থেকেও আমরা এর সমর্থন পাই যেখানে বলা হয়েছে , শ্বেতকেতুই ভারতে প্রথম বিবাহ প্রথার প্রচলন করেন , কিন্তু বিবৃত কাহিনী থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে , বিবাহের আগে শ্বেতকেতু তাঁর মাতা পিতার সহিত পরিবারের মধ্যেই থাকতেন যদিও , পণ্ডিত সমাজে আজ একবাক্যে স্বীকৃত যে পরিবারের থেকেই বিবাহ প্রথার উদ্ভব , তবুও , বাখোফেন , মরগান প্রমুখ নৃতত্ববিদ একদা একথা স্বীকার করতে চাননি

       যাইহোক , স্মৃতি শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ “ মনুসংহিতায়” মোট আট প্রকার বিয়ের কথা উল্লেখ আছে। সেগুলো হলো , যথাঃ- ১) ব্রাহ্ম
                                 ২) আর্য
                                 ৩) প্রাজাপত্য
                                 ৪)আসুর
                                 ৫) গান্ধর্ব
                                 ৬) রাক্ষস
                                 ৭) দৈব
                                 ৮ ) পৈশাচ
বর্তমানে মনুষ্য সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই স্বীকৃত ও লক্ষণীয় । বিবাহের মাধ্যমে একজন নারী ও পুরুষ সারাজীবন একসাথে সুখ – দুঃখে থাকার প্রতিজ্ঞা করেন অগ্নিকে সাক্ষী রেখে ।
  “ যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম
  যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ‘’। অর্থাৎ তোমার এই  হৃদয় আমার হোক আর আমার এই হৃদয়ও তোমার হোক।

 বিবাহের সূচনা নিয়ে যেমন নানান মতবাদ আছে , তেমনি কালে কালে বিয়ের রীতিনীতি আয়োজনের ক্রমধারায় পরির্বতন লক্ষণীয়আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে বিয়ে প্রচলিত ছিলো দুটো অসমবয়সী নারী পুরুষের ভেতর  সেক্ষেত্রে হয়তো কন্যার বয়স চার , পাত্রের বয়স  পনেরো কিংবা আরো একটু বেশী আমাদের ঠাকুমা দিদিমার মুখে শোনা গল্প থেকেই বোঝা যায় সেই সময়ের বৈবাহিক পদ্ধতি সেই সময়ে বিয়ের কণেকে সাজানো হতো লাল চেলিতে , তবে বরের সাজ হতো বাঙালীর চির পরিচিত ধুতিতেই স্বর্ণালঙ্কারের প্রচলন যুগে যুগেই ছিলো

   যৌতুক প্রথা ছিলো বঙ্গদেশের বহু প্রাচীন প্রথা   শার্লি লিণ্ডেনবম পরিচালিত এক গবেষণায়  জানা যায় , বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিলো কৃষি নির্ভর আর বিবাহযোগ্য পাত্রের আয়ের উৎস তেমন ভালো ছিলোনা অন্যদিকে বিবাহযোগ্য পাত্রী পাওয়া যেত হাতেগোণা তাই সে সময় পাত্রপক্ষকে পাত্রীপক্ষকেই যৌতুক দিতে হতো পরে অবশ্য পরিবেশ অর্থনীতির  পরিবর্তন ঘটলে এই ধারারও আমূল পরিবর্তন ঘটে

     বঙ্গদেশে  বিয়ের ছাপানো আমন্ত্রণ পত্রের প্রচলন উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি । আগে আমন্ত্রিতদের বাড়িতে সশরীরে গিয়ে তেল , হলুদ, পান, সুপারি হাতে দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতে হতো । তাছাড়া , নিমন্ত্রিত মেয়েদের তাদের বাড়ি থেকে গাড়ী করে নিয়ে আসতে হতো এবং ভোজনের পর আবার তাদের গাড়িতে করেই  পৌঁছিয়ে দিতে হতো ।আর যেসব নিমন্ত্রিতরা দূর থেকে আসতেন , তাদের গাড়ী ভাড়া বাবদ কিছু অর্থ দিতে হতো কর্মকর্তাকে । প্রাচীন রীতিনুযায়ী হিন্দু বাঙ্গালী বিয়েতে পাত্র পাত্রী দেখা , লগ্নপত্র/ পাটীপত্র লেখার মতো প্রাথমিক দেখাশোনা পর্ব শেষ হওয়ার পরেই আসে নিমন্ত্রণ পর্ব ।  একেবারে প্রথম দিকের আমন্ত্রণ পত্র কেমন ছিলো তা জানা না গেলেও উনিশ শতকের শেষ ভাগ ও তার পরর্বতী সময়ের কয়েকটি বয়ান দেখলেই সেই সময়ের আমন্ত্রণ পত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় । লক্ষ্ণীয় যে এই সময়ের আমন্ত্রণ পত্রের কোথাও  পাত্র কিংবা পাত্রীর বংশ পরিচয় উল্লেখ থাকতো না।

    বিবাহের শাস্ত্রীয় আচার  ও মেয়েদের দ্বারা সম্পন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সমূহ এখনও বজায় আছে বটে , কিন্তু বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে ভোজনের ব্যাপারে ।আগে বিয়েতে ফলার ও ভাতের পরির্বতে লুচির চল ছিলো , এমনকি রান্নাবান্নার ক্ষেত্রেও বাড়ির গিন্নিদের পরির্বতে সেখানে আসে উড়িয়া বামুন । সামাজিক নিয়ম এবং জাতপাতের চলমান ধারাকে মাথায় রেখে স্বাভাবিক ভাবেই ব্রাহ্মণরাই অগ্রাধিকার পেতো। সবার প্রথমেই তাদেরকেই ভোজনে আহ্বান করা হতো ।  গৃহকর্তা কে অতিথিবর্গের সকলের সামনে গিয়ে বলতে হতো _____” আপনাদের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ আছেন , তাঁদের গাত্রোস্থান করতে আদেশ হউক”। পরিবেশনও সম্পন্ন হতো ব্রাহ্মণদের দ্বারা , ভোজনের শেষে তাদের দক্ষিণা দানের রেয়াজও ছিলো । খাওয়ানো হতো কর্মকর্তার বাড়িতেই। মাটিতেই কুশাসন বিছিয়ে  কলাপাতায় খাওয়ানো হতো । পাতার সামনে জলভর্তি মাটির গেলাস, দই ও ক্ষীর পরিবেশনের জন্য মাটির খুরি, যা আজ অদ্দৃশ্য থেকেও বেশি । খাদ্য তালিকায় থাকতো , লুচি, বেগুন  ভাজা , ডাল , আলুর দম, মাছের কালিয়া এবং মিষ্টান্নের ভেতর, রসগোল্লা, মিহিদানা, লেডিকেনী ইত্যাদি । বাড়িতেই বসত ভিয়েন। মহিলাদের খাওয়ার জন্য ছিলো পৃথক পংক্তি। বর আসতো চতুর্দ্দোলায় চেপে , বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর কনে শ্বশুর বাড়ী যেতেন মহাপায়ার করে ।

      লৌকিকতার ক্ষেত্রটিও ছিলো তাৎপর্যময়।আটআনা বা একটাকা দিয়ে মূলত তা সারা হতো। বিশিষ্টজনরা চারটাকা পর্যন্ত দিতেন। পরে টাকার জায়গায় বই আসে। তবে সবথেকে চমকপ্রদ যেটা ছিলো, সেগুলো আসলে “ কবিত্বপূর্ণ “ কাগজ। এগুলো হয় সোনালী রঙের কিংবা রুমালের ন্যায় এক প্রকারের কাগজের ওপর লাল কালি বা সোনার জলে ছাপা কবিতা , ছড়া বা বিবাহ সম্পর্কিত যৌতূক ।দুই পরিবারের মানদণ্ড ধার্য করা হতো এগুলোর উপর।কেননা এর মাধ্যমেই উপস্থিত স্বজনেরা বিচার করতেন কোন পরিবার কখানা উপহার বিলি করেছেন।

---তবুও বিবাহ , যার অক্ষরে অক্ষরে জড়িয়ে থাকে পবিত্র এক বন্ধন !


প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু




      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন