পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

তন্ময় ধর

ঙ্গা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?
                               

তপোলোক-দেবলোক-ব্রহ্মলোকের ছোঁয়াছুঁয়িতে এখানে সব পথ মৃত্যু পেরোনো অমরত্বের পথ। পৃথিবীর সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণা-মলিনতা পেরিয়ে অপার শাশ্বত সৌন্দর্য্যের ধাক্কায় সম্মোহিত হয়েই আপনাকে এপথে চলতে হবে। যাত্রা শুরু হবে কাকভোরে, সে আপনি দেরাদুন থেকেই আসুন কিম্বা হরিদ্বার-হৃষীকেশ থেকেই আসুন। হরিদ্বার-হৃষীকেশ থেকে চাম্বা হয়ে যে পথটি উত্তরকাশীর পথে গিয়েছে, সেটি দীর্ঘ, তার সৌন্দর্য্যেও কিছু কমতি রয়েছে। সুতরাং আপনাকে বেছে নিতে হবে দেরাদুন-মুসৌরি-সুবাখোলির পথ। সে পথ বড় দুর্গম।  পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া সর্পিল সংকীর্ণ পথের পাশে একবার অপরূপকথার আলোর উঁকি তো পরমুহুর্তেই ভয়ঙ্কর ধস আর অতল খাদের ভয়াল ভ্রুকুটি। স্বর্গ ছেঁড়া জলপ্রপাত এসে কখনো ভিজিয়ে দিয়ে যায়। কখনো পাইন-দেওদারের শরীর ছোঁয়া একিচলেত রোদ্দুর এসে এক অন্য পৃথিবীর উষ্ণতার ছোঁয়া দিয়ে যায়। প্রভাতকল্পার তরল আলো ভেঙে দেরাদুন থেকে বাস যাত্রা শুরু করতেই ঘন্টাখানেকের মধ্যে মুসৌরির ৬০০০ ফুট পাহাড়ের কুয়াশা ভিজিয়ে দেব আপনাকে। পিছনে ফিরে দেখবেন, বহুদূরে পড়ে রয়েছে মানুষের সংসারের কোলাহল।


সবুজে মাখা পাহাড়, দুধেল শাদা ঝর্ণা, নাম-না-জানা ফুলের উপত্যকা আর অজানা পাখির কলকাকলির পাশ দিয়ে আপনি যখন এক অজানা মায়াময় জগতের গহনে হারিয়ে যাবেন, তখন হঠাৎই ব্রেক কষবে বাস। জায়গাটার নাম সুবাখোলি। সত্যিই সুবহ মানে ভোরের এক অনন্য সৌন্দর্য্য চোখ মেলে রয়েছে পথে, পথিকের চোখে, পথিকবনিতার স্বপ্নে। এখানেই পাইন-দেওদারের নরম রৌদ্রছায়ার খেলার ভেতর সেরে ফেলতে হবে প্রাতরাশ। ধোঁয়ার গন্ধ মাখা চা আর গরম পরাটা বা থুকপার স্বাদই আলাদা।   আবার যাত্রা সর্পিল পথে। হঠাৎ একটা নদীর সঙ্গে দেখা। নদীর গহন নীল চোখে চোখ রাখতেই যুগযুগান্ত পেরিয়ে ভেসে আসবে অদ্ভূত একটা পাহাড়ী গানের সুর। পাইন-দেওদারের লুকোচুরি থেক একটা পাখি করুণ সুরে ডেকে উঠবে। দূর পাহাড়ী গ্রাম থেকে এক দেবশিশু হাত নেড়ে টা-টা করে দেবে। ঘুম-ঘুম সব পাহাড়ের শিলালিপি পড়তে পড়তে আপনি হঠাৎ দেখবেন, নরম আলো মাখা সূর্যটা প্রায় মাঝ আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। আর শীতল হাওয়া মাখা একটা মস্ত পাহাড়ী ধ্বসের সামনে এক তেমাথার মোড়ে বাস থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এ জায়গাটার নাম ধরাসু। ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্সের খলনায়ক ভক্করাসুর সাথে নামের মিল খুঁজে পেলেন নাকি? এ জায়গার ধস সত্যিই গোটা পথের ভিলেন অংশ। ধুলো, নুড়িপাথর আর বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা পাথরখন্ডের পাশ দিয়ে খুব সাবধানে পেরোতে হবে পথের এই অংশটুকু। যারা বড়কোট-হনুমানচটি হয়ে যমুনোত্রীর পথে যাবেন তারা বাঁদিকের পথ ধরবেন। আপনি যাবেন ডানদিকে, গ্যানসু-উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রীর পথে। ভোর সাতটায় যে বাস দেরাদুন ছাড়ে, তা উত্তরকাশী পৌঁছায় দুপুর দেড়টা নাগাদ। উত্তরকাশীতে দুপুরের আহার সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে গঙ্গোত্রী যাওয়ার ছোট বাস বা গাড়িতে চেপে যান বিকেল তিনটের আগেই। সাড়ে তিন ঘন্টার পথ।



তিনটের পরে আর বাস পাবেন না। আর যদি একটা দিন উত্তরকাশীতে বিশ্রাম নিতে চান, তাহলে প্রচুর সস্তার হোটেল আছে। রয়েছে অনেক ধর্মশালাও। সন্ধেয় ঘুরতে পারেন ভাগীরথীর তীরে মায়াময় পথে পথে। শক্তিমাতার মন্দির এবং বিশ্বনাথ মন্দির দেখে নিতে পারেন পায়ে হেঁটেই। কোন প্রবেশমূল্য বা লাইন দেওয়ার ব্যপার নেই। একটু দূরে রডোডেনড্রনের বাগান কিম্বা মানেরি ড্যাম দেখতে যেতে পারেন, হাতে দু-তিন ঘন্টা সময় থাকলে।
পরের দিন খুব সকালে গঙ্গোত্রীর পথে বেরিয়ে পড়ুন। তীর্থের মরশুমে অর্থাৎ মে থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রী পর্যন্ত ছোট বাস চলে। বাকি সময় ছোট গাড়ি। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এপথ তুষারপাতের জন্য বন্ধ থাকে। উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রীর দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। পথের এক-তৃতীয়াংশ পেরোতেই তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গেরা আপনার চোখ আটকে রেখে দেবে। দেবলোকের এই পথের ঝর্ণা-নদী-গাছ-ফুল-পাখি সব লক্ষ্য করতে করতে এগিয়ে চলুন। এমন দৃশ্যসুখ জীবনে খুব বেশী আসে না। মাঝপথে গাংনানিতে থামবে গাড়ি। উষ্ণজলের একটি ক্ষীণধারার ঝর্ণা আছে এখানে। স্থানীয় মানুষদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই ধারা। আশেপাশের দোকানে সামান্য জলপানের ব্যবস্থা আছে। গরম চা, পরোটা, পকোড়া খেতে পারেন। ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশামোড়া পরিবেশে ওসব খাবারের স্বাদই আলাদা। খাওয়া সেরে স্থানীয় উলের শীতবস্ত্র কিনে নিতে পারেন। এরপর যত গঙ্গোত্রীর দিকে এগোতে থাকবেন, দুর্গম পথে হাড়হিম শীতল বাতাসের তীব্রতা বাড়তে থাকবে। এরই মধ্যে গাড়ির ড্রাইভার পাইনবনের পাশে এক চিলতে নদীবিধৌত এক গ্রামের পথে থেমে যাবে। এই গ্রামের নাম হর্শিল। আপেল এবং অন্যান্য সুস্বাদু পাহাড়ী ফলের বাগান আছে। দুরন্ত এক ঝর্ণাধারা দেখিয়ে ড্রাইভার বলবেন, এখানেই ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ ছায়াছবির ‘তুঝে বুলায়ে ইয়ে মেরি বাহেঁ’ গানের দৃশ্যায়ন হয়েছিল।
গঙ্গোত্রীর ছোট্ট বাসস্ট্যান্ড থেকেই শুরু হয়ে গেছে দোকানের সারি। বিচিত্র পূজার সামগ্রীর অভাব নেই সেখানে। তবে সব কোলাহল ছাড়িয়ে ভরে আছে গঙ্গা এবং অসিগঙ্গার তীব্র জলধ্বনি। আর সব দৃশ্যের উপর উজ্জ্বল হয়ে আছে শিবলিঙ্গ এবং ভাগীরথী গ্রুপের অন্যান্য তুষারশুভ্র শৃঙ্গগুলি। গঙ্গোত্রীতে হোটেল এবং ধর্মশালা রয়েছে প্রচুর। মন্দির এবং নদীসঙ্গমের কাছাকাছি কোন হোটেলে থাকতে পারেন। গঙ্গোত্রীতে দ্রষ্টব্য স্থান প্রচুর। বাসস্ট্যান্ডের গা বেয়ে ট্রেকিং-এর রাস্তা চলে গিয়েছে ভোজবাসা-গোমুখ-তপোবনের পথে। এই পথে যেতে হলে সকালেই অনুমতি নিয়ে নেতে হবে স্থানীয় ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস থেকে। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ হিমবাহ প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ। দুর্গম এই পথে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘন্টা। প্রতিদিন মাত্র ২০০ পর্যটককে এপথে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কাজেই সকালে দ্রুত নাম লেখাতে না পারলে এর আশা ত্যাগ করতে হবে। সেক্ষেত্রেও আপনার জন্য অজস্র দ্রষ্টব্য অপেক্ষা করে আছে গঙ্গোত্রী মন্দিরের আশেপাশে।
গঙ্গোত্রী মন্দিরটির বয়স বেশী নয়। অষ্টাদশ শতকে জেনারেল অমর সিং থাপা এই মন্দির তৈরি করেন। বর্তমানে সংস্কার করে ঝকঝকে-তকতকে করা হয়েছে। মন্দিরের একপাশে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে পারেন ভগীরথশিলায়। এখানে বসে তপস্যা করেই ভগীরথ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে আনেন। সিঁড়ি বেয়ে আরো নীচে নেমে স্নান করে নিতে পারেন ভাগীরথীতে। মন্দিরে পূজা দিয়ে দুপুরের আহার সেরে নিতে পারেন কাছাকাছি কোন রেস্টুরেন্টে। এরপর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন স্থানীয় দ্রষ্টব্যগুলির জন্য। মন্দির থেকে কয়েক পা এগিয়ে লোহার সেতু পেরিয়ে পৌঁছে যান গৌরীকুন্ড এবং সূর্যকুন্ডে। এখানে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখুন উন্মত্ত জলরাশির খেলা, সুবিশাল প্রস্তরখন্ডের মৌনতা, ঘিরে থাকা চির-অরণ্যের আলোছায়ার খেলা, চিরচঞ্চল জলরাশি থেকে বিচ্ছুরিত তীব্র জ্যোতি। ব্যাকগ্রাউন্ডে চির-উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে শিবলিঙ্গের তুষারশৃঙ্গ। এখানে জীবন তুচ্ছ। অনন্ত সৃষ্টির এক চিরায়ত সৌন্দর্য্যের সামনে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। মহাকালের জপের মালায় আজকের দিনটি নেই। জন্ম-মৃত্যু-দুঃখময় সংসারের অন্ধকার পেছনে ফেলে আপনি চলে এসেছেন আলোকতীর্থে। এরপর ভাগীরথীর তীরের অরণ্যময় পথ ধরে এগিয়ে চলুন পান্ডবগুহার দিকে। মাত্র দু’ কিলোমিটার পথ। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে সেই জনবিরল পথ আর ফুরোতে চাইবে না। সন্ধের নির্জনতায় সে পথ আরো গা-ছমছমে হয়ে ওঠে। ফিরে এসে জলমগ্ন শিবলিঙ্গ দেখতে চলুন। এখানেই শিব তাঁর জটা থেকে মুক্ত করেছিলেন দেবী গঙ্গাকে। আরো অসংখ্য দ্রষ্টব্য ছড়িয়ে রয়েছে আশেপাশে।
গঙ্গোত্রীতে কিন্তু কোন এটিএম নেই। পথে শেষ এটিএম হর্শিলে, গঙ্গোত্রী থেকে ২৮ কিলোমিটার আগে। বিএসএনএল ছাড়া বাকি সংস্থাগুলির টেলিফোন নেটওয়র্ক অত্যন্ত দুর্বল।

কিভাবে যাবেনঃ-
দেরাদুন থেকে উত্তরকাশীর বাস ছাড়ছে সকাল ৭ টায়, ৮ টায়, বেলা ১ টায় এবং ২টোয়। সময় লাগে সাড়ে ছ’ঘন্টা। উত্তরকাশী থেকে ছোট গাড়িতে গঙ্গোত্রী যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা।
তীর্থের মরশুমে হৃষীকেশ থেকে সরাসরি গঙ্গোত্রী যাওয়ার বাস ছাড়ছে সকাল ৭টায়। সময় লাগে প্রায় এগারো ঘন্টা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন