পুরুষোত্তম শ্রীচৈতন্যদেব
(তৃতীয় পর্ব)
প্রথম দুটি খণ্ডে সমকালীন সমাজ ও চৈতন্য জীবনীকারদের সম্বন্ধে আমরা কিছু ধারণা পেয়েছি। এবার সময় আসছে সেই সময়ের সাথে সাথে নবদ্বীপের সমাজচিত্র ও শিক্ষার সামগ্রিক রূপটি নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষণ করার। দক্ষিণ রাঢ় বাংলায় গঙ্গার পশ্চিমে নদীয়া জেলার অন্তর্গত গ্রাম নবদ্বীপ। সংস্কৃত ও ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষায় তখন সমগ্র ভারতের মধ্যে অগ্রগণ্য এই গ্রাম। দূরদূরান্ত থেকে ছাত্র আসতেন ব্যাকরণ ও ন্যায়ের পাঠ নিতে। সংস্কৃত ব্যাকরণে নবদ্বীপের পন্ডিতরা সমগ্র দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। আমাদের প্রাণের মানুষ চৈতন্যদেবের বাবাও (পন্ডিত জগন্নাথ মিশ্র) ছিলেন ব্যাকরণের বিশেষ পন্ডিত। তিনি নিজ পান্ডিত্যগুণে 'পুরন্দর' উপাধিও লাভ করেছিলেন। সেই সময় নবদ্বীপের পথে-ঘাটে ব্যাকরণ ও ন্যায় নিয়ে মুখে মুখে আলোচনা ও তর্ক লেগেই থাকতো। কিন্তু নবদ্বীপের পন্ডিতরা শাস্ত্র ও ব্যাকরণে চিরন্তন বুৎপত্তি লাভ করলেও বাংলায় ন্যায়শাস্ত্রের প্রচার ও শিক্ষাপ্রদানের কৃতিত্ব যদি কারো প্রাপ্য থাকে, তা একমাত্র দিগ্বিজয়ী পন্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্যের। পরে তিনিই ওড়িষ্যার রাজদরবারে আমন্ত্রিত হন রাজপণ্ডিতের আসন অলংকৃত করতে। তিনি আজও বাংলার গৌরব, প্রত্যেকটি ন্যায়ের ছাত্রের কাছে প্রাতঃস্মরণীয়।
একটি সময়ে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নের একমাত্র পীঠস্থান ছিল মিথিলা। মিথিলার পন্ডিতদের কাছে বাংলা থেকে অগণিত ছাত্র ছুটে যেতেন শুধুমাত্র ন্যায় অধ্যয়নের জন্য। কিন্তু বাংলার ছাত্রদের মেধা ও পান্ডিত্যের জন্য আশঙ্কায় থাকতেন মৈথিলী পন্ডিতের দল। তাই ন্যায়ের কোনো টীকাগ্রন্থ সঙ্গে করে বাংলায় নিয়ে আসা ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। এই প্রতিকূল অবস্থায় পন্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য সমস্ত ন্যায়ের টীকা কণ্ঠস্থ করে বাংলায় ফিরে আসেন এবং শুরু করেন ন্যায়শিক্ষার টোল। তাঁর এই ঋণ বাংলা কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।
ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন বলছেন- "নবদ্বীপে ন্যায়ের টোল তখন হিন্দুস্থানে অদ্বিতীয়; দর্শন, কাব্য, অলংকার প্রভৃতি শাস্ত্রেরও সেইসময় বিশেষরূপে চর্চা হইতেছিল।" তাঁর ভাষায়- "পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে নবদ্বীপ তিনটি শ্রেষ্ঠ পুরুষকে উপহার দিয়াছে - রঘুনাথ শিরোমনি, স্মার্ত রঘুনন্দন ও চৈতন্যদেব।" প্রথম দুজন শাস্ত্রকার সেইযুগের গর্ব। আর তৃতীয় জন? চলতে থাকুক আমাদের ধারাবাহিক, ধীরে ধীরে
জানবো তাঁর পান্ডিত্য, ভক্তিরস ও দর্শন।
এই হলো নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজ ও শিক্ষার সামগ্রিক ছবি। কিন্তু ধর্ম? চৈতন্য জন্মের আগে সমাজের চিরকালীন ভেদাভেদ ও ধার্মিক সংকীর্ণতার ওপরে কখনোই উঠতে পারেনি শিক্ষিত নবদ্বীপ। উঁচু নীচু ব্রাহ্মণ শুদ্রের ভেদাভেদ কুরেকুরে খেতে থাকে সমাজের ভিতকে। চৈতন্যদেব ছিলেন উদার। তাঁর মানবধর্ম জাত চেনেনি কখনো। নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও থোড়-মোচা বিক্রেতা গরিব শুদ্র শ্রীধরের সাথে যেমন তিনি মজা করে তর্ক করতেন, তেমন ভিক্ষুক শুক্লাম্বরের ঝুলি থেকে খাদ্য গ্রহণ করতেও পিছপা হতেন না কখনো। আজও মানুষ আত্মগরিমা প্রতিষ্ঠা করেন প্রতি ক্ষণে। কথায় কথায় স্থাপন করেন কাজের অহংকার। আর পঞ্চদশ শতকে তিনি ছিলেন সেসবের উর্দ্ধে। এখানেই তাঁর যুগোত্তীর্ণ মানবতা। তাই তিনি মানুষের দেবতা, অন্তজের প্রাণ।
রাতের অন্ধকারেও আকাশে থাকে আলোর তৃপ্তি, বয়ে নিয়ে যাওয়া ভালোবাসা। একটি মাত্র উজ্জ্বল চাঁদের উপস্থিতি চিনিয়ে দেয় আকাশের অস্তিত্ব। কিন্তু তারপাশেও অগণিত জ্যোতিষ্কের ভিড় যেন প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করে চাঁদের স্বকীয়তাকেই। মহামানব কখনো একা আসেন না, সঙ্গে আনেন তাঁর পারিষদদের। চৈতন্য আবির্ভাবের পূর্বে নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজে অগ্রগণ্য ব্যাক্তিত্ব ছিলেন পন্ডিত অদ্বৈত আচার্য। চৈতন্য জীবনী বিশ্লেষণে তাঁকে উপেক্ষিত রাখলে যেন অধরাই থেকে যায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বের আদি রূপ। তিনি ছিলেন তৎকালীন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অবিসংবাদী নেতা। শান্তিপুরের কমলাক্ষ ভট্টাচার্য নিজ নেতৃত্বগুনে হয়ে উঠেছিলেন অদ্বৈত, সংখ্যালঘু ভাববাদী বৈষ্ণবসমাজের গুরু। শুদ্ধ চিত্তে তিনি প্রতি সকালে গঙ্গাজল ও তুলসী নিয়ে আবাহন করতেন স্ময়ং নারায়ণকে। বৈষ্ণব সমাজ আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, চৈতন্যদেব তাঁরই ডাকে অবতীর্ণ হন নদিয়ায়, মান্যতা দেন অন্তজ শ্রেণীর সংগ্রামকে।
আর একজনের প্রসঙ্গ না আনলেই নয়। তিনি চৈতন্য আমলে বৈষ্ণব সমাজের দ্বিতীয় নেতা নিত্যানন্দ প্রভু (পিতৃদত্ত নাম 'কুবের গোস্বামী')। ধারে, ভারে, ও ব্যাক্তিত্বে তিনি সেই শতকের এক উজ্জ্বল পুরুষ। বীরভূম জেলার একচক্র বা একচাকা গ্রামে (বর্তমানে তারাপীঠের নিকটে বীরচন্দ্রপুর গ্রাম) ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় একজন অবদূত রূপে সারা ভারত ভ্রমণ করে কাটিয়ে দেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে অচেনা সন্ন্যাসীর সঙ্গে ঘর ছেড়ে তাঁর বেরিয়ে পড়া ঈশ্বর উপলব্ধির উদ্দেশ্যে। তারপর বৃন্দাবন থেকে শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে চৈতন্যদেবের কথা শুনে তাঁর নবদ্বীপে আগমন। আর সেই থেকেই শুরু দুই ভাইয়ের মানবধর্ম প্রচার। চৈতন্য জীবনী ঘাঁটতে গিয়ে আমরা বারে বারে তাঁর ওপর চৈতন্যদেবের অগাধ শ্রদ্ধা ও নির্ভরতার বিশেষ পরিচয় লক্ষ্য করেছি। একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারলাম না - চৈতন্যদেব তখন মানুষের ঈশ্বর, ভক্তের ভগবান। তিনি একে একে বরদান করছেন সকল ভক্তকে। এমনকি আচার্য অদ্বৈতকেও। কিন্তু বরদান করলেন না শুধু প্রভু নিত্যানন্দকে। উপরন্তু প্রভুর পরনের বস্ত্র ছিঁড়ে তিনি শ্রদ্ধাভরে প্রদান করলেন আর তাঁর পাদোদক পান করতে বললেন সকল ভক্তকে। এই হলো নিত্যানন্দ স্বরূপ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাঁকে স্ময়ং বলরাম বলেই বিশ্বাস করেন। চৈতন্যদেবও নবদ্বীপে নিত্যানন্দ আগমনকালে হলধর বলরামের স্বপ্ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
এমনই ছিল তখনকার নবদ্বীপ। শিক্ষায়, চেতনায়, ধর্মসচেতনতায় সারা ভারতের মধ্যে তার স্থান ছিল সবার ওপরে। এহেন নবদ্বীপের জ্যোতি সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে নি। তারসঙ্গে যোগ হয়েছিল এতোগুলি মহামানবিক চেতনার আধার- তাই পঞ্চদশ শতকে নবদ্বীপ তথা বাংলার পথ আটকায়, এ সাধ্য কার। খুব তাড়াতাড়িই এই বৈষ্ণব সমাজে প্রচলিত মানবধর্মের ছাতার তলায় এসে পড়েন ভারতবর্ষের বিভিন্ন দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক, যুগপুরুষ এবং অগণিত সাধারণ মানুষ। পরবর্তী খণ্ডগুলিতে আমরা দেখবো কিভাবে অকূল চৈতন্য প্রভাবে সমাজের মাথা, রাজা, মুসলিম কাজী পর্যন্ত নগরে কীর্তন করতে করতে হেঁটেছিলেন নীচ চণ্ডালদের হাত ধরেও।
আজও আমরা মুক্তি পাইনি ধর্ম সংকীর্ণতার প্রকোপ থেকে। আজও একজন মুসলিম বা হিন্দুকে নির্মমভাবে মরতে হয় নিছক জাতিদাঙ্গার কারণে, ধর্মাচরণের কারণে। ৬০০ বছর আগে সেই মহামানব যে ধর্মের পথ তুলে এনেছিলেন সমাজের সামনে, তার প্রত্যেকটি মুহূর্ত হয়তো আজও সমান প্রাসঙ্গিক, শিক্ষণীয়ও বটে। জাত নয়, ধর্ম হয়, মানুষের একমাত্র ধর্ম মানবধর্ম। আজও বারে বারে ফিরে আসে চন্ডিদাসের উক্তি - "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"।
(ক্রমশঃ)
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন