পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

ঋষেণ ভট্টাচার্য্য



নারী



যে সমস্ত মহিলাগণ নিম্নবর্ণিত নিবন্ধটি পড়িবার উপক্রম করিতেছেন, অনুগ্রহ করিয়া পাঠপূর্বে সর্বপ্রথম ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রণাম জানাইবেন।
ইহার কারণ সেই ব্যক্তিটি না জন্মাইলে আজও আপনাদিগের সম্মুখে অকাল বৈধব্যে দুইটি পথই উন্মুক্ত হইতো, হয় সহমরণ অথবা দেবদাসী হিসাবে সমাজে দেহদান। সদ্যজাত শিশু-কন্যার নগ্ন পশ্চাৎদেশ দর্শনে পিতা নরকগামী হইয়া থাকেন - উক্ত যুগে এমত ন্যক্কারজনক ধারণাও বহুল প্রচলিত আখ্যা পাইতো।
অদ্যাপি আপনাদের পরমতম হিতৈষীগণ ভাবিতেন, স্ত্রী-জাতির বিদ্যাভাসই তরান্বিত বৈধব্যের হেতু। 
অবশ্য কেবল নারীই নহেন, তিনি পুরুষদিগেরও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। প্রকৃত অর্থেই তিনি নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের প্রণম্য।

এ হেন মহামানব, যিনি তাঁহার সমগ্র জীবন অতিবাহিত করিলেন বঙ্গীয় তথা, ভারতীয় নারীমুক্তি এবং উহাদিগের যন্ত্রণামোচনে, যিনি প্রভুত অর্থোপার্জন এবং তাহার সিংহভাগ নির্দ্বিধায় উক্ত প্রয়োজনে ব্যয় করিয়াও শেষ জীবনে সমস্ত ভুলিয়া সাঁওতালপল্লীতে আদিবাসীদিগের সহিত শাকসব্জি চাষাবাদে দিনপাত করিয়াছিলেন।
তাঁর ন্যায় মহাপুরুষের এরূপ সিদ্ধান্তের কারণ তিনি শেষ জীবনে তাঁহার সমগ্র জীবন ও কর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও তিতিবিরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন।  আশ্চর্য লাগিলেও ইহাই সত্য বীতশ্রদ্ধার কারণ সেই নারীজাতি! ইহা সত্যই অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক, যে নারীজাতির প্রতি তিনি তাঁর শেষ রক্তবিন্দু ব্যয় করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তিনিই শেষ জীবনে তাঁহাদের প্রতি চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্থ হইয়া সমাজ ত্যাগ করেন।

সমাজত্যাগ কালে অত্যন্ত ক্ষোভের সহিত তিনি জানাই দেন, তাঁহার জীবনের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ভ্রান্তি নারীজাতির সেবা ও উহাদের উন্নতিসাধনের প্রচেষ্টা। কারণ, তাঁহার মতে যিনি নিজ অবস্থান সম্পর্কে সম্যক সচেতন নহেন, যিনি সর্বদা অদৃষ্ট এবং তাঁহাদিগের চালিকাশক্তির বশবর্তী থাকিয়া কেবল ভিক্ষাপ্রার্থণা করিয়া দিনযাপনকেই আপন নিয়তি হিসাবে মানিয়া লইতে অভ্যস্ত, যিনি কদাপি আপনাকে পুরুষের সমকক্ষ মানিয়ে লইয়া আপন দাবী প্রতিষ্ঠা করিতে অপারগ এবং যিনি সর্বক্ষণ কাহারো ছত্রছায়ায় থাকিয়া নিকৃষ্টতর জীবনযাপনেও সাচ্ছন্দ বোধ করিয়া থাকেন, তিনি আর যাহাই করিয়া থাকুন না কেন, তাঁহার জীবদ্দশায় দুঃখ মোচন সম্ভবপর নহে।
নিজ চেতনা এবং বিবেক জাগ্রত না হইলে যেরূপ নিজ উন্নতিসাধন সম্ভব নহে, তদ্রুপ বাহির হইতে যতই বলপ্রয়োগ করা হউক না কেন উহাদের অবস্থান অনড়ই রহিবে।

এহেন মহাপুরুষের মৃত্যুর বহু বৎসর অতিবাহিত হইবার পর, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের বহু পরে, বর্তমান যুগে কতিপয় রাজ্য ব্যতিত প্রায় সমগ্র দেশ ভ্রমণ করিয়া যুগপৎ বিস্মিত ও ব্যথিত হইয়া আমি লক্ষ্য করিয়াছি, শহর গ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, কেবলমাত্র আর্থিকভাবে অনগ্রসর, দরিদ্র এবং দারিদ্রের সর্বশেষ সীমায় অবস্থানকারী এবং পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী ব্যতিত আমাদিগের দেশের নারীর অবস্থার সামান্য বাহ্যিক পরিবর্তন হইলেও, অন্তরের প্রকৃত অবস্থানের বিন্দুমাত্র উন্নতিসাধন ঘটে নাই। 

আর্থিক অনগ্রসর ও নিম্ন এবং নিম্নতর ও তম আয়ভুক্ত পরিবারের নারী এবং পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা প্রকৃত অর্থেই বর্তমানে আর্থিক শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বাধীন হইয়া, পুরুষের মুখাপেক্ষি না থাকিয়া, সংসার তথা তাহাদের সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ লইয়া চালিকাশক্তি হিসাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজমত প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইয়াছেন। ইহা ভিন্ন দেশের প্রতিটি শ্রেণীতে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন নারীর আভ্যন্তরীণ অবস্থান একটি অঙ্গুলিপ্রমাণ অগ্রসর হইয়াছে কিনা ইহা তর্কসাপেক্ষ।
বর্তমান যুগেও স্বোপার্জিতা নারীর উপার্জনহীন অথবা তুলনামূলক নিম্নোপার্জিত পুরুষের সহিত বিবাহ কেবল ব্যতিক্রম হিসাবেই পরিগণিত হইয়া থাকে।

ইহা সত্যই লজ্জার বিষয়, অদ্যাবদি নারীজাতি উহার দাবী অর্জন অপেক্ষা শারীরিক গঠন ও সামাজিক সুরক্ষা এবং সংস্কারের দোহাই পাড়িয়া পুরুষের নিকট দাবী ভিক্ষা ও আশ্রয়দান শ্রেয় মনে করিয়া থাকেন।

নারী বিষয়ক প্রবন্ধ রচনাকালে কেবল দুইটি কথা মনে আসিয়াছিলো।
প্রথম হইলো ইহাই যে, উক্ত মহাপুরুষটির মহানির্বাণের পর উঁহার আত্মা পঞ্চভূতে বিলিন হইবার শত বৎসর অতিক্রান্ত হইবার পরও সহস্র কোটি প্রবন্ধ রচনা করিবার পরেও আমাদিগের দেশের বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় বসবাসকারী নারীগণের প্রকৃত আভন্তরিণ মুক্তি ও অগ্রগতি কতকটা হইয়াছে? যাহা হইয়াছে, তাহাও কী পর্যাপ্ত? আমাদিগের সমাজে নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী প্রগতি ইহা কী আদৌ আলোচনার স্তরে পৌঁছোইবার যোগ্য?
দ্বিতীয়ত, অপর যে কথাটি মাথায় আসিয়াছিলো, বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, শিক্ষা, নারী তোষণ, ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে কেবল একজন নারীর মুখই মনে পড়িয়া যায়। যে গ্রাম্য নারী আজ হইতে শতবর্ষ পূর্বে সম্পূর্ণ নিরক্ষর হইয়াও, মানসিকভাবে এমত উন্নত মনস্ক ও আধুনিকা ছিলেন, যিনি, এক বিদেশিনী মহিলাকে নিঃশংকোচে এবং নির্দ্বিধায় তাঁহার হস্ত চুম্বনে সম্মতি দান করিতেন।

দারিদ্র অশিক্ষা কুশিক্ষা এবং অন্তরসারশূন্য জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ ও প্রয়োগবিহীন পুঁথিগত শিক্ষা দীর্ণ ভারতবর্ষে আমার চোখে তিনিই আদর্শ নারী, নারী সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায় যে মহিয়সী মহিলার নাম স্বীকার না করিলে, যিনি সেযুগেও বিজাতীয় স্পর্শশুচিতাকে জয় করিয়াছিলেন, সেই সারদামণি দেবী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন