পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

কৌশিক চক্রবর্ত্তী


পুরুষোত্তম শ্রীচৈতন্যদেব
(পর্ব- চার)


চৈতন্যদেবের নবদ্বীপে বাল্যজীবন নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশ থাকে না৷ তা নিয়ে বহু গ্রন্থে ও গবেষণায় বহুবার আলোচনা হয়েছে৷ অন্নপ্রাশন, উপনয়ন থেকে গয়ায় পিতৃকার্য এবং ঘর ছেড়ে নীলাচল গমন- এই পর্যায়টুকু বহুল আলোচিত এবং সর্বজনজ্ঞাত৷ তবু জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে নবদ্বীপে চৈতন্য জীবনকে সরাসরি দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়৷ প্রথম পর্যায়ে যদি আমরা পরম জ্ঞানী, বিদ্যানিধি অধ্যাপক নিমাই পন্ডিতকে দেখি, তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যায় কৃষ্ণপ্রেমে দিব্যোন্মাদ এবং সংকীর্তনরত বিশ্বম্ভরকে৷ এই পরিবর্তনের পটভূমিকা হয়তো সাজানো ছিল বহু আগেই, শুধু গয়ায় শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর সংস্পর্শে এসে তিনি দিব্যচৈতন্য লাভ করেন৷ পিতৃকার্য সেরে গয়া থেকে নবদ্বীপ ফিরে আসার পর বৈষ্ণবরা পেয়েছিলেন এক নতুন নেতা'কে - সংকীর্তন কান্ডারি প্রভু বিশ্বম্ভরকে৷ এই সময়েই দূর হয়েছিল তাঁর সমস্ত পান্ডিত্যের অহংকার আর অধ্যাপনার ইচ্ছে৷ তথাপি ছাত্ররা আর কেউ অন্যত্র শিক্ষালাভে যেতে রাজি ছিলেন না৷ তাই সকলে মিলে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়৷ নবদ্বীপের পথেঘাটে সন্ধ্যেবাতি আর শাঁখের শব্দের সাথে ধ্বনিত হতে লাগলো খোল কর্তালের মাতন৷ সুসজ্জিত চৈতন্যদেবের অগ্রভাগে নাচ ও কীর্তনের মাধ্যমে নেতৃত্বদানে বৈষ্ণবরা পেলেন এক নতুন উদ্যমশক্তি৷ 
নগর কীর্তনে জমায়েত হতে শুরু করলেন অগণিত মানুষ৷ শুধুমাত্র চৈতন্যদেব নন, বৈষ্ণব সমাজের কান্ডারীদের মধ্যে নেতৃত্ব দিলেন দ্বিতীয় নেতা তথা অবধূত নিত্যানন্দ,  আচার্য অদ্বৈত, বণিক শ্রীবাস, গায়ক মুকুন্দ, গদাধর প্রভৃতি বৈষ্ণবগণ৷ বাংলার ইতিহাসে শাসকের অত্যাচারের ওপর কার্যত এ এক প্রথম প্রতিরোধ৷ 

জীবনী গ্রন্থকার বৃন্দাবন দাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই সময়কালে প্রভুর একাধিকবার ভাবাবেশের কথা উল্লেখ করেছেন৷ দশ অবতারের ভাব থেকে হলধর ভাব- বিভিন্ন সময়ে ভক্তরা দেখতেন প্রভুর আবেশ৷ নিত্যানন্দ আগমনের পূর্বেও হলধর ভাবে আবিষ্ট হন চৈতন্যদেব৷ নিত্যানন্দ আসছেন এই স্বপ্ন দেখে প্রভু বলছেন 

কহিতে প্রভুর বাহ্য সব গেলো দূর
হলধর ভাবে প্রভু গর্জয়ে প্রচুর
"মদ আন, মদ আন" বলি প্রভু ডাকে
হুঙ্কার শুনিতে যেন দুই কর্ণ ফাটে 
(চৈ:ভা:)

হলধর বলরাম মদিরা পান করতেন৷ তাই হলধর আবেশে মদিরার কথাই বলতে শোনা যায় বিশ্বম্ভরের মুখে৷ এমন নিত্য আবেশে শিশুসুলভ চাঞ্চল্য প্রকাশ থেকে অবতার ভাব প্রদর্শন- প্রতি মুহূর্তে চলতো নিত্য নতুন লীলা৷ 

চৈতন্যদেবের নবদ্বীপ পর্যায়ে আরো দুটি বিখ্যাত ঘটনা হলো নবদ্বীপের অত্যাচারী চাঁদ কাজী এবং কোটাল জগ্ননাথ ও মাধবের (জগাই মাধাই) মধ্যে মানবপ্রেমের বীজবপন৷ চৈতন্য জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা শাসক ও রাজশক্তির সামনে চৈতন্যপ্রভাব বারে বারে দেখে থাকি৷ নবদ্বীপে কাজী থেকে উড়িষ্যার প্রবল পরাক্রমশালী গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্রদেব বা রাজামুন্দ্রীর প্রশাসক রায় রামানন্দ - প্রত্যেকেই ছিলেন একনিষ্ট চৈতন্য সেবক৷ এমনকি গৌড় সুলতান হুসেন শাহের দুই উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারী দবীর খাস ও সাকর মল্লিক উড়িষ্যায় থাকাকালীন চৈতন্যদেবের সাথে গোপনে দেখা করতেন৷ পরবর্তী সময়ে এঁরাই বৃন্দাবনে বিখ্যাত ছয় গোঁসাইয়ের অন্যতম রূপ ও সনাতন গোস্বামী নামে শ্রীকৃষ্ণের গুপ্তলীলা প্রকাশ করেন৷ তবে অনেক গবেষকের মতে চৈতন্যদেব রাজা প্রতাপরুদ্র ও উড়িষ্যাকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন৷ উড়িষ্যার প্রধান শত্রু বাংলা। আর এই বাংলার দুই প্রধান রাজকর্মচারীকে কৃপাপ্রদান তারই অঙ্গ কিনা তা অবশ্য প্রমাণসাপেক্ষ৷ তবে বিভিন্ন সংকটে তিনি যে উড়িষ্যা ও তাঁর গজপতি রাজশক্তিকে ছায়াপ্রদান করেছিলেন তা অনস্বীকার্য৷ এই কারণেই তাঁর আর এক নাম 'প্রতাপরুদ্র সংত্রাতা'৷ উড়িষ্যার বিভিন্ন লৌকিক ও অলৌকিক ক্রিয়ার বিবরণগুলি পর্যায়ক্রমে আমরা পরবর্তী পর্বগুলিতে নিশ্চই আলোচনা করবো৷ 

চৈতন্য চরিত্রে প্রকট ছিল অনেকগুলি সত্ত্বা৷ নবদ্বীপে কখনো তাঁকে দেখা যেত শিশুর মতো গঙ্গায় জলক্রীড়া করতে৷ আবার কখনো বলিষ্ঠ নেতার মতোই দৃঢ় ছিল তাঁর বজ্রকঠিন নেতৃত্ব৷ তাঁর নেতৃত্বগুনে দেখা যেত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আকুতি, দোষীকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা এবং জাতিভেদকে তুচ্ছ করে মানবধর্মকে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার মতো দৃঢ়চেতা পদক্ষেপ৷ তাঁর দণ্ডদানের সমতাভাব বোঝাতে নবদ্বীপের একটি ঘটনা আলোচনা করা যেতেই পারে৷ তিনি বলেছিলেন শচীমাতার বৈষ্ণব অপরাধ ছিল৷ আচার্য অদ্বৈতর কাছে তিনি অপরাধী ছিলেন৷ তাই তাঁর প্রেম ভক্তি পাবার অধিকার ছিল না৷ শচীমাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিস্বরূপ ছিলেন আচার্যের ছায়াসঙ্গী৷ পরবর্তী সময়ে নিমাইও হয়ে ওঠেন তাঁর সহচর৷ স্বভাবতই মাতা শচী সবসময় শঙ্কিত থাকতেন এবং আচার্য কে খুব একটা পছন্দ করতেন না৷ তাই বিশ্বম্ভর বলেন আচার্যের পদধূলি গ্রহণ করলে তবেই মা হবেন অপরাধমুক্ত৷ এই কথা শুনে আচার্য অদ্বৈত বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং সেই অবসরে শচীমাতা আচার্যের পদধূলি গ্রহণ করেন৷ এমনই ছিলেন চৈতন্যদেব৷ মানবশিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে তিনি ছিলেন কাঁচের থেকেও স্বচ্ছ৷ তাঁর কাছে আপন-পর তুচ্ছ৷ তিনি নির্দ্বিধায় বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন ভিক্ষু শুক্লাম্বরকে, আবার অবলীলায় ত্যাগ করতে পারেন রাজ্আমন্ত্রণ৷ 

এহেন প্রভুর আবির্ভাবে নদিয়ার লোকজন যে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হবেন, তা বলাই বাহুল্যতা৷ চৈতন্যের শক্তিতে তাঁরা সকলে ছিলেন বলীয়ান৷ যে সময় নবদ্বীপের কাজী চাঁদ খানের সাথে বিবাদ বাঁধে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের, সেই সময় তিনি নিজে সংগঠিত করেন মানুষের আন্দোলন৷ কাজী হরিনাম সংকীর্তনের বিরোধিতা করবার জন্য নির্বিচারে মৃদঙ্গ ভাঙতেন, ছত্রভঙ্গ করতেন কীর্তন মিছিল৷ তখন প্রভু নবদ্বীপ থেকে বিশাল মিছিল সহযোগে এগিয়ে এসেছিলেন কাজীর দরজায়৷ প্রত্যেকের হাতে শান্তির মশাল৷ সেই সময় ভারতবর্ষ দেখেছিলো প্রথম মানুষের আন্দোলন, শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ৷ সেই প্রেম ভক্তির বন্যায় ভেঙে যায় কাজীর যাবতীয় প্রতিরোধ, কাজীও হয়ে ওঠেন চৈতন্য অনুগামী৷ বাংলার ইতিহাসে এ এক অনন্য গৌরবের কাহিনী৷ শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ট মানুষের মুক্তিলাভের কথা৷ নেপথ্যে সেই চৈতন্যদেব৷ 

তাঁর মতো বলিষ্ঠ তথা সহানুভূতিশীল নেতা বর্তমান ভারতবর্ষের কাছে উদাহরণস্বরূপ৷ তাঁর অনুগামী ও ভক্তদের মধ্যে যে একতা এবং মৈত্রীভাব দেখা যেত, তা চৈতন্য পরবর্তী ভারতে সত্যিই বিরল৷ পন্ডিত শ্রীবাসের একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হয় তাঁর অন্দরমহলে চৈতন্যদেবের কীর্তন কালে৷ অন্য ভক্তদের কীর্তন আনন্দে বিঘ্ন ঘটবে বলে তিনি ঘরের রমনীদের কাঁদতে পর্যন্ত বারণ করেন৷ এমনকি বেদনায় জর্জরিত শ্রীবাস নিজেও কীর্তনে মেতে থাকেন বহু সময়৷ পরে চৈতন্যদেব জানতে পারলে নিজে হাতে শ্রীবাসের পুত্রের দেহ সৎকারে নিয়ে যান নবদ্বীপের গঙ্গার পাশে৷ মধ্যযুগের বৈষ্ণব ইতিহাসে এ এক উজ্জ্বল সময়৷ মৈত্রীর এমন উপমা সারা বিশ্ব কতবার দেখেছে, তা আজও গুনে বলা যায়৷

(ক্রমশ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন