পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

দেবযানী গুপ্ত

 ভৈরবী
               ***********
               

পাহাড়ের কোলে ছবির মতো গঞ্জ । বেশীরভাগই আদিবাসী পরিবার । তারই মাঝে বাংলো বাড়ী কযেকটা forest officer দের । শাল - মহুয়া - পলাশ - হরিতকি ঘেরা জংলা বাগান । গাছ - পাহাড় ঘেরা সবুজ প্রকৃতিতে লতা গুল্মের মতোই বেড়ে উঠেছে আর এক প্রকৃতি ঋদ্ধি । 
     এখানের মানুষজন - প্রাণী - পাখী , সবই তার খুব প্রিয় । ওর বাবা forest officer আর মা , একদম 'মা', তাঁর আর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন নেই । 
     পাখ- পাখালির ডাকের সাথে ঋদ্ধির গলার মিষ্টি ভৈরবী আলাপে এখানের মানুষজনের ঘুম ভাঙে । সারাদিন চঞ্চল ঝর্নার মতো কলকল করলেও সুরের সাথে একাত্ম হয়ে তানপুরা হাতে রেওয়াজে বসলে , ওকে মা সরস্বতীর মতোই লাগে । স্থানীয় লোকেরা অবশ্য তাই বলেই ওকে ডাকে । 
     আজও ভোর এলো । রেওয়াজে বসেছে ঋদ্ধি ;কিন্তু বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে । এতো অনুশীলনের পরেও  'কোমল গা ' কেন ঠিকমতো ছুঁতে পারছেনা ! মনটা ওর বিক্ষিপ্ত  হয়ে ওঠে । একটা মুখ মনের পর্দায় ভেসে উঠলেই সুর মূর্ছনায় গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে । এতো বছরের সাধনায় , একটা অচেনা মুখ এভাবে বাগড়া দিচ্ছে ! সহ্য করতে না পেরে হুহু করে কেঁদে উঠলো তানপুরা রেখে ! 
        মাথায় নরম হাতের ছোঁয়া --মা ! কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন ও লক্ষ্য করেনি এবারে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়ে কান্না আরো জোরালো হলো । মা কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলেন না । ওকে শান্ত হতে সময় দিলেন । তারপর উঠিয়ে , খাইয়ে বললেন , ' বাইরে কত আলো মেঘের খেলা , সবুজ প্রকৃতি , পাখীর হইচই ;আর তুই কাঁদছিস ? যা ঝর্নার ধারে ঘুরে আয় , ভালো লাগবে । আমি যাই , অনেক কাজ পড়ে আছে । ' 
     ঋদ্ধি নিজের ছন্দে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেলো । ঝর্ণাটা ওদের বাড়ীর পেছনেই । বাগানের সীমানা শেষেই ঝরঝর কলকল করে বয়ে চলেছে । ওর খুব প্রিয় বন্ধু , কতকথা হয় দুজনে!  আদর করে ঋদ্ধি ঝর্নার নাম দিয়েছে ' ঝিলমিল ' । কিন্তু মা কে তো বলতে পারছে না , ওখানে তৃতীয় কেউ এসেছে । 
      ঋজু ! শহর থেকে আসা smart ঝকঝকে ছেলে , হাতে  গীটার । যখন হাসে ওর চোখদুটো বুজে যায় আর কোঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে গান গায় । এক পলকেই ভালবাসতে ইচ্ছে হয়  এবং তাইই হয়েছে ! ঋদ্ধির মনের ফাঁকা শ্লেটে প্রথম আঁচড়টা ঋজু দিয়ে বসে আছে ! 
   আজও দেখা হতেই হাসলো,  ঋদ্ধিও । তবে , জল তেষ্টাতে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ । কথা বলতেই পারছেনা । দু - একবার চেষ্টা করে পালিয়ে গেলো । ঋজু অবাক চোখে ওর চলে যাওয়া দেখে , গীটারে মন দিলো । ওর ও ঋদ্ধিকে ভালো লাগে । তবে , প্রানাযাম ওকে শান্ত হতে শিখিয়েছে । তাছাড়া ও অনেকটা বড়োও । .
    সন্ধ্যেবেলায় , অফিস থেকে ফিরে , বাবা জানালেন , পাশের ফাঁকা বাংলোতে নতুন লোক এসে গেছে , ওদের তিনি dinner এ নেমন্তন্ন করেছেন । এখানে এরকমই রীতি । নতুন কেউ বদলি হয়ে এলে পাশপাশি সবাই তাদের আপ্যায়ন করে , আলাপ - পরিচয় বাড়াতে  । এরকম চলতেই থাকে , তাই ঋদ্ধির বিশেষ আগ্রহ নেই । ও পড়তে চলে গেলো , নিজের ঘরে । সামনে H.S.আর সাথে Entrace গুলোও আছে , তাইই ...। 
     রাতের খাবার সময় মা ডাকলেন । আলাপ করতে এসে ওর heart beat বেড়ে গেলো অনেকটাই । সবার সঙ্গে বসে , ওই চোখ বুজে হাসা ছেলেটা , ঋজু ! 
    রাত্রে অনেকক্ষণ অবধি ঘুম এলো না । তবে , পরদিন ভোরবেলায় যথারীতি রেওয়াজে বসলো । আজ  আরো বেশী করে সুর সুরে থাকছে না , ক্রমশ ওর আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে যেন ! 
    আজ আর মা সামনে এলেন না , ঋদ্ধি নিজেই নিজেকে সামলে পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলো । এ কি হচ্ছে ! টেবিলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন চোখ লেগে গেছে ! এমন সময় কানে এলো , কেউ ওর গাইতে  না পারা সুর গুলো খু্বই দক্ষতার সঙ্গে গেয়ে চলেছে ! 
     প্রথমে মনে হলো স্বপ্ন !  পরে বুঝলো , নাহ , সত্যিই । পায়ে পায়ে নিজের রেওয়াজের ঘরের দিকে এগোলো । বেশ কযেক পা দূর থেকেই বেশ মিষ্টি একটা গন্ধ পেল ধুপ আর ফুলের । পৌঁছল যেন একটা ঘোরের মধ্যে ! সামনে মা ! 
         চোখ বুজে একাত্ম হয়ে গেয়ে চলেছেন , 'বাট চলত গোরি , /চুনারি রং ডোরি।  ' আর,  দু চোখে ধারা বইছে । বাহ্যজ্ঞান শূণ্য,  মনে হচ্ছে মাকে । এই মাকে ঋদ্ধি চেনেনা , দেখেনি কখনো ! ওর মনে হলো সামনে ' বেদমাতা গায়ত্রী'  !  চুপ করে দাঁড়িয়ে মায়ের আরাধনা  শুনতে লাগলো । এক সময় মায়ের   গান  শেষ হলো । তানপুরা  রেখে , সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই ঋদ্ধি মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল । শান্ত হবার পর, মা কেবল হেসে একটি প্রশ্ন করলেন , ' ঋজু কে ভালোবেসে ফেলেছিস তো ? ' ...বাইরে তখন ভোর , ঝকঝকে একটা সোনাঝরা দিনের রূপ নিয়েছে । দূরে  কোথায় একটা পাপিয়া ডেকে উঠলো অসময়ে ....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন