পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৩০ জুন, ২০১৮

শর্মিষ্ঠা দত্ত


অভিযোজন (৪)

রাত প্রায় সাড়ে নটা ...বাচ্চাদুটোকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন ভারতী ।এ বাড়িতে আসার পর থেকেই বারান্দায় মেঝের ওপর বসে রয়েছে মল্লিকা ।দুপুরে আলুসেদ্ধ-ভাত রান্না করেছিলেন  ,বাচ্চাদুটোকে খাইয়ে বোনকেও চেষ্টা করেছিলেন খাওয়ানোর ...একটা দানাও দাঁতে কাটেনি সে।সকালে প্রসূন এসে ডাকতেই সব কাজ  ফেলে হুড়মুড় করে মল্লিকার শ্বশুরবাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন ভারতী।মাসিমাই বললেন ওদের নিয়ে আসতে । মল্লিকাকে প্রণবের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের হাতেই চোট লেগেছে তাঁর । মল্লিকাকে বললেন ,"বৌমা , তুমি দিদির লগে বাপের বাড়ি যাও গিয়া ... তোমারে  আর তোমার মাইয়াগো  আমি এইভাবে আর কয়দিন বাঁচামু কও ! প্রণব যে আমার পোলা হেইডা ভাবতেও আমার লজ্জা হয় ।"প্রসূনের সঙ্গেও একচোট হাতাহাতি হয়ে গেছে প্রণবের ।

এ বাড়িতে ওদের নিয়ে আসার পর বৌদি স্বভাবতই ক্ষুব্ধ ,কিন্তু এখনও বলেনি কিছুই ।একটু আগে দাদা ফিরেছে অফিস থেকে ...দরজা বন্ধ করে পরামর্শ চলছে এখন ।হয়ত একটু পরেই ঝড় আছড়ে পড়বে ।তবে ভারতী ঠিক করে নিয়েছেন কোনো জবাবদিহি করবেন না তিনি ।এ বাড়িতে মল্লিকারও তো ভাগ আছে ...সে তার মেয়েদের নিয়ে এখানে নিজের অধিকারেই থাকতে পারে ।শুধু একটা রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে ।মেয়েদুটোকে ঠিকমতো মানুষ করতে গেলে টাকার দরকার  ! দুই বোনে মিলে সেটা ঠিক জোগাড় করে ফেলবেন । বিয়ের পর থেকে এই চার বছর ধরে বোনটা তো কম কষ্ট পায়নি ! প্রণবকে ফেরানোর চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি কোনো ,হয়তো ওর আর একটু শক্ত হওয়া উচিত ছিল ।ভারতী , এমনকি প্রভাও অনেকবার বলেছেন একথা , কিন্তু প্রণব একবার ভালোমুখে কথা বললেই গলে জল হয়ে যায়  মল্লিকা ...এভাবেই নিজের ভুলের খেসারত দিয়ে চলেছে দিনের পর  দিন ।

ভারতী দু কাপ চা করে বারান্দায় এসে মল্লিকার মাথায় হাত রাখলেন ।"মলি , একটু চা মুখে দে এইবার ...সকাল থিক্যা  প্যাটে কিস্যু  পড়ে নাই  , এইবার পিত্তি পড়ব..."ভারতীর কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে চমকে তাকালো মল্লিকা ।ভারতী চায়ের কাপদুটো তার সামনে  নামিয়ে সদর দরজা খুলতে গেলেন ।ততক্ষণে দাদা বৌদিও বেরিয়ে এসেছে উঠোনে ।

দরজা খুলেই ভারতী দেখলেন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রসূন  আর উমা । "তোমরা এত রাইতে ?" 

ভারতীকে পাশ কাটিয়ে বারান্দায় উঠে আসে উমা ।" বৌদি ,তোমাকে একবার হাসপাতালে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে ।মেজদার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ।"

চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগের সামনে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে ইতিমধ্যেই ।মল্লিকা আর ওর দাদাকে  নিয়ে উমা আর প্রসূন যখন পৌঁছল ট্রলির ওপর সাদা চাদরে মোড়া প্রণবের শরীরটা তখন ঘন্টাতিনেকের পুরনো লাশ ।সনাক্তকরণের পর প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দীর ভিত্তিতে বডি পোস্টমর্টেমে পাঠাল পুলিশ ।চূড়ান্ত মত্ত অবস্থায় সন্ধ্যে ছটা নাগাদ নোনাপুকুর  ট্রামডিপোর সামনে হঠাত্ই বাসের সামনে চলে আসে প্রণব ।বাসের ধাক্কায় মাথার ঘিলু শুদ্ধ বেরিয়ে এসে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার ।রাস্তার লোকজনই পুলিশে খবর দেয় , পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে আসে ।আনআইডেন্টিফাইড বডি হিসেবে হয়ত  মর্গে চালান হয়ে যেত কিন্তু ওই হাসপাতালেরই  নার্সিং স্টাফ ওদের পাড়ার  আলোদির ডিউটি ছিল  ইমারজেন্সিতে ,সেই  চিনে ফেলে প্রণবকে ,তারপর বাড়িতে খবর পাঠায় ।

রাত বারোটা নাগাদ তাঁতীবাগানের বাড়িতে ফিরল ওরা।প্রমোদকে খবর দেওয়া হয়েছে কিন্তু  কাল সকালের আগে আসতে পারবে না সে ।  ভারতী এর মধ্যেই মেয়েদুটোকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন প্রভার কাছে ।মাসিমার বয়েস হয়েছে ,তাঁকে একা রাখা ঠিক নয় ।যদিও পাড়ার দু -চারজন মহিলা আছেন এখন ।প্রভার বুকের ভিতরটা আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গেলেও দুচোখে আষাঢ়ের মেঘ ।যে কোনো মুহূর্তে বানভাসি হয়ে যেতে পারে এই সংসার । অবশ্য ভেসে যাওয়ার আর বাকিটাই বা রয়েছে কি ! তবু বাঁধ হয়ে এখনও আগলে যেতে হবে তাঁকে ...যতদিন বাঁচবেন।যতই অমানুষ হোক ,তবু প্রণব তো তাঁর নিজেরই সন্তান ! মন মানতে চায় না ...তবু ! দায়িত্ব -কর্তব্যকে চিরকালই  ব্যক্তিগত শোক দুঃখের ওপরে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন তিনি ।এর মধ্যেও নাতনিদের ভবিষ্যৎ ,তাদের নিরাপত্তা এবং মল্লিকার জীবন নিয়েও  তাঁকে ভাবতে হবে বৈকি ! 

মল্লিকা কিন্তু বেশ  স্বাভাবিকভাবেই বাড়ি ফিরল ওদের সঙ্গে ।শাড়ি -ব্লাউজ ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ল মেয়েদের পাশে ।প্রভা এমনকি ভারতীও বেশ অবাক হলেন ওর আচরণে ।কয়েকঘণ্টা আগেও যে মেয়ে ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছের মত ভেঙে পড়েছিল ,প্রবল বন্যায় তলিয়ে না গিয়ে সে এমন তরতাজা হয়ে উঠছে  কিভাবে ! ওর মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো ? 

ওরা ফেরার পর পাড়ার মহিলারা বাড়ি ফিরে গেলেন ।উমা চা করে আনল ।"বৌদি ওঠো ...একটু চা খাও ..." চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে মল্লিকা হঠাত্ বলে উঠল , " আমাকে কি আজই শাঁখা ভেঙে ,সিঁদুর মুছতে হবে মা ?" প্রভার চোখের জল আর বাঁধ মানল না ,হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি ।ভারতী প্রভার মাথাটা বুকে টেনে নিলেন ।উমা মল্লিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল "আজ আর তোমায় কিচ্ছু করতে হবে না বৌদি । এবার একটু ঘুমাও তো !"

তক্তাপোষের ওপর মল্লিকা মেয়েদের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পরার পর উমা মাটিতে বিছানা পেতে  ভারতী আর প্রভাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল ।পাশে প্রণবের ঘরে প্রসূন । কাল সকালে প্রথমে  বড়দার সঙ্গে প্রসূন যাবে মর্গে , বডি রিলিজের পর শ্মশানে দাহকাজ শেষ করতে হবে ।আজ আর ঘুমোবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না ...চারজনের একই  ভাবনায় কেটে গেল একটা দীর্ঘ নির্ঘুম রাত ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন