টিফিন বাক্স
“ মাথাটা সোজা করনা!”
দাঁতে রাবার ব্যান্ডটা চেপে বড় মেয়ে রুমির চুলে একটা ঝটকা দিলো শর্মিষ্ঠা।
“ আআআহ......মাআআআ!”
ককিয়ে উঠলো মেয়ে।
এটা এ বাড়ীর রোজকার
দৃশ্য। এখন সকাল সাড়ে নটা বাজে আর পনেরো মিনিটের মধ্যে স্কুল বাস এসে যাবে। ছোট মেয়ে সুমি অবশ্য রোজই সকাল সাড়ে আটটা থেকে
তৈরি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বড় মেয়ে রুমি বই মুখে করে বসে অপেক্ষা
করে মা কখন এসে তার চুল বেঁধে দেবে। আর চুলও বটে, একেবারে কাঁথার মত, চিরুনি ঢুকতে
চায় না। আর স্কুলের নিয়ম দুই বিনুনি বাঁধতে হবে। যার ফলস্বরূপ সক্কাল সক্কাল
শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ লেগে যায় বাড়ীতে।
তুখোড় খেলোয়াড়ের মত
শর্মিষ্ঠা ওই সময়ের মধ্যেই দুই মেয়েকে ব্যাগ, জামা, জুতো, টিফিন সমেত পৌঁছে দিল
বিল্ডিঙের গেটে, যেখানে ওদের স্কুল বাস এসে দাঁড়ায়। মেয়েদের স্কুল
বাসে তুলে দিয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে রোজকার মত শর্মিষ্ঠা নিজের
ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হল। আজই শেষ স্কুল, কাল থেকে গরমের ছুটি শুরু। কাল থেকে
সকালটা একটু শান্তিতে কাটবে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল শর্মিষ্ঠা। এমন সময়
বিল্ডিঙের গার্ড এসে একটা চিঠি দিয়ে গেলো ওর হাতে। চিঠির ওপরের ঠিকানার হাতের
লেখাটা দেখে শর্মিষ্ঠার মুখে একটা হাল্কা হাসি খেলে গেলো। বড় মাসীমার চিঠি। বাড়ীতে
ঢুকে চিঠির খামটা ধরিয়ে দিলো স্বামী অরিত্রর হাতে।
“কার চিঠি?”
“বড় মাসীমার।” বলল
শর্মিষ্ঠা।
চিঠিটা খুলে পড়ে ফেলল
অরিত্র, “শুনছো? মাসীমা লিখেছেন উনি একুশ তারিখে আসছেন। আবার দিন পনেরো
থাকবেনও লিখেছেন।”
“সেতো ভালো কথা।” বলেই
শর্মিষ্ঠা কি একটা ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, “হ্যাঁ গো, দিন পনেরো
মানে তো ওমাসের ছ-সাত তারিখ অবধি। তাহলে? আমাদের পুরী যাওয়া তো ...”
“হুম, ও মাসের তিন
তারিখে, সেটাই তো ভাবছি!”
“বলছিলাম, ওনাকে সঙ্গে
নিয়ে গেলে কেমন হয়? মানে এখন কি ব্যবস্থা করা সম্ভব?” জিজ্ঞাসা করলো শর্মিষ্ঠা।
“দেখি কথা বলে।” অরিত্র
অফিস যাবার জন্য তৈরি হতে উঠলো।
অরিত্র একটা ছোট মারওয়াড়ী
ফার্মের অ্যাকাউন্টস ডিভিশনে কাজ করে। মাইনে যা পায় তাতে ওদের চারজনের সংসার
কোনরকমে চলে অল্প কিছু বাঁচে। সেই টাকা আর ব্যাংক লোন দিয়ে বছর খানেক হল ওরা এই ছোট্ট
দু কামরার ফ্ল্যাটটা কিনেছে।
বড় মাসীমা বিরুবালাদেবী
অরিত্রর নিজের মাসী নন। ওর মায়ের পিসতুতো বোন। খুব অল্প বয়সে ওনার বিয়ে হয়। ওনার
একটা ছেলে ছিল। ছেলেটির যখন বারো বছর বয়স তখন ওনার স্বামী ও ছেলে দুজনেই একসঙ্গে নৌকাডুবিতে
মারা যান। শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা আর এই অপয়া বউকে নিজেদের কাছে রাখতে চাননি। তাই উনি
অরিত্রদের বাড়ীতে এসে ওঠেন। অরিত্র
ছোটবেলা থেকেই মা আর মাসীর স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়েছে। উনি যদিও অরিত্রর মা সৌদামিনীদেবীর
চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন, তবুও বাড়ীর কোন কাজ সৌদামিনীকে না জিজ্ঞাসা করে করতেন
না। সৌদামিনীদেবী আপত্তি করলে হেসে বলতেন, “তুমি হইলে এই বাড়ীর গিন্নী। তোমারে না
জিগাইয়া করি কেমনে?”
সৌদামিনীদেবী মারা যাবার
পর উনি কাশীতে ওনার গুরুদেবের আশ্রমে চলে যান। শর্মিষ্ঠা ওনাকে একবারই দেখেছে। ওর
বিয়ের সময়। মাঝে মাঝে চিঠি দেন, ওদের খবরাখবর নেবার জন্য। এই প্রথম আসছেন ওদের
বাড়ী।
বিরুবালা স্বপাক আহার
করেন তাই ওনার জন্য আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে শর্মিষ্ঠাকে। রুমি, সুমির
ঘরের এক কোনে ওনার জন্য কেরোসিনের একটা স্টোভ রেখে, কিছু বাসন-পত্র আর চাল, ডাল
ইত্যাদি দিয়ে ওনার রান্নাঘর সাজিয়ে দেয় শর্মিষ্ঠা।
একুশ তারিখে অরিত্র,
মাসীমাকে আনতে ষ্টেশনে গেলো। রুমি, সুমি খুবই উৎসাহিত। ওদের ঘরে থাকবে বড়ঠাকুমা।
একটা ছোট সুটকেস, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ আর হাতে জপের মালা নিয়ে বাড়ী ঢুকলেন
অশতিপর বৃদ্ধা বিরুবালাদেবী। শর্মিষ্ঠা, রুমি, সুমি ওনাকে প্রণাম করার পর উনি ঘুরে
ঘুরে বাড়ী দেখতে লাগলেন।
“বাঃ! খাসা বাসা। ছোটোর মধ্যে সবই আছে।”
তারপর নিজের রান্নাঘর
দেখে একগাল হেসে বললেন, “খোকা! বৌমা হইল লক্ষ্মী! সব দিকেই তার নজর।”
ওদের তিনজনকে ঘরে বসিয়ে
শর্মিষ্ঠা রান্নাঘরে চা করতে গেলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রুমি সুমি হাসতে হাসতে
রান্নাঘরে এসে ঢুকলো।
“জানো মা? বড়ঠাকুমা কি
বলছে? আমি বললাম সুমি থার্ড হয়েছে আর আমি ফোর্থ হয়েছি। তখন জিজ্ঞাসা করলো এর মানে
কি? আমরা বললাম এর মানে ও তিন হয়েছে আর আমি চার হয়েছি। তখন ঠাকুমা কি বলল জানো?
তোমরা এতো কম হইলা ক্যান ? আরও একটু বেশী হইলে ভালো হইত না?” রুমি হাসতে হাসতে
বলল।
ওদের হাসি আর থামতেই চায়
না। শর্মিষ্ঠা অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে, বকে ঝকে মেয়েদের চুপ করিয়ে চা দিতে
গেলো। মাসীমা ভালবাসেন বলে অরিত্র ক্রিম বিস্কুট এনেছে। শর্মিষ্ঠা সেটাও একটা
রেকাবিতে সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছিল চায়ের সঙ্গে। সবাই গল্প করতে করতে চা বিস্কুট খেলো।
সবার খাওয়া হয়ে যাবার পর প্লেটে দুটো বিস্কুট পড়েছিল। শর্মিষ্ঠা চায়ের বাসন গুলো
তুলতে যেতেই ওকে অবাক করে দিয়ে বড়মাসীমা বিস্কুট দুটো ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে নিজের
ব্যাগ থেকে একটা পুরনো ছোট অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন বাক্স বার করে তাতে তুলে রেখে
দিলেন। আর ব্যাস আবার শুরু হয়ে গেলো রুমি সুমির খুক খুক হাসি।
সেদিন অরিত্র বাড়ী এলো
দুটো ভালো খবর নিয়ে। এক, বড় মাসীমাকে ওরা সঙ্গে নিয়ে যাবে পুরীতে, সব ব্যবস্থা হয়ে
গেছে, আর দুই, শনিবার ওদের অফিস ক্লাবের
নাটক আছে, “ অপরাজিতা”, ওরা সবাই দেখতে যাবে।
শনিবার দুপুর থেকে সাজ
সাজ রব। সবাই সেজে গুজে ট্যাক্সি চড়ে রওনা হল নাটক দেখতে। হলে ঢোকার মুখে অফিস
ক্লাব থেকে স্নাক্সের প্যাকেট বিতরন করছে, মাছের চপ আর মিষ্টি। সকলের সঙ্গে লাইন
দিয়ে বড়মাসীমাও প্যাকেট নিলেন এবং নিজের কাঁধের ঝোলার মধ্যে ভরে ফেললেন।
শর্মিষ্ঠা একটু ইতস্তত
করে বলে ফেলল, “মাসিমা ওই প্যাকেটে মাছের চপ আছে। আসলে আপনি তো খান না ...
তাই......”
“আমি খাইব না তো কি? আমার
নাতনীরা খাইব।” মাসীমা চটপট বলে উঠলেন।
সেদিনকার নাটক খুব ভালো
হয়েছিল। নাটক দেখে ফেরার পথে পাশের বাড়ীর সান্যাল বউদির সঙ্গে দেখা । মাসীমাকে দেখে
উনি পরের দিন চায়ে নেমন্তন্ন করলেন।
পরের দিন বিকালে
শর্মিষ্ঠা, রুমি, সুমি আর মাসীমাকে নিয়ে গেলো সান্যাল বউদির বাড়ী। খুব ভালো
ব্যবস্থা করেছিল সান্যাল বৌদি। চা, বিস্কুট, চানাচুর, মিষ্টি। অনেক রকম গল্প হল,
খাওয়া হল। খাবার পর সান্যাল বৌদি চায়ের
কাপগুলো উঠিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে যেতেই বড় মাসীমা প্লেটের বাঁচা বিস্কুট গুলো তুলে
ক্ষিপ্র হাতে নিজের ঝোলার টিফিন বাক্সে ভরে ফেললেন।
শর্মিষ্ঠা জল খাচ্ছিল,
ওনার কাণ্ড দেখে ভীষণ একটা বিষম খেলো।
বাড়ী এসে অরিত্রকে সব কথা
খুলে বলল শর্মিষ্ঠা। অরিত্র সব শুনে বলল, “দেখি সময় সুযোগ বুঝে আমি কথা বলবো
মাসীমার সাথে।”
পরের দিন সকালে রুমি
সুমির ঘরে উঁকি দিয়ে শর্মিষ্ঠা দেখল বড়ঠাকুমা আর নাতনীদের আসর বসেছে বিছানার ওপর
আর মাঝখানে খোলা রয়েছে সেই টিফিন বাক্স যাতে ভরা রয়েছে নানা রকমের বিস্কুট । ওকে দেখতে পেয়ে
মেয়েরা চেঁচিয়ে উঠলো, “মা এই দ্যাখো বড়ঠাকুমা আমাদের কি দিয়েছে।”
শর্মিষ্ঠা ঘরে ঢুকে দেখে
রুমির গলায় একটা সোনার চেন আর সুমির হাতে দুটো সোনার রুলি।
“এসব কি মাসীমা?” চমকে
জিজ্ঞাসা করলো শর্মিষ্ঠা।
“তুমি না কইরো না বৌমা। এ
আমার আশীর্বাদ। অদের বিয়ার সময় আমি তো আর থাকুম না। তুমি এই দিয়া কিসু গড়াইয়া দিও। তোমরা ছাড়া আমার
আর তো কেউ নাই। আমার যা আসে সব তো তোমাদেরই। আর কটা দিনই বা বাচুম। এই তোমার
সংসার, তোমার মাইয়াদের দেইখ্যা গ্যালাম......” গলাটা ধরে এলো বিরুবালার।
শর্মিষ্ঠা আর কোন কথা না
বলে নিজের চোখের জল লোকাতে অন্য ঘরে চলে গেলো তাড়াতাড়ি।
পরের দিনগুলো হাসি গল্পে
আর পুরী যাবার ব্যবস্থা করতে কেটে গেলো।
পুরী এক্সপ্রেসে চড়ে ওরা
সবাই ভোরবেলা পুরী পৌঁছে গেলো। হোটেলে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েই সমুদ্রে স্নান
করতে যাওয়া হবে। বড় মাসীমা খুব খুশী। জীবনে এই প্রথম উনি সমুদ্র দেখবেন। নিজের আলু সিদ্ধ
ভাত বানিয়ে রেখে উনি নাতনীদের সাথে সমুদ্রে স্নান করার জন্য তৈরি হলেন। পরনে সাদা
থান, পায়ে হাওয়াই চটি, কাঁধে ব্যাগ।
সবার সাথে চটি খুলে
মাসীমাও সমুদ্রে নামলেন। নাতনীদের খুব উৎসাহ। তারা ঠাকুমার দু হাত ধরে জলে
দাপাদাপি করতে লাগলো। এমন সময় এলো বেশ বড় একটা ঢেউ আর তিনজনকে একসঙ্গে দিলো জলে
ফেলে। নাতনীদের সঙ্গে ঠাকুমাও জলে ডুবে, নোনা জল খেয়ে, বালি মেখে, হেঁচে, কেশে
একাকার। এরপর আর সমুদ্রে স্নান বেশী জমলো না। শর্মিষ্ঠা আর অরিত্র সবাইকে নিয়ে
হোটেলে ফেরত এলো।
গোলটা বাধল হোটেলে ফেরার
পর। ঘরে জামাকাপড় বদলে বিরুবালা নিজের কাঁধের ব্যাগটিকে খুলে দেখেন তার মধ্যে ওনার
টিফিন বাক্সটা নেই। বাচ্চা মেয়ের মত কাঁদতে শুরু করলেন বিরুবালা। রুমি, সুমি ঠাকুমাকে
কাঁদতে দেখে ছুটে মাকে ডেকে নিয়ে আসলো।
“কি হয়েছে মাসীমা কাঁদছেন
কেন?” শর্মিষ্ঠা জিজ্ঞাসা করলো।
কিছুক্ষণ বিরুবালা কোন
উত্তর না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চললেন। তারপর শর্মিষ্ঠার
অনেক পীড়াপীড়ির পর উনি শুধু একটাই কথা বললেন, “আমার টিফিন বাক্স...”
শর্মিষ্ঠা দেখল ওনার ভেজা
ব্যাগটা ঘরের কোনে পড়ে রয়েছে, তারপাশে
ব্যাগের ভিতরের ছোটোখাটো জিনিষপত্র ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু টিফিনবাক্সটা কোথাও নেই। ও
বুঝলো মাসীমা ব্যাগ সুদ্ধ সমুদ্রে স্নান করতে নেমেছিলেন আর ঢেউ এর সাথে টিফিন
বাক্সটা ভেসে গেছে।
মাসীমা ফুঁপিয়েই চলেছেন।
শর্মিষ্ঠা কি করবে বুঝতে পারছেনা।
“কি টিফিন বক্স, টিফিন
বক্স, করে চলেছো বলতো সকাল থেকে?” অরিত্র এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
ওকে দেখে মাসীমার কান্না
আরও বেড়ে গেলো। ওনাকে কাঁদতে দেখে রুমি, সুমিও ফোঁপাতে শুরু করেছে।
“এতো আচ্ছা ঝামেলা! একটা
টিফিন বক্স আর তাতে খান কয়েক কোড়ানো বিস্কুট। সেই নিয়ে এতো কান্নাকাটির কি আছে
সেটা তো বুঝতে পারছিনা!” এবার অরিত্রর গলায় ধমকের সুর।
শর্মিষ্ঠা তাড়াতাড়ি
অরিত্রর কাছে গিয়ে বলল, “তুমি রুমি সুমিকে নিয়ে একটু আমাদের ঘরে গিয়ে বস। আমি
দেখছি।”
রুমি সুমি বেরিয়ে যেতেই
শর্মিষ্ঠা এসে বসলো বিরুবালার পাশে। আসতে করে কাঁধে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে খুব নরম
গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “ওই টিফিন বাক্সটা......
আপনার খুব প্রিয় ছিল, তাই না?”
শর্মিষ্ঠার কথায় জলভরা
চোখে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন বিরুবালা। মনে মনে অনেক দূরে চলে গেছেন
তিনি। খুব হাল্কা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, মনে হল বহু দুর
থেকে ভেসে আসছে ওনার আওয়াজ......
“তখন আমার আট–নয় বৎসর
বয়স। মা আমারে একটা থালা ভইরা বেদানা লিসু খাইতে দিসিলো। বেদানা লিসু, তোমরা কখনও
দেখো নাই, এই দেশে পাওয়াই যায় না। ওইদেশে আমাদের বাগানে একটা গাছ ছিল। আমি পা
ছড়াইয়া বইস্যা খাইতাসিলাম। খবর আইলো সবাই গ্রাম ছাইড়া পলাইতাসে। আমরাও তখনই আমাদের
বাসা ছাইড়া বাহির হইলাম। লিসু আর খাওয়া হইল না। পথে কত লোক! সবাই চলতাসে। আমরাও তাদের সাথে
চললাম। তিনদিন......তিন রাত...... কিছু খাবার নাই...... শুধু জল খাইয়া...... ” বলতে বলতে আবার ফুঁপিয়ে উঠলেন বিরুবালা।
“তারপর ?”
“তারপর আর কি? আমরা আইসা
পৌঁছাইলাম রিফিউজি ক্যাম্পে। তিনদিন পর ওরা আমাদের খাইতে দিল। তিনদিন না খাইয়া
থাকার যে কি কষ্ট ...... তার চেয়েও কষ্ট নিজের সন্তানকে ক্ষুধায় কষ্ট পাইতে
দ্যাখা...... । ওই টিফিন বাক্সটা আমার মা আমায় দিসিলো। কয়েসিল সব সময়
কাছে খাবার রাখবি। বলা যায় না কখন লাগে। আমি তাই কখনই ওই টিফিন বাক্সটা আমার কাছছাড়া
করি না। তোমাদের মেসো আর আমার পোলাটা যেইদিন চলে গেলো...... আমি কিছুই জানিনা ......
ভাত খাইতাছিলাম আমি ...... রে রে কইরা সবাই আমার দিকে ছুইটা আসলো...... বলল
এক্ষুনি বাইর হইয়া যা...... কিছুই পাই নাই গো বৌমা ...... স্বামী পুত্রের জন্য
কাঁদতেও দেয় নাই ওরা আমারে...... ” কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন বিরুবালা।
“ মাসীমা...!” আর কিছু
বলতে পারেনা শর্মিষ্ঠা, কান্নায় তার গলা বুজে যায়।
“ আসার সময় এই ব্যাগটা আর
ওই টিপিন বাক্সটা ওরা আমায় আনতে দিসিলো ...... ওইটুকুই আমার আছে......” একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন বিরুবালা।
“জানেন তো মাসীমা শুনেছি
সমুদ্র কিছুই নেয় না, সব কিছুই ফিরত দেয়। আপনি মন খারাপ করবেন না।” বলল শর্মিষ্ঠা।
ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান
হাসলেন বিরুবালা।
সেদিন বিকালে ওনাকে
কিছুতেই হোটেল থেকে বার করতে পারলো না শর্মিষ্ঠা। উনি বললেন পরের দিন মন্দির
দর্শনে যাবেন।
বিকালবেলায় সমুদ্রের ধারে
ঘুরতে ঘুরতে শর্মিষ্ঠা মাসীমার কথাগুলো ভাবছিল। খুব খারাপ লাগছিল ওর। হঠাৎ রুমি
সুমির চিৎকারে সম্বিত ফিরে পায় ও।
“মা মা দেখো আমরা কি
পেয়েছি।” হাতে একটা কিছু নিয়ে ছুটে আসছে ওরা। মাসীমার টিফিন বাক্স! আনন্দে চোখে জল
এসে যায় শর্মিষ্ঠার।
ওরা তাড়াতাড়ি হোটেলের
দিকে রওনা হয়। হোটেলে পৌঁছে সবাই এসে ঢোকে মাসীমার ঘরে। সকলের মুখ
হাসিতে উজ্জ্বল। বিরুবালা ওদের দেখে একটু অবাক চোখে তাকান। তারপর রুমি সুমির হাতের
দিকে তাকিয়ে ওনার মুখেও জ্বলে ওঠে হাজার ওয়াটের আলো।
“ব্যাস খুশী তো? এবার রাখো
যত খুশী বিস্কুট আর খাওয়াও নাতনীদের।” বলল অরিত্র।
“বালাই ষাট! ঠাকুর করুন
যেন তোমাদের এই বিস্কুটের দরকার কখনও না পড়ে।” বলে মাথায় হাত ঠেকালেন বিরুবালা।
“এবার বল তোমার আর কি
চাই?” বলল শর্মিষ্ঠা।
মুখ নিচু করে মিটিমিটি
হাসতে লাগলেন বিরুবালা।
রুমি, সুমি ঠাকুমার গলা
জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো,” বলো না ... তোমার আর কি চাই?”
“একবার বেদানা লিসু খাওয়াইতে
পারিস?” আদুরে আদুরে গলায় বলে উঠলেন বিরুবালা।
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন