পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৩০ জুন, ২০১৮

সম্পাদকীয়

বেশ কিছু দিন ধরে লিখতে ইচ্ছা করে না ৷ লেখার মধ্যে কোন আনন্দ পাই না ৷ মনে হয় শিথিলতা চলে আসছে ৷ দু ফোটা বৃষ্টি পড়লে স্বাদ জাগে কিছু লিখি ৷ কিন্তু কি লিখব ? কবিতা ,প্রবন্ধ না গল্প ৷ সত্যি বলতে কবিতা বলতে আমি নিজেকে বুঝি ৷ প্রতিদিনের জীবনে রোদ , ঘাম নিসৃত হয়ে যার উৎপত্তি হয় তাই আমার কাছে কবিতা ৷ মিথ্যা কিছু লিখতে গেলে হাত ধরে আসে ৷ জুন মাস মানে বর্ষা ৷ গ্রীষ্ম ,বর্ষার মাঝে রোদটুকু ধরা দেয় আমার যাপনে ৷ ভিতর থেকে একটা কিছু গলে না গেলে আমার লেখা আসে না । তেমনই সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে মোট ৬ দিন গেল অথচ কিছু লিখতে পারলাম না । বৃষ্টির ছোঁয়ায় ধরা দিল কিছু শব্দ ৷ শব্দ মানে ঈশ্বর ৷সাধনার ফল ৷ প্রকৃতির বুকে বয়ে যাওয়া বাতাস ধরা দেয় মাধবীকুঞ্জে ৷উড়ে বেড়ায় প্রজাপতির দল বর্ষার চিবুক ধরে ।

বর্ষা এসেছে বুকের গভীরে 

কখন মেঘ কথা বলে খোয়াই পথে 

আষাঢ়ের চিবুক ধরে 

ছুঁয়ে যায় স্তনাগ্রে  চুপিচুপি 

শব্দরা নিজস্ব বনভূমি গড়েছে 

সেখানে কবিতা টাঙিয়ে রাখে এডাল ওডালে

আমি দেখি রোদ্দুর গোটা রাত জুড়ে হেলেঞ্চাবনে , মাধবীকুঞ্জে 

দেখে আসি 
আরও কত রোদ্দুর জমল এই মেঘের দেশে


সত্যি মেঘের দেশে এখন শুধু রোদ্দুর ৷ রুগ্ন সবুজ বালিকা দাঁড়িয়ে থাকে কোপাই নদীর পাড়ে ৷ ধুলো জল ম্লান হয়ে যায় ঘাসের আড়ালে ৷ তখনই নামে তুমুল বৃষ্টি ৷ সবুজবালিকা ধীরে ধীরে গাছ হয়ে ওঠে ... জন্মায় নতুন পাতা । একে একে প্রাচীন ঝুড়ি নামতে করে তার দুচোখ বেয়ে । বাইরে তখন ভাত ফোটার গন্ধ আর মাটির গন্ধ মিলেমিশে একাকার ...


কিন্তু "সৃজন " মিশে গেছে একেবারে মাটির কোণায় কোণায় I বিগত মে মাসে প্রকাশিত হল " আমার সৃজন " পত্রিকার পাগল সংখ্যা l দ্বিতীয় বছর দ্বিতীয় সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ করব ৷ এই ভাবে জড়িয়ে থাকুন আপনারা  ৷ লেখা পাঠান অবশ্যই ৷ সৃজনে থাকুন ,ভালোবাসায় থাকুন ।

পারমিতা চক্রবর্ত্তী
সম্পাদিকা 

পিনাকী মুখোপাধ্যায়


 ভালোবাসা    
 
সম্বন্ধটা ভেঙে গেল ।রিসিভারটা নামিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন সুরেখা । পূর্ণার খুশি খুশি মুখটা ভাসছে চোখের সামনে । অনেক বোঝানোর পরে নিমরাজি হয়েছিল মেয়ে । ছেলের বাড়ি থেকে যেদিন দেখতে এল সেদিনও কেমন কাঠ কাঠ ব্যবহার করছিল পূর্ণা । অপ্রতিভ লাগছিল সুরেখার । কিন্তু সুরেখাকে অবাক করে পাত্রপক্ষ সেদিনই জানিয়ে দিয়েছিল , পূর্ণাকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে । ফটো  দেখে আবির , মানে ছেলে আগেই পছন্দ করেছিল । তারপরেই বিবাহিত দিদিকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে এসেছিলেন আবিরের মা , বাবা । আসার কথা ছিল আবিরেরও । কিন্তু শেষ মুহূর্তে অফিসিয়াল ট্যুরে কলকাতার বাইরে চলে যেতে হওয়ায় আসতে পারেনি সেদিন । তার জন্য আবিরের বাবা বার বার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন ।  
ওঁদের সৌজন্য , আন্তরিকতায় অভিভুত হয়ে পড়েছিলেন সুরেখা । ঠিক হয়েছিল ট্যুর থেকে ফেরার পরে এক বন্ধুকে নিয়ে আবির এসে আলাপ করে যাবে পূর্ণার সঙ্গে । আবিরের মা বলেছিলেন , “ আমাদের দিক থেকে আমরা ফাইনাল করে যাচ্ছি । এবার আবিরকে আপনাদের পছন্দ হলেই পাকা কথা হয়ে যেতে পারে  … “ 
এতটা বোধহয় পূর্ণাও আশা করে নি । ওর মুখের কঠিন রেখা গুলো নরম হয়ে আসতে দেখেছিলেন সুরেখা । বুক থেকে একটা ভারী পাথর যেন নেমে গিয়েছিল ।মনে হয়েছিল এবার বুঝি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন । 
একটা অ্যাক্সিডেণ্টে পূর্ণার বাবা যখন  হঠাৎ করে চলে গেলেন তখন পূর্ণা মাত্র দেড় বছরের । মেয়েকে বুকে চেপে সেই শুরু  সংগ্রামের জীবন ।ওঁরা  বিয়ে করেছিলেন  দু বাড়ির অমতে । অমন দুঃসময়য়েও শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে কেউ এগিয়ে আসেন নি । সুরেখার দাদা পাশে এসে দাঁড়ালেও ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সুরেখা বা তার মেয়ের ভার নেবেন না তাঁরা ।সুরেখা আশাও করেননি ।
কম্পেনসেসন গ্রাউন্ডে স্বামীর চাকরিটা পেয়েছিলেন সুরেখা । স্বামীর সহকর্মীরা খুব সাহায্য করেছিলেন । মেয়েকে স্কুলের ডে বোর্ডিঙে রাখার ব্যাবস্থা করেছিলেন । অফিস থেকে ফেরার পথে মেয়েকে নিয়ে ফিরতেন । বহু প্রলোভন ছিল , ছিল হাজার প্রতিবন্ধকতা । দাঁতে দাঁত চেপে , মেয়েকে আগলে লড়াইটা ছিল  সুরেখার একলার ।
অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে পুরোটা সময় দিয়েছেন মেয়েকে । সখ , আহ্লাদ  , সবই ছিল শুধুই মেয়েকে ঘিরে । বাবার অভাব কোনদিন বুঝতে দেন নি । ভারী বাধ্য ছিল পূর্ণা । পড়াশুনায় ভাল ছোটবেলা থেকেই । ইংরেজিতে ফার্স্টক্লাস নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর সদ্য ভর্তি হয়েছে ইউনিভার্সিটিতে । অফিসের এক কলিগের মারফৎ এসেছিল সম্বন্ধটা । নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে             ১ 
বিয়ের কথা ভাবার  ইচ্ছে ছিল না সুরেখার । কিন্তু যে ভদ্রলোক এনেছিলেন সম্বন্ধটা তিনি বললেন দেখাশোনা হলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না । তাছাড়া পড়াশুনার ভীষণ গুণগ্রাহী ওরা । তাই বিয়েটা যদি হয়েও যায়  পড়াশুনা কনন্টিনিউ করতে কোন অসুবিধা হবে না ।   আর আপত্তি করতে পারেন নি সুরেখা । তারপর তো আবিরের সঙ্গে পরিচয়ের পর আক্ষরিক অর্থেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন । সুদর্শন , মার্জিত , ভদ্র ইঞ্জিনিয়ার পাত্রটিকে যে মেয়েরও মনে ধরেছে সেটা পূর্ণার মুখ দেখেই বুঝেছিলেন । তাঁর সম্মতি নিয়েই এরপর দুবার বাইরে মিট করেছে ওরা । পূর্ণার মত নাকউঁচু মেয়েও প্রচ্ছন্নভাবে প্রশংসাই করেছে আবিরের । সবকিছুই তো ঠিকঠাক চলছিল । আচমকা কী এমন ঘটলো ভেবে পাচ্ছেন না সুরেখা । আবিরের মা যখন ফোন করে বললেন , এই সম্বন্ধটা নিয়ে তাঁরা আর এগোতে পারছেন না , সুরেখা এত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারেন নি । তারপর জিগ্যেস করেছিলেন , “ অসুবিধেটা কোথায় যদি একটু বলেন ...”
অদ্ভ ুত  হেসে আবিরের মা বলেছিলেন , “ কথায় কথা বাড়ে ভাই । আমরা যখন ডিসিশন নিয়েই নিয়েছি তখন আর ...নমস্কার ...ভালো থাকবেন ...”
সুরেখাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রেখে দিয়েছিলেন ফোনটা ...
পুরো ঘটনাটা যেন ছায়াছবির মত দেখতে পাচ্ছিল পূর্ণা । আজ রবিবার ।  আজ বিকেলেই আবার আবিরের সঙ্গে দেখা করতে যাবার কথা । খুব যদি ভুল না করে ফোনটা দুপুরের মধ্যেই আসবে । পূর্ণার ইনটুইশন তাই বলছে । যে কোন মুহূর্তে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকবে মা ।   
“ মা “ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একটা নরম আদরের বলয় যেন তৈরি হয়ে যায় পূর্ণাকে ঘিরে । নিরাপত্তার আশ্চর্য উষ্ণতা সেখানে ।হাজার ওঠা পড়া , ঘাত প্রতিঘাতের এতটুকু আঁচও সে বলয় ভেদ করে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি পূর্ণাকে । ভালোলাগায় , ভালোবাসায় দুচোখ বুজে আসতে চায় । ঠিক তখনই ঘরে এসে ঢোকেন সুরেখা ।
মায়ের এমন মর্মভেদী দৃষ্টি বুঝি কখনো দেখেনি পূর্ণা । বুকটা কেঁপে ওঠে । ফোনটা কি এসেছিল তবে ? আর কিছু ভাবার আগেই সজোরে একটা চড় এসে পড়ে পূর্ণার গালে । হিসহিসে গলায় সুরেখা বলে ওঠেন , “ কী বলেছিস তুই আবিরকে ? কেন বলেছিস ? তোর আবিরকে পছন্দ নয় তুই তো আমাকেই বলতে পারতিস । অন্য কাউকে যদি পছন্দ করে থাকিস আগে বলিসনি কেন আমাকে ? এরকম একটা প্রহসন কেন করলি তুই ? “
কান্নায় গলা বুজে আসে পূর্ণার । জীবনে এই প্রথম মা গায়ে হাত তুললেন তার । বলল , “ কাউকে পছন্দ করা নেই আমার । তোমাকে তো বলেইছিলাম  আমি রাজি নই । তবুও জোর করলে । কী করব আমি ? “

“ কী করবি মানে ? “ তল কূল খুঁজে পাচ্ছেন না সুরেখা । 
ফোঁপাতে ফোঁপাতে চিৎকার করে ওঠে পূর্ণা , “ শুনে রাখ আবার যদি কোন জায়গায় আমার বিয়ের চেষ্টা কর আমি এই একই কাণ্ড করব । জানিয়ে দেব তিন বছর আগে আমাকে মেণ্টাল অ্যাসাইলামে ভর্তি করার কথা । বাবাও যে পাগল ছিলেন জানিয়ে দেব সে কথাও । “
মাথায় যেন রক্ত চড়ে যায় সুরেখার । পূর্ণার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে ওঠেন , “ কেন ? কেন এসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছিস তুই আবিরকে ? বল কেন বলেছিস ? “ 
কান্না জড়ানো গলায় পূর্ণা বলে ওঠে , “ কারণ ... কারণ  তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না আমি । তোমাকে একা ফেলে কোত্থাও যাব না আমি ... কোত্থাও না ... কক্ষনো না ... কোনদিন না ... “
হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন সুরেখা । বুক জুড়ে উথাল পাথাল ঢেউ । কী  যেন আটকে এল গলায় । চোখের বাঁধ ভেঙে গেল সহসাই । বুকের মাঝখানে টেনে নিলেন পূর্ণাকে । ভালোবাসার ওমে জড়িয়ে নিলেন সেই ছোট্টবেলার মত । হাসি আর কান্নার অনুরণন মিলে মিশে গেল তাঁর কণ্ঠস্বরে । বললেন , “ বোকা কোথাকার ! সত্যিই তুই পাগল । আমি ধরতে না পারলেও তোর পাগলামি যে ধরে ফেলেছে ওরা । আবিরের মা ফোন করে বললেন – ‘  অনেক ভাগ্য করে এমন মেয়ে পেয়েছেন ভাই ।ওকে বলবেন  ওর মত পাগলির খোঁজেই ছিলাম আমরা ।বলবেন আবির তার বাবা , মায়ের প্রতি যতটা দায়বদ্ধ ততটাই দায়বদ্ধতা থাকবে তার বউয়ের মায়ের জন্যও । ‘ “ 
একটু থেমে সুরেখা আবার বললেন, “ উনি বললেন তোর যখন খুশি তুই আসবি আমার কাছে । আমিও যাব যখন যখন আমার মন চাইবে । ওরা খুব ভালো রে । তুই আর অমত করিস না সোনা ... “ 
নির্বাক চেয়ে থাকে পূর্ণা । এমনটা হতে পারে কল্পনাই করেনি । আর কী আশ্চর্য !  মায়ের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত মানুষগুলোর ওপর সেই আগের মত  রাগটা কেন যে  আসছে না আর !কেন যে কিছুতেই আর শএুপক্ষ ভাবা যাচ্ছে  না মানুষগুলোকে ! 
আজ সকালে ফোনে অ্যাসাইলামের গল্পটা শোনার পরে গম্ভীর গলায় আবির বলেছিল – ‘ এতো সাংঘাতিক ব্যাপার ! খুব ভালো করেছ জানিয়ে ... ঠিক আছে , আমি একটু ব্যাস্ত আছি এখন । পরে কথা বলছি ...’
পলকের জন্য থমকে গিয়েছিল পূর্ণা । ক্ষুব্ধ হেসে মনে মনে বলে উঠেছিল , “ প্রেমের বেলুন চুপসে গেল এক মুহূর্তে ! এই তো ভালবাসা ! ... “
সেই ‘ ভালোবাসা ‘ শব্দটাই এই মুহূর্তে পূর্ণার কাছে ধরা দিচ্ছে এক অন্যরকম ব্যঞ্জনায় ।মায়ের কোলে মুখ গুঁজে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ভালোবাসার এক বর্ণালি দেখতে পায় পূর্ণা ।বিভিন্ন রং গুলো তাদের স্বতন্ত্রতা নিয়েও মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল ।

শুভশ্রী সাহা



দ্বিচারিণী ---

অনেক ভোরে চেঁচামেচির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল তকাইয়ের। ঘুম মাখা মুখে দেখল মায়ের জায়গাটা খালি,
উঠে বাইরে আসতেই বাবাকে দেখল মাথা ঠুকছে দেওয়ালে, মার শরীরটা পাশের ঘরে ঝুলছে---  মা নোংরা মাগী ছিল ঠাকুমা বলছে চেঁচিয়ে---- মা তো তার মা ছিল সে জানে

( শব্দের হাতেখড়ি গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী )





স্বপন রায়




আহমেদ ফরাজের জীবন ও কবিতা  
.................................................................................................
      ‘অব কে বিছড়ে হ্যায় তো শায়দ কভি খ্বাবোঁ মে মিলে
      ‘ জিস তরহ সুখে হুয়ে ফুল কিতাবোঁ মিলে..’
        
#
‘পুরুষপুর’ বললে চিনতে হয়ত অসুবিধা হবে, তবে ‘পেশোয়ার’ বললে সবাই চিনবেন। পাকিস্তানের ‘খাইবার পাখতুনখাওয়া’ রাজ্যের রাজধানী। ১৯৩০ সালের ২৩ এপ্রিল সীমান্ত গান্ধী ‘খান আব্দুল গফফর খানে’র নেতৃত্বে পেশোয়ারের ‘কিসস্যা খাওয়ানি বাজারে’ হাজার হাজার মানুষ ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে অহিংস আইন-অমান্য আন্দোলনের জন্য একত্রিত হয়। এই অহিংস আন্দোলনের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ ঘোড়সওয়ার বাহিনি।কয়েকশো মানুষ মারা যায়।মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের অকুস্থল হয়ে ওঠে পেশোয়ার। নিরীহ, অসহায় মানুষের মৃত্যু কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারেনি। আরো তীব্র হয়ে উঠেছে, ছড়িয়ে পড়েছে ‘খাইবার পাখতুনখাওয়া’র দিকে দিকে।এরকমই অগ্নিগর্ভ সময়ে ১৯৩১ সালের চোদ্দই জানুয়ারি এই রাজ্যের নওশেরার কোহাটে জন্ম হয় কবি আহমেদ ফরাজের।
#

আহমেদ ফরাজ জন্মসূত্রে পেশোয়ারের সম্মানিত সৈয়দ পরিবারের সদস্য ছিলেন। ‘কোহাটে’র বিখ্যাত পীর ‘হাজি বাহাদরে’র উত্তরাধিকারী হিসেবে এই পরিবারের প্রতি স্থানীয় মানুষের বিপুল শ্রদ্ধামিশ্রিত আস্থা ছিল।‘ফরাজ’ এই নামটি ছিল ওঁর ছদ্মনাম, উর্দু শায়েররা যা হামেশাই নিয়ে থাকেন।উর্দুতে বলা হয়, ‘তখল্লুস’।প্রকৃত নাম বা পরিবারদত্ত নাম হল সৈয়দ আহমেদ শাহ।পিতা বা ‘ওয়ালিদ’ আগা সৈয়দ মুহম্মদ শাহও ছিলেন কবি বা শায়র। তো, ছোটবেলা থেকেই ফরাজ এক শায়রানা আন্দাজে বড় হয়েছেন। খুব ছোট যখন তিনি, বাবা ঈদের নতুন জামা ইত্যাদি নিয়ে এলেন, সবাইকে দিলেন। ছোট্ট ফরাজের খুব একটা পছন্দ হয়নি সেই উপহার। তো তিনিও বাপকা বেটা! তাঁর স্বরচিত প্রথম শেরটি তাৎক্ষণিক তৈরি করে বাবাকে বললেন, ‘লায়ে  হ্যায় সবকে লিয়ে কপড়ে সেল সে/লায়ে হ্যায় হমারে লিয়ে কম্বল জেল সে’...আর এই রসবোধ আমৃত্যু তিনি বহন করেছেন। তিনিই তো লিখবেন, ‘ওহাঁ সে এক পানি কি বুঁদ না নিকল সকি ফরাজ/ তমাম ওম্র জিন আখোঁকো হম ঝিল লিখতে রহেঁ’।( একফোঁটা জলও বেরোল না ওখান থেকে/ সারাজীবন যে চোখদুটোকে আমি ঝিল লিখে এলাম)
#
·         ফরাজের পরিবার পেশোয়ারে চলে আসে কিছুদিন পরে। ফরাজ বিখ্যাত এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন।পোস্টগ্রাজুয়েশন করেন পেশোয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে। তাঁর বিষয় ছিল,উর্দু আর ফার্সি।ছাত্র থাকা কালীন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ তনহা তনহা’ প্রকাশিত হয়।কলেজ জীবনেই আহমেদ ফরাজ বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং তখনকার দুই বিখ্যাত বামপন্থী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আর আলি সরদার জাফরির সংস্পর্শে আসেন। ফয়েজকে তাঁর মেন্টরও বলা চলে।১৯৪৭-এ যখন ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হতে চলেছে, ফরাজের বয়েস তখন ষোলো বছর।কিশোর ফরাজ তখনই শের শায়েরির দিকে ঢলে পড়েছেন।ঠিক এগারো বছর আগে লক্ষ্ণৌ-এ গঠিত হয়েছে গঠিত হয়েছে The All India Writers' Association.’ এই সংগঠনের পাকিস্তানী শাখার সঙ্গে ফরাজ ভবিষ্যতে জড়িয়ে যাবেন।
#
 এমন নয় যে হঠাৎ ক’রে এই সংগঠন গজিয়ে উঠেছিল।ভারতের  প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৩২ সালে লক্ষ্ণৌ থেকে ‘অঙ্গারে’ নামের গল্প সংগ্রহ বেরোবার পর থেকে। ১৯৩৩ সালে এই বইটিকে নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। বইটিতে গল্প লিখেছিলেন, আহমেদ আলি, সাজ্জাদ জাহির, রাশিদ জাহান এবং মাহমুদুজ জাফর। ১৯৩৫ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘The Indian Progressive Writers' Association , ১৯৩৬ সালে কলকাতায় তৈরি হয় The Progressive Writers' Association’, একইসঙ্গে উর্দু সাহিত্যিকদের সংগঠন কাজ করছিল, ‘আঞ্জুমান তরক্কি পসন্দ মুসন্নিফিন’ নাম নিয়ে। এদের ঘোষিত আদর্শ ছিল সমাজতন্ত্র। ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌতে এই সংগঠনগুলি এক হয়ে যায়। গঠিত হয়, The All India Writers' Association’ গড়ে ওঠে। নেতৃত্বে থাকেন সৈয়দ সাজ্জাদ জাহির, আহমেদ আলি। একে একে এই এসোসিয়েশনে তখনকার অগ্রণী লেখক, কবিরা যোগ দিতে থাকেন। সৈয়দ ফকরুদ্দিন বেলে, হামিদ আখতার, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আহমেদ কাসিম সহ উর্দুসাহিত্যের প্রথম সারির ব্যক্তিত্বরা এসোশিয়েসনের প্রথম সম্মেলনে যোগ দেন। মুন্সি প্রেমচাঁদ এই সম্মেলনের উদবোধন করেন।রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছাপত্র পাঠান। যাইহোক এই সংগঠনই দেশভাগের পরে পাকিস্তানে ‘The All Pakistan Progressive Writers Association’ নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।তরুন আহমেদ ফরাজ এই সংগঠনে যোগ দেন এবং শায়েরি লিখতে থাকেন ‘ফরাজ কমিউনিস্ট’ নাম নিয়ে।

মলয় রায়চৌধুরী



    হৃৎপিণ্ড : আর কতো দূর হুলি ?
       আমি : আরও তিন মাস, রাজকুমার ।

       রাজকুমার আমায় বলেছিলেন যে, আমবাগানে পড়াশুনা শেখাবার  বদলে, দোলখেলার নাচানাচির বদলে, বাউলদের ছিলিমটানা হইচইয়ের বদলে, একটা ইন্সটিউট অফ টেকনোলজি খোলার ইচ্ছে ছিল তাঁর, উনি বেঁচে থাকলে তা-ই করতেন, ওনার অতিবামুন কাল্টগুরু হবার আদেখলাপনা ছিল না ; জমিদারি আর ব্যবসা অবহেলা করে ওনার ছেলে অতিবামুন কাল্টগুরু হয়ে গিয়েছিল বলে রাজকুমার মারা যাবার আগের বছর, ১৯৪৫ সালের মে মাসে  কড়া চিঠি লিখেছিলেন তাকে, মনে আছে আমার :
      “আই হ্যাভ দিস মোমেন্ট রিসিভড ইয়োর লেটার অফ ৮থ এপ্রিল অ্যাণ্ড কোয়াইট ভেক্সড উইথ দি নেগলিজেন্স শোন বোথ অন দি পার্ট অফ রাজা বরদাকান্ত অ্যাণ্ড ইয়োর ওন মোক্তারস অ্যাবাউট দি সেল অফ শাহুশ তালুক । অ্যাজ ফর দি ফরমার, হি ডাজ নট কেয়ার এ পাইস অ্যাবাউট হিজ ওন অ্যাফেয়ার্স --- বাট হাউ ইয়োর সারভেন্টস ক্যান শেমফুলি নেগলেক্ট টু রিপোর্ট দিজ ম্যাটার্স ইজ সারপ্রাইজিং টু মি । অল দ্যাট আই হ্যাভ হিদারটু হার্ড ফ্রম আদার কোয়ার্টার্স, অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ হোয়াট মিস্টার গর্ডন হ্যাজ রিটন টু মি অ্যাবাউট ইয়োর আমলাজ নাউ কনভিনসেস মি অফ দি ট্রুথ অফ দেয়ার রিপোর্টস । ইট ইজ ওনলি এ সোর্স অফ ওয়ানডার দ্যাট অল মাই এসটেটস আর নট রুইনড । ইয়োর টাইম, আই অ্যাম শিওর, বিইং মোর টেকন আপ ইন রাইটিং ফর নিউজপেপার্স অ্যাণ্ড ইন ফাইটিং উইথ দি মিশনারিজ দ্যান ইন ওয়াচিং ওভার অ্যাণ্ড প্রোটেক্টিং দি ইমপরট্যান্ট ম্যাটার্স হুইচ ইউ লিভ ইন দি হ্যাণ্ডস অফ ইয়োর ফেভারিট আমলাজ -- ইনস্টেড অফ অ্যাটেণ্ডিং দেম ইয়োরসেল্ফ ভিজিল্যান্টলি ।”
       হাবশিকে বলছিলুম, ও বুঝুক বা না বুঝুক, জানিস, রাজকুমার বলেছিলেন, বুঝলি হুলি, ধনী হবার চেষ্টা করবি, পয়সাঅলা হবার চেষ্টা করবি, বৈভবশালী হবার চেষ্টা করবি,  ব্যবসাদার হবার চেষ্টা করবি, কারখানা খোলার চেষ্টা করবি । অতিবামুন হবার চেষ্টা করিসনি, জাতধর্ম যাক চুলোয় । ধর্ম নিয়ে এতো ঢাকঢোল পেটাবারই বা কী দরকার ।
        উড়ুক্কু মাছ দুটো লাফিয়ে উঠে বললে, গুড ফিলোজফি, বাট বেঙ্গলিজ লাভ হোয়াইট কলার জবস ।
        রাজকুমারকে  যদি সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ইংরেজরা, যারা নেটিভদের ভালো চোখে দেখতো না, আর বাড়ির লোকেরা, জলচল বন্ধ করে একঘরে  না করতো, তাহলে উনিও ধিরুভাই আম্বানি হতে পারতেন, এমনকি ওদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকতে পারতেন, ধিরুভাই আম্বানিও তো আরবদেশে ভুঁড়িকাঁপানো মেয়েদের নাচ দেখতো।  তবে রাজকুমারের দোষ ছিল যে উনি কারখানা বসাবার চেয়ে সবকিছু কেনা আর বেচায় এতো জড়িয়ে পড়েছিলেন যে পরে গিঁট খুলে বেরোতে পারেননি, নয়তো রানিগঞ্জ থেকে কলকাতা, বর্ধমান থেকে হাওড়া  পর্যন্ত রেল লাইন উনিই বসিয়ে দিতেন ।
        ধিরুভাইয়ের বিরাট কারখানা কেমন খেপে-খেপে  বিদেশ থেকে লুকিয়ে আনা হয়েছিল তা কি আর আমি জানি না, সকলেই জানে, ওনার মা, ছেলেরা, গাঁয়ের লোকেরা, দিল্লির নেতারা, কিন্তু কই ওনার কাগজপত্র তো ওনার নাতিরা পুড়িয়ে দেয়নি, উল্টে ওনার বড়ো ছেলে বড়োলোকদের মধ্যে সবচেয়ে বড়োলোক হয়ে গেল । সেই কারখানা বসানোর তিকড়মবাজি নিয়ে সিনেমাও হলো, ওনাদের কিন্তু কেউ কমপ্রাডর বলে টিটকিরি মারে না, তার কারণ যারা টিটকিরি মারতো তারা আজ ভিখিরি । এক নৌকরি দে দে ও বাবু, ভগবান তেরা ভলা করেগা, ভিক্ষে করে মরে ।
         বড়োলোক হতে হলে যা দরকার রাজকুমারের চরিত্রে কাজকম্মে সবই ছিল, বাধ সাধলো ওনার আশেপাশের বাঙালিরা আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হিংসুটে সায়েবরা  ।
         বাংলার ইতিহাসে রাজকুমার ছিলেন প্রথম প্রেমিকবয় ।
         উনি যে মারা গেলেন সে খবর অব্দি কলকাতায়, পৌঁছোয়নি, তখন তো আর পাবলিকের জন্যে টেলিগ্রাফ ছিল না, ফোনও ছিল না, চিঠি পৌঁছোতেই তিন মাস লাগতো, বিলেতে কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল, তা খুঁজে বের করতেই কতোকাল লেগে গিয়েছিল।  কেমন বংশ রে বাবা ।
         ওনার বাড়ির লোকে গঙ্গার ঘাটে কুশপুতুল জ্বালিয়ে অন্ত্যেষ্টি করলে, এখন ওনার হৃৎপিণ্ড নিয়ে যাচ্ছি আসল শ্রাদ্ধের জন্যে, জানি না কী করবে বাড়ির লোকে, হয়তো লুকিয়ে ফেলবে । অতিবামুন কাল্টের তো নতুন হুজুগ জেগেছে, সব ঠাকুরদেবতাকে এক জায়গায় জড়ো করে তাদের হাপিশ করে ফেলে সেই ফাঁকা জায়গাটাকে পুজো করা, নিরাকার গোল্লাছুট যাকে বলে ।
        নেইকে পুজো করা আর নেইকে পুজো না করার মধ্যে তফাত আছে কোনো ? বলুন দিকি ।
         রাজকুমার যখন সুতানুটি-গোবিন্দপুরের বাড়িতে থাকতেন তখন রোজ বাড়ির ঠাকুদেবতার ঘরে বসে কতোক্ষণ পুজো করতেন, তখন তাঁকে কেউ ডাকতে পারতো না, লোকে দেখা করতে এলেও দু’ঘণ্টা বসে থাকতে হতো । যারা নেইকে পুজো করতে লাগলো তারা ওনাকে কতো যে হ্যাটা করেছে তা ইয়ত্তা নেই ।
        হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, ঠগীর একটা দল বাঘিনীর বাচ্চাদের সঙ্গে আমাকে জন্মাতে দেখে নিজেদের দলে নেবার জন্যে তক্কে তক্কে ছিল, তার কারণ আমার মাথার চুলের রঙ ছিল আগুনের মতন, বাঘিনী মায়ের কাছ থেকে পাওয়া । একদিন ওদের দলটা আমাকে কম্বল চাপা দিয়ে ধরে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করে জানতে চেয়েছিল যে ওরা সবাই তো ওদের মায়ের সামনে দিক থেকে জন্মেছে,  তাহলে আমি কোন যাদুবলে বাঘিনীর পেছন দিক থেকে জন্মালুম ।
         ঠগীর দল আরও অবাক হলো যখন দেখলো যে প্রতি বছর আমার বয়স চার বছর বেড়ে যায়, যার দরুণ আমি পাঁচ বছর বয়সে কুড়ি বছরের হয়ে গিসলুম । আঠেরো বছর বয়সে আমাকে শেখানো হলো কেমন করে সিল্কের হলদে রুমালে দুটো রুপোর সিক্কা  বেঁধে পেছন দিক থেকে মানুষ খুন করতে হবে, একজন পা চেপে ধরবে, একজন মাথা মাটিতে চেপে ধরবে আর একজন গলায় ফাঁস দেবে ।
        ঠগীজন্মের রুপোর টাকাগুলো যদি লুকিয়ে রাখতুম, তাহলে এই জন্মে বিলেত আমেরিকার নিলামঅলাদের দিয়ে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতুম ।
         আমাদের ঠগী সর্দারের মোহোল্লা আর লোকাল কমিটির ক্যাডাররা  আশেপাশের গাঁয়েগঞ্জে লোক পাঠিয়ে খবর যোগাড় করতো, কোন পথ দিয়ে বানিয়ারা তীর্থযাত্রীরা যাবে, কখন যাবে, আর সেই খবর অনুযায়ী আমরা রাস্তার ধারে লুকিয়ে ওৎ পেতে থাকতুম, এখন যেমন মাওবাদীরা পুলিশ মারার জন্যে রাইফেল হাতে লুকিয়ে থাকে আর দনাদ্দন গুলি ছোঁড়ে । পাশের রাষ্ট্রের ছোঁড়ারা যেমন এদেশে কয়েকজনের ঘুমন্ত গোষ্ঠী তৈরি করে বোমা মারার জন্য প্যাঁচ কষে, তেমনি আমরা তিনজন ঠগীর ক্যাডার তৈরি করে তক্কে তক্কে থাকতুম ।
         আমাদের ঠগী দলটা এক রাতে স্লিম্যান নামে একজন সাহেবের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে গেলুম । সকলের সঙ্গে আমারও ফাঁসি হয়েছিল, কিন্তু আমি যখন বললুম যে আমাকে কোনো বাঘের খাঁচায় হাতপা বেঁধে ফেলে দেয়া হোক তখন সাহেবরা তাই করেছিল । দুটো বাঘ আমাকে কেমন করে খাচ্ছে দেখার জন্য সাহেব মেমরা ঝিলমিলে চকরাবকরা পোশাক, পালকদেয়া রঙিন টুপি পরে সকাল থেকে জড়ো হয়েছিল । তাদের অমন জড়ো হতে দেখে পরে গোবিন্দপুরের বাইরে একটা চিড়িয়াখানা খোলা হয়েছিল, যেখানে শাদা চামড়ার সাহেব-মেমরা যেতো, পরে বাদামি চামড়ার সাহেব-মেমরা, আরও পরে ধুতি-শাড়ি শার্ট-প্যান্ট পরা দেশি পাবলিকরা, এতো পাবলিক হতে লাগলো যে তাদের তিতকুটে ঘামের গন্ধে চিড়িয়াখানার মাটি থেকে সব ঘাস লোপাট হয়ে গেল ।
         ঠগীর দলে প্রথম দিন ছিল আমার খুনোখুনি-লুটপাটের শিক্ষানবিশির, তাই রাস্তার ধারে জঙ্গলের আড়ালে ওৎ পেতে তীর্থযাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি খুন করিনি । যারা খুন করলো তারা তীর্থযাত্রীদের টাকাকড়ি সোনাদানা কেড়ে নিয়ে  মরা লোকগুলোর পেছন দিক দিয়ে আর মরা মেয়েমানুষদের সামনে দিক দিয়ে ঝর্ণাপতন খেলা খেললো, তারপর তাদের হাড়গোড় ভেঙে আগে থাকতে খুঁড়ে রাখা গর্তে কবর দিয়ে দিলে, তার ওপর এক বস্তা পাথুরে নুন ।
         আমরা ঠগীরা পয়দা হয়েছিলুম মা-ভবানী, মানে মা কালীর ঘাম থেকে । দেবীমূর্তিই তিরিশ ইঞ্চির সিল্কের রুমালে বাঁধা সিক্কা দিয়েছিলেন ।
         শিখে যাবার পর আমি শুধু মেয়েমানুষদের খুন করতুম, সে তার বয়স যতোই হোক, ওই পেছন দিক দিয়ে আমি কিছু করতে পারতুম না, কেননা আমি বাঘিনী মায়ের পেছন দিক দিয়ে জন্মেছিলুম, দলের ঠগী ক্যাডাররা  বলতো যে মেয়েমানুষদের ছেড়ে দেয়া উচিত, খুন করা তো এক্কেবারে অনুচিত, আর খুনের পরে সামনে দিয়ে ঝর্ণাপতন খেলা নোংরামির চূড়ান্ত । আমি বলতুম যে ঠগী কভাডারই যখন হয়েছি, তখন আবার নোংরামি নিয়ে ভাববো কেন, যতো রকমের নোংরামি হয় চালিয়ে যাবো ।
         এখনকার দিনের ঠগীরা এই ধরনের খেলা ট্যাক্সিতে, বাসে, আড়ালে করে বেড়ায়, লুকিয়ে নয়, খোলাখুলি, বুক ফুলিয়ে । যে যতো নোংরামি করতে পারে, তার ততো বেশি ফোটো কাগজে ছাপা হয়, টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়, টেলিভিশনে দেখানো আর কাগজে ছাপা হবে জেনে তারা ছ্যাদলাপড়া দাঁত বের করে হাসে ।
         এই যে লুট শব্দটা ইংরেজিতেও তিনশো বছর যাবত চালু,  শব্দটা তো আমরা, ঠগী ক্যাডাররাই, ইংরেজদের দিয়েছিলুম । ওরা কোনো শব্দ চুরি করতে কুন্ঠিত হয় না, যেমন কুন্ঠিত হয় না অন্য দেশের মালপত্তর হাতাতে। একে ওরা বলে ইউরোপিয় মূল্যবোধ ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না, গরিবের টাকা লোটার লুচ্চাদের ।
         তুই জানিস না, আমি আগাম দেখে যেতে পেরেছি, আর এরাই কিনা আমায় বদনাম করে দিয়েছিল।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না, বাড়ির চালে আগুন লাগিয়ে সর্বস্ব লোটার লাফাঙ্গাদের ।
         তুই জানিস না, চোখ বুজে আমি জ্বলন্ত খেত-খামার আর চালাবাড়ি দেখেছি ।
         এক বছরে চার বছর করে বাড়তে থাকার দরুন ষোলো বছর বয়সে আমার চৌষট্টি বছর বয়স হয়ে গেলে আমাকে সবাই মিলে ঠগীদলের হাইকমাণ্ড-পলিট ব্যুরোর নেতা করে দিলে, লুটপাটের সোনাদানা টাকাকড়ি আমিই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতুম । হুলিঠগী নামে আমি বিখ্যাত হয়ে উঠলুম, গাঁয়ে-গাঁয়ে আমার নাম নৈরাজ্যের নাট্যকার হিসাবে ছড়িয়ে পড়েছিল । আমার ভয়ে রাতের দিকে মানুষ দলবেঁধেও বেরোতো না ।
         হুলিঠগীর মা-ভবানী নামে যে কালীবাড়িতে বউরা পাকা তাল  আর মুলো নিয়ে আজকাল পুজো দিতে যায়, সেই মন্দির আমিই প্রতিষ্ঠা করেছিলুম, লুটের টাকায় । লুটের টাকা না হলে মানুষ কিছুই প্রতিষ্ঠা করতে পারে না । প্রতিষ্ঠান মানেই লোটালুটির কারবার ।
         এখন বুদ্ধিমান পাঁয়তাড়াবাজরা পনজি-স্কিম নামে লুটের টাকা যোগাড়ের খেলা আরম্ভ করেছে, অনেকে সেই খেলা খেলতে গিয়ে ল্যাংটো পোঁদে বাড়ি ফিরেছে, অনেকে আত্মহত্যা করে নিয়েছে, কিন্তু লুটের টাকা সেই যে একবার ওরা হাতিয়ে নিলে, তারপর সেসব টাকাকড়ি যে কোথায় ডানা মেলে উড়ুক্কু মাছ হয়ে গেল কেউই জানতে পারলে না । মূর্খগুলো ভাবলোই বা কী করে যে টাকা খাটিয়ে হুশহুশিয়ে ডবল করা যায় ! টাকার কি মানুষের মতন ফিবছর বাচ্চা হয় !
         রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললে, বাঙালি আর বাঙালি নেই, মহামূর্খের কৌম হয়ে গেছে ।
         আমার নাম হুলি, এখন আমি জাতে শুদ্দুর, না চণ্ডাল-শুদ্দুর নয়, গন্ধবেনে, আড়কাঠির লোকেরা মা-বাপকে পালতোলা জাহাজে চাপিয়ে কালাপানি পেরিয়ে আখকাটার জন্যে ভিনদেশে নিয়ে চলে গিয়েছিল,  আমি তখন ঝুপড়িতে ছিলুম না, খোসা ছাড়িয়ে বস্তায় পোস্ত ভরছিলুম, আফিম চাষ না হলে বাঙালি কি আর পোস্ত খেতে শিখতো, অ্যাঁ ?
         বাঙালিরা পোস্ত খেতে ভালোবাসে, আলুপোস্ত, পেঁয়াজ পোস্ত, ধুঁধুল পোস্ত, কাঁচা পোস্তবাটা সর্ষের তেল মেখে, পোস্তর বড়া,  সেই থেকে আমি রাজকুমারের বাড়ির চাকর, আসলে রাজকুমারের খাস-চাকর, ওনার আফিম কারখানায় কাজ করতো বাবা আর মা, কারখানা মানে অনেক উঁচু ছাদের ঘরে আফিমের বস্তা সাজিয়ে রাখা, আমিও খাটতুম, কিন্তু বেগার, আমার চোখ কটা বলে ছোটোবেলা থেকে আমার নাম হুলি।  
         কোম্পানি পাঁচ হাজার চাষিকে দিয়ে আফিম চাষ করাতো, আফিমের হিসেব রাখা, রপ্তানি করা, রপ্তানির খরচ-খতিয়ান লেখা, এই সবের জন্যে কোম্পানি অঢেল কেরানি, হিসেবের খাতা লেখার লোক আর ছড়িদারদের চাকরি দিয়েছিল। দিকে দিকে গজিয়ে উঠল বাঙালি কেরানির দল, বাবুর দল, তারা ভদ্দরলোক হবার চেষ্টা করে করে হেদিয়ে কাঁকুড় হয়ে গেল, কিন্তু বাংলাদেশে কেরানির পাল পয়দা করে গেল, সরকারি চাকরির জাঁতিকল পেতে যেতে পারলো ।       
         রাজকুমারের  সঙ্গে আমিও কালাপানি পেরিয়ে পালতোলা ক্লিপার জাহাজে চেপে বিলেতে গেছি, পরপর দু’বার, আমি শুদ্দুর বলে কালাপানি পেরিয়ে জাত যায়নি, কিন্তু রাজকুমারের  জাত চলে গিয়েছিল, যখন প্রথমবার গেলেন, ফেরার পর গঙ্গাজলে চান করিয়ে কুলীন পুরুত ডাকিয়ে নিজের জাতে ফিরেছিলেন, তা সত্ত্বেও ওনার ভারিভরকম বউ আলাদা ঘরে থাকতেন-শুতেন, ফলে রাজকুমার বিলেতে গিয়ে আশ মেটাতেন । জ্ঞানীগুণিরা রাজকুমারকে গ্রিস দেশের রাজা ক্রিসাসের সঙ্গে তুলনা করতেন, যিনি গ্রিসদেশের মানুষকে অনেক কালের জন্যে বড়োলোক করে তুলেছিলেন ।
        রাজকুমারের কাজকারবারের দরুনই তো সুতানুটি-গোবিন্দপুর আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠল, দেখা দিলো অন্য রকমের মানসিক জীবন । শহুরে জটিলতার হ্যাঙ্গামের সঙ্গে নিয়মানুবর্তীতা, হিসাবনিকাশ, নিখুঁত হবার চেষ্টাচরিত্তির । বাঙালির, যে বাঙালি তখন বাঙালি হিসেবে গড়ে উঠছিল, তার গঠন-বিগঠনের গলনপাত্র হয়ে উঠল সুতানুটি-গোবিন্দপুর । গাঁগেরাম থেকে জনে জনে মানুষ এসে জড়ো হতে লাগলো, যারা একে আরেকজনকে চেনে না, বোকা-হাবার মতন তারা দিন আনি দিন খাইতে চরকিনাচন দিতে লাগলো ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না তাঁরই অবদান হিসাবে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে তাৎপর্য পেয়েছে জেলখানার গিজগিজে ডিগডিগে বিচারাধীন কয়েদি , থানার পেটমোটা ওসি যেন সাত মাসের অন্তঃসত্বা, চিনের রঙিন আলোয় ঝলমলে বেশ্যালয়, ভাটিখানার ঠেলাঠেলি, মল, মালটিপ্লেক্স, ডিসকো, নাইট ক্লাব, পাগলা গারদ, দেওয়ানি আর ফৌজদারি আদালতের চাকুরে বিচারক, মোক্তার, অপরাধী, পাগল, দ্রোহী, বিরোধী ।
        হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না শহর এখন সংঘাতক্ষেত্র ।
        তুই কেমন করে জানলি, ক্লাইভের পোষা গুণ্ডারা তো দেখিয়েছিল, সেটাই রিপিট হতে থাকে, শুনিসনি নাকি, হিস্ট্রি রপিটস ইটসেল্ফ ?
        হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না লাঠিবাজ ক্যাডারের দল, কে কাকে কেন পেটায় কেউই জানতে পারে না ।
        তুই জানিস না, আমি যেসব লাঠিবাজ পুষতাম, এরা তাদেরই বংশধর, তারা ধুতি পরতো বা লুঙ্গি, এরা প্যাণ্টালুন পরে, এই যা তফাত ।
        হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না গাঁয়ে  গঞ্জে শহরে বেকার ছেলেদের ক্লাব নামের অলস আড্ডাখানা, যেখানে তারা দিনভর ক্যারাম আর তাস খেলে ।
        আমি জানি হুলি, দিনভর লোকে চণ্ডীমণ্ডপে বসে গ্যাঁজাতো, দাবা খেলতো, এরা তাদেরই চেলাচামুণ্ডা।
        হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না অকর্মণ্য বুকনিবাজ দলনেতা, দলদাস, মন্ত্রী, আমলা, ট্রেড ইউনিয়ান, কেরানি ইউনিয়ান নেতাদের ।
        দেখেছি, দেখেছি, হিন্দুদের নেতারা আমার বিরুদ্ধে কতো বদনাম দিয়ে বেড়াতো, সেই তাদেরই তো রক্ত বইছে এখনকার বুকনিবাজদের শিরায়, আর তুই বলছিস আমি দেখে যেতে পারলুম না । আমার শবের বদলে কুশপুতুল পুড়িয়ে শ্রাদ্ধের সময়ে হিন্দুদের চাঁইরা কতো হ্যাঙ্গাম করেছিল ; ওদের কথা মানা হয়নি বলে ওরা একঘরে করে দিলে, আমার ছেলেরাও চটে-মটে হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে গেল, আর আমার ব্যবসাও লাটে উঠে গেলো ।
        চিনে আফিম চালানের জন্যে রাজকুমারের দুটো ক্লিপার জাহাজ ছিল, একটার নাম এরিয়েল, সেই যে সিলভিয়া প্লাথ এরিয়েল নামে কবিতার বই ছাপিয়ে ছিলেন, তা তো রাজকুমারের কাছ থেকেই পাওয়া । সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে রাজকুমারের দেখা হয়নি, রাজকুমার অনেক আগেই জন্মেছিলেন তো । সিলভিয়া প্লাথের যেমন অকাল মৃত্যু হয়েছিল, তেমনই এরিয়েল জাহাজেরও অকাল মৃত্যু হয়েছিল, কেননা জাহাজটাকে চীন বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল, বিলেতি কোম্পানির ওসকানিতে, যারা রাজকুমারকে এক্কেবারে পছন্দ করতো না, এদিকে বাইরে-বাইরে দেখাতো কতোই না রাজকুমারকে ভালোবাসে ।
         রাজকুমারের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কীই বা বলি, অন্য জাহাজটা, যার নাম ছিল ম্যাভিস, তার ওপর সমুদ্রে বাজ পড়ল একদিন, জাহাজ পুড়ে ছাই, বিলেতি কোম্পানিরা সে খবর পেয়ে মাগি-মরদের মদ গেলার আর আস্ত পোড়ানো শুয়োর খাবার আর নাচানাচির পার্টি দিয়েছিল । ওয়ান টু থ্রি ফোর, হোয়্যার ইজ দি পার্টি টুডে ? অন দিস ডান্স ফ্লোর, ঝিংকিচিকিং ঝিংকিচিকিং ঝিংকিচিকিং ।
        রাজকুমারের বাড়িতে কেউই ওনাকে পছন্দ করতো না, অথচ ওনার টাকাতেই সবাই ফুটানি মারতো । এই যে রাজকুমারের এক ছেলের বারোটা বাচ্চা হলো, সাত ছেলে আর পাঁচ মেয়ে, তার খরচ যোগানো কি সোজা কথা, সেসব খরচের টাকা তো রাজকুমারের কাজকম্মো থেকেই আসতো, এখন খরচের মজাও নেবে আবার  রোজগারের উপায়কে খারাপ ভাববে, এ কেমন ধারা কথা বাপু, অ্যাঁ । বারোটা বাচ্চা বিয়োতে বউটার যে কষ্ট হয়েছিল, তা কি রাজকুমারের বড়ো ছেলে অনুভব করতে পেরেছিল ? রাতে বিছানায় গেলেন, মশারি টাঙালেন আর ব্যাস, অ্যাঁ, কী মানুষ রে বাবা, ধন্যি মহাপুরুষ । দিনের বেলা সকাল থেকে নেই-ঠাকুরের পুজো ।
         রাজকুমারের টাকাতেই তো একটা বাঙালি রাজবংশ গজিয়ে উঠলো ; রাজকুমারের দেখাদেখি নিজেদের নামে নাথ জুড়তে হলো ।
         বাঙালি পাবলিক অবশ্য মনে করে যে ওনার এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা জরুরি ছিল, নয়তো বাঙালিরা নোবেল প্রাইজ পাবার গর্ব করতে পারতো না, নোবেলের মেডেল চুরি যাবার গর্ব করতে পারতো না, এই পার ওই পারের জাতীয় সঙ্গীতের গর্ব করতে পারতো না, যদিও ওই পারের দাড়িয়াল টুপিয়াল লোকেরা চোপোর দিন চেল্লাতে থাকে যে ওনার লেখা জিম্মি মালাউন জাতীয় সঙ্গীত চলবে না, কোনো পাকিস্তানিকে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত লেখাও । পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের শিরোনাম দিয়ে হুমায়ুন আজাদ নামে এক জ্ঞানীগুণী মানুষ একটা বই লিখেছিলেন, তার জন্যে তাঁকে রামদা-কাটারি মেরে-মেরে কোতল করলে সউদি আরবের বাঙালি চুটকিদাড়ি ট্যাংরাটুপি খিদমতগাররা ।
          রাজকুমারের বড়ো ছেলে নিজের অতিবামুন কাল্টের জন্যে  লিটল ম্যাগাজিন বের করা আরম্ভ করলে, বন্ধুবান্ধবদের জড়ো করে কফিহীন কফিহাউস  তৈরি করলে, সবই তো রাজকুমারের টাকায় । সেই টাকাকে তোমরা ঘেন্না করোনি, অথচ রোজগারের উপায়কে ঘেন্না করলে । কী আর বলি, বড়োলোকদের ব্যাপার-স্যাপারই ভিতরঘুন্না। তবে তারপর থেকে লিটল ম্যাগাজিন বের করার আর অতিবামুনগোষ্ঠী হবার চল আরম্ভ হতে পেরেছিল । সবচেয়ে পেল্লাই যে অতিবামুনগোষ্ঠী গড়ে উঠল তা বিগ ম্যাগাজিন, দুর্গন্ধবনিকের দরিয়া।
          রাজকুমারের পরিবারও বামুন, তবে উঁচু বামুন নয়, কায়েত আর বামুনের মাঝ-মদ্যিখানে, তবে বদ্যি নয় । ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্তয় বলেছে যে পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য আর পা থেকে শুদ্র লোকেরা জন্মেছিল । যদি তাই হয় তাহলে পুরুষের মুখ থেকে বেরিয়ে কোথায় আটকে গিয়েছিলেন রাজকুমারের পরিবার যে খাঁটি বামুনের ছাতার তলা থেকে সরে গেলেন ।
         রাজকুমারের এতো টাকাকড়ি থাকা সত্বেও  বাড়ির ছেলে আর মেয়েকে খাঁটিমার্কা বামুনরা বিয়ে করতে চায়নি, রুপোর সিক্কার পুঁটলি দিতে চাইলেও তারা রাজি হয়নি, কনে  সুন্দুরী হলেও চায় নি, তাই ওনার ছেলেপুলেরা বামুন থেকে অতিবামুন কাল্ট হয়ে গিয়েছিল ।
         আসলে ওনাদের বাপঠাকুদ্দার কেউ একজন মোচোরমানের বাড়ির রান্নাঘরের মম গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলেন, তারা বোধহয় গোরুর শিককাবাব কিংবা দোপেয়াজা রাঁধছিল, রেগেমেগে রাজকুমার এখন বিদেশে গেলে অন্য  মাংসও খান ।
         আমিও খেয়েছি, খুবই ভালো খেতে, আহা বিলেতের গোলাপি শুয়োরের তো তুলনাই হয় না, জড়িয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, মাদি শুয়োরের গোলাপি থনে চুকুস-চুকুস করতে মন চায় । গোরুর মাংসের চেয়ে হাজার গুন সুস্বাদু, মোচোরমানরা তো শুয়োরের মাংস খায় না, হালাল করা যায় না বলে, কিন্তু হিন্দুর ঝটকাতেও শুয়োর  মরে না, বিলেতে শুয়োরের মাংস পাঁঠার মাংসের চেয়েও মোলায়েম, মুখে দিলেই গলে যায়, কিন্তু গোরুর মাংস তো ছিবড়ে, অ্যাহ, বিটকেল, ভাবা যায় না ।
         রাজকুমার গোরুর মাংস খান না, রুচিতে বাধে ।
         আমি তো শুদ্দুর হুলি, আমাদের কোনো রুচি রয়েছে দেখলে  বামুনরা চটে যায়, বামুন মানে জাতবামুন নয়, টাকাবামুন ।
         ঢাকনা দেয়া ভেনিশিয়ান কাঁচের জারে ফরম্যালিনে চোবানো রাজকুমারের  হৃৎপিণ্ড নিয়ে আমি লণ্ডন থেকে পালতোলা জাহাজে চেপে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ফিরছি । ফরম্যালিন মানে একরকমের শরবত, তাতে মরা মানুষের হৃৎপিণ্ড  বেঁচে ওঠে, শরবত খায় আর অনেককাল তাতে আয়েশ করে শুয়ে থাকে, সেই হৃৎপিণ্ড ইচ্ছে হলে কথা বলতে পারে, হাসতে পারে, গাইতে পারে, কাঁদতে পারে ।
         ওই শরবতে মরা মানুষের যে-কোনো অঙ্গ চুবিয়ে রাখা যায় । এই জন্মে যদি বিয়ে করে সংসার পাতি, আমি মরে গেলে আমার ছেলেপুলেদের বলে যাবো যেন ওরা আমার দুই অণ্ডকোষ আর লিঙ্গখানা শরবতে চুবিয়ে রাখে, পছন্দ হলে পরের জন্মে এসে ওটাই ফিট করে নেবো, যদি আগামি জন্মেরটা মনের মতন না হয় ।
         প্রথমবার গিসলুম ‘দি ইন্ডিয়া’ নামের ক্লিপার জাহাজে, তিনটে মাস্তুল ।  অনেক ঘুরে যেতে হয়েছিল, আফ্রিকার পোঁদের তলা দিয়ে কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে, আমার বেশ ভালোই লেগেছিল, তিন মাস   জাহাজে কাটিয়েছিলুম, কতো দেশ দেখতে দেখতে গিয়েছিলুম, কালো হাবশি, শাদা চামড়ার লোক, নানা রঙের শাদা চামড়ার মেম । দেখলেই লোভ হতো । হাবশি মেয়েদের দেখেও আমার খুব লোভ হতো, ওদের পাছা আর বুক বেশ উঁচু-উঁচু, টাটকা, বুক খুলেই ঘুরে বেড়ায়, সুতানুটি-গোবিন্দপুরের শুদ্দুর বউদের মতন ঢিলেঢালা নয়, বউবাজারের সন্ধ্যাবাজারে যদি অমন হাবশি মেয়েদের আনতে পারতো, আহা, জীবন সার্থক হয়ে যেত গো ।
          দ্বিতীয়বার রাজকুমারের  সঙ্গে ‘বেন্টিঙ্ক’ নামের জাহাজে করে সুয়েজখাল পেরিয়ে বিলেতে গিসলুম, জাহাজখানা বিরাট, তাতে আশিজন যাত্রী ছিল আর রাজকুমারের  ছোটো ছেলে , ভাগ্নে , ইংরেজ সচিব আর আমরা তিনজন চাকর, অন্য দুজন আমার চেয়ে বয়সে বড়ো। । সুয়েজ খাল তৈরি হবার দরুন যাওয়া-আসার সময় অনেক কমে গিসলো ।
         মিশরে ইব্রাহিম পাশার অতিথি ছিলেন রাজকুমার, আমি তো ওনার খাস চাকর, ওনার আদর-যত্নের ভাগ আমিও পেইচি । পাশা ওনাকে লাল মখমলের পোশাক আর নিজের খচ্চরঘোড়া দিয়েছিলেন ঘুরেফিরে শহর-বাজার দেখার জন্য । পাশা ওনাকে শাহজাদা অফ বেঙ্গল বলে ডাকতেন ।
         মিশর দেশটা যে এতো পুরোনো তা জানতুম না, মরুভূমির মাঝখানে কী বিরাট বিরাট তিনকোনা বাড়ি, যাকে ওরা বলছে পিরামিড, ওর ভেতরে নাকি আগেকার রাজা রাজড়াদের অনেক গল্প আছে, তাদের মলম মাখানো সোনায় মোড়া বাক্সবন্দী লাশ আছে, কতো যে গয়নাগাটি আছে তার ঠিকঠিকানা নেই, সেকালের মানুষদের শক্ত শক্ত ভাষায় গল্প লেখা আছে দেয়ালে-দেয়ালে । মরুভূমির মাঝখানে কেন যে এমন তিনকোনা বাড়ি বানিয়েছিল সেকালের রাজারা তার খোঁজ-খবর নিচ্ছে সায়েবের দলবল ।
        মিশরের লোকেরা তাদের মন্দিরকে বলে মসজিদ, তার ভেতরে ঠাকুর-দেবতা নেই, রাজকুমারের ছেলে যেমনধারা পুজো করে এরাও তেমনি ধারা পুজো করে, কিন্তু হাঁটু মুড়ে নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে সবাই মিলে কাতারে বসে পুজো করে, কোনো শুদ্দুর বামুন তফাত নেই । এখানে মরে গেলে কাউকেই পোড়ায় না, আমাদের দেশে নেড়েদের যেমন গোর দেয়া হয় এখানেও তাই ।  মেয়েদের দেখতে খুবই সুন্দর, জড়িয়ে চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল, একজন স্বামী চারজন বউ রাখতে পারে, শুনে বড়ো ভালো লাগলো, চারজন বউই স্বামীর সঙ্গে থাকে, স্বামী মরলে বউদের কবরে পোঁতা হয় না । যারা অনেক বড়ো লোক, যেমন পাশা, বউ ছাড়া বাঁদিও রাখে, তাকে বলে হারেম, আমাদের দেশে সায়েবরা আসবার আগে নেড়ে সুলতানদের যেমন ছিল ।
         মিশর থেকে আমরা গেলুম মাল্টা নামে একটা দ্বীপে, দিনকতক সেখানে থাকতে হল, আমাদের কারো ছোঁয়াচে রোগ আছে কিনা যাচাই করার জন্যে । দ্বীপটায় বিলেতের রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব, মন্দিরকে বলে চার্চ, ওদের ঠাকুর-দেবতাকেও দেখা যায় না, তবে ওরা মনে করে কুরুশকাঠে পেরেক-বেঁধা পোশাক-খোলা লোকটাই ভগবানের ছেলে । সেই দিক থেকে রক্ষে । ঠাকুর-দেবতাকে দেখতে না পেলে সে আবার কেমনতর পুজো ! যা নেই তাকে পুজো করার বদলে এখানকার সায়েবরা চার্চে একজনকে আছে নাম দিয়ে পুজো করে, তা সে পোশাক পরে না থাকলেই বা ।
         মাল্টা দ্বীপ  থেকে রাজকুমারের পুরো দল গেলুম ফরাসিদেশের বোর্দো নামে একটা জায়গায়, মদের উৎসব আরম্ভ হয়েছিল, এখানকার মদকে বলে ওয়াইন, রাজকুমার মদ খেতে ভালোবাসতেন, আর ওনার যে কোম্পানি ছিল, সেই সিটি কোম্পানি তো সুতানুটি-গোবিন্দপুরে, মায় তার বাইরেও,  যেখানে-যেখানে সাহেব-মেমরা বাসা বেঁধেছিল, সেখানেও মদ বিক্রি করতো । মদ খেয়ে মেমরা এতো হাসতো যে তাদের ঠোঁটের হাসি খাবার ইচ্ছে হতো আমার, মনের ভেতরেই চেপে রাখতুম, যদ্দিন না রানি ভিক্টোরিয়ার মুনশির সঙ্গে আলাপ হলো ।
         বোর্দো থেকে আমরা রাজকুমারের সঙ্গে গেলুম প্যারিস নামে একটা শহরে, দশদিন ছিলুম, সেখানের লোকগুলো কী বোকা, প্যারিসকে বলে পেয়ারি ।  মেমদের দেখতে কী সুন্দর কি বলব, তাই বোধহয় প্যারিসকে পেয়ারি বলে, কচি মেমগুলো যেন নরম তুলতুলে পুতুলের মতন, দেখলেই চটকাতে ইচ্ছে করে । যে কচি মেমরা রাজকুমারকে পছন্দ করতো,  তারা রাত্তিরে ওনার হোটেলের ঘরে এসে ফুর্তি করতো, বিলিতি বাজনার তালে তালে ফরাসি নাচ নাচতো, কুঁচির থাক দেয়া ঘাগরা পরে । আমারও ইচ্ছে করত ফরসা মেমদের সঙ্গে ফুর্তি করার, রাজকুমারের দেয়া হাতখরচের টাকায় এখানকার বউবাজারে গিয়ে করতে পারতুম, কিন্তু আমি ওনার খাস চাকর বলে সাহসে কুলোয়নি, আর ভাষাও তো জানিনে, দরদস্তুর করতুম কেমন করে ।
         অন্য দুজন চাকরের  মধ্যে যাকে আমরা হরিখুড়ো বলতুম, ঘুরে এসেছিল পিগালে নামের পাড়ায়, ওই ঘোরার জন্যেই দেশে ফিরে নুনুর রোগ দেখা দিয়েছিল, সেই রোগের যন্তন্না থেকে ছাড়ান পেতে দলা-দলা আফিম খেতো, এসব কথা আমি হরিপদ খুড়োর খুড়িকে বলিনি কখনও, খুড়ি টের পেয়ে গিয়েছিল নিশ্চই, খুড়িকেও তো ওই রোগে ধরল, খুড়ো-খুড়ি দুজনে আফিমের দলা খে্যে ভোম মেরে পড়ে থাকতো ।
         মানুষের আনন্দের পথে কেন যে রোগের লাইন টেনে দেয় ভগমান তা বুঝতে পারি না । ভগমানই আনন্দ তৈরি করেছে, আবার ভগমানই আনন্দের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এ কেমন বিচার, অ্যাঁ !
         রাজকুমারের সঙ্গে আমরা সবাই ১৮৪৬ সালের ১৮ই মার্চ লণ্ডনে পৌঁছেছিলুম । ওনার ছোটো ছেলের লণ্ডন আর সেখানকার আদবকায়দা একেবারেই পছন্দ হলো না । রাজকুমার  আমায় বলেছিলেন, বেশ দুঃখ করে বলেছিলেন, পলকাটা মদের গেলাসে সোনালি রঙের মদে চুমুক দিতে দিতে, এরা বঙ্গদেশকে ডুবিয়ে দেবে, কিছুই শিখতে চায় না, বিলেতের লোকেরা কেমন দিকে দিকে কল-কারখানা বসিয়ে দেশটাকে সারা পৃথিবীর মালিক করে তুলছে, আর আমার নিজের রক্তই আমাকে বুঝতে পারলে না । ওরা আমিন, বানিয়ান, সেরেস্তাদার, বানিয়া, মুৎসুদ্দি কথাগুলোকে খারাপ মনে করে, ঘরের খেয়ে মিছিল দিয়ে রাস্তা জ্যাম করবে, আর নিজেদের ভদ্রলোক ছাপ্পা মেরে বারফট্টাই দেখাবে, দেখে নিস তুই, একদিন ভদ্দরলোক নামের  প্লেগ ছড়িয়ে পড়বে দেশময়, কেরানি হবার জন্যে মানুষ হত্যে দিয়ে কালীঘাটের কালীর দোরে পড়ে থাকবে ।
       লণ্ডনে রাজকুমার  রোজই খানাপিনার ব্যবস্হা করতেন,  কিংবা অন্য বড়োলোক সাহেবরা ওনার জন্যে খানাপিনার ব্যবস্হা করতো । রাজকুমার যে কেন মদ খেতে এতো ভালোবাসতেন কে জানে, বরং আমাদের মতন আফিম আর তাড়ি খেলে ওনার স্বাস্হ্য ভালো থাকতো । শুধু তো মদ খাওয়া নয়, কচি সুইটহার্ট মেমদের নিয়ে আমোদ করতেন, সারারাত মেতে থাকতেন আমোদে, মেমগুলোরও লজ্জা শরম ছিল না, এমন পোশাক পরতো যে অনেক কিছুই দেখা যেতো, আমার মতন হেলাফেলার চাকরেরও পুঁইমেটুলি দেখে শরীর চিনচিন চিনচিন করতো, চাকরদের চানের ঘরে গিয়ে চিনচিন কমাতে হতো ।
         ৩০ জুন ডাচেস অফ ইনভেরনেসের প্রাসাদে রাতের খাবারের নেমন্তন্নয় খাবার টেবিলে বসে হঠাৎই রাজকুমারের তেড়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো । ওই অসুখেই উনি পয়লা  আগস্ট মারা গেলেন, মাত্র একান্ন বছর বয়সে। আমার আর হরি খুড়োর কাঁদতে কাঁদতে গলা বুজে গিয়েছিল ।
         কলকাতায় লোক মুখে খবর পাঠানো হয়েছিল, সে খবর পৌঁছোলো আড়াই মাস পরে । ইতিমধ্যে ওনার অন্ত্যেষ্টিতে কী করা হবে কেউ ঠিক করতে পারল না বলে কবর দেয়া হলো ; একজন হিন্দুকে গোর দিয়ে দেয়া হলো, এতো বড়ো একজন মানুষ, লাখ লাখ টাকার মালিক, তাকে মুখে আগুন দেবার লোক পাওয়া গেল না ।      হাসপাতালের বিছানায় উনি যদি একবার বলতেন, হুলি, তুইই আমার মুখে আগুন দিবি, কেউ দিক বা না দিক, তাহলে আমিই দিতুম, হলেই বা শুদ্দুর ।
           নিজের মা-বাপের মুখে আগুন তো দিতে পারিনি, কে তাদের মুখে আগুন দিয়েছিল তাও জানি না, গুজব আসতো যে যারা আড়কাঠির ফোসলানোয় বিদেশে আখখাটার মজুর হয়ে গেছে, তাদের সবাইকে ধরে-ধরে কেরেস্তান করে দিয়েছে সেখানকার পাদ্রিরা, মুখে আগুনের আর দরকার নেই, মাটি খুঁড়ে পুঁতে দিলেই কাজ শেষ, মাটিতে মিশে ভালো সার হয়ে যাবে, আখকে আরও মিষ্টি করে তুলবে, সায়েবরা সেই মিষ্টি আখ থেকে চিনি তৈরি করে চায়ের কাপে চামচের টুঙটুঙি বাজাবে, জন্মদিনের কেকে চিনির আরক দিয়ে লিখবে,, হ্যাপি বার্থডে টু  ড্যাডি রামু গাণ্ডুবনিক, হ্যাপি বার্থডে টু মাম্মি হরিমতি গাণ্ডুবনিক ।
         রাজকুমারের গোর যেমন অনেককাল রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অচেনা পড়েছিল, তেমন ছিল ক্লাইভ নামে সাহেবটার, কেউ জানতোই না কোথায় তেনাকে গোর দেয়া হয়েছিল ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ভিড়, জঞ্জাল, জ্যাম, মারামারি, মিছিল, বিশৃঙ্খলা, হুমকি ।
         তুই কেমন করে জানলি যে আমি জানি না, আমি সবই আগাম দেখতে পাই ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না মোটর সাইকেলে চেপে মাঝরাতে কোটিপতি-বাড়ির যুবকদের হার ছিনতাই দল ।
         জানি হুলি জানি, তোকে আর আপশোষ করতে হবে না ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ ।
         জানি হুলি জানি, ওরা তো আমার পোষা লাঠিয়ালদেরই ছেলেপুলে ।
         এখন রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড যত্নকরে সামলে দেশে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাকেই দেয়া হয়েছে, ওনার তিনজন চাকরের মধ্যে আমাকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন উনি । আমি সব সময় নজর রাখছি যাতে সমুদ্রের ঢেউয়ে ফরম্যালিন শরবত চলকে না ওঠে, যাতে গোলাপি প্রজাপতির মতন  হৃৎপিণ্ডের কষ্ট না হয় ।
        জাহাজে একদিন রাজকুমারের  হৃৎপিণ্ড আমাকে ডেকে বললেন যে একা-একা ভাল্লাগছে না, তাই একটু গল্প করতে চান । আমি তো থ । কোথায় আমার মালিক একজন রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড, আর কোথায় আমি গৃহস্বামীর পরিবারের থাকা-খাওয়ার ছোকরা চাকর যাকে ওনারা বলেন ভৃত্য, কীই বা গল্প করব রাজকুমারের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে, রাজকুমার সামনে থাকলে না হয় তাঁর পায়ের কাছে বসে ওনার নানা দেশ ঘোরার গল্প শুনতুম, মোজরি জুতো খুলে পা টিপে দিতুম, সব দেশে তো আমি সঙ্গে যাইনি ।
         রাজকুমারের  হৃৎপিণ্ড বললেন, জানি তুই আমাকে মনে-মনে হৃৎপিণ্ড বলছিস, কিন্তু হুলি, তুই তো আমার  খাস-চাকর, বিশ্বাস কর, এটা আমার হৃদয়, হৃৎপিণ্ড আর হৃদয়ের তফাত জানিস তো ।
         আমি গলার ভেতরে জমে থাকা কুয়াশা সরিয়ে বললুম, মাফ করবেন হুজুর, আপনি তো আপনার মাথার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তবে হৃদয় কেটে নিয়ে যাচ্ছি কেন আমরা ?
         রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললেন, দ্যাখ, লোকে সামনাসামনি আমাকে যাই বলুক না কেন, তুই তো জানিস আড়ালে ওরা আমাকে বানিয়ান, মুৎসুদ্দি, মহাজনি সুদখোর, আবগারি ঘুষখোর, বউবাজারের বাড়িগুলোর মালিক, আফিমচাষি, কোম্পানির দালাল এইসব কথা বলে বেড়ায় ।
         আমি ভেবে পেলুম না কী বলি, আমরা চাকররা তো এসব কথা আলোচনা করি না, করার সময় পাই না, তবু বললুম, ওরা বলুকগে, ওদের সংসারে যারা জন্মাবে তারা এইসব কাজ একেবারে ভুলে গিয়ে দেশটাকে ডোবাবে, বিলেতের লোকেদের তো দেখলুম, সকলেই বানিয়াগিরি করে কিংবা করতে চায় ।
         রাজকুমারের হৃদয় বললে, তুই তো জানিস, হরিমোহনের ছেলে উমানন্দ, ওই যার আরেকটা নাম নন্দলাল, বলে বেড়িয়েছিল যে যৌবনের গরমে, টাকাকড়ি, ক্ষমতা-প্রতিপত্তির জোরে, আমি নাকি কুসঙ্গে পড়ে ধর্ম আর জনমতকে ভয় পাই না, টিকি কেটে ফেলে দিয়েছি, পৈতে ফেলে দিয়েছি, মদ খাই আর মুসলমান মেয়েদের সঙ্গে শুই, মুসলমানের হাতের রান্না খাই ।
        আমি বললুম, হুজুর, আপনি যে মদ ইচ্ছে খাবেন, যার সঙ্গে ইচ্ছে শোবেন, তাতে অন্যলোকের মাথাব্যথা কেন হয় ? আপনার মুসলমান বাবুর্চি এতোভালো রাঁধে, যা বেঁচেখুচে থাকে, তা খেয়ে দেখেছি, আহা, মন ভরে যায় । আর কুসঙ্গ মানে তো চোগা-চাপকান পরা আপনার জমিদার বন্ধুরা ।
        জাহাজের ক্যাপ্টেনের দেয়া মদ খেয়ে আমার গলায় লাল রঙের মেঘ জমে আছে, ঘড়ঘড়ানির দরুন টের পেলুম । আর সবাই যাবার সময়ে আর আসার সময়েও ঢেউ সামলাতে না পেরে বমি করেছিল, আমি করিনি, বরং নীল সমুদ্র আমার খুবই পছন্দ হচ্ছিল, দূর-দূর পর্যন্ত কিচ্ছু দেখা যায় না, দেখা পাওয়া যায় না বলেই আরও ভালো লেগেছিল ।
       সমুদ্রে মাঝে মাঝে উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক, তিমি মাছেদের ঘাই দেখতে দেখতে যেতুম ।
        রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললে, উনি বন্ধু নয় রে, ওই চোগা-চাপকান পরা জমিদার আমার পথদেখানোর লোক ছিলেন ; তবে ওনার দেখানো পথে চলতে গিয়ে আমার বড়ো ছেলেটা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে ।
         পরের জন্মে তো দেখেছি রাজকুমারের  নিজের একজন নাতি বানিয়াগিরি-জমিদারি ভুলে গিয়ে পদ্য লিখে আর গান গেয়ে বাঙালি জাতটাকে ক্যাবলা করে দিলে, কতো লোকে চট দিয়ে ওনার নকল দাড়ি তৈরি করে বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখে, যাতে ছেলেপুলেরা ক্যাবলা-টাইপ হয় । হয়তো সেই কারণেই চটকলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেল, সায়েবদের থেকে কিনে নিয়ে মেড়োপার্টিরা চটের ফাটকা খেলে ডুবিয়ে দিলে ।
         এখন সকলেই পদ্য লিখতে চায় আর গান গাইতে চায় । ছেলে-ছোকরারা যখন বিপ্লব আরম্ভ করলে তখনও পদ্য লেখা আর গান গাওয়া শুরু করলে, সেই সঙ্গে খুনোখুনি। ব্যাস দেশের দফারফা । সেসব নিয়ে সিনেমাও হয়েছে । যাক, বিপ্লব ফেল মারলেই বা, পদ্য আর সিনেমা তো পাওয়া গেছে ।
         রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড আমার মালিকের,  যিনি পয়লা আগস্ট ১৮৪৬ লণ্ডনের সেইন্ট জর্জ হোটেলে  একান্ন বছর বয়সে মারা গেলেন, আর ৫ আগস্ট তারিখে কেনসাল গ্রিন গোরস্তানে তাঁকে  এলেবেলে সমাধি দেয়া হলো ; হিন্দু, খ্রিস্টান ব্রাহ্ম কোনো রীতিই মানা হয়নি ।
          ওনার শব তো কলকাতায় পায়নি পরিবারের লোকেরা, তাই গঙ্গার ধারে একটা কুশপুতুল তৈরি করে ওনার নামে শ্রাদ্ধশ্রান্তি করেছে । তাও আবার হিন্দু বামুন আর অতিবামুন কাল্ট মিলে ঝগড়া বাধিয়ে ফেলেছিল, কোন মন্তর পড়া হবে, পিণ্ডদান করা হবে কি না, বড়ো  ছেলে ন্যাড়া হবে কিনা । ছেলেরা তো বাপকে কেয়ারই করেনি কখনও, ওনাদের কথা না বলাই ভালো ।
          সমাধি দেবার দু’মাস পরে কবর থেকে তুলে ওনার বুক থেকে হৃৎপিণ্ডখানা কেটে বের করে নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে অন্ত্যেষ্টি করতে চাইলেন আত্মীয়স্বজন ছেলেপুলেরা, তাই নিয়ে যাচ্ছি সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ।
         প্রথমবার আসার সময়ে রাজকুমার নিজের সঙ্গে  ইংরেজ ডাক্তার , ভাগনে , বাঙালি সহকারী , আমাকে নিয়ে তিনজন চাকর আর মুসলমান বাবুর্চি আসলাম মিয়াঁকে এনেছিলেন ।
         ডাক্তার বলেছিল যে রাজকুমারের স্বাস্হ্য ভালোই আছে, চিন্তার কারণ নেই । সেবারও রাজকুমার রোজই নানা হোটেলে খানাপিনার আয়োজন করতেন, কতো কতো বিলিতি সাহেব-মেমরা আসতো, রাজকুমার  অনেকের হাতে মুঠো-মুঠো হীরে-মুক্ত গুঁজে দিতেন ।
         মেমদের দেখেছি, হাঘরে, আদেখলাপনার শেষ নেই, তারা ওনাকে দেখনদারি দিয়ে ভালোবাসতো, ঢলাঢলি করতো, জড়িয়ে ধরে, হাত ধরে হোটেলের ঘরে টেনে নিয়ে যেতো । একজন মেম তো রোজই আসতো রাজকুমারের কাছে, পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরতো । নিশ্চই কোনো ইংরেজ  খোচর এই খবরগুলো সুতানুটি-গোবিন্দপুরে পৌঁছে দিয়েছে । বাঙালিরা তো কালাপানিতে জাত যাবার ভয়ে যায়না ।
         যাক, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি থেকে খোচর হবার শিল্পখানা বাঙালিরা শিগগিরই আয়ত্ত করে ফেললে ।
         রাজকুমার যেদিন মারা গেলেন,  সেদিন এমন ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল যা আমি বিলেতে কেন, সুতানুটি-গোবিন্দপুরেও আগে কখনও দেখিনি ; আবদুল করিম, রানি ভিক্টোরিয়ার মুনশি, উনিও বলছিলেন যে ব্রিটেনে এসে পর্যন্ত এমন ঝড়বৃষ্টি দেখেননি ।
         মুনশি আবদুল করিমের সঙ্গে আমার ভালো আলাপ-পরিচয় হয়ে গিয়েছিল, মুনশিজি যেচে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সেই যেদিন রাজকুমারকে রাতের ভোজে ডেকেছিলেন রানি, তারিখটা মনে আছে, আট জুলাই, সে রাতেও প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল, রানির মতন করে রাজকুমারও কাঁটা-চামচ-ছুরি দিয়ে মাংস কেটে-কেটে খেয়েছিলেন, ছাগলের মাংস নয়, অন্য কিছুর, বেশ ভালো গন্ধ বেরিয়েছিল । তার আগে রানির সঙ্গে একদিন রাজকুমার  বিলেতের রাজা-রানিদের সেনাবাহিনীর সেলাম নিয়েছিলেন, ওদের পোশাক কেমন যেন বিটকেল, চোখ পর্যন্ত গোল টুপিতে ঢাকা, দেখতে পায় কেমন করে ভাবছিলুম ।
         রানির পছন্দ হয়েছিল রাজকুমারকে, নিজের ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন, ‘ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকটি বেশ ভালো ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চমৎকার মানুষ।’
         রানির মুনশিও বিশ্বাস করতে চায়নি যে আমি এর আগেও জন্মেছি, বলতো কাফেররা এরকম বিশ্বাস করে, তোরা মুরতাদ, তোরা মালাউন, তোরা জিম্মি, কাফেরদের তো জন্নতে যাবার নেই, আর কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করারও বালাই নেই। রানি ভিক্টোরিয়ার জন্যে দুজন চাকর এদেশ থেকে গিয়েছিল, অন্যজনের নাম মোহম্মদ বক্স, তার সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি, রানির খাস-আর্দালি বলে তার পোঁদে খুব তেল ছিল । আবদুল করিমের তো কোমরে তরোয়াল ঝুলতো, বুকে রানির দেয়া মেডেল ঝুলতো, মোহম্মদ বক্স অমন তোল্লাই পায়নি, তাই হয়তো খিটখিটে মেজাজের  হয়ে গিয়েছিল ।
        আবদুল করিম একটা গোপন খবর দিয়েছিল । রানি আর রাজবাড়ির সবাই নাকি জল দিয়ে ছোঁচায় না, পাতলা কাগজে পুঁছে নেয় । আবদুল করিম তাই রানির কাজ সেরে নিজের ঘরের চান করার ঘরে গরম জলে চান করে শুদ্ধ হয়ে নিতো, নইলে নামাজ পড়বে কেমন করে । শুদ্ধ হবার জন্যে পাশপকেটে ঢিলা কুলুপ রাখতো।
         চাকরদের মুখ উঁচু করে তোলা অনুচিত, সব সময়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তবুও আমি রানিকে দেখেছিলুম, দেখতে ভালো নয়, বড্ডো মোটা, জানি না মুনশির কেন পছন্দ হয়েছিল, হয়তো রানি বলে, হয়তো শাদা চামড়া বলে, সোনাদানা পেতো বলে ।
         যদিও রানির পরিবারের সবাই বলাবলি করতো যে মুনশির সঙ্গে ৬৮ বছরের রাণির একটা গোলমেলে সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে, নয়তো একজন আরেকজনকে অতো চিঠি লেখালিখি করবেই বা কেন, বালটিমোর, বাকিংহাম, বালমোরাল প্রাসাদের সোনালি গলিঘুঁজিতে রানির সাতহাতি ঘাঘরার কাপড় ধরে পেছন পেছন হাঁটবে কেন, মাঝরাত পর্যন্ত রানির ঘরে থাকবে কেন !
         মুনশি আমায় বলেছিল যে রানিকে উর্দু হিন্দি আর ফারসিতে সড়গড় করে তোলার জন্যেই ও চিঠি লিখতো আর রানিও ওকে চিঠি লিখতেন । সেসব চিঠিপত্তর অবশ্য রানি মারা যেতেই রানির পরিবারের লোকেরা হাপিশ করে দিয়েছে । রানিকে পাঠানো একটা চিঠিতে মুনশি করিম যে দু লাইন কবিতা লিখেছিল, তা আমার এই জন্মেও মনে আছে, ও পড়ে শুনিয়েছিল আমায়,

                 মোহব্বত মেঁ নহিঁ হ্যায় ফর্ক জিনে অওর মরনে কা
                 উসি কো দেখ কর জিতে হ্যাঁয় জিস কাফির পে দম নিকলে

         তবে মুনশি আবদুল করিমের যে কেন গনোরিয়া হয়েছিল তা আমি জানি, রানির নিজের ডাক্তারই করিমের রোগ ধরে ফেলেছিল । রানি কেন জানতে চেয়েছিলেন করিমের যৌনরোগ আছে কিনা ! আসলে রাজারাজড়াদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা । রানির তো আর গনোরিয়া হতে পারে না, হলে পুরো বিলেতি সাম্রাজ্যে ঢি-ঢি পড়ে যেতো ।
          বেচারা আবদুল করিম চব্বিশ বছর বয়সে ব্রিটেনে এসেছিল, ওর কি সাধ-আহ্লাদ হয়নি লণ্ডনের মেমদের সঙ্গে শোবার, দেশে ফিরে গেলে সেই তো বাদামি চামড়ার বউ বা আগ্রার কালো-বাদামি চামড়াউলিদের কোঠা । আবদুল করিমের সঙ্গে আমি লিডসের হলবেক শহরতলিতে গিয়েছি, ওটাই তখন মেমদের রমরমে বউবাজার  ছিল, পরে তো সোহো হয়ে উঠল বউবাজার, বউবাজার মানে বউদের বাজার নয়, মেমদের বাজার, যাকে এক রাতের জন্যে কিংবা কিছুক্ষণের জন্যে বউ করে নিয়ে ভালোবাসাবাসি করা যায়, আমাদের সুতানুটি-গোবিন্দপুরেও আছে, আমার এতোগুলো জন্মের আগে-পরেও আছে ।
         রানির সঙ্গে ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় যখন আবদুল করিম যেতো তখন এক ফাঁকে শহর দেখার নাম করে সেখানের মেমদের বউবাজারেও ঢুঁ মারতো, আমার সঙ্গে সেসব গল্প করতো, আমি ছাড়া তো দেশের আর কোনো মানুষ ছিল না যার সঙ্গে নিজের লুকোনো  ব্যাপারগুলো ভাগ করে নেয়া যায় ।
         দশ বছর বিলেতে ছিল আবদুল করিম, নিজের লুকোনো জীবনের ঘটনাগুলো একটা ডায়রিতে লিখে রাখতো । আবদুল যখন দেশে ফেরার জন্য তৈরি তখন ওর বাক্স-প্যাঁটরা ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল  রানির পরিবারের লোকেরা, ডায়রিটা পাবার জন্যে, কিন্তু আবদুল করিম তো মহা চালাক, আগেই ডায়রিখানা এক আত্মীয়ের হাতে আগ্রায় পাচার করে দিয়েছিল ।
         যখন পাকিস্তান হলো তখন ওর ভাইপোরা সেই ডায়রিখানাকে বাঁচাবার জন্য লুকিয়ে পাকিস্তানে চলে গিসলো কেননা ভাইপোদের সন্দেহ ছিল যে জওহারলাল নেহেরু মাউন্টব্যাটেনের বউয়ের চাপে পড়ে ডায়রিখানা খুঁজে বের করবে আর নষ্ট করে ফেলবে, হয়তো জেলেই পুরে দেবে আবদুল করিমের আত্মীয়দের ; ওই ডায়রি বাঁচাবার জন্যেই ওদের পাকিস্তানে যেতে হয়েছিল নয়তো যেতো না, সেখানে গিয়ে ওরা মোহাজির নামে অনেককাল বদনাম ছিল, সে তো দাউদ ইব্রাহিম নামে এক মোহাজির পাকিস্তানে যাবার পর ওরা করাচিতে এখন শান্তিতে আছে ।
         দেখি পরের জন্মে যদি মোহাজির হয়ে পাকিস্তানে জন্মাতে পারি, ওদের বউগুলো অপরূপ সুন্দরী হয় আর উপরি পাওনা হলো যে চারটে করে অমন কচি সুন্দরীকে বিয়ে করা যায় ।
         বলেছি তো, আবদুল করিম বিশ্বাস করতো না যে আমি এর আগেও জন্মেছি । ওদের ধর্মে নাকি বার বার জন্মানো বারণ । যাক আমার তো অমন ধর্মের বালাই নেই, তাই জন্মাতে পেরেছি, মনেও রাখতে পেরেছি আগের জন্মের কথা । রাজকুমারও  বিশ্বাস করতেন না যে আমি এর আগেও জন্মেছি, আর আগের জন্মের বেশ কিছু ঘটনা আমার মনে আছে । এই যেমন জব চার্নকের হিন্দু বউয়ের কবরের ওপর যে মুর্গিটাকে বলি দেয়া হয়েছিল, সেটা তো আমিই গাঁ থেকে এনে দিয়েছিলুম । সিরাউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেছিল, তখন দুদলের সেনারাই ভাবলে আমি অন্য দলের, বর্শায় গিঁথে মেরে ফেললে, বর্শার ডগায় আমার মুণ্ডুটা রাস্তায় পোঁতা ছিল, সুন্দরবন থেকে একটা বাঘ এসে ধড় আর মুণ্ডু দুটোই চিবিয়ে-চিবিয়ে আয়েস করে খেয়ে নিলে , চিবোবার আওয়াজ এখনও আমার কানের খোলে রয়ে গেছে।
         বাঘের পেটে দু’রাত এক দিন আমার মুণ্ডুটা ভালোই ছিল, তবে বাঘের পেটের ভেতরটা বড্ডো গরম।