পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮

সম্পাদকীয়





এখানে চুপ থাকতে হয় ৷যখন পাশের বাড়ির আলো নিভে যায় ৷ নামিয়ে দিতে হয় শাড়ির আঁচল ৷ঝড় আসার আগের মুহূর্তে পাখিদের তীক্ষ্ণ অথচ অন্তর্ভেদী চিৎকার ফিরে ফিরে আসে ৷ গাছেরা মুখ খুলে শুয়ে থাকে সূর্যের পাশে ৷
যেন সতীদাহ চলবে ৷ পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ভাবি অন্তঃপুরের কথা ৷ভাবি সেই সব রাতে'র কত বাতাসহীন কাহিনী । লম্ফের আলোয় ফুঁ দিতে দিতে ঠাকুমার ঘামের গন্ধ আটকে যায় ডিমের কুসুমের মত ।


তারপর একগ্রোস অভিমান জমা থাকে নিকানো মেঝে । ওগো ! পুরাতন পাটাতন পুরানো গন্ধর কথা বল ৷ যা কিছু পুরাতন সবই আমার তোমার সকালের ঘুম ভাঙা মুখের গন্ধের মত ৷
তোমায় যেদিন খোয়াইয়ের পথে দেখি বৈশাখের মাদুলী গলায় এক চুমুক ভালোবাসায় ভরে গেছিল হরিণ রঙা পথ । মাদোলে'র দ্রিমিক দ্রিমিক আওয়াজ হারিয়ার মাঝে ৷

ওগো বসন্ত এসো পুরাতন ভৃত্যরূপে আম্রকুঞ্জে


বসন্ত আঙিনায় দাঁড়িয়ে " সৃজন " এগিয়ে চলছে রোদ হয়ে ৷ " সৃজন " সাথে সাথে "আমার সৃজন" দ্বিতীয় প্রকাশ হতে চলেছে ৷ খুব শীঘ্রই আমরা শান্তিনিকেতনে বাউল গানের অনুষ্ঠান করতে চলেছি ৷ পাশে চাই আপনাদের ৷ " আমার সৃজন " পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন প্রয়োজন ৷ আপনাদের পাশে চাই ভীষণ ভাবে ৷ সবাই ভালোবাসায় থাকুন । সৃজনে থাকুন ৷যখন সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি তখন দীঘায় বসে ৷ কিছু মুহূর্ত ভাগ করে নিলাম আপনাদের সাথে ৷

এ বলিষ্ট হাতে মিলিয়ে যাবে শরীর
বেড়ে উঠবে ফেনার মত প্রেম নামক বিষয়বস্তু
নোনা হাওয়া ছুঁয়েছে চিবুক 
আরো একটু দূরত্ব সমান্তরাল হোক

মুক্তি ! 
বালির  পোকার মত নোনা সমতল আক্রান্ত করেছে
এখন শব্দময় বন্ধুত্বের থেকে ঝাউয়ের পর্যটন বড় বেশী আকর্ষণ করে .
দেখা যায় তেতলা'র বারান্দায় বসে শীর্ণ টবের মধ্যে সমুদ্র 
জীবনের পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি দূর নীলিমায় করবীর মধ্যে 

এসো নীরবতা আলিঙ্গন করি

পারমিতা চক্রবর্ত্তী
সম্পাদিকা
সৃজন 

পিয়ালী বসু ঘোষ

#সাঁঝবিহান পর্ব-৯
___________________

লন্ঠনের মৃদু আলোয় সাঁঝকে কাছ থেকে দেখে সতীশ । ওর চোখের পাতায় আচমকাই স্নেহের ঠোঁট ছোঁয়ায় ও ।খুব কাছে গিয়ে দুহাতের পাতায় ওর লক্ষ্মীপ্রতিমার মত মুখটা তুলে নিয়ে বলে "ভালো থাকবে সাঁঝ,লক্ষ্মী হয়ে থাকবে। অতীতকে মনে রাখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়না.....আর সামনে না এগুলো জীবনটা বৃক্ষর মত হয়ে যায় ।স্থাণু,স্থবির । তখন সে শুধু আশ্রয় হয়ে ওঠে কিন্তু নিজে আশ্রয় চাইলে পায়না, কিন্তু কখনও কখনও আমাদের সকলেরই তো একটা আশ্রয় দরকার হয়,তাইনা ?কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মেছ যখন,যে সুযোগ বৃক্ষের নেই সে সুযোগ তুমি হারাবে কেন ?"

সাঁঝ এসব কেতাবি কথার আয়োজন বোঝেনা ।দুহাতে চেপে ধরে সতীশের কবজি দুটো।
চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে সাঁঝের । এমন সাঁঝকে সতীশ দেখেনি আগে ।হঠাৎই ওর বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে সাঁঝ ।ওর শরীরের স্পর্শ পায় সতীশ ।সাঁঝের বুকের মসৃণ পেলব যন্ত্রণার ওঠানামা বুঝতে পেরে ভালোলাগা খারাপলাগার এক মিশ্র অনুভুতিতে সতীশেরও স্নায়ু দূর্বল হয়ে ওঠে ।

তবু নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়ায় সতীশ ।
একটা লাঠি আর একহাতে লন্ঠন নিয়ে কলমি তার দুই মেয়ে নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই সতীশ বেরিয়ে যায় । বৈচি কতগুলো বুনোফুল ওর ফ্রকের কোচরে করে নিয়ে এসেছিলো ।সতীশ এমন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো যে ফুলগুলো পড়ে গেলো মাটিতে ।ও পিছন ফিরেও দেখলনা । ভারী অবাক হলো কলমি । অন্যমনস্ক ভাবে ঘরে ঢুকতেই সাঁঝ ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো । কলমির বুক কেঁপে উঠলো । তবে কি ও যা ভেবেছিলো তাই ! কিন্তু গোমস্তা জানলে এ গাঁ থেকে ওদের বাস উঠে যাবে যে.......

যতটা দ্রুত সতীশ কলমির বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল,ততটাই ধীর গতিতে ও নিজের ডেরার পথ ধরলো । মনে পড়লো সকালে ফজিরাম কিছু বলতে চেয়েছিল, তবে বোধহয় এ কথাই হবে ।ওর কথা শুনে কলমির বাড়িতে গেলেই ভালো হতো ।এমন বিশ্রী দুর্বিপাকে পড়তে হতনা ওকে ।সাঁঝকে ওভাবে ওই আলোছায়া বুটিকাটা গালচেতে বুকের সাথে লেপ্টে না রাখলেই ভালো হতো । সাঁঝ অন্যের ঘরে যাবে, ওর গায়ে পরপুরুষের গন্ধ না থাকলেই ভালো । অবশ্য মানুষ নয় জানোয়াররা বুঝতে পারে শরীরের গন্ধ । মানুষ ওসব গন্ধ পায়না ।মানুষই সহজে ধুয়ে ফেলতে পারে যাবতীয় গন্ধ ।আবার উল্টোটাও বড্ড সত্যি । জানোয়াররা সেই গন্ধ পেলেও সঙ্গীকে ফেলে,ছেড়ে কিম্বা অত্যাচার করে চলে যায়না । সতীশের মনে হয় এমন অনুভুতিহীন হলেও চলতো ওর এখন ।মনুষ্যত্ব বিবর্জিত জন্তু হলেই বা কি ক্ষতি হতো ওর ? ও নয় শুধুই রমণ বুঝতো,প্রেম নয় ।ও নয় প্রেমিকার স্তনসন্ধি তে চুমু খেয়ে আঁচড়ে কামড়ে চলে আসতো ।ফেরার পথে ভুলে যেত রমণচিহ্ন । কিন্তু কই তেমন তো কিছু হচ্ছেনা ।
কেমন এক পরাধীন গ্লানিতে ওর অজান্তেই তৈরী হওয়া বোধের কাছে পুরোপুরি হেরে ভূত হয়ে নিষ্ফল একটা লাফালাফি করছে মন ।

বনবীথি পাত্র


#প্রতিশোধ

.
গতরাতেও হারানকাকা এসেছিল মায়ের কাছে। মাকে খুব বকাবকি করছিল। মায়ের কান্নার আওয়াজ আসছিল ঘরের ভেতর থেকে। হারানকাকা যেদিন আসে, সেদিন রাজুর ঘরে ঢোকা মানা। ঝুপড়ির বাইরে পলিথিন দিয়ে ঘেরা জায়গাটাতে মা ওর বিছানা পেতে দেয়। প্রথম প্রথম ভয় করতো, আর করে না। ভোরবেলাই পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে রাজুর। ঘরের দোর তখনও বন্ধ ভেতর থেকে। বালতি থেকে গলাকাটা বোতলে জলটা ভরতে গিয়েই বালতির পাশে জিনিসটা কুড়িয়ে পায়। এটা হারানকাকার মোবাইল, কতবার দেখেছে হারানকাকাকে এটায় কথা বলতে। কালকে হোটেল থেকে কতসব খাবার এনেছিল হারানকাকা, পেটের মধ্যে সব যেন গুড়গুড় করছে। আর দাঁড়াতে পারেনা রাজু, ছুট লাগায়। আজকাল মাঠে গেলে অফিসের বাবুরা বাঁশি বাজিয়ে তাড়া করে। অগত্যা ভরসা এই রেললাইন।
ধুস্ আলোও জ্বলছে না মোবাইলটাতে। হঠাৎ রাজুর মনে পড়ে গতরাতে ঘর থেকে ভেসে আসে মা আর হারানকাকার কথাগুলো। হারানকাকা বলছিল, মোবাইলের সব ছবি সবাইকে দেখিয়ে দেবে। মা কাঁদছিল আর বলছিল, ছবিগুলো সবাইকে দেখালে মাকে আত্মহত্যা করতে হবে। বস্তির পুঁটিপিসি আত্মহত্যা করেছিল, আর কখনো ফিরে আসেনি পুঁটিপিসি। আত্মহত্যা করলে মানুষ মরে যায়। মা মরে গেলে রাজুর ভীষণ কষ্ট হবে। মাকে কিছুতেই মরতে দেবে না রাজু। মোবাইলেই ছবিগুলো আছে বলছিল হারানকাকা। মোবাইলটা কানে নিয়ে টিভির মতো স্টাইল মনের সুখে গালাগাল দেয় হারানকাকাকে। হারানকাকা নাই বা শুনল, মনের রাগটা কিছুটা যেন কমল রাজুর। এবার মোবাইলটাকেই শেষ করে দেবে । এই মোবাইল আর কোনদিন খুঁজে পাবে না হারানকাকা.......




রীনা রায়





তৃতীয় পর্ব:
এক একটা মানুষের চেহারা এমন হয় যে কিছুতেই বয়স বোঝা যায় না, কেমন একটু পাকানো টাইপের, এদের ত্রিশ বছর বয়সেও পঞ্চাশ মনে হয়, আবার সত্তর বছরেও পঞ্চাশ লাগে।
শেখরকে দেখতে ঠিক ঐ ধরনের, ওর বয়স এখন ছত্রিশ/সাঁইত্রিশ হলেও ওকে দেখে পঞ্চাশোর্ধ মনে হয়। নিজের এই পাকানো চেহারাটা নিয়ে শেখর একটুও খুশী নয়। সারাক্ষণ চোখে মুখে কি যেন একটা বিরক্তি লেগে থাকে, কোনো কিছুতেই যেন তৃপ্ত নয়।
চেহারা অনেকসময়ই একটা মানুষকে বিচার করতে সাহায্য করে, তার ইতিহাস বলে দেয়।
যেমন শেখরকে দেখেই বোঝা যায় ওর চলার পথটা মোটেও মসৃণ ছিলোনা এবং সেটা একশভাগ সত্যি।
শেখরের বাবা একটা প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন। তখন বেতনও পেতেন খুবই কম। কোনোরকমে দিন গুজরান হতো। তখন শেখর সবে ক্লাস এইট, আচমকাই বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়, দিনদুয়েক টানাপোড়েনের পর উনি মারা যান। জমানো পুঁজি কিছুই ছিলোনা, যেটুকু ছিলো বাবার চিকিত্সায় তাও শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই শেখরকে রোজগারের চেষ্টা করতে হয়। বাড়িতে ওর মাও টুকটাক সেলাই ফোঁড়াই করতেন।
সারাদিন নানারকম ছোটোখাটো কাজ, টিউশন পড়ানো আর রাত জেগে পড়াশোনা করে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে শেখর একসময়ে ইতিহাসে এম এ পাশ করে ফেললো। এরপর ভগবানের দয়ায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে চাকরিও পেয়ে গেলো।
কিছু টাকা জমিয়ে শেখর ততদিনে একটা দোতলা বাড়িও করে ফেলেছিলো।
শেখরের কোনো এক দূরসম্পর্কের পিসির ননদের বাড়ি ছিলো ওদের পাড়াতেই। কলেজে যেতে আসতে অনন্যাকে উনি দেখতেন।
অনন্যার তখন এম এ ফাইনাল ইয়ার। ইউনিভার্সিটি বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিলোনা, তাই ও বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতো। একদিন বাড়ি এসে দেখে পাড়ার ঐ কাকিমার সাথে আরও দুই ভদ্রমহিলা বসে আছেন । মা ওকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো, ওনারা নাকি ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনেছেন।
বাবার রিটায়ারমেন্টের সময় এগিয়ে আসছিলো, তাই ওর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বিয়েটা হয়েই গেলো। অবশ্য ওর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করেছিলো।
শেখরকে তখন অপছন্দ না করার মতো কিছু ছিলোনা। বাবা বললেন, ''দেখেই বোঝা যায় পরিশ্রমী ছেলে, আমার মেয়ে ওখানে খারাপ থাকবেনা"। কিন্তু মানুষকে ওপরে দেখে আর কতটুকু চেনা যায়! যে ঘর করে সেই জানে।
শেখরের মায়ের মিষ্টি ব্যবহারেও মা বাবা মুগ্ধ হয়েছিলো। উনি মানুষটা সত্যি তেমন খারাপ ছিলেন না, কে জানে হয়তো ওরই কপালে সইলোনা! না হলে এত যে ভালো মানুষ, ওর সাথে এত দুর্ব্যবহার কেন করতেন?
যাইহোক, এক শুভদিন দেখে, অনেক পাঁজিপুঁথি বিচার করে ওদের রাজযোটক সাব্যস্ত করে বিয়েটা হয়েই গেলো!
প্রথম প্রথম ওর ভালোই লাগতো, ভাবতো ওর স্বামী কতো কেয়ারিং! দিনে দিনে ও বুঝতে পারলো আসলে মানুষটা ভীষণভাবেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, নিজের পাকানো চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে, আর অনন্যা যেহেতু দেখতে সুন্দর ছিলো তাই সবসময় ওর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতো। কারণে অকারণে ওকে সন্দেহ করতো, এবং দিনে দিনে রোগটা বেড়েই চললো।
একদিন ও মন্দিরে পুজো দিতে গেছে, লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখলো শেখর লাইন থেকে বেরিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ও অবাক হয়ে যায়, তারপর দেখে একটু দূরে একটা ছেলে ওকে দেখছিল, তাকেই আড়াল করে শেখর দাঁড়িয়ে! দিনকে দিন এই পসেসিভনেস বেড়েই চললো। ও একা কোথাও বেরোতে পারতোনা, এমনকি ওর কোনো প্রয়োজনে টাকা পয়সা নিলেও তার প্রতি পয়সার হিসেব দিতে হত। কারুর সাথে ফোনে কথা বললে মোবাইলে স্পীকার অন রাখতে হতো। বাপের বাড়ি গেলে সঙ্গে করে গিয়ে আবার নিজে নিয়ে ফিরতো।
প্রতি মুহূর্তের এই নজরদারি ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল।
একবার সম্পর্ক ভাঙার কথাও ভেবেছিল। ঠিক সেই সময়েই ও সন্তানসম্ভবা হোল, অন্যদিকে ওর বাবাও হঠাৎই মারা গেলেন।
সবদিক থেকে ও যেন অসহায় হয়ে পড়লো।
(ক্রমশঃ)

শর্মিষ্টা দত্ত


অভিযোজন (২)

সকালে রান্না সেরে সেলাই মেশিন  নিয়ে বসেছিলেন ভারতী ।আজ বিকেলেই ডেলিভারি দিতে হবে ব্লাউজগুলো ।কাল সারাদিন মল্লিকাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন , কোন কাজই হয়নি ।পাড়ার দর্জির দোকান থেকে অর্ডার নিয়ে মেয়েদের জামা-কাপড়  সেলাই করেন ভারতী ।সামান্য যা আয় হয় তাতে তার নিজের খরচটুকু চলে যায় ।দাদার কাছে হাত পাততে হয়না ,সংসারের টুকটাক জিনিসপত্রও আনতে পারেন ,মল্লিকার হাতেও  অল্পসল্প দিতে পারেন কিছু  ।তাঁর নিজের আর কি ই বা এমন খরচ ! একা বিধবা ...তবু এই কাজটা করেন বলে নিজেকে এখনো দাদার সংসারের গলগ্রহ মনে হয় না । ভাইপোরা স্কুল আর দাদা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর বৌদি গেছে পাড়া বেড়াতে ।বাড়িতে ভারতী এখন একা ।আজ কিছুতেই কাজে মন বসছে না ,থেকে থেকেই কাল রাত্তিরে মল্লিকার জলভরা চোখদুটো চোখের সামনে ভাসছে । তাড়াতাড়ি হাত চালাতে লাগলেন ভারতী ।বাঁচাখোঁচা কাপড় দিয়েই বাচ্চার জন্য বানিয়ে ফেললেন দুটো ফ্রক ...ঝড়ের গতিতে ।

অর্ডারটা ডেলিভারি দিয়েই যেতে হবে মল্লিকার বাড়ি ।কে জানে ,কেমন আছে মেয়েটা ! নিজের বলতে তো এই একটা বোনই আছে তাঁর ।দাদা তো অনেক দূরের মানুষ এখন ...নেহাতই বেনিয়াপুকুরের এই বাড়িটা পৈত্রিক ,তাই ভারতী নিজের অধিকারেই থাকেন এখানে ।বছর তেরো  আগে ,বিয়ের দু বছরের মাথায় যখন ম্যালেরিয়ায় স্বামী মারা যান তখন বাবাই শ্যামবাজারের শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে এখানে ফিরিয়ে এনেছিলেন ।মল্লিকা তখন মাত্র এগারো  বছরের মেয়ে ,ওই বয়সেই দিদিকে আগলে রেখেছিল দুহাতে ।মা তো মারা গেছেন সেই কবেই ...মল্লিকার জন্মের তিন বছর পরেই ।মল্লিকা ছোটবেলা থেকে দিদির কাছেই মানুষ ।বাবাও  চলে গেছেন তাও প্রায় সাত বছর হতে চলল ।দুই বোনই পরস্পরের অবলম্বন হয়ে উঠল অবশেষে ।ন 'বছরের ছোট বোনটাই এখন ভারতীর সব । সম্ভব হলে মল্লিকাকে এখানেই নিয়ে আসতেন হাসপাতাল থেকে , কিন্তু দাদা -বৌদি কালই সাফ বলে দিয়েছিল ,ভারতী যেন মল্লিকাকে তার শ্বশুরবাড়িতেই রেখে আসে ।দাদার পক্ষে আর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব না ।

সারাটা দুপুর ধরে প্রায় দশটা ব্লাউজের বোতামঘর সেলাই করে ,হুক লাগিয়ে , গলায়-পিঠে হেম দিতে দিতেই বিকেল সাড়ে চারটে বেজে গেল ।রোদ পড়ে এসেছে , শীত কামড় দিচ্ছে শরীরে ...ঘরে পরার শাড়িটার ওপরেই একটা মোটা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভারতী ।'পরিধান টেলর্সে ' গুণে -গুণে দশটা ব্লাউজ ডেলিভারি দিয়ে ,পরবর্তী কাজের জন্য ছিটকাপড় ভরে নিলেন ব্যাগে । তারপর টাকা-পয়সা বুঝে নিতে নিতেই সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল ।ইতিমধ্যেই  ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে ।তাড়াতাড়ি পা চালালেন ভারতী ...মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকান থেকে পাঁচ টাকার সন্দেশ নিলেন ...মল্লিকা ভালোবাসে ।শুধু তার জন্য নিলে তো হবে না ...তার শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্য সবসময়ই বেশি বেশি করেই জিনিস নিয়ে যেতে হয় ভারতীকে ।এসব সামাজিকতা -কর্তব্যের দায় তাঁরই ...দাদা থাকতেও ! অবশ্য দাদা যে প্রণবের সঙ্গে মল্লিকার বিয়েটা দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছে , এটাই অনেক ! নয়তো মল্লিকার বিয়ে নিয়ে অশান্তি তো কম হয়নি ।ভারতীই কি মেনে নিতে পেরেছিলেন ! তবু অদৃষ্ট বলে মেনে নিয়েছেন সব । নয়তো তাঁর বিএ পাশ ,এমন সুন্দরী বোনের কি প্রণবের মতো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা !

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তাঁতীবাগানে ঢুকে পড়লেন ভারতী ।গলির মোড় থেকেই উমা আর প্রণবের উত্তপ্ত বাক্যালাপ আর মল্লিকার চাপা কান্নার আওয়াজ কানে এল তাঁর ।বন্ধ দরজাটার সামনে মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে করাঘাত করলেন ...আকস্মিক থেমে গেল সব আওয়াজ ...নিরুপায় নৈঃশব্দে ডুবে গেল শীতের সন্ধ্যে ।

স্বপন রায়

আহমেদ শামলৌ এবং ফার্সি কবিতার বাঁকবদল #
........................................................................
      ‘সমুদ্র হিংসে করে তোমায়
      তুমি কুঁয়ো থেকে একফোঁটা জল খেয়েছিল!’

#
আহমেদ শামলৌ, তাঁর হৃদয়বিচ্ছুরণ, তাঁর ফার্সি অভিযোজনা এক অস্থির প্রত্যয়ে তাঁকে নিযুক্ত রেখেছিল কবিতায়।তিনি রাজনৈতিক ভেদশক্তিকে কবিতার আর্তি শুনিয়েছিলেন।১৯২৫ থেকে ২০০০, একটি শতাব্দীর পঁচাত্তর শতাংশ আহমেদ শামলৌ-এর সঙ্গে বেঁচেছিল আর কবিতা, ফার্সি কবিতা মূলত তাঁর হাত ধরেই মুক্ত হয়েছিল হাফিজিয়ানার ছান্দসিকতা থেকে তাঁর ‘শের-এ-সফেদ’ এর মাধ্যমে।তবে এই ধারামুক্তি শামলৌ-এর ক্ষেত্রে শুধু কবিতাই ছিলনা। তিনি ইরানের শাহ এবং  মৌলবাদী ইসলামি বিপ্লবের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন।দুই আমলেই তাঁকে জেলে যেতে হয়।ইসলামি আমলে তাঁর বইগুলো নিষিদ্ধ করা হয়।তবে শামলৌ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়ের বিরোধীদের সঙ্গে আমৃত্যু আপোষ করেননি।
#
 ‘জল ছিল খুব বাঁধভাঙা, সেই জলের ঘুমে আমি
  রাস্তা খুঁজি তোমায় ভেবে,আমিও কি ছাই জানি
  কিভাবে ওই ভ্রুয়ের হানায় আমার ছদ্মবেশ
  ধুসরতায় কুড়িয়ে পেল রঙিন সুরার রেশ
  নিচ্ছি সুরা নীতির ফাঁকে একটি কোনে বসে
  ভাবনাগুলো পাখিই হল তোমার সঙ্গদোষে...’(হাফিজের লেখার অংশ, অনুবাদে)
হাফিজের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সহজ ছিলনা।এই অনন্য কবির উদাস সুফিয়ানা যে ‘রুবাইয়াৎ-এ-হাফিজের’(কবি নজরুল অনুবাদ করেছিলেন)সৃষ্টি করেছিল তার প্রভাব শুধু ইরান কেন সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ে!মাত্রাশাসিত হাফিজি গজল(গজল হাফিজেরই দেন) এখনো তার সাংগীতিক আবেশে মুগ্ধ করে কাব্যরসিকদের।তবে শুধু হাফিজ(১৩২৫/২৬-১৩৮৯/৯০) কেন, ওমর খৈয়াম-এর(১০৪৮-১১৩১)রুবাইয়াৎ -এর প্রভাবও বহ শতাব্দী ধরে ফার্সি কবিতাকে ভাবানুবন্ধনে আটকে রেখেছিল।আর আহমেদ শামলৌ-এর মত কবিদের কাছে ওমর খৈয়াম, হাফিজের প্রতিষ্ঠিত ঘরানা থেকে বেরিয়ে আসাই ছিল রীতিমত চ্যালেঞ্জের।হাফিজের গজল ছিল ঘনসংবদ্ধ, মাত্রাশাসিত, অনুপ্রাসিত, ভাওয়েল এবং কনসোনেন্টের ঐক্য এবং স্বরসাদৃশ্যের সমতা, বিপরীতধর্মিতা,সমান্তরালতা নিয়ে এক ভাবনাগহন খেলা। অঙ্ক তো ছিলই, কিন্তু গভীর কল্পনা আর রসবোধের সূক্ষ্মতায় হাফিজের গজলকাঠামো গড়ে উঠেছিল।এই গঠনের তারতম্য ঘটতে শুরু করে  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বব্যাপী নরসংহার, অক্ষশক্তি এবং মিত্রশক্তির চূড়ান্ত লড়াই, সমাজতান্ত্রিক মতবাদের উত্থান, ফ্যাসিবাদের পতন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, নান্দনিক পরিসর স্ফীত হতে থাকে, মূল্যবোধের সঙ্করায়ন শুরু হয়ে যায়, ভাষা মুক্ত হতে থাকে। এরকম একটা সময়ে আহমেদ শামলৌর লেখালিখি শুরু হয়।
#
আহমেদ শামলৌর জন্ম ১২ ডিসেম্বর ১৯২৫-এ তেহরানে।বাবা ছিলেন আর্মি অফিসার।বদলির চাকরি।ঘুরে বেড়াতে হত পুরো পরিবারকেই।১৯৩৮ সালে শামলৌ স্কুলের পড়া শেষ করে তেহরানের টেকিনিকাল কলেজে ভর্তি হন।এই সময়টায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওয়ার্ম-আপ শুরু হয়ে গেছে।হিটলার জার্মানিতে মানবতার সব চেয়ে বড় অপরাধগুলির মহড়া শুরু করে দিয়েছে। শামলৌ কবি ‘নিমা উশিজের’ কবিতায়   সম্ভবত এই সময়েই আকর্ষিত হন।নিমা উশিজের লেখাতেই তিনি সাবেকি ছন্দের কাঠামোকে (আরো নির্দিষ্ট অরে বললে,হাফিজি কাঠামো)ব্যাপ্ত করার, মুক্ত করার অনুপ্রেরণা পান। নিমা উশিজের লেখালিখি “শের-এ-নিমাই” ধারা হিসেবে পরিচিতি পায় সমগ্র ইরানে।উশিজ ফার্সি কবিতার প্রচলিত তাল এবং অন্ত্যমিলকে নান্দনিক ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে নতুন ফার্সি কাব্যকাঠামো আর কাব্যভাষা তৈরি করার সাহস দেখিয়েছিলেন।াহমেদ শামলৌ এর গুরু  নিমা উশিজের একটি লেখা পড়া যাকঃ

‘হলুদ অকারণে লাল হয়নি
লাল এখনো রঙ রাখেনি অকারণের দেয়ালে

সকাল এসেছে আজাকু পর্বতের ধার ঘেষে
ভাজনা পাহাড় তবু পরিষ্কার নয়
হাল্কা আলোর তুষার এই হযবরল ক’রে চলেছে
তার ছোঁয়া জানলায় কার্নিশে
#

এই যে ভাজনা পাহাড় দেখা যাচ্ছেনা
মন তো খারাপ হবেই
অতিথি না-চাওয়া অতিথিনিবাসগুলোর মুখ ভার হয়ে আছে
একজনের জড়িয়ে যাওয়া আরেকজনের সঙ্গে
এত অপরিষ্কার আলো আজ
লক্ষ্যহীন
কিছু মানুষ এখনো ঘুমে
কিছু অমার্জিত
কিছু সরল মানুষ’  (আমার মেঘলা ঘর)
#
হাফিজের কবিতার ঘরাণা এভাবেই বদলে যাচ্ছিল।আগেই বলেছি আহমেদ শামলৌ-এর বাবা সামরিক অফিসার হওয়ার জন্য তাদের ঘুরতে হত বিভিন্ন জায়গায়।তিনি যখন এভাবে ভ্রাম্যমান তাঁর প্রেরণাস্বরূপ নিমা উশিজ(১৮৯৬-১৯৫৯)তখন সাবেকি ফার্সি কবিতাকে  এক নিগড়মোচিত আবহাওয়ায় নিয়ে যাচ্ছেন। তবে নিমা উশিজ ক্ল্যাসিকাল গঠনশৈলিকে পুরোপুরি বর্জন করেন নি!আহমেদ শামলৌ-এর হাতেই ফার্সি কবিতা মুক্ত হয়েছিল প্রাচীনত্বের মনোরম শৃঙ্খল থেকে।এই ধারামুক্তির সঙ্গে কোথাও না কোথাও শামলৌ-এর ব্যক্তিগত জীবনের ঝোড়ো ওঠানামাময় বৈচিত্রের যোগ রয়েছে ব’লে আমার মনে হয়।ইরানের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি নানাকারণে স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেন নি! স্বাভাবিক নিয়মেই বয়ঃসন্ধির যে সময়ে স্কুল পেরনোর কথা তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়!গ্রেপ্তার করে লালফৌজ।কারণ তাঁর বাবা অক্ষশক্তির সেনা অফিসার ছিলেন।একবছরের কারাবাসের পরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পিতাপুত্র দু’জনকেই  গ্রেপ্তার ক’রে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। একেবারে শেষ মুহূর্তে আসা নির্দেশের ফলে প্রায় অলৌকিকভাবে তাঁর মুক্ত হন!এরই মধ্যে শামলৌ সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় আকৃষ্ট হয়েছেন। আবার এরই মধ্যে তিনি চেষ্টা করেছেন হাইস্কুলের পরীক্ষায় বসার কিন্তু প্রতিবারই কোন না কোন বাধা এসে পড়ায় আর বসা হয়ে ওঠেনি !বিয়ে করেছিলেন তিনবার। প্রথম দুটি টেঁকেনি।তবে তাঁর তৃতীয় বিয়েটি সুখের হয়েছিল।এই স্ত্রী আয়েদাকে নিয়ে লেখা তাঁর কিছু কবিতাও আছে!
#
‘মোহাম্মেদ মোসাদেঘ’ ছিলেন স্বাধীনভাবে ভোটের মাধ্যমে জিতে আসা ইরানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৫১-১৯৫৩)।উদারনৈতিক, সেকুলার, সংবেদনশীল কবি ও লেখক মোসাদেঘের অন্ধ ভক্ত ছিলেন আহমেদ শামলৌ।‘মোহাম্মেদ মোসাদেঘ’   ভূমিসংস্কার, জমির খাজনা মকুব সহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা জনিত পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন।তবে ১৯১৩ সাল ব্রটিশদের মালিকানায় থাকা , ‘Anglo Persian oil Company’র জাতীয়করণ করতেই তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকা আর ব্রিটেন ইরানে সামরিক অভ্যুথান সংঘটিত করিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ‘মোহাম্মেদ মোসাদেঘ’কে ক্ষমতাচ্যুত করায় ।আহমেদ শামলৌ আত্মগোপন ক’রতে বাধ্য হন।ছ’মাস আত্মগোপন ক’রে থাকার পরে তাঁকে মিলিটারি জুন্টা গ্রেপ্তার করে।এক বছরেরও বেশি সময় বন্দীথাকতে হয় তাঁকে। জেল থেকে বেরিয়ে আহমেদ শামলৌ আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন কবিতাসহ  সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়।নিজের কবিতায় যেমন তিনি নিরিক্ষাকে নিরন্তর প্রয়োগের মাধ্যমে চূড়ান্ত করছিলেন একইভাবে ঐতিহ্যবাহী ফার্সি সাহিত্যের রক্ষনাবেক্ষন, অনুবাদ এবং সম্পাদনাতেও তিনি একইভাবে সক্রিয় ছিলেন।অন্যদিকে নিজের সেকুলার এবং সামাজিক ন্যায় ভিত্তিক অবস্থানেও অনড় ছিলেন।
#
আহমেদ শামলৌ কিভাবে ফার্সি কবিতাকে নতুন করার মত একেবারেই অসামাজিক একটি নান্দনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিপীড়নমূলক একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরন্তর সক্রিয়তাকে মেলাতে পারলেন আমি জানিনা। যেকোন প্রেক্ষাপটেই এটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। সাধারণত এক্ষেত্রে কবিরা প্রতিবাদের টাইমসারভিং কবিতাই লিখে যেতে থাকেন। কবিতাকে নতুন করার মত অজনপ্রিয় একটি কাজে মনোনিবেশ করার মত সময় তাঁদের থাকেনা!শামলৌ এই কঠিন কাজটাই করেছেন। কবিতার বিপ্লব গরম গরম বুলি বা চিৎকার ক’রে হয়না! আহমেদ শামলৌ-এর সারাজীবন ধরে এর প্রমাণ দিয়ে গেছেন!
#
১৯৪৮ সালে তিনি “সোখাম” পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করেন।প্রথম বইটি কবিতার বই ‘ দ্য ফরগটেন সং’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে।১৯৪৮-এ গল্পের বই,’দ্য উওম্যান বিহাইন্ড দ্য ব্রাস ডোর’।তবে ১৯৫১ সালের ‘মেনিফেস্টো’ কাব্যগ্রন্থে তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসে।আবার এসময়েই ফার্সি কবিতার প্রতিষ্ঠিত আদল ভাঙার কাজেও তাঁর কলম সক্রিয় হয়ে ওঠে!নিমা উশিজের লেখায় যে নতুনায়ন শুরু হয়েছিল ফার্সি কবিতার আহমেদ শামলৌ তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান! এমন নয় যে তাঁর কবিতা ছিল সহজ সরল উচ্চারণের সমাহার! যেমন প্রতিবাদী কবিদের কবিতা হয়ে থাকে।এক জটিল ছাঁচভাঙা আঙ্গিকের মধ্যে জীবনপ্রভার অচেনা অনুভবের বিচ্ছুরণ নিয়ে আসতে শুরু করেন আহমেদ শামলৌ।আর এই প্রক্রিয়াতেই তিনি আধুনিক ফার্সি কবিতার অন্যতম পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন!আহমেদ শামলৌ-এর কিছু কবিতা পড়া যাক। অনুবাদ যেহেতু ইংরেজি অনুবাদের অনুবাদ,খামতি থেকেই যাবে। আমিও অসহায়, ফার্সি জানিনা!
#
১.
সে রোগা
লম্বা আর মেদহীন
জানা ছিল যে
একটি শব্দে রাখা দুরূহ বার্তা
যেন সেই
#
চোখে মধুমাখা প্রশ্রয়
       আর প্রশ্ন
মুখ জুড়েই সত্য
 আর বিরোধী হাওয়া
সে
ঝলসানো কিছুটা
#
স্বল্পবাক একজন
সঙ্গে ঘোরাজলের শব্দ
নিজেই নিজের কথা বলছে এমন
পোকারা তাকিয়ে আছে তোমার শস্যের দিকে এমন (জালাল আল-ই-আহমেদ স্মরণে/ অংশ)
#
২.
ঘাসজমির ফুটিফাটা ভোর
 একজন ঘোড়সওয়ার
 একা
 দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ
 লম্বা কেশর ঘোড়ার মিশে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়
 #
 হে ঈশ্বর
 সে কথা বলুক
 অস্থির হোক
  যা কিছু হবে বা হতে পারে সবই কিন্তু হ’তে চলেছে

  #
  মেয়েটি
  হেজের কেয়ারি ছুঁয়ে
  তার মিহি স্কার্ট কাঁপছে
  হাওয়ায়
  কথা না-বলা মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে
 #
 হে ভগবান
 মেয়েটি কথা বলুক কিছু করুক
 যখন
 পুরুষ কিছু বলছে না
 বা করছে না
 শুধু বুড়ো হয়ে যাচ্ছে...(বিষণ্ণ গান)
#

৩.
    ‘আমি তোমায় ভালবাসি’
    বলেছ, না বলোনি
    এটা জানার জন্য ওরা তোমার
    নিশ্বাসের
    গন্ধ শুঁকবে
   #
   হৃদয়ের গন্ধও বাদ যাবেনা
   কঠিন সময় এখন
   প্রিয়তমা
  #
  ভালবাসাকে মেরে
  কানাগলির পোস্টে ঝুলিয়ে দিচ্ছে ওরা
  দেরাজে রাখতে হবে ভালবাসাকে
  এখন
  #

 এখন এই সর্পিল কানাগলিতে
 পোড়ানো হচ্ছে কবিতা আর গান
 যারা পোড়াচ্ছে
 তাদের মাথা ঠাণ্ডা তাদের চাউনি শীতল
 #
 এমনকি ভাবনাতেও ‘না’
 ওরা
 গভীর রাতে
 দরিজায় নক্‌ করছে
 আলোগুলো মেরে ফেলতে চায়
এখন
আলোও লুকিয়ে রাখতে হবে
ওই দেরাজেই
ভালবাসার পাশে
#
রাস্তার মোড়ে মোড়ে
ওরা
হাতে ধারালো অস্ত্র
কাটারি ছুরি ড্যাগার, খুব কঠিন সময় এখন
প্রিয়তমা
#
ওদের হাসি
সার্জারি ক’রে ঠোঁটে
আর গানগুলো 
মুখে লেপ্টে দেয়া হয়েছে
খুশি
আর আনন্দগুলো সরিয়ে নিতে হবে
যেভাবে
ভালবাসা আর আলো সরিয়ে রেখেছি আমরা
#
মদে
আর হুল্লোড়ে
ওরা পাখির মাংস পোড়াচ্ছে
লিলি আর লাইলাকের
আগুনে
ওদের উৎসব মানে আমাদের চেয়ে থাকা
#
ভালবাসা, আলো, খুশির পাশে
এবার ঈশ্বরও
দেরাজের ভেতরে পাশাপাশি
ভীত
#
বাইরে শুধুই খুন আর গান  ( এই কানাগলিতে)
#
ক্রমশ

তৈমুর খান

তুমি তো জলের মতো
                      

তুমি তো জলের মতো
তোমার সন্দিগ্ধ স্রোতে নামতে ইচ্ছা হয়
এতদিন তীরে তীরে তীর্থ খুঁজে ফিরি
তীর্থে তুমি নেই
শুধু গাছেরা ঝরায় পাতা
উন্মুখ আকাশ চেয়ে থাকে জলে

তুমি তো জলের মতো বহমান স্রোতে
যুগতরী ভাসিয়ে নিয়ে যাও
কারা সব তরীতে যায় ? আমি শুধু ভ্রম
সুদূরের নীরব মরীচিকা

উড়ন্ত ছায়ার ভাষা আমাকে ভেজায়
অথবা ভেজায় না যদিও
কিছুটা প্রলাপ পাই , কিছুটা কুয়াশা
হাওয়া বয়ে যায় দেখি, হাওয়ায় হাওয়ায় গূঢ় পরকীয়া....

অনিন্দ্য রায়

হয়তো তোমারই



স্পর্শলতাটির পাতা ছিঁড়ে আমি তোমাকে পড়াই
খুলি হাওয়ার চাদর, কামিজ জলের
    আর চুলে যে রাত্রির ফিতে তা-ও খুলে
                                             বিছানায় পাতি
ঘুমের কলসি ফেটে ঘরময়  বিভূতি ছড়াল

মাখি গায়ে, তোমাকে মাখাই
আমাদের চিন্তাগুলি সাঁই-
সাঁই ওড়ে, তাদের রেচন
মুখে লাগে, আদরের ধন
পান করি একসাথে, চাটি

তোমার শরীর আজ আহার্যের বাটি

একেকটি ব্যঞ্জন খাই, তারপর ধুয়ে নিয়ে
                                     উপুড় করে রাখি
হাত ঘষি পিঠে
বাটি গরম হয়ে উঠলে আবার উল্টে দিই
দেখি, ভেতরে সমস্ত জল বাষ্প হয়ে আছে
আমিও বাড়াই জিভ
             ওই ফোঁটা ফোঁটা কামকুয়াশাকে খাই
এবং শরীর ফুলে ওঠে
এবং শরীর গত শতাব্দীর সেগুনগাছের মতো ফুলে ওঠে
এবং লতাটি তার কাণ্ড জড়িয়ে বড়ো হয়
ফোটে ফুল
কেশের বাদ্যের গুঁড়ো
         বাজে তা-ও
             সেই শব্দ নীহারিকা পের হয়ে যায় আরও দূরে

সেখানে কি আছে মাটি
    পৃথিবীর মতো থকথকে লেই?
আছে লোহা-তামা-পেতল-ইস্পাত ?

আয়ুধ বানিয়ে নিতে সেখানেও বন্ধক রাখতে  হয়
         হৃদয়-বাসন !
সেখানেও গাছ হয় বীজ থেকে
অপরিচিতের লতা  ছুঁতে চেয়ে যেই হাত বাড়ালাম
ঝনঝন করে নীরবতা ভেঙে গেল
কথার পাতায় আলো কেঁপে উঠল
          তোমার মুখের বিকিরণে
         

ভজন দত্ত



(প্রিয় পাঠক গত সংখ্যায় লেখা দিতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি।না,কোনো অজুহাত নয়।পারলে ক্ষমা করবেন।)
            ।।  পুরুলিয়ার মুখ ।।
                                     ভজন দত্ত
দ্বিতীয় পর্ব :
৪.
বর্তমানে বিশ্ব একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের ধাক্কায় সবকিছুর মধ্যেই নানান পরিবর্তন এসেছে।এই বাংলার 'মুখোশ গ্রাম ' চড়িদাতেও লেগেছে সেই পরিবর্তনের ঢেউ। টিভি ও ফিল্মি দুনিয়ার প্রভাব এসেছে।যেমন, শিবের মুখোশের মধ্যে ব্যাটারির আলো জ্বালিয়ে তৃতীয় নয়ন বা কোমরে ব্লাডার বেঁধে শিবের জটায় গঙ্গার জলধার করা এসব। অনেকে আক্ষেপ করে বলেন,  মুখোশ ও বীরত্ব ব্যঞ্জনাই হল ছৌনাচের আসল। তা যেন এখন পুতুল নাচ হয়ে যাচ্ছে। মুখোশ তৈরির ব্যয় বাড়ছে দিন দিন তাই সাদা সাপ্টা স্বল্পব্যয়ে মুখোশের ব্যবহার ও চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে পর্যটন শিল্পের বিকাশের ফলে পর্যটকরাও মুখোশ স্মারক হিসাবে ক্রয় করছেন পুরুলিয়া শহর বা চড়িদা বা ঝালদা বা জয়পুরে।জয়পুরের ডুমুরডি গ্রামেও মুখোশ তৈরি হয় একই পদ্ধতিতে। তরুণদেব ভট্টাচার্য্য তাঁর পুরুলিয়া গ্রন্থে  ( প্রকাশ:১৯৮৬) লিখেছেন, " দশবছর আগে চোড়দায় মুখোস তৈরি করতেন ২৯ টি পরিবার।পরবর্তীকালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ টি। ডুমুরডিতে সংস্থা আছে তিনটি। বর্তমানে আরো কটি জাশগায় মুখোশ তৈরি সুরু হয়েছে।তাদের মধ্যে অন্যতম,পাড়া,ঝালদা ১নং ব্লক,সাঁতুড়ি ও আড়শা। "( বানান অপরিবর্তিত, পৃষ্ঠা  ৩৩৭-৩৩৮) বর্তমানে পুরুলিয়ার শিল্প মানচিত্রে এই মুখোশ শিল্প এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিকমত বিপণন করতে পারলে মুখোশ শিল্প থেকে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
৫.
চড়িদা গ্রামে দত্ত,শীল ও পাল পদবীধারী সূত্রধররা সপরিবারে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।লোকশ্রুতি যে তাঁরা এসেছিলেন বর্ধমান জেলা থেকে।তাদের জমি দিয়েছিলেন, তখনকার বাগমুন্ডির রাজা।তা এমনি এমনি দেননি সে জমি । তার পিছনে জমিদারের শর্ত ছিল।সে শর্তটি হোল,জমিদারের দেবদেবীর মূর্তি গড়ে দিতে হবে।নানান দেবদেবীর মধ্যে ভাদুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরাই পুরুলিয়ায় মুখোশ তৈরির সূচনা করেন। আর তার পিছনে বাগমুন্ডির রাজা বা জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। যতদূর জানা যায় এই চড়িদা গ্রাম থেকেই জয়পুর থানার ডুমুরডি ও অন্যান্য জায়গায় তারা বসতি স্থাপন করে।
৬.
প্রস্তরযুগের পরবর্তীকাল থেকেই মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক সকল পর্বেই ব্যবহৃত হয়েছে মুখোশ।মুখকে ঢেকে রাখাই তার কাজ। আর নৃত্যে মুখোশের ব্যবহার আদিম লোকসমাজের এক অভ্যেস।পৃথিবীর সবদেশেই তা  দেখা যায়। ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার জাভা,সুমাত্রা, বলীদ্বীপ, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা মহাদেশে,সুমের সভ্যতায়,গ্রীক ও রোমান রাজত্বে, দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলে ও পৃথিবীর আরো নানান জায়গায় নানান কারণে মুখোশের ব্যবহার দেখা যায়। প্রবহমান সেই  পরম্পরা বহন করে চলেছে পুরুলিয়ার মুখোশ।লোকায়ত স্তরে নৃত্যে বিশেষ করে ছৌ নৃত্য মুখোশ ছাড়া ভাবাই যায় না। বর্তমানে আজ তা বাস্তবিকই শুধু পুরুলিয়ার মুখ নয়, বাংলার রূপ হিসেবে স্থান লাভ করেছে। তো, কবি কী বলতেন, এই পুরুলিয়ার এই মুখোশ দেখে। আমাদের মুখোশ গ্রাম চড়িদা আজ বাংলার গর্ব।
ঋণ:
১/ পুরুলিয়া : তরুণদেব ভট্টাচার্য্য, ফার্মা কে এল এম, কোলকাতা : ১৯৮৬
২/ পশ্চিমবঙ্গ ( পুরুলিয়া জেলা সংখ্যা),জুন, ২০০৭
৩/অহল্যাভূমি পুরুলিয়া : সম্পাদনা, দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন, কোলকাতা : জুলাই, ২০০৩
আলোকচিত্র : উজ্জ্বল দাস। 

পৃথা রায় চৌধুরী


ফল / 

ভোরের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেল
মণিদা' ভরা মাসের পোয়াতি বউ
চির বধির করে গেল বুঝি ঘুমভাঙা পাড়া।

ঢুকে আসে তুলো তুলো সদ্যোজাত কান্না,
ফিডিং বটলস্ট্রেচারে মৃত মাতৃসুখ।

এখন দূরে দূরে ছায়া হয়ে থাকে মণিদা
তুলোকান্নার চারা ঢেকে রেখেছে
গাছের আমানত।

শর্বরী মুখার্জী ও সিলভিয়া ঘোষ


 শঙ্খবেলা



এসো আজ আমরা শরীরী হয়ে উঠি
শঙ্খ লাগা মন দুটি বেঁচে উঠুক শরীর থেকে শরীরে
আমাদের প্রেমের কবিতারা আজ সঙ্গীত হয়ে জবাব দিক সঙ্গমাবদ্ধ দু জোড়া ঠোঁটে

চরম শরীরী আবেশে আমার চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে আসা জল, আজ পূর্ণতা পাক তোমার ঠোঁটের ছোঁয়ায় ঠিক যেমনটা চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরের পর
কালবৈশাখী আসে, তছনছ করে দেয় সাজানো বাগান কে, সেইরকম... ঠিক সে রকম পাগল হাওয়া বইয়ে দাও আমার হৃদয়ে আজ

জানি মন তুমি প্লেটোনিক প্রেমে বিশ্বাসী কিন্তু আমার মনেরও যে একটা শরীর আছে!! 
শরীরের একটা খিদে আছে... প্রেমে সবটা চাই... সবটা... মন সায় দেয় যেখানে শরীর তো সেখানেই জাগে... 

জানি অন্তরবাসের কয়েকইঞ্চি নীচে থাকা লাল টকটকে হৃদয়ের কথা সব প্রেমিক পুরুষের জানা থাকে না শুধু লাল তিলকেই হৃদয় ভেবে আদর করে বারবার, গভীর হীরের খনিতে নামতে চায়না কেউ
শ্লেট পাথরের গায়ে অংহকারের নাম খোদাই করতে মরিয়া হয়ে ওঠে...

কিন্তু ঐ লাল হৃদয়টারও যে একটা শরীর আছে! 
সেই শরীর কে চেনে ক'জন? সবাই তো মাতে যৌনতাতে... সেখানেও হৃদয়ের ক্ষত হয় কতশত...   মলম লাগিয়ে দিয়ে ক্ষত ভরাট করতে  পারে ক'জন 
শরীরকে ভালবেসে চরম শরীর হয় ক'জন ? এসব তথ্য  জানে কোন্ পরিসংখ্যান !

মৃনালিনী

"সম্পর্কের সুতো ও সময়"
                ১
হাত বাড়ালেই বন্ধু হয় না প্রমিক হয়
ঝোলাগুড় প্রেমিক
একটুু বেসামাল হলেই অন্যের পাতে।
                 ২
স্বামী একটু আলাদা
গোবেচারা টাইপ
সুযোগ পেলেই অন্যের দুধের পাতিলে
চোখ বন্ধ করে চুকচুক চুকচুক
ধরা পড়ে গোঁফে লেগে থাকে দাগে।
                 ৩
কুমারী বসন্তের কোকিল
ঋতুর মতোই বন্ধু নামে প্রেমিক বদল
একটা দুটো অ্যাবোশন না হলে যুবতী
                      নারী হয় না আজকাল!
                   ৪
বিবাহিতা  চলমান বৌদি
পরিনীতা তাই জমে জমে খেলা
শুধু সুতো বাঁধা উরন্ত ঘুরি চাই নরম মান্জা।
                   ৫
ধর্ষিতা চারিদিকে তাকিয়ে দেখো
এবার চোখের জলে স্বপ্নের নৌকা ছাড়ো
বর্ষা ওই  ওই যে এল...

                                                                 
                                                                  

শুভশ্রী সাহা


সম্পর্ক

হয়তো তোমার জন্যে কেউ অপেক্ষায় ছিল,
আমার থেকে অনেক বেশি সুযোগ্য
তাই পেরিয়েছো অক্লেশে চেনা গন্ডি
ফেলে রেখে তোমার সাজানো ঘর
তোমার জমি একলা  পুরোনো বর
এখনো বারান্দার রেলিঙে ভিজে শাড়ির দাগ
তোমার রাখা টবের চারার তোলা মুখ
হয়ত মানাতে পারিনি মানতে পারনি তুমিও
একলা ঘরে তুমিই পারমিতা এখনো
মনে পড়ে দুপুর রোদে কাটাকুটি খেলা
পায়ের দাগে আলতো চুমু নরম বেলা
এখনো কি হাসতে গেলে নাকের পাটা ফোলে
ঘেমে নেয়ে রান্না ঘরে বড় কাহিল হতে
শ্রান্ত আমি ভীষন এখন,  পালটে গেছি আমি
গভীর রাতে শুধু ভাবি কবে ফিরবে তুমি--

জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি


মূর্খ কাগজে আমি নারী লিখলাম

খোঁড়াখুঁড়ি। ঘোরাঘুরি
মৃদু কোলাহল। মেঘলা দিন
আঁচলে মুখ মুছলে
                    দুপুর
একটি গোপন খেলা

অতঃপর
মূর্খ কাগজে আমি নারী লিখলাম





সেসব খালবিলে বৃষ্টি হতে নেই

বিশ্বাস করি আসন্ন আকাশ’ও
ভরে যাবে ভিক্ষার থালার মতো
ভাগাড়ে ফুল ফুটবে বা উড়ন্ত কাক

যতটুকু পারো
                    বুক থেকে সিঁড়ি
সেসব খালবিলে বৃষ্টি হতে নেই



ধানরঙা শরীর ভেঙে

আমাদের দূরত্বের মাঝে
হাত বাড়িয়েছে সন্ধি
সবটুকু উষ্ণতার ভিতর
হেঁটে গেলে কোনদিন
ধানরঙা শরীর ভেঙে
                       বি-রতি

নতুন অতিথির আগমনে





দূরবর্তী ছায়াপথে প্রথম ফুল
হাতের তালুতে কী অকারণ ভালোলাগা
বিজ্ঞাপনে। প্রতিসরণে। প্রতিক্রিয়ায়
লিপিবদ্ধ নিখোঁজ টেলিস্কোপ

দূরবর্তী ছায়াপথে প্রথম ফুল
        কেন্দ্র ছুঁয়ে জেগে থাকে
                গভীর থেকে গভীরতর ঘুমে



শমিতা চক্রবর্ত্তী


বেলা শেষের আলোয় 
-------------------------------
                            
                      -------------------------

পায়ে কোনরকম চপ্পল টা গলিয়েই দৌড় দিলো স্নিগ্ধা --ইস্ আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে ! যাবার আগে একবার নিজের ব্যাগ টা চেক করে নিলো --মায়ের প্রেসক্রিপশন টা নিয়েছে তো --মায়ের প্রেসারের ওষুধ টা আজ আনতেই হবে -ওটা ফুরিয়ে এসেছে .

               আজ প্রায় ছমাস হতে চললো এই শুভঙ্কর স্যার এর বাড়ির কাজ টা .কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে লোকটার প্রতি !  কী ভীষণ নির্ভর করছে লোক টা ওর ওপর ! ও না গেলে সকালে ব্রাশ টা পর্যন্ত করতে চায়না -রঘু দার হাতে .আসতে আসতে অবশ্য হাত -পা এখন অনেক টা ই সচল --ওয়াকার ছাড়া একটু একটু করে হাঁটছেন ও এখন . প্যারালাইজড অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল হলেও --মনটায় বোধ করি এখনও জোর পাচ্ছেন না ! 

          ডক্টর মহুয়া ম্যাম এর সময় কোথায় স্বামীর দেখভাল করার !  ভীষণ ব্যস্ত মানুষ ! ওনার নার্সিং হোম 'জীবন -দীপ ' এই শহরের নামী দামী নার্সিং হোম গুলোর মধ্যে একটা ! তার ওপর আজ দিল্লী কাল মুম্বই এ সেমিনার লেগেই থাকে !  তাই তো নিজের নার্সিং হোমের একজন কেয়ারিং নার্স কে স্বামীর দেখভালের জন্য নিযুক্ত করেছেন ! 

              স্নিগ্ধা ঠিক যা ভেবেছে তাই --উনি ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ বসে আছেন -রঘু দা কতবার সেধে গেছে -'সাহেব চলুন ব্রাস টা করে নিন , রাতের বাসী জামাকাপড় গুলো ছেড়ে ফেলুন ' . কিন্তু ঐ এক গোঁ --স্নিগ্ধা আসুক না ! 

               ও বাবা স্যারের মুখ ভার !  গম্ভীর গলায় ----কি ব্যাপার স্নিগ্ধা এতো দেরী যে --আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছি !  স্নিগ্ধা মিষ্টি হেসে ----- মাফ করবেন স্যার -আজ বড় দেরী হয়ে গেলো --মায়ের শরীর টা তেমন ভালো নেই -একটু ঘরের কাজ ও সেরে আসতে হল .

      মিষ্টি হাসি বুঝি সব কিছু ভুলিয়ে দেয় !  শুভঙ্কর সেন ও সব ভুলে বললেন ---- সে না হয় হল কিন্তু স্নিগ্ধা আজ তোমার কপালের টিপ টা কই --কেমন যেন খালি খালি লাগছে মুখ টা ! 
  
        আরক্ত হল স্নিগ্ধা র মুখ --মানুষ টা তাকে এতও খেয়াল করে !  ওর এই বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এতো গভীর ভাবে তাকে কেউ কোনদিন খেয়াল করেছে বলে মনে পড়েনা ! নিজের দিকে তেমনভাবে তাকাবার সুযোগ ই হয়নি কখনও !  মাত্র আঠারো বছর বয়সেই বাবার মৃত্যু আর তারপর ই তো শুরু জীবন যুদ্ধ ! মা আর ছোট ছোট তিনবোন সম্বল বলতে বাবার জমানো সামান্য কিছু টাকা আর এই মাথা গোঁজার আস্তানা   টুকু !  কোনরকমে এই মিড ওয়াইফারী নার্সিং ট্রেনিং টা করেছিল --তারপর এই নার্সিংহোম ঐ নার্সিংহোম ঘুরে ঘুরে চাকরী -বোনে দের মানুষ করা বিয়ে দেওয়া এসব করতে করতেই কখন যেন পেরিয়ে গেলো তার বিয়াল্লিশ টা বছর !  ওর সাজগোজ বলতে ঐ পরিপাটি করে শাড়ি পরা , একটা লম্বা বেণী আর কপালে ছোট্ট টিপ !  আজ তাড়াহুড়ো তে টিপ পরতেই ভুলে গেছে !
স্যার এখন অনেক টা সুস্থ হাঁটছেন ও একটু একটু করে . ম্যাডামের নির্দেশ রোজ বিকেলে বাগানের দিকটায় একটু হাঁটাচলা করাতে হবে ওনাকে --যাতে নিজের ওপর কনফিডেন্স টা একটু বাড়ে . সেদিন বিকেলেও হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক গল্প হচ্ছিলো দুজনে --হঠাত্ই স্নিগ্ধা একটু মজা করেই বললো --স্যার এবার তো দেখছি আপনি একদম সুস্থ হয়ে গেছেন --আমার তো এবার ছুটি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে !  থমকে দাঁড়ালেন শুভঙ্কর সেন --হঠাত্ই স্নিগ্ধা র হাত দুটো ধরে বললেন প্লিজ প্লিজ স্নিগ্ধা --আমাকে ছেড়ে যেও না --আমি হয়তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়বো ---তুমি জানোনা -আমি কী ভীষণ একা !  তোমাদের ম্যাডামের অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কাছে আমি একেবারে সংকুচিত হয়ে থাকি !  কোথায় বিত্তশালী বাপের বিদূষী কন্যা ডাক্তার মহুয়া মিত্র আর কোথায় আমি নেহাতই মফস্বলের এক কলেজের ছাপোষা অধ্যাপক শুভঙ্কর সেন ! 

             ঘটনার আকস্মিকতায় খানিকটা অপ্রস্তুত হল স্নিগ্ধা --কেউ দেখে ফেললো না তো ওদের !  মুখে অবশ্য হাসি টেনে বললো --কী যে বলেন স্যার ! আর মনের মধ্যে একঝলক দখিনা বাতাস বয়ে গেলো ! তবে কি কোথাও ওর ও একটু একটু করে ভালোলাগা তৈরী হচ্ছে ! 

         মনকে চোখ রাঙালো স্নিগ্ধা --এসব কী ভাবছে !  ম্যাডাম এই কাজের জন্য তাকে ভালোরকম স্যালারি দেন . নার্সিংহোমে যা পেতো তার চেয়ে অনেক -অনেক বেশী . মায়ের ওষুধ -বিষুদ ,  একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখা --সবই এই ম্যাডামের দয়ায় ! 

              ম্যাডাম মুম্বই থেকে আজ রাতের ফ্লাইটে ফিরবেন --রঘু দা , মিনতি দি ভীষণ ব্যস্ত আজ --ম্যাডামের সবকিছু পারফেক্ট আর টাইমলি চাই --এসে যদি কোথাও এতটুক ত্রুটি পান তো কুরুক্ষেত্র বাঁধাবেন ! 

           আজ ও বাগানে হাঁটতে হাঁটতে স্নিগ্ধা র সঙ্গে গল্প করছেন স্যার --অল্প বয়সে নাকি কবিতা টবিতা ও লিখতেন --সেসব কবিতা র দু -এক ছত্র শোনাচ্ছেন ও স্নিগ্ধা কে আর শিশুর মতো হাসছেন !  হাসিতে যোগ দিচ্ছে স্নিগ্ধা ও মাঝে মাঝে তারিফ ও করছে কবিতার !  এমন করেই শেষ বেলার মৌতাত টুকু উপভোগ করছেন দুজনে ! 
   
              হঠাত্ই সম্বিত ফিরলো ম্যাডামের ডাকে --বাহ্ শুভ --তুমি তো পুরোপুরি ফিট দেখছি --এতোটা হাঁটতে পারছো !   আর এ তুমি ? তোমার তো রাতের ফ্লাইট ছিলো !  হ্যাঁ কাজ মিটে গেলো - তাই দুপুরের ফ্লাইট ধরেছি - তোমাদের জানাইনি --সারপ্রাইজ দেবো বলে ! 

                তা যাই বলো শুভ --খুব ভালো লাগছে তোমায় দেখে --বেশ ফ্রেশ লাগছে তোমায় --এর ক্রেডিট টা কিন্তু স্নিগ্ধার ই --কি বল !  তাহলে --এবার স্নিগ্ধা কে অব্যহতি দিই ?  ও আবার নার্সিংহোমে ফিরে যাক ! 

               বেলাশেষের নরম আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা স্যারের মুখ টায় কেউ যেন এক পোঁচ কালি লেপে দিলো ---হ্যাঁ মানে না পুরোপুরি সুস্থ তো হইনি --এখনই স্নিগ্ধা কে -----
চোখ পাকালেন ম্যাডাম --শুভ কনফিডেন্স লেভেল টা বাড়াও --এবার তো তোমাকে কলেজে জয়েন করতে হবে !  

         স্নিগ্ধার ও হঠাত্ই মনে হল কেমন যেন আলো কমে আসছে -সেই কবিতা টার মতো 'গোধূলি যে ক্রমশ বেগুনী ' ----- কেন জানে না বুকের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলো -কেমন যেন পাড় ভাঙার শব্দ .
               ____________

তপময় চক্রবর্তী


বসন্ত আসবে বলে 




কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব'লে
নিজেকে বিদ্ধ করেছ কফিনের ফালে,
আতরের গন্ধেমাখা  সুদূর  ঝাপসা পথে
কালো ঝরা পাতার খস খস শব্দে,
আর ওই দূরের বাতাসের হুইসেলে
গা ধুয়ে যায় শুদ্ধ শীতল পরশে,
চাওয়া পাওয়া সেরে লাল বিকেলে
শুকনো পাতার মতো শেষ হয় বনে,
বন্দী ছবি প্রতিচ্ছবির ফ্রেমের কোণে,
নীতিহীন মুখ ও রাঙে নানা রং -এ
আর কালো কোকিল ও রঙীন ডাকে ,
যে সৌন্দর্য জন্ম লয় -- -- কমলার ফুল বনে ; 
মানুষের মনে কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে 
সে সুদূর তরঙ্গে নাড়িয়ে দেবে কৃত্রিমতাকে
পৌঁছে যাবে মাকড়সার রোজগার বোনা জালে,
যে অন্তে শুকনো পাতার মতো ঝরে নাকো বনে ।।

মানসী গাঙ্গুলী


                              শেষ বেলায়

        খবরটা পেয়ে মিতা কেমন হতভম্ব হয়ে যায়।কাঁদবে কি,সে তো ভাবতেই পারছে না এমনটা কি করে হয়।সুমন চলে গেল!এ যে বিনামেঘে বজ্রপাত! এইতো কিছু আগে সুস্থ মানুষ বাড়ী থেকে বেরল।এটা কি সত্যি নাকি দুঃস্বপ্ন!শেষ সময়ে সে ছিল না সুমনের পাশে।অফিসে গিয়ে ফাইল খুলে বসেই সে অসুস্থ বোধ করে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের টেবিলে লুটিয়ে পড়ে সে।অথচ সকালে বড় ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে খেয়েদেয়ে ছোট ছেলেকে আদর করে সুমন বেরল বাড়ী থেকে আর এইটুকু সময়ের মধ্যে এই খবর!সুমনকে ছাড়া একা পথ চলবে কেমন করে মিতা?কি করবে সে এখন?দু'দুটো দুধের শিশুকে একা বড় করবে সে কেমন করে?ছোটো ২ বড় ৫,সবে কেজিতে পড়ছে।
         বাড়ীর অমতে সুমনকে বিয়ে করে বাড়ী ছেড়েছিল সুমনের হাত ধরে।সে হাত ছেড়ে সুমন চলে গেল তাকে শূন্য করে দিয়ে,এ জীবনতরী  সে বাইবে কেমন করে!তবু চলতে হবে একাকী,জীবন যখন আছে বিশেষ করে ছেলে দুটোর মুখ চেয়ে।চোখের জল ফেলার বিলাসিতা বা সময় কোনোটাই তার নেই।চোখে এখন সে সরষের ফুল দেখছে।কিন্তু জীবন সব কিছু মেনে নিতে শেখায়, তাই মিতাকেও সব মেনে নিতে হয়।সুমনকে শেষ যাত্রায় সাজিয়ে দিয়ে শুরু হল তার জীবনযুদ্ধ।কর্মরত অবস্থায় অফিসে অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ায়,অফিস থেকে মিতাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরী দিতে চেয়েছিল কিন্তু মিতা তা নিতে পারেনি,দুধের বাচ্চাদের কার কাছে রেখে সে যাবে কাজে তাই।এবার সুমনের অফিস থেকে যা প্রাপ্য ছিল তা দিয়ে সে শুরু করল লড়াই,বাড়ীতে বসেই সে শুরু করল কাপড়ের ব্যবসা,সেটা দাঁড় করাতেও তাকে কম কষ্ট করতে হয় নি।কোনোরকমে চলে যাচ্ছিল,কিন্তু একটু স্বচ্ছলভাবে থাকার জন্য এবার সে বাড়ীর নীচতলার বসার ঘরটা খালি করে রাখল পেয়িং গেস্ট।
         জীবন তাকে অনেক কিছু শেখাচ্ছে,আরও কত কি শেখার আছে বাকী,দেখা যাক।শোক আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে না,চলতে হবে,যেতে হবে অনেকদূর, একা,এপথে কেউ নেই তার সঙ্গী।ছেলেরা বড় হবার সাথে সাথে খরচ বাড়তে লাগল,তাই ব্যবসার ফাঁকে শুরু হল টিউশনি।সারাদিনে ঘরের সব কাজ একা হাতে,নিজের ওপর যথেচ্ছ অবহেলা করে ছেলেদের মানুষ করাই তখন তার একমাত্র ব্রত।মায়ের একনিষ্ঠ সাধনায় ছেলেরা পড়াশুনোয় বেশ ভাল হয়ে উঠতে লাগল,তাই স্কুলের শিক্ষকেরাও তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করতেন।এভাবে সবার সহায়তায় ও আশীর্বাদে ছেলেরা এক এক করে স্কুল পার করল ভাল রেজাল্ট করে।বড় হবার সাথে সাথে মায়ের লড়াই তারা দেখেছে,মায়ের কষ্ট উপলব্ধি করেছে,বস্তুতঃ মা তাদের বাবার অভাব বুঝতে দেননি কোনোদিন।তাই ছেলেদের কাছে মা-ই সব।এই লড়াইয়ে চলার পথে কত কুপ্রস্তাব,কত লোভ হাতছানি দিয়েছে মিতাকে কিন্তু সে মোটেই সেসব আমল দেয়নি,মনপ্রাণ ঢেলে দুইছেলেকে মানুষ করেছে, নিজের দিকে তাকানোর কথাও তার মনে পড়ে নি বা সে ইচ্ছাও তার হয়নি।বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তি হল যেদিন,বাবার ছবিতে প্রণাম করে,মাকে প্রণাম করে রওনা দিলে সুমনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কাঁদে মিতা,তার তো কাঁদবার অবসরটুকুও নেই।দুই ছেলে হবার পর সুমন বলেছিল,"দু'জনকেই ইঞ্জিনিয়ার করব",একজনকে মিতা সেপথে এগিয়ে দিতে সফল হয়েছে,আর একজনকে এগিয়ে দিতে পারলে তবেই হবে তার কর্তব্য শেষ। তিনবছর পর মিতা পেরেছিল ছোটছেলেকেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠাতে,কি শান্তি সেদিন তার,সুমনের ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তার মনে হয়  ছবির সুমনের মুখে যেন খুশীর রেশ।কিছুদিন পর বড়র পড়া শেষ হলে মিতার পক্ষে তাকে আর পড়ানো সম্ভব হয়নি,সে চাকরী নিয়েছে।তার একাকীত্বে, সুমনের ছবিই তার সঙ্গী,তার সাথে কথা বলেই সে মনে শক্তি পায়।সেদিনও মিতা সুমনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদে আর বলে,"জীবনের পথে চলতে একাকী লড়াই করতে করতে আমি ক্ষতবিক্ষত, ছোটটি চাকরী পেলে আমার লড়াই শেষ,সেই পর্যন্ত যাতে লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারি,আশীর্বাদ কর"।এমন একনিষ্ঠ ভালবাসা, এমন একনিষ্ঠভাবে সন্তানপালন সচরাচর দেখা যায় না।              ছেলেরা বড় হয়েছে,সময়ের সাথে মিতার শরীরে আজ বয়সের ছাপ স্পষ্ট, দেহে মনে ক্লান্ত যখন তখনই ঘটল বিপর্যয়।
          কিছুদিন যাবৎ মিতা মানসিকভাবে বড় অস্থির,সব কাজ ঠিকঠাকই করে কিন্তু মনকে শান্ত রাখতে পারে না।এতকাল যে নিজেকে সংযত করে চলেছে,আজ যখন চুলে রূপোলী রেখা দেখা দিয়েছে,তাই বলে সেইসময়!নিজেকে নিজেই বোঝায় সে,শান্ত রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু একি হল! রাতে ঘুম আসতে চায় না,কেবলই যে মিত্রবাবুর মুখটা ভাসে তার চোখে।হ্যাঁ,মিত্রবাবু তার পেয়িং গেস্ট এখন,গত কয়েকমাস হল তিনি এবাড়ী এসেছেন।আসার পর থেকেই তিনি মিতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তার এই লড়াইয়ের জন্য।এরপর তার প্রতিটি রান্নার তারিফ করা,এভাবে আস্তে আস্তে দু'জনের মাঝে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে।মিতার ওনাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়,অবসরে বসে গল্প করে,আজকাল মিত্রবাবুর অনুরোধে ওনার সাথেই একসাথে খায় মিতা,খাবার সময় মিতা ভাল করে না খেলে মিত্রবাবু মৃদু রাগও করেন,বেশ লাগে মিতার।মিত্রবাবুর সপ্রশংস দৃষ্টিতে মিতা নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করে আজকাল।উনি যখন তাকান তার দিকে,মনে হয় যেন খোলা বইয়ের পাতার মত দেখতে পাচ্ছেন তার ভেতরটা।কতবছর পার হয়ে গেল আজ মিতা কোনো পুরুষের সপ্রশংস দৃষ্টিতে লজ্জা পাচ্ছে,কোনো পুরুষের সঙ্গ উপভোগ করছে।মাঝে মাঝে আজকাল তার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়।আবেগে ভেসে যাচ্ছে মিতা,নিজেকে সংযত করতে ইচ্ছাও হয় না।কিন্তু ছেলে দুটো বাড়ী এলেই মনে হয় ছি ছি,এ ঠিক নয়,এ সে কি ভাবছে!কিন্তু সারাদিন যখন একা থাকে সে,মানুষটার সাহচর্যে সে বড়ই খুশী থাকে,কোনো কাজে আজকাল আর তার ক্লান্তি লাগে না।
         এভাবে চলতে থাকে,দিন যায়, মাস যায়,একদিন মিত্রবাবু মিতাকে প্রেম নিবেদন করে বসেন।অল্পবয়সে বাবা-মা মারা গেলে,ছোট ভাইবোনেদের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর।সবার বড় হওয়ায়,তাদের লেখাপড়া  শিখিয়ে,বিয়ে দিয়ে,আজ তাদের সংসারে তিনি অবহেলিত,অপ্রয়োজনীয় হয়ে ঘর ছেড়েছেন।তাদের জন্যই তাঁর সংসার করা হয়ে ওঠে নি,ভাবেনওনি কখনো নিজের কথা,কিন্তু আজ যে তারা এতটা স্বার্থপর হয়ে যাবে তাও তিনি ভাবতে পারেননি।আজ তার আপন বলতে আর কেউ নেই। মিতাকে দেখার পর থেকে বড় আপনার মনে হয়েছে ওনার,বস্তুত দু'জনের জীবনে কিছু মিলও রয়েছে,দু'জনেই আজীবন যুদ্ধ করে কাটালেন সংসারের জন্য।তিনি বলতে দ্বিধা করেননি যে সারাজীবন দায়িত্বের চাপে যে প্রেম তার দরজায় কোনোদিন কড়া নাড়েনি,তা মিতাকে দেখে তার জীবনে এসে হাজির হয়েছে,যা তিনি উপেক্ষা করতে পারছেন না।মিতার হাতদুটি ধরে যখন উনি প্রেম নিবেদন করলেন,আবেগে সারাশরীর থরহর করে কেঁপে উঠেছিল মিতার,যে আবেগ মিতাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সুমনের শেষযাত্রার সঙ্গে,নাকি তাতে পলি পড়েছিল এতদিন,যা আজ হঠাৎ বাঁধভাঙ্গা হয়ে বুকের মাঝে উথালপাতাল করছে।ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে মিতার,তবু সংযমের কাঠিন্য বজায় রেখে সে বলেছে তা সম্ভব নয়,এতে ছেলেরা তাকে সম্মান করবে না।মিত্রবাবু নিজে ছেলেদের সাথে কথা বলতে চেয়েছেন,মিতা রাজী হয় নি যদিও তিনি বুঝেছেন,মিতার অন্তরে তিনি তাঁর একটা জায়গা করতে পেরেছেন আর তাই তিনি বলেছেন অপেক্ষায় থাকবেন সেদিনের যেদিন মিতা রাজী হবে।
          মিতা সুমনের ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,বলে, "তুমি আমায় শক্তি দাও,তুমি ছাড়া এজীবনে আমার কাছে আর কেউ কোনোদিন আসতে পারে নি তোমার জায়গায়,এ জায়গা আমি অন্য কাউকে দিই কিভাবে"।মন অস্থির,রাতে শুয়ে ঘুম আসে না,স্বপ্নে দেখে সুমন যেন বলছে,"আমি তোমায় কি দিতে পেরেছি,দু'টো সন্তান দিয়ে সমস্যার মুখে ফেলে দিয়ে চলে এসেছি।আমার হাত ধরে তুমি সবাইকে ছেড়ে এলে,সেই আমি থাকতে পারলাম না তোমার বলভরসা হয়ে,সংসার আগলে।তুমি মিত্রবাবুকে বিয়ে করে খুশী থাকো, আমি তাতেই খুশী হব"।ঘুম ভেঙ্গে যায় মিতার,বুকের ভেতর তোলপাড় করছে,খুব ইচ্ছে করছে কারো বুকের মাঝে আশ্রয় নিতে বস্তুত একজন যখন তার জন্য বুক পেতে বসেই আছে।কিন্তু সমাজ,সংসার বড় বালাই।সংযমেরই জয় হল শেষে,আবেগকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে।
          এরপর ছোটছেলের চাকরী হলে,মিতা দুইছেলের একই সাথে বিয়ে দেবে মনস্থ করে,সেইমতই সব ব্যবস্থা হয়।মিত্রবাবু ততদিনে ওদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছেন,কবে থেকে যেন তিনি ছেলেদের অভিভাবক হয়ে উঠেছেন,ছেলেরাও তাঁকে খুব ভালবাসে।সব মিটে গেলে মিত্রবাবু এবার আর মিতার কথা শোনেন না।তিনি দুইছেলে ও দুই বউকে ডেকে আজ মিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখেন,কেবল মিতা সেখানে থাকতে রাজী হয় নি,তাই ছিল না।নিমেষে বাড়ীর চিত্র বদলে গেল।যে মিত্রকাকুকে তারা নিজেদের অভিভাবক,একান্ত আপনার জন ভাবত এতদিন,তাঁকে অপমান করতে সেদিন তাদের বাধেনি,তার সাথে নিজেদের মাকেও তারা দেবীর আসন থেকে টেনে অনেক নীচে নামিয়ে ফেলে।মিতা এমনই আশঙ্কা করেছিল,তাই আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল সে,দুই ছেলেকে বাড়ীর দুটোতলা ভাগ করে লিখে দিয়ে নিজে স্বেচ্ছায় গিয়ে উঠল বৃদ্ধাশ্রমে,যেখানে আগে থাকতে তাঁদের দু'জনের জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন মিত্রবাবু।এতে অন্তত সমাজ-সংসার তাদের দিকে আর আঙুল তুলবে না এই আশা করে।

ঝুমা চৌধুরী


#পরকীয়া

মৃন্ময়, 
বাঁকা চাঁদের আলো এখন আবিরের চাদর গায়ে দিয়ে আছে
জানো না এখন তো বসন্তকাল !
শিশির পড়ছে টুপটুপ করে

আগের বসন্তে কি হয়েছিলো তুমি জানো না বুঝি!!

শিশির এসে ভাব জমালো
নিশিরাত তারাদের দিলো জ্বালিয়ে
চাঁদ বসলো শিশির কণার গা ঘেঁষে
গল্পে গল্পে আদর
আদরে আদরে উষ্ণতা
বসন্ত  উঠলো ঘেমে!
"চাঁদের বুকে দাগ" লাগলো
চাঁদ তার নাম দিলো "ভালোবাসা" 

মৃন্ময় জানো, তখন রোজ লজ্জা ভাঙতো চাঁদের!
রোজ ইচ্ছা করে উড়িয়ে দিতো বুকের আঁচল
শিশির গড়িয়ে পড়তো কপাল থেকে গাল গাল থেকে ঠোঁট
ঠোঁট থেকে গলা বুক পেট নাভি....
জানো মৃণ্ময় একদিন কি হলো!!

ভোর হলো,বেলা বাড়লো
ঝলমলে রোদ
কই শিশির!!!
রদ্দুরের হাত ধরে সে আকাশেরই বুকে অন্য কোথাও!
ওরা এক পর্দার আড়ালে!
এক দরজার পেছনে!
এক চাদরে!
ওরা সহবাসে!

তার পর থেকে বসন্ত এলেই চাঁদ আবিরের চাদর মাখে।
মৃন্ময়, তুমি জানো না আগের বসন্তে কি হয়েছিলো!!
সবাই বলেছিলো "চাঁদ শিশিরের পরকীয়া"
অথচ চাঁদ ভালোবেসে "সহমরণ' চেয়েছিলো।

                     ঝমা চৌধুরী


#একটা অন্য গল্প

মরে যাওয়া নদীটার গা ঘেসে 
হেঁটে যাচ্ছিলো কালো প্রেমিকাটি
তার চোখের গভীরতা মাপতে গিয়ে একদিন
ডুবে গিয়েছিলো ভবঘুরে প্রেমিকটিও
ওর কালো গালে চুমু লেপে দিয়েছিলো
ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেছিলো,"হোক না কালো
তবুও ও মেয়ে তুই ভালো"

তারপর কোনো একদিন নির্জন দুপুরে বৃষ্টি ভিজলো দুজন
এক ভারাক্রান্ত বিকেলে একসাথে সূর্যাস্ত দেখলো
মুড়ি চপে একটা সোহাগী সন্ধ্যা বাঁচলো
আর গভীর রাতে খসে যাওয়া তারা দেখে আনন্দে আত্মহারা হলো
মেয়েটি আহ্লাদী সুরে বললো,"এমন করেই জীবন জুড়ে সোহাগী রঙ ঢালো
ও ছেলে তুইও বেশ ভালো।"

এরপর কোনো এক ফাল্গুনে লজ্জা ভাঙল খিল
মনের অলিগলি পার করে মুঠো খোলা সুখ
উড়িয়ে দিলো বুকের আঁচল!
মনের ভাঁজ খুলে ডুবকি লাগালো শরীরী উপত্যকায়
গোপনীয়তা বেড়া জালে লাগলো আগুন
কালো প্রেমিকা ছড়িয়ে পরলো
দুপুরের চিলেকোঠায়,অন্ধকার সিঁড়ির ঘরে,পোড়ো বাড়ির থামের আড়ালে

বাকী টুকু ইতিহাস লিখলো অবজ্ঞার নীলচে খোলসে

"ব্যাকরণ না মানা প্রেম গনগনে আগুনের শিখা তাই
না ছুঁলে তিরতিরে জ্বালা
ছুঁয়ে দিলেই ছাই...."

                        ঝুমা চৌধুরী----

#স্বপ্ন বাড়ি

ষড়ঋতু জড়িয়ে,অলস দুপুর আর নির্জন রাতের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে
তোমার আমার অসমাপ্ত উপন্যাস

তোমার ছুঁড়ে দেওয়া শব্দ খুঁটে খুঁটে তুলে রাখি আমি,
তোমার আলগা অভিমানে বুলিয়ে দিই ভালোবাসার লালচে তুলি
কিছু ঝগড়া পুষি সোহাগী সংলাপের রেশ ধরে

আড়াল টপকে যেটুকু আদর
আমার মনের গলির মুখে পৌঁছে দাও তুমি
সদর দরজা খুলে তাকে তুলে আনি।
মনের আড়াল ভেঙে মিশিয়ে দিই শরীরী ঘামে

ঠান্ডা গরম ভাত নেই,কয়েনের ঝনঝন নেই
পুষে রাখা সম্পর্কে অহংকারের ঝাঁঝ নেই
দিন শেষে ঘেটে ফেলা বিছানায়
অধিকারের আঁশটে গন্ধ নেই

শুধু আছে,
আদরে সোহাগে অভিমানে অনুযোগে
অনুভবের আঙুল ছুঁয়ে স্বপ্ন পাড়ায়
তোমার আমার অন্য একটা বাড়ি "ভালো বাসা"...