সোনালী চিলের ডানা
------------------------------ ------
অফিস থেকে ফেরবার সময়, বাড়ির কাছে পার্ক টাতে একটু বসে যান , বিনয় বাবু। বাড়িতেও তো চাবি ঘুরিয়ে ঢুকতে হবে। রমা , নিশ্চয়ই বাড়িতে নেই। বুবাই কে নিয়ে টিউশনিতে গেছে। সেই তো একলা বাড়িতে ঢোকা, পরে ঢোকা আর আগে-- ফারাক কি?
রমা খুব সংসারী মহিলা। খুব গোছানো। সবচেয়ে বড় গুন, নিজের অবস্থান কে ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, বিনয় বাবুর। সাধারণ গ্রামের মেয়ে হয়ে, এত উচ্চাশা কি করে নিজের ভেতরে , লুকিয়ে রেখেছিল, বুঝে পান না তিনি।
বিয়ের পরে তো, বেশ সাধাসিধে, গোলগাল , মিষ্টি বউ হয়ে ঢুকলো, সোনারপুর এ বিনয়দের , যৌথ পরিবারে।
বিনোয়বাবুর বাবা রা তিন ভাই। তিনজনে একসঙ্গে থাকেন। খোলামেলা বেশ বড়ো বাড়ি। বাংলাদেশ থেকে, ছিন্নমূল হয়ে ,আসবার পরে, নিজেদের চেষ্টায় একটু একটু করে বাবা , কাকা রা দাঁড়িয়েছেন। সুন্দর করে বাড়ি করেছেন। ফলফুলের গাছ লাগিয়েছেন। সময় মতন, বাড়ির বড়ো ছেলে, বিনয়ের বিয়ে দিয়েছেন , গ্রামের মেয়ে রমার সঙ্গে।
রমার ছিল, আকাশ ছোঁয়া উচ্চাশা। বিনয় চাকরি করতো কলকাতায়। রোজ যাতায়াত করতো সোনারপুর থেকে। রমা বায়না করতে থাকলো, কলকাতা তে থাকবার জন্য। এর মধ্যে, বুবাই এসেছে তাদের জীবনে। রমার বক্তব্য, বুবাই কে , ভালো করে মানুষ করতে হবে। তাই, শহরে গিয়ে থাকতেই হবে। তার জিদ এবং কৌশলের কাছে মাথা নত করে, শহরের ঘুপচি ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। বুকের ওপরে, একমন ওজনের দুঃখের পাথর বয়ে নিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করলেন বিনয় বাবু।
কর্মী মেয়ে রমা , খুব তাড়তাড়ি, শহরের জীবনে , অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। বুবাই কে ভালো স্কুলে ভর্তি করা শুধু নয়,বুবাইয়ে র জীবনের মধ্যে নিজের জীবন কে একবারে ঢুকিয়ে নিলো। নিজের কোনো আলাদা অস্তিত রাখলো না। বিনোয়বাবুর ও চাকরিতে উন্নতি হয়েছে। এক হাত পা ছড়ানো ফ্লাট কেনা হলো। বাবা , মারা গেলেন। মা কে নিয়ে আসবার কথা বলতেই, রমা হাঁ হাঁ করে উঠলো---" কেন? মা তো ভালোই আছেন ওখানে। সবার সঙ্গে আছেন। এখানে মা এলে আমি কি করে দেখবো? বুবাইকে দেখে , আমার কি আর সময় আছে? "
*
ঠিক কথা। বিনোয়বাবু , অফিস ফেরত চাবি দিয়ে দরজা খোলেন, চা বানান। বারান্দাতে বসেন। মা র কথা ভাবেন। রমা , বুবাই কে নিয়ে অংক টিউশনিতে গেছে।
সারাদিন শুধু বুবাই বুবাই আর বুবাই। সারাদিন বুবাইয়ে র কানে মন্ত্র পড়া,--"কোনো ছেলে কে খাতা দেখবি না।"
" কাউকে বেশী পাত্তা দিবি না।"
এক ঘন্টা খেলবি। তার বেশী না."
ওর পায়ে ব্যাথা তো তোর কি? তুই ওকে পৌঁছে দিতে যাবি না।"
"ঠাকুমা কে দেখতে যেতে হবে না। তোকে ফার্স্ট হতে হবে বুবাই। সময় নষ্ট করলে চলবে না।
*
বিনয় বাবু অবাক হয়ে দেখেন, সেজেগুজে একটা স্বার্থপর রোবটের মতো স্কুল যাচ্ছে বুবাই। কঠিন মুখ। সেই চঞ্চল , বায়না করা ছেলে টা কোথায় হারিয়ে গেছে। তার বদলে , সে এখন কম কথা বলে। লড়াইয়ে র ময়দানের খেলোয়াড়ের মতো , তার মুখের পেশী গুলি শক্ত। কোনো দিকে দৃষ্টি নেই। শুধু ওকে ফার্স্ট হতে হবে , হতেই হবে। রাত বাড়তে থাকে। বুবাইয়ের ঘরের দরজার বন্ধ দরজার সামনে এসে স্তব্ধ হয়ে যায়, চাঁদ, তারা, শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত। মা- ছেলে দুজনের চোখে জ্বলে, শিকারীর হিংস্রতা।
*
অথচ, কি আশ্চর্য! এত দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের পরেও, প্রত্যেক বার পরীক্ষা তে প্রথম হয়, তারই প্রতিবেশী র ছেলে সুমিত। সে ছেলে, হাসতে হাসতে রেজাল্ট নিয়ে তাদের বাড়ি ঢোকে। বিনয় কে প্রনাম করে। " কাকিমা" বলে, রমাকে জড়িয়ে ধরে। রমার চোখ ধক ধক করে জ্বলে। সুমিত খেয়াল ও করে না। আপনমনে খোলা হওয়ার মতো,নিজের বাড়ি চলে যায়।
প্রত্যেক বছর একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হতে হতে, বুবাই ক্লাস টেন এ ওঠে।
*
রমা র মুখ দেখলে এখন ভয় করে, বিনয় বাবুর। সে মুখ মানুষের না এক ভয়ংকরী র? এক প্রেত সাধনা কারী ভৈরবী র মতো লাগে রমা কে। যন্ত্রে ফেলে লেবুকে চটকানোর মতো, নিংড়োতে থাকে বুবাই কে, রমা। বিনয় বাবু হাত জোড় করেন রমা র সামনে -" ছেলে টা কে কি মেরে ফেলবে তুমি? সেকেন্ড তো হচ্ছে প্রত্যেক বার। তবে?"
" কেন পারবে না ফার্স্ট হতে? কি আছে ঐ সুমিতের মধ্যে? ফার্স্ট হতেই হবে। নইলে ওকে ছাড়বো না!"
বিনয় বাবু আর পারেন না। এটা একটা সংসার? মূল্যবোধ নেই। ভালোবাসা নেই। আছে শুধু, লোভ আর আকাঙ্খা র তীব্র বিষ! খুব শরীর খারাপ লাগে তার। আগামী কাল, ক্লাস টেনের ফার্স্ট টার্মিনাল এর রেজাল্ট বেরোবে। আগামী কাল , সুমিত আবার ফার্স্ট হবে। আবার মা ছেলে, ভাত খাবে না। আবার বাড়ী থেকে,শ্মশানে র চিতার মরা পোড়ানো গন্ধ বেরোবে।
না, কাল ভোরে উঠেই , তিনি , সোনারপুর এ যাবেন। আর নিতে পারছেন না তিনি।
পরদিন ভোরের ট্রেনে, সোনারপুর চলে গেলেন , বিনয় বাবু। রমা শুধু একবার চোখ তুলে তাকালেন। বুবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। একবুক কষ্ট নিয়ে , ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। আহারে! কি মায়াময়, ঘুমন্ত বুবাই। এক সুকুমার কিশোর, পরম শান্তিতে, বালিশ আঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে। একবার ভাবলেন, রমা কে কি হাতেপায়ে ধরবেন? বলবেন কি, ছেড়ে দাও ছেলেটা কে রমা। নষ্ট করো না ওর কৈশোর টা কে!
নিঃশাস ফেলে জুতো তে পা ঢোকালেন ,বললেন," রমা, বুবাই যখন স্কুলে যাবে, যদি পারো , ইলেকট্রিসিটি বিল টা বিল টা দিয়ে এস। আজ লাস্ট ডেট। " রমা ,কলের পুতুলের মতন মাথা নাড়ে। নিঃশাস ফেলে, সোনারপুর চলে গেলেন বিনয় বাবু।
*
সেদিন রাতেই ফোন এলো রমার। উনি যেন এখুনি কলকাতায় চলে আসেন। একবুক আশংকা নিয়ে পাখীর মতো উড়ে , বাড়ি চলে এলেন বিনয় বাবু।
এসে যা দেখলেন, যা শুনলেন, তাতে মাথা ঘুরে গেল তার। বুবাই খুন করেছে সুমিত কে! আকাশ যদি ভেঙে পড়তো মাটিতে, পৃথিবী তলিয়ে যেত অতলে, বিনয় বাবু, এত ভেঙে পড়তেন না। কিন্তু এ কি? এ কি করে সম্ভব?
রেজাল্ট বেরোনোর পরে, দেখা গেল, সুমিত যথারীতি ফার্স্ট হয়েছে। বুবাই সেকেন্ড। ছুটির পরে, বুবাই , সুমিত কে,ডেকে নিয়ে আসে ওর বাড়িতে। রমা ছিল না। ফাঁকা বাড়িতে, সুমিত কে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে, ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে, কম্পাস দিয়ে খুঁচিয়ে , খুঁচিয়ে মেরেছে বুবাই। মনের গোপন কোনের সমস্ত হতাশা, রাগ, ঘৃণা সব দিয়ে মেরে ফেলেছে নিরীহ ছেলেটিকে।
রমা হতবাক হয়ে বসে আছে। বুবাই ও তাই। সুমিতের মৃতদেহ ,সেপটিক ট্যাংক এ ফেলে দিয়েছে মা ছেলে মিলে।
*
বিনয় বাবু ভাবলেন। অনেক ভাবলেন। তারপরে উঠে পুলিশ কে ফোন টা করলেন।
বুবাই একটা কথা ও বলে নি। যে ছেলে ছিল , মায়ের হাতের যন্ত্র পুতুল, সে মার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। পুলিশ আসার পরে ছেলেকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন বিনয় বাবু।
খুব শান্ত স্বরে বুবাই বললো," ঠিক করেছ ফোন টা করে বাবা। তবে তুমি ও যদি মায়ের হাতের পুতুল না হতে, আমাকে এই ভাবে জেলে যেতে হতো না। সুমিত কেও মরতে হতো না। আসি বাবা।"
,----------------------------- ------------------------------ --------
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন