অভিযোজন (১)
সময়টা আটের দশকের শুরু ,তখনো মানুষের সন্ধ্যেগুলো দূরদর্শন কেড়ে নেয়নি । আত্মীয়-স্বজন ,বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যাওয়া আসায় মানুষের সময় কেটে যেত বেশ ।শেষ ডিসেম্বরে কুয়াশার আস্তরণ মেখে শুনশান মধ্য কলকাতার তাঁতীবাগান লেন ।কলকাতায় শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে , পাড়ার সব বাড়ির জানলা-দরজা তাই বিকেল থেকেই বন্ধ । সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আড়াই ফুট চওড়া অন্ধগলিটার সামনে একটা হাতে টানা রিকশা এসে থামলো । ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলোয় এক টাকা চার আনা পয়সা ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নামলেন ভারতী , হাত ধরে নামালেন ছোট বোন মল্লিকাকে ।তার আগে মল্লিকার কোল থেকে ছোট্ট পুঁটলিটাকে নিজের কোলে জড়িয়ে নিয়েছেন তিনি । এই বারো মিটার লম্বা গলির তৃতীয় এবং শেষ বাড়িটার ঠিকানা আট বাই তিনের এ । চোখসওয়া অন্ধকারে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে রঙচটা কাঠের দরজাটায় ঠকঠক্ করে কড়া নেড়ে অনুচ্চ স্বরে বললেন ," মাসিমা দরজা খোলেন , আপনের বৌমা আর নাতনিরে লইয়া আইছি ।" ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসে না ।সদ্য প্রসূতি মল্লিকা ক্লান্তিতে ঢলে পড়ে দিদির গায়ে ।এবার বেশ জোরে কড়া নাড়েন ভারতী ।দোতলা থেকে বাড়িওয়ালি জেঠিমার গলা পাওয়া যায় ,"কে ?...বৌমা এল নাকি হাসপাতাল থেকে ?" ভারতী উত্তর দেওয়ার আগেই সদর দরজাটা সশব্দে খুলে যায় । সামনে দাঁড়িয়ে উমা ...মল্লিকার অবিবাহিত ছোট ননদ ।আবছায়া অন্ধকারেও তার চোখমুখের বিরক্তি ভারতীর চোখ এড়ায় না । " উমা , তোমার বৌদির শরীরটা খুব খারাপ লাগতাসে ,খুব কাহিল ...ওরে ঘরে গিয়া শুইতে দাও ..." ভারতীর কথা শেষ না হতেই উঠোনের ওপাশের ঘর থেকে প্রভার গলার স্বর ভেসে আসে ..."বৌমারে আমার ঘরে নিয়া আসো ভারতী ।এই ঘরেই মাটিতে ওর বিছনা করসি ...
অন্ধকার উঠোন পেরিয়ে মল্লিকাকে নিয়ে প্রভার ঘরের ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভেতরে আসেন ভারতী ।টিমটিমে ষাট ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে এ ঘরে । ইঁট দিয়ে উঁচু করা তক্তাপোশের ওপর নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে তিতলি ...মল্লিকার দেড় বছরের শিশুকন্যা ।অন্যদিকের সরু চৌকিটার ওপর মল্লিকার দেওর প্রসূন যথারীতি বইখাতা ছড়িয়ে বসে আছে ,আর তিন মাস বাদেই তার হায়ার-সেকেন্ডারি পরীক্ষা । মেঝেতে মাদুরের ওপর একটা পাতলা তোষক পেতে মল্লিকা আর তার সদ্যজাত কন্যার জন্য বিছানা করে রেখেছেন প্রভা ।ক্লান্ত মল্লিকা ধপ করে বসে পড়ল সেখানে ।ভারতীর কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে তার গোলাপী ফুটফুটে মুখের দিকে তাকিয়ে প্রভা বললেন "আসো দিদিভাই , নিজের ঘরে আসো ...আমার ঘরে জোড়া লক্ষ্মী আইসে ভারতী ...আমি খুব খুশি ...তিতলির বোনের নাম আমি রাখলাম তিতির ।কি বৌমা , কি কও ? "
উমা বিরস মুখে বলে ওঠে , "মা , ভাই কিন্তু পড়ছে ।সামনে পরীক্ষা ।আজ নাহয় আদিখ্যেতাটা একটু কমই করলে !" প্রভা কিছু বলার আগেই পাশের ঘর থেকে জড়ানো গলায় প্রণব কিছু বলে ওঠে ।ভারতী দেখলেন মল্লিকা চমকে তাকালো দু ঘরের মাঝে বন্ধ দরজাটার দিকে ...তার দু-চোখে টলটল করছে দু-ফোঁটা জল !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন