পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                  উল্টে গেলে-৪ 

    তা টুজোপুজো তো দিব্যি কেটে গেল দৌড়ে দৌড়ে টুজোপুজোকে চেন না? টুজো হল ওই যে সেই দুজো ছিল না, তার নাতি দুজোকে চেন নিশ্চই, না চিনলে আর ক্রিকেট ক্রিকেট খেলিখেলা কর না! এই টুজো কিন্তু বংশগতভাবে একটা গুণ পেয়েছে বল ওর হাত থেকে ফস্কে বাউন্ডারির বাইরে কিছুতেই যায় না ওর ভাবলেষহীন মুখ দেখলে মনে হবে, এই যাঃ! ফস্কে গেল বুঝি ক্যাচটা! কিন্তু দেখা গেল ঠিক সময়ে ঠিক মত বডি মুভমেন্ট করে ওর দুহাত ঠিক বলের তলায় এঁটে গেল ফেবিকুইকের মত এই টুজো না থাকলে এবারে পুজো তো কার জলে যেন হাবুডুবু খাচ্ছিল আর ভেসেই চলে যাচ্ছিল প্রায় ঠিক দুদিনের মাথায়, যখন পুজো যাই যাই করছে, উড়ে গিয়ে ক্যাঁক করে ধরে ফেলল তার টুঁটি ফলে পুজোর আর ভেসে যাওয়া হল না কেচ্ছার গন্ধ পাচ্ছ না? এইবার সনাতন বাঙালি জেগে উঠবে। পুজো কার জলে কোথায় কেলি করল, কে ভাসাতে গিয়েও তাকে ভাসাতে পারল না...তাহলে সরিয়ে সরিয়ে বলি শোন! রস আর সর হল দুই যমজ ভাই রস গড়ালে সর ফেটে যায়, আর সর পড়লে রস জমে যায় এমনই এদের আদায়-কাঁচকলায় সম্পোক্ক এবার এই আদা আর কাঁচকলা, সর আর রসে মিলে কী কেলেচ্ছাটা করল বলি অত অধৈর্য হলে চলে না বাপু! কেচ্ছা-টেচ্ছার একটা আলাদা ইমেজ আছে, ভলিউম আছে, সার্কাজম আছেআরও অনেক কিছু আছে, তোমরা বুঝবে না বলে আর বলছি না একদিন রস শুক্তো রান্না করবে বলে আনাজ কাটছিল রসের শুক্তো বাওয়া! তেতো হবে নি কো কিছুতেই! তা রস পেঁপে কাটল, কাঁচকলা কাটল, আলু কাটল, আরো গাদা গুচ্ছের কী কী সব কাটান কুটোন করল কিন্তু উচ্ছে বা করলা কাটল না তাই দেখে সরের কী পিত্তি জ্বলানো হাসি! শান্তিময়ের মত অনেকক্ষণ ইকো-টিকো দিয়ে হাসার পরে থামল বটে, কিন্তু ভ্রুটা কুঁচকে গেল ওর পার্মানেন্টলি ভাব একবার, যে সর মেখে এককালের ললনারা ভাঁজ-টাঁজ আটকাতো, তারই কপালে ভাঁজের পর ভাঁজ আর এই হল গিয়ে ক্লাইমেক্সের শুরু! রস আনাজ ফেলে ছুটে এল, যতই আদা-কাঁচকলা হোক না কেন, আফটার অল যমজ তো! সে পরম মমতায় সরের কপালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল আর কাঁদতে থাকল। ওর চোখ থেকে অনবরত জল ঝরছে দেখে সরের তো কপাল আরও কুঁচকে উঠেছে, দিকে রসের হাত বুলনোর চোটে কপালটাও বেজায় চ্যাটচ্যাট করছে, আরেকদিকে রসের কান্না! সর তো আর রসিক না, বেজায় খেঁচো লোক, তাই ক্যাঁকখ্যাঁক করে গলা দিয়ে এমন বিচিত্র আওয়াজ তুলল যে সে যাত্রা রস রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার শুক্তোয় ঢুকে গেল। উচ্ছে, করলা ছাড়া রস এমন মিষ্টি শুক্তো বানালো যে, তা খেয়ে ইতিহাসের পাতা ছিঁড়ে ফেলল সবাই একে একে। সেই থেকে শুক্তোর নাম আর কোন ইতিহাস বইতে হাজার খুঁজলেও পাবে না। হ্যাঁ এইবার আসি সেই কেচ্ছার কথায়।    
    পুজো এমনিতে বেশ ভালই। ভাল মানে প্রেম-ট্রেম করলেও কেচ্ছার ধারেকাছে যায় নি। টেচ্ছার সঙ্গেই ছিল ওর গোপন আঁতাত। কেমন সেটা একটু ডিটেলে বলি আগে। ধরা যাক, পুজোর মনে খুব ভাব এসেছে, ও চোখ টিপে কেচ্ছাকে ডেকে নিল। কেচ্ছাও ল্যাংল্যাং করে ইনিভিসিবল ম্যানের মত এসে দাঁড়িয়ে পড়ল পুজোর গায়ে গায়ে। তারপর চলল, খুব ফষ্টিনষ্টি। কিন্তু দেখতে কেউ পেল নাই। সবাই ভাবল পুজোর একটু মাথার গন্ডগোল হয়েছে আবার, একা একাই হাসছে, গাইছে, খোঁয়ারি কচ্চে। ফলে কেচ্ছা আর হল না। টেচ্ছা আবার ভালমানুষের মত মুখ করে কেটে পড়ল হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে। অ্যাকচুয়ালি, মাটিতে পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে, লোকে ভাবছে হাওয়ায় ভাসছে, মানে লোকে আদৌ কিছু ভাবছে না আর কী! ভাবার স্কোপ রাখলে তো! তো, সেবার পুজো এভাবে ঘোমটার তলায় খ্যামটা নাচতে খুব বোর হয়ে গেছে। টেচ্ছাকে আর ডাকে নি। ভাবল এবার কেচ্ছার সঙ্গেই একটু ইয়ে করা যাক। যেমন ভাবা তেমনিই ফট করে কেচ্ছা সশরীরে হাজির। সে আবার অন্তর্যামী কিনা। পুজো প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেলেও, পরে যো হোগা দেখা যায়ে গা… ভেবে নিয়ে কেচ্ছার সঙ্গেই ওর তাইরেনারেটা শুরু করে দিল। ব্যাস্‌, যা হবার তা হয়ে গেল এবার। সবাই দেখছে ওদের কেলোর কীর্তি, মোবাইলে রেকর্ড পর্যন্ত করে নিল কয়েকজন… উফফ, কী দারুণ জমাটি ব্যাপারস্যাপার গো সে! রস আর সরও দেখেছে সব। রস তো গড়িয়েই পড়ল আনন্দে, আর সর ফুলে আরও মোটা হয়ে গেল। এদিকে টুজো তো তখন ক্ষেপে বেগুনি হয়ে গেছে রাগে। ওর পশ্চিম ভারতীয় রক্তে তুফান উঠেছে। দাদাঠাকুরের দেওয়া সেই বিশাল গ্লাভসখানা পরে নিয়ে বাড়ি থেকে হনহন করে বেরিয়ে পড়ল। আর এসে দাঁড়াল সোজা কেচ্ছার সামনে। তাপ্পর এক সপাটে গ্লাভস হাতের চড়!! কেচ্ছার প্যান্ট হলদে থেকে কমলা হয়ে গেল, চোখে নীল, বেগুনি আভা, গালের চামড়া থেকে ধোঁয়া উঠছে… সেই অবস্থায় ওকে চ্যাংদোলা করে টুজো ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিল চলন্ত ভ্যাটের গাড়িতে। আর পুজোকে এমন ধমকালো যে পুজো কেচ্ছা আর টেচ্ছা দুজনের নামই একেবারে জিন্দেগি থেকে ধুয়ে ফেলল সার্ফ এক্সেল দিয়ে।       
  তো, সেই টুজো আর পুজো, মানে লিড রোলে যারা আছে তাদের কথা কওয়াই হল গিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ দুজো, পূজা, খাজা, গজাএমন সাইড রোলের পাবলিক পাঁউরুটি, ঘুগনির লোভে অনেক আসে, অনেক যায় টুজো কিন্তু খুব স্মার্ট, একটুও কুঁজো না, এমনকি লাইফে কোনদিন কুঁজোর জল পর্যন্ত খায় নি আর পুজো একদম লক্ষ্মী হয়ে গেছে সেই থেকে। টুজোকে ফলো করে সোজা মর্তের দিকে গুটিগুটি পায়ে চলে এসেছে। এসে সোজা প্যান্ডেলে উঠে বসে আছে। টুজোর যথারীতি সব দিকে নজর। চুন থেকে পান খসার উপায় নেই। সব কিছুই ঠিকঠাক মত চলছিল। কিন্তু অষ্টমীর দিন কোথা থেকে যেন মেঘ-টেঘ এসে বৃষ্টি জুড়ে দিল। টুজো আবার ফুঁসতে শুরু করল, গ্লাভস জোড়া আনে নি বলে খুব আফসোস হচ্ছে এখন। মনে হচ্ছে খালি হাতে ফিল্ডিং করার অভ্যেস যে কেন ছেড়ে দিয়েছিল ও! যত নষ্টের গোড়া ওই দাঠাকুরের গ্লাভস্‌! না দিলে হয়ত বাজার থেকে কিনে পড়ত, কিন্তু দুজোর গ্লাভস বলে ফান্ডা দেখাতে গিয়ে সারাক্ষণ তো আর হাতে এঁটে রাখত না! এখন মাঝেমাঝে ওর মনে হয়, ওর হাতের পাঞ্জা দুটোই আর নেই, হাতের চেটোয় নিজের চামড়ার বদলে, গ্লাভসের চামড়া গজিয়েছে। জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে একবার হাত দেখাতে গেছিল ও, গ্লাভসশুদ্ধু হাত পেতে দিয়েছিল লোকটার সামনে। তারপর তার ধমকে গ্লাভস খুলে দেখাতে তিনি বললেন, ‘যান মশাই, আপনার হাতের রেখা সব মুছে গেছে। বেকার খাটালেন আমায়। পাথরটাথর যে দেব, তারও সুযোগ নেই। কী করতে এসেছেন এখানে, অ্যাঁ!!’ ভিজিট দিয়ে মানে মানে সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল সে যাত্রা। এবার সেই মুছে যাওয়া ভাগ্যরেখা নিয়ে খালি হাতে মেঘের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হবে ওকে। মনের জোর পাচ্ছে না যদিও, হাঁটুদুটো অজান্তেই ঠকঠক করে কেঁপে গেল...শূন্যে ঘুসিটা ছুঁড়ে দিল চোখ বুজে, হাওয়া কেটে সাঁই করে আওয়াজ হল শুধু। মেঘকে একচুলও নড়ানো গেল না। এরপর আবার সর্বশক্তি দিয়ে মারল, আবার, আবার... শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেছে টুজোর, ও নিজেই বুঝতে পারছে এবার ও হেরে যাচ্ছে, ক্লান্তিতে ওর শরীর এলিয়ে পড়ছে, চোখ বুজে আসছে, জ্ঞান হারানোর মুহূর্তে ও বুঝতে পারল মেঘ প্রচন্ড গর্জন করে উঠল জয়ের আনন্দে, বৃষ্টি এসে গেছে আর পুজো নির্লজ্জের মত সেই বৃষ্টিতে ভিজছে!     

   শেষে কিন্তু হাল ধরল সেই দুজোই। মানে দুজোর ভূত এসে এক্কেবারে ঘাড় মটকে দিল মেঘের আর বৃষ্টিকে তুলে এমন আছাড় মারল যে তার ৭৭খানা হাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। শোনা যায়, মেঘ আর বৃষ্টি ৩৩দিন ছেরামপুরের ওয়ালশ হাসপাতালের পাতালে ভর্তি ছিল। ওখান থেকে তারা আবার কালীপুজোর সময় উদয় হয়েছিল। সে গল্প অবশ্যি অন্য। পরে হবে কোনদিন।    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন