পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭

রীনা রায়।


"তিতলি"
*******

ছোট্ট তিতলি ,ছটফটে তিতলি, ছোট থেকেই মাছ খেতে চায় না । মা অনেক চেষ্টা করেও তাকে মাছ খাওয়ার অভ্যাস করাতে পারেনি। মা বলতেন "মাগো মেয়ে হয়ে জন্মেছো, পরের বাড়ি যেতে হবে, ওখানে কেউ তোমার আবদার শুনবে না।" তিতলি ঠোঁট বেঁকিয়ে চলে যেত।
বাবা বলতেন "ছেড়ে দাওনা, মা বাবার কাছে অন্তত একটু ডানা মেলে ভেসে বেড়াক, শ্বশুরবাড়িতে তো সব মেয়েকেই মানিয়ে নিতে হয়।" 
বাবার প্রশ্রয়ে , মায়ের আদরে তিতলি ডানা মেলে বেড়াতো।
চব্বিশ বছর বয়েসে তিতলি ভালবেসে বিয়ে করল নীলাজ্ঞনকে। বিয়ের আগে তিতলি, নীলাজ্ঞনকে বারবার বলেছিল, মাছের গন্ধেই তার বমি আসে, তাকে যেন মাছ খাবার জন্য কেউ জোর না করে।
নীলাঞ্জন বলেছিল তার মা খুব উদার মনের, সে কখনও সুপ্রিয়া ওরফে তিতলির ওপর জোর করে কোনও কিছু চাপিয়ে দেবে না। অষ্টমঙ্গলার পর শ্বশুরবাড়ি এলে, দিন কয়েক বাদে শাশুড়ি মা সুপ্রিয়াকে (এখানে সবাই তাকে সুপ্রিয়া বলে, তিতলি কেউ বলেনা, তার মনে হত তিতলি যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ) বললেন "দেখ বৌমা,সধবা মেয়েদের মাছ খাবোনা বলতে নেই, স্বামীর মঙ্গলের জন্য সধবা মেয়েদের পাতে প্রতিদিন একটু করে মাছ থাকা উচিত। অগত্যা স্বামীর মঙ্গলের জন্য তিতলিকে মাছ খাওয়া শুরু করতে হল, তার চব্বিশ বছরের অভ্যাস ত্যাগ করে তাকে নতুন অভ্যাস তৈরি করতে হল। প্রথম প্রথম তার বমি হয়ে যেত, শাশুড়ি মা বলতেন, "ও কিছু না, দুদিন পরেই অভ্যেস হয়ে যাবে। মেয়েমানুষকে সব অভ্যাস করতে হয়।" মাত্র দুমাস পর তিতলি আশ্চর্য হয়ে দেখল, এখন সে মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না, উপোষের দিনগুলো নিরামিষ খেতে তার কষ্ট হয়। পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের সাথী নীলাঞ্জন একদিন রাত্রে হঠাৎ করেই কিছু না বলে, চলে গেল অনেক দূরে। 
তিতলি বিধবা হল, সমাজ নিদান দিল, মাছ মাংস খাওয়া চলবেনা। কারণ সে বিধবা, তার সমাজের নিয়ম মেনেই চলা উচিত। যে তিতলি পঁয়ত্রিশ বছর মাছ ছাড়া ভাত খায়নি, তাকে আবার নতুন অভ্যেস করতে হবে। মেয়ে তাকে জোর করে নিজের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ছেলে-বউমার সংসারে এল সে। মাস ছয়েক যাওয়ার পর বৌমা রুমা একদিন বলল, "মা দেখো, এখন আর কেউ অতো মানেনা, তুমি মাছ খাওনা, আমার একার পক্ষে নিরামিষ, আমিষ ঝামেলা পোয়ানো বেশ কষ্টকর হচ্ছে , সকাল দশটার মধ্যে এত রান্না, তারপর অন্য কাজও তো আছে..." মেয়ের সংসারে গিয়েও সে দেখেছে, সেখানে তার একার জন্য মেয়েকে নতুন করে সব ধুয়ে নিরামিষ রান্না করতে হচ্ছে। প্রথমদিকে হাসিমুখে করলেও শেষদিকে সেও যেন একটু বিরক্ত হত। 
ছোট্ট তিতলি এখন আর ছোট্ট নেই। তিনি এখন সুপ্রিয়াদেবী। ষাট বছর বয়েস তার। তিনি ভাবলেন, আর কতবার বদলাবো নিজেকে ? কতবার অন্যের ইচ্ছেকে নিজের ইচ্ছেতে পরিনত করতে হবে ? 
বৌমা রুমিকে তিনি ডেকে বল্লেন, "রুমি, তুমি আমার জন্য ভেবনা। হ্যাঁ, তোমার কষ্ট হচ্ছে আমি বেশ বুঝতে পারছি । আমি তো এখনও অথর্ব হয়ে যাইনি , নিজেরটুকু আমি নিজেই বেশ করে নিতে পারব। কাল থেকে আমি নিচের তলায় সব বন্দোবস্ত করে নেব।"
রুমি বলল, "মা তুমি রাগ করেছ জানি, ঠিক আছে, আমি সব সামলে নেব। তুমি এসব কথা বললে তোমার ছেলে দুঃখ পাবে।" ছেলে এসে অনেক বোঝানো সত্ত্বেও তিনি নিজের সিদ্ধান্ত বদলালেন না। 
অনেক তো হল, তিনি ঠিক করলেন, বাকি জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচবেন। 
তাঁর খেতে ইচ্ছে হলে খাবেন, না হলে খাবেন না। 
তিনি মনে মনে ভাবলেন, নিজের ইচ্ছে, নিজের ভালোলাগা গুলোকে এবার সম্মান জানাবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন