কুসুমকথা
………………
যুগান্তর মিত্র
"কীরে, আমাকে ভুলেই গেলি ?” জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল কুসুম।
বাবার বদলির চাকরি। মালতিপুর বিদ্যামন্দিরে ক্লাশ ফাইভে ভর্তি হলাম। সেই স্কুলে আমার প্রথম বন্ধু কুসুম। একসঙ্গে স্কুলে যাতায়াত করি। একদিন মা বলল, "তোদের দুটিতে বড্ড মিল। বড়ো হলে তোদের বিয়ে দিয়ে দেবো।" আমি সেকথা কুসুমকে বললাম। খুব খুশি হয়েছিল।
সেভেনে থাকতেই বাবার আবার ট্রান্সফার। এখন আমরা থাকি উত্তরবঙ্গে। জলপাইগুড়ির ছায়াঘেরা ছোট্ট জায়গায় আমাদের ভাড়াবাড়ি। কলেজের ছুটি চলছে; দুপুরে জানালার পাশে বসে আকাশ দেখছিলাম। হঠাৎ দেখলাম কুসুম জানালা দিয়ে আমাকে ইশারায় ডাকল। সম্মোহিতের মতো বেরিয়ে গেলাম। দূরের বাগানে আমাকে টেনে নিয়ে গেল কুসুম। সেই একইরকম মুখ। বয়স যেন থমকে আছে।
"না রে কুসুম। তোকে আমি ভুলিনি।"
আমি জানি এর থেকে বড়ো মিথ্যে আর নেই। কুসুমকে প্রথমদিকে খুবই মনে পড়ত। তারপর ধীরে ধীরে ভুলেই গিয়েছিলাম একসময়।
কুসুম আমার দিকে দৃষ্টি পেতে বলল, "বিয়ে করবি না আমাকে ?" ঘোরের মধ্যেই বললাম, "হ্যাঁ হ্যাঁ করব কুসুম।"
"তাহলে এখনই বিয়ে কর আমাকে।"
হাতের মুঠো খুলে সিঁদুর দেখাল। আমি মন্ত্রচালিতের মতো সিঁদুর পরিয়ে দিলাম কুসুমের সিঁথিতে। ও খুব জোরে হেসে উঠল। তারপর সেই সিঁদুর হাতের তালু দিয়ে মুছে শিরিষ গাছের গায়ে লাগিয়ে বলল, "পাগল একটা ! কেউ যদি দেখে ফেলে কী বলবে ?"
হাসতে হাসতে কুসুম গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছোটাছুটি করছে। আমিও পিছু নিলাম। অনেকক্ষণ এভাবে ছুটতে ছুটতে কুসুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম আমাদের বাড়িতে চলে যায়নি তো ?
ঘরে ফিরে মার কাছে শুনলাম, ভূষণকাকু বাবার অফিসে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, দিন পনেরো আগে কুসুম জলে ডুবে…। বাজ-পড়া গাছের মতো আমি দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।
আমি সেদিন কুসুমকে সত্যিই বিয়ে করেছিলাম। সেই সিঁদুর, শিরিষ গাছে মুছে ফেলা, সব সত্যি। বিশ্বাস না-হলে দেখে নিও সেই দাগ এখনও আছে। এত ঝড়জলেও এতটুকু মোছেনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন