পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

তুষার সরদার

কাল-নিধন
                                                           

         কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসের উচ্চপদস্থ চেয়ারে বসা অবস্থা থেকে তুলে দাঁড়-করিয়ে-দেওয়া কটাক্ষপাতে, গ্লাসভর্তি জলের পিপাসা পাইয়ে দেবার দেহভঙ্গি নিয়ে সে বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে আসতো বিহানের দিকে। কাছে এসে সে অপরূপ ভাবে থমকে দাঁড়াতো। চোখ, মুখ, গলা, দেহ সব কিছুর সাহায্যে অনিবার গলায় বলতো, -
-আজ, দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোক্যাল -।
         জোরে একটা ধড়াস শব্দ হয়। শব্দটা শুধু বিহান শুনতে পায়। কারণ শব্দটা হয় তার বুকের গভীরে কোথাও। তারপর সেই ধড়াস শব্দটার শতশত প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যেতে থাকে বিহানের শরীরের সবকটি কোণায় - আনাচে কানাচে। কোনমতে সে বলে ,-
-আচ্ছা। কোন বগি?
-পাঁচের শেষে - ছয়ের প্রথমে।
        কথাটুকু শেষ করে সুষীম ছন্দে হেঁটে সে চলে যায়। অফিসে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। সে একজন সাধারণ করণিক। কিন্তু নারী-পুরুষের আকর্ষণ কবেই বা এইসব বা অন্যসব বাহ্যিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে এগিয়েছে? বিশেষতঃ যে আকষর্ণের বেশির ভাগটাই এখনো পর্যন্ত জৈবিক হয়ে যায়নি।

ছন্দার কাছেই বিহান শুনেছে ছন্দার সমবয়সি বন্ধুবান্ধবদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে, এমনকী তাদের বাচ্ছা-কাচ্চাও নার্সারিতে ভর্তি হয়ে গেছে। ছন্দার বিয়ের কথাবার্তা বা সম্বন্ধ আনাআনি চললেও এখনও পর্যন্ত বিয়ে ঠিক হয়নি। তবে ছন্দা কী তেমন সুন্দরী নয়? ঠিক জানে না বিহান। তবে ছন্দার চোখ, অধরোষ্ঠ, কণ্ঠস্বর, হাসির শব্দ, আর বিশেষ করে ছন্দার কবিতাপ্রিয়তা খুব টানে বিহানকে। ছন্দার অতি সাধারণ রূপ তারই দু’একটি গুণের স্পর্শে বিহানের কাছে বড়ো মধুর হয়ে উঠতো।
খুব ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা তাদের দুজনের এই সম্পর্কের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে এইভাবে বলা যায় যে, ছন্দা বিহানের সঙ্গে এপর্যন্ত মধ্যমপ্রকার একান্ত সময় কাটিয়ে আসছে। ছন্দার সঙ্গে বিহানের বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। তবুও ছন্দার সঙ্গে ওইরকম ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানোর ডাকে সাড়া দিতে বিহানের পাপবোধ হয় না। কেন হয় না কে জানে? পাপবোধটা আসলে কীভাবে নির্ধারিত হয়? পাপের যথাযথ সংজ্ঞা ঠিক কীরকম?

দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোক্যাল। পাঁচনম্বর বগির পিছনের দিকের এক জানালার ধারের সিটে ছন্দা বসেছে। পাশে খুব ঘেঁষে বিহান। একটু কম ঘেঁষে বসলেই সে বিহানকে বলে, -‘ওভাবে সাতমাইল দূরে বসে আছো কেন? আমি কী তোমার কাছে অস্পৃশ্য নাকি?’
এইভাবে বসে তারা একসাথে শেওড়াফুলি স্টেশন পর্যন্ত যাবে। তারপর এই ট্রেনেই আবার দুজনেই যে যার অফিসে ঢোকার জন্য হাওড়ায় ফিরে আসবে। এই গায়ে-গায়ে পাশাপাশি ট্রেনের সিটে বসে যাওয়া-আসাটাই হচ্ছে সেই ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানো।
        শেওড়াফুলি লোক্যালের এই যাওয়া-আসার পথে খোলা জানালা দিয়ে তারা চৈত্রের বাতাস ডেকে এনে গায়ে মাখে। লাল অথবা কমলা আগুন লেগে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া দু’জোড়া চোখ দিয়ে তারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, পীতভূষণ রাধাচূড়ার রূপে একসঙ্গে বিমোহিত হয়। বিহানের গায়ে খুব ঘন হয়ে বসে থাকা ছন্দার অঙ্গগন্ধে বিভোর হয়ে ওঠা বিহানের উতল বুকে কত না কলরব জাগে। ছন্দা সেসব শুনতে পায় না। সেসময়ে ছন্দার নিজের ভিতরে কিছু কি হয়?

ছন্দা কমলালেবু খেতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু চৈত্রের কমলালেবু ছোট হয়। টকও হতে পারে। শেওড়াফুলি লোক্যালে কমলালেবুওলা উঠলে ছন্দা তাকে ডাকবেই। কীভাবে জানে না বিহান, কমলালেবুর ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে ঠিক মিষ্টি লেবুগুলোই ছন্দা বেছে নেয়। আর কিছুতেই বিহানকে সে লেবুর দাম দিতে দেয় না। সব বারেই বলে, -
-‘আমি তোমাক খাওয়াবো।’
        কমলালেবুর কোয়াগুলো ছাড়িয়ে আঁশগুলো সযত্নে ফেলে দিয়ে একট্রেন লোকের জোড়া জোড়া চোখের মধ্যে সে নিজের হাতে বিহানের মুখে তুলে দিয়ে দিয়ে সত্যিই খাওয়ায়, - নিজেও খায়।
ছন্দার বুক দেখতে বড়ো সুন্দর। বিহান তাকিয়ে ফেলে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছন্দা কিভাবে যেন সেটা ঠিক বুঝতে পারে। তখন ওর দিকে থাকা বিহানের হাতটা ছন্দা তার শাড়ির আঁচলের আড়াল করে টেনে নিয়ে ওর গাবলুগুবলু নরম বুকের নীচের দিকটাতে ছোঁয়ায়, ছুঁইয়ে ধরেই থাকে। বিহানের নিতান্ত বোকাটে হাত সেসময় যথাগন্তব্যে ঘুরে বেড়াবার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠার বদলে প্রায় অবশ আর সমর্পিত হয়ে পড়ে। তখনও ছন্দাকে শারীরিকভাবে পাবার কোনরকম ইচ্ছা বিহানকে দখল করে বসেনি। তখনও ঠিকমত সে বুঝে উঠতে পারেনি ছন্দার বুক শুধুই মাংসের আঁষটে গন্ধে ভরা কিনা।

বেশ কিছুদিন এইভাবে কেটে গেছে। শুধুমাত্র শেওড়াফুলি লোক্যালই ছিল তাদের নিভৃত কূজনের জায়গা। সিনেমা হলের আবছা আঁধারে বা কোন পার্কের একান্ত নিভৃতিতে ছন্দাকে সঙ্গী করার ইচ্ছা বিহানকে কখনো হাতছানি জানায়নি। ছন্দা নিজেও সেসব প্রস্তাব কখনও দেয়নি। তবে শেওড়াফুলি লোক্যাল ছাড়া তারা দুজনে একদিন ছন্দার দৈনিক যাওয়া-আসার পথে মালিয়া নামের এক অনাদৃত স্টেশনে নেমে একটা গাছের তলায় কিছুক্ষণ পাশপাশি বসেছিল।
        যাত্রীবিরল সেই স্টেশনের একদিকে একটা গাছের তলায় বসে তারা সেদিন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিল। সেসব কথার মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। তবে ছন্দা একবার হঠাৎ একটা কথা বলেছিল, -আমি তোমার ঘর ভাঙতে চাই না। এটা কী ছন্দার উদারতা ছিল? কোন মেয়ে শুধু ইচ্ছা করলেই কী কোনো পুরুষের ঘর ভেঙে দিতে পারে? কিংবা কোন পুরুষের কী শুধু ইচ্ছা হলেই সে কোনো মেয়ের ঘর ভেঙে দিতে পারে?  বিহান জানে না। হয়তো ছন্দাও জানতো না।
        সেদিন উল্লেখযোগ্য কথা কিছু না হলেও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, অন্ততঃ বিহানের কাছে। সেদিন মাঝখানে খানিক ফাঁক রেখে তারা দুজন মুখোমুখি বসেছিল। কথাবার্তার মাঝখানে বিহানের মহাভাগ্যে গাছের উপর থেকে একটা কাঠপিঁপড়ে হঠাৎ খসে পড়লো ছন্দার ডানদিকের বুকে। পড়েই সেটা ছন্দার গলার দিকে বেয়ে যেতে লাগলো। কাঠপিঁপড়ে কামড় বিহান খেয়েছে। খুবই যন্ত্রণাদায়ক। কোনকিছু না ভেবেই ছন্দার বুক থেকে পিঁপড়েটাকে খপ্‌ করে দু’আঙুলে ধরে নিয়ে ফেলে দিল বিহান....আর ছন্দার বুক ছুঁয়ে ফেললো। ছন্দা বিহানের দিকে তাকিয়ে সে একরকম করে হাসলো – মুখে বললো, - ‘থ্যাঙ্ক ইউ!’

        তার বেশ কিছুদিন পর সেইরকম এক শেওড়াফুলি লোক্যালে যাওয়া-আসার পথে ছন্দা কোনরকম ভূমিকা না করে হঠাৎই বললো,-
-‘শোনো না গো, তোমাকে একটা কথা বলি। মায়ের চাপে পড়ে একটা স্রেফ লোক-দেখানো বিয়ে করতে হচ্ছে আমাকে। তুমি তো জানোই, মা ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই। শুধু মায়ের কথার জন্য, মায়ের শান্তির জন্যই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হচ্ছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমি কিন্তু একদম মনখারাপ করবেই না। করবে না তো? আমাকে কথা দাও!’
         তখন বাতাসে শীতের প্রথম পরশ লেগেছে। ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে হালকা শীতের পালক তাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছন্দার বিয়ে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় ব্যাপার ছিল। সেটা যে হবে তা বিহান জানতো। সেজন্য বিহানের তেমন মনখারাপের কোন কথা ওঠে না। ছন্দা অবিবাহিত থাকুক এমনটা বিহান কখনও চায়নি। শান্ত গলায় সে বলে,-
-‘তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে এটা আমাকে তুমি বলেছিলে।’
-‘বলেছিলাম বুঝি? তা হতে পারে। সে হোক গে –’
কথা অসমাপ্ত রেখে গায়ের চাদরটা টেনে নিজেকে আরো ভালো করে ঢাকলো ছন্দা। তারপর বিহানের হাতটা সেইরকম ঘনিষ্ঠ ভাবে চাদরের নীচে তার বুকের তলায় টেনে নিয়ে গাঢ় গলায় বললো, -
-‘তুমিই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। প্রথম তোমাকেই আমি মনের দরজা খুলে ভিতরে ডেকেছি। মন্ত্রপড়ে বিয়ে না হলেও তুমিই কিন্তু আমার আসল বর! এই যে পাত্র, সে থাকে সেই জলপাইগুড়িতে। সেখানেই তার চাকরি। বিয়ের পরেই আবার সেখানেই সে ফিরে যাবে। কিন্তু আমি যাবো না। আমার চাকরি তো এখানে। তার উপর আমার মা এখানেই থাকবে। তাই বিয়ের পরও আমি মায়ের কাছেই থাকবো। এইরকম কথাবার্তা আগেভাগেই বলেকয়ে তবে বিয়েটা সেট্‌ল করা হয়েছে। বিয়ের পর আমি তোমার সঙ্গেই - মানে - আমার আসল বরের সঙ্গেই হানিমুনে যাবো। হানিমুনে আমরা কিন্তু পুরীতে যাবো না। ওখানে বড্ড বেশি ভিড়। আমরা যাবো - গোপালপুর-অন-সী! তুমি কী বলো?’ 
        বক্তব্যের আকস্মিকতায়, ওজনে এবং প্রস্তাবের অভিনবত্বে বিহান ঘাবড়ে গিয়ে এই বিষয়ে যথোচিত কিছুই বলে উঠতে পারলো না। কিন্তু জবাব একটা দিতে হয়। একটু চুপ থাকার পর ছন্দার শেষ কথাটুকুর জবাবে বিহান আস্তে আস্তে বললো, -
-‘এ ব্যাপারে এখন কিছু না বলাই ভালো। তবে তুমি যদি একান্তই তাই চাও সেটা পরে কোন একসময় ভেবেটেবে দেখা যাবে। কিন্তু কবে তোমার ওই বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে?’
-‘ধুর্‌! তার এখন বেশ দেরি আছে। কেন বলো তো? আমার বিয়েতে তোমার খুব তাড়া আছে বুঝি? আচ্ছা! তাহলে যত তাড়াতাড়ি আমাকে সম্ভব তুমি আমাকে পর করে দিতে চাও?’
-‘না, সে কথা নয়। এমনিই জিগ্যেস করছি।’

        তারপর বোধহয় মাসখানেক পরে ছন্দার সেই ‘বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে বিয়েটা’ হয়ে গেল। সে বিয়েতে বিহান যায়নি। কারণ ছন্দার  বিশেষ আপত্তি ছিল - ছন্দার মন্তব্য অনুযায়ী - ওই ‘লোক-দেখানো বিয়েটা’তে যেতে।
        বিয়ের পর ছন্দা তার দ্বিতীয় এবং নকল বরের সঙ্গে পুরীতে লম্বা হানিমুনে গেল। বাড়ি ফিরে এসে আরো কতদিন ছুটিতে কাটালো। তারপর একদিন অফিসে জয়েন করে আসল হানিমুনের সময় তোলা দুজনের অগুনতি ঘনিষ্ট ফোটো দেখালো সবাইকে। ইচ্ছা করলে বিহানও সেসব ফোটো দেখতে পারে বলে জানালো। দিন কয়েক পর বিহান নিজেই ছন্দাকে বললো,-
-‘গোপালপুর-অন-সী যাবার ব্যাপারটা একেবারেই বাদ দেওয়া যাক।’
-‘তুমি ঠিক বলেছো গো। খুব ইচ্ছা থাকলেও এখন আর গোপালপুর-অন-সী যাওয়া যাবে না। অবশ্য শুধু গোপালপুর কেন, আমার তো এখন কোত্থাও যাওয়া একেবারেই বারণ! এমন কী বাড়তি ট্রেন-জার্নিও বারণ। এটা প্রথম মাস তো! খুব সাবধানে থাকা উচিত। অবশ্য গাইনির ডাক্তার বলেছে পুরো দশমাসই আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।’
-‘তাহলে, - তুমি আগে যেসব কথা আমাকে বলেছিলে –’
-‘ধুস্‌! কী যে সব কথা বলো তার ঠিক নেই। তুমি নিজেই তো দেখলে গো, আমার কত লেট-ম্যারেজ হল। যতদিন সেটা না হচ্ছিল ততদিন আমার টাইম-পাসটাও তো যথেষ্ট জরুরি ছিল না কী....তোমার কি ফিলিংস বলে কিছুই নেই!’
_________________________


 ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার:  Cesar Legaspi

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন