কলকাতার পথচলা #
কোম্পানির শাসনের শুরুতে কলকাতায় রাস্তা বলতে পায়ে চলা পথ | বনজঙ্গল নদীর পাশ দিয়ে কিংবা এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় মানুষ পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতো | যদিও বেশ কিছুটা দূরের পথে যেতে হলে যানবাহন বলতে গরুর গাড়ি আর পালকি | কলকাতার বাবুরা পালকি চড়েই যাতায়াত করতো |বলা যায় বাবুকালচারের প্রতীক ছিল পালকি| তাদের বাড়ির মেয়েরা সে কালে পরপুরুষের চোখের আড়ালে গঙ্গাস্নানে যেত পালকি চড়ে| সব সমেত বেহারারা পালকি জলে ডুবিয়ে তুলে নিতো | বড় ঘরের মেয়েদের সঙ্গে পুণ্য অর্জন থেকে পালকিও বাদ পড়তো না|
1798/99 সাল নাগাদ প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাঁধানো রাস্তা সার্কুলার রোড তৈরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার রাস্তায় ছুটতে লাগলো ঘোড়ায় টানা গাড়ি| গতি পেলো কলকাতার নগরজীবন | ব্রাউনলো তার আদরের পালকিতে চাকা লাগিযে তার সামনে ঘোড়া জুতে দিতে বানিয়ে ফেললো ব্রাউনবেরি গাড়ি|তাঁর মস্তিস্কপ্রসূত এই ব্রাউনবেরি নামক ঘোড়ার গাড়ি সেকালে খুবই জনপ্রিয় ছিল | আসতে আসতে সাবেকি পালকির জায়গায় সাহেবদের জন্য দামি আর কর্মচারীদের জন্য সাদামাটা ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয় | নানান নামের এই সব ঘোড়ার গাড়ি| চেরট,ফিটন,ল্যান্ডো, টমটম,এক্কা গাড়ি যাকে হয়তো ছ্যাকড়া গাড়ি বলা হয়| “এক্কা গাড়ি ঐ ছুটেছে ঐ দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে”---আধুনিক কলকাতার রাস্তায় যা আজ অতীত |
এখনো আমরা কথায় কথায় বলি রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার খুব চাপ | সেই ঘোড়ায় টানা জুড়িগাড়ির কথা কে না জানে?? কিন্তু পাথুরিয়াঘাটার যদু মল্লিকের নাতি মন্মথ মল্লিকের ট্রটিং গাড়ি টানতো দুটো জেব্রা | তাঁর আস্তাবলে ঘোড়া নেই তা নয় নিজের আভিজাত্য জাহির করতে বলা যায় বড়োলোকি খেয়াল চরিতার্থ করার জন্যই তিনি আলিপুর পশুশালা থেকে ছ হাজার টাকায় দুটি জেব্রা আনান| তাকে ট্রেনিং দিয়ে গাড়ি টানাবার উপযুক্ত করানো হয় | সালটা খুব দূরেরও নয় 1935 এর ঘটনা | কলকাতার রাস্তায় সেদিন মহা ধুমধামের মধ্যে দিয়ে জেব্রা টানা সেই গাড়ি ছোটে, মহানগরের রাস্তায় তা দেখার জন্য ভিড় উবচে পড়ে| হয়তো সেখান থেকেই পরবর্তীকালে জেব্রা ক্রসিংয়ের সূত্রপাত |
এই জেট গতির যুগে ভাবলে অবাক লাগে, দেড়শো বছর আগে বিবেকানন্দের মাতা ভুবনমোহিনী দেবী শিশু বিবেকানন্দকে নিয়ে কলকাতা থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে যাচ্ছেন স্বামীর কাছে গরুর গাড়িতে চেপে |
সালটা 1873 এর 24শে ফেব্রুয়ারী সে এক বিস্ময়কর মজার দিন | ঐ দিন ব্রিটিশ সরকার ঠিক করেছে পণ্য সরবরাহের সুবিধের জন্য ট্রাম চালাবে |ইংলিশম্যান পত্রিকার খবর অনুযায়ী ওই দিন মাল নয় সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে মানুষই ট্রামে চেপে বসে | তা বসলে হবে কি! গাড়ি তো মোটেই এগোয় না| অস্ট্রেলিয়া থেকে তেজি ঘোড়া আমদানি করা হয়েছে, তাসত্ত্বেও ট্রাম একচুল নড়ে না | এদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে শিয়ালদা স্টেশন ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর লোক টিকিট কেটে ট্রামে চেপে বসেছে| সেদিন থেকেই কোম্পানি বুঝে গেছে এই ভূতের বোঝা বয়ে নিয়ে যেতে হবে| যত না লোক ট্রামে চড়েছে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে সেদিনের মজা দেখার জন্য | ইংলিশম্যান পত্রিকায় সেদিন যারা ট্রামে চড়তে পারেনি তাদের দুঃখের কোথাও বর্ণনা করা হয়েছিল |
ইতিহাসে আছে ঠাকুর বাড়ির মেয়ে বৌরা হ্যাটকোট পরে ঘোড়ায় চড়ে ময়দানে হওয়া খেতে বেরোতেন | রাস্তা দিয়ে তাদের যেতে দেখে চিতপুরের অঞ্চলে বাড়ির মহিলারা জানলার কপাট বন্ধ করে দিতো ঝটাস ঝটাস| সেযুগের প্রেক্ষিতে ওই দৃশ্য দেখাও ছিল মহাপাপ| জানতে পারলে স্বামী গঙ্গাজলি হবে | কিন্তু ঘটনাটা মোটেই মিথ্যে নয় | জ্যোতিরীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী কাদম্বরীদেবীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ময়দানে বৈকালিক ভ্রমণে বার হতেন |
সেইসময় গগনেন্দ্রনাথতার কন্যাকে স্বয়ং ঘোড়ায় চড়া শিখিয়ে ছিলেন | এই ঘোড়সওয়ারীদের দের হাওয়া লাগে পটুয়া পাড়াতেও| সে পাড়ার মেয়েরা দেখে পোটো তার হাতের মুন্সিয়ানায় বানিয়েছে ঘোড়ায় চড়া এক নারী | তখন তারা বলাবলি করে এ নিশ্চই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের পট | তা দেখে কেউ কেউ হিংসায় মুখ বেঁকালো, কেউ আবার তার স্বামীর কাছে বায়না জুড়লো ওরকম একটা পট কেনার | কিন্তু এ ছবি কোথায় যেন মুক্তির আলোকবর্তিকা স্বরূপ | হয়তো এভাবেই অন্দরমহলের খিলটা ধীরে ধীরে খুলে যায় প্রবেশ করে এক ঝলক টাটকা বাতাস |
সব যুগেই যারা সময়ের থেকে এগিয়েছিলেন তাদেরকে সমসাময়িক সময়ের অনেক নিন্দা সমালোচনার ঝড় সামলে এগোতে হয় যার সুফল ভোগ করে পরবর্তী প্রজন্ম |
ভাগ্গিস তাঁরা সমসাময়িক নারী সমাজের জড়তা কাটিয়ে সম্মুখের ঐ বাঁধনছেঁড়া রাস্তায় পা ফেলেছিলেন | যে পথ অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে আজকের নারী| সেই জয়যাত্রার পথ ধরেই আমার প্রিয় শহর কলকাতারও অগ্রগতি | আজও সে ক্রমাগত নিজেকে ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে | তাইতো এ নগর চির যৌবনা, চির নবীনা | চলায় তার ক্লান্তি নেই | তার এই বিরামহীন চলার সাক্ষী হয়ে আছে সেই সময়ের মাইলফলক সভ্যতার চাকা| চাকা আবিষ্কার যেমন একটা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় তেমনি কোনো শহরকেও অগ্রগতির সোপানে আরোহন করতেও সাহায্য করে ||
কোম্পানির শাসনের শুরুতে কলকাতায় রাস্তা বলতে পায়ে চলা পথ | বনজঙ্গল নদীর পাশ দিয়ে কিংবা এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় মানুষ পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতো | যদিও বেশ কিছুটা দূরের পথে যেতে হলে যানবাহন বলতে গরুর গাড়ি আর পালকি | কলকাতার বাবুরা পালকি চড়েই যাতায়াত করতো |বলা যায় বাবুকালচারের প্রতীক ছিল পালকি| তাদের বাড়ির মেয়েরা সে কালে পরপুরুষের চোখের আড়ালে গঙ্গাস্নানে যেত পালকি চড়ে| সব সমেত বেহারারা পালকি জলে ডুবিয়ে তুলে নিতো | বড় ঘরের মেয়েদের সঙ্গে পুণ্য অর্জন থেকে পালকিও বাদ পড়তো না|
1798/99 সাল নাগাদ প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাঁধানো রাস্তা সার্কুলার রোড তৈরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার রাস্তায় ছুটতে লাগলো ঘোড়ায় টানা গাড়ি| গতি পেলো কলকাতার নগরজীবন | ব্রাউনলো তার আদরের পালকিতে চাকা লাগিযে তার সামনে ঘোড়া জুতে দিতে বানিয়ে ফেললো ব্রাউনবেরি গাড়ি|তাঁর মস্তিস্কপ্রসূত এই ব্রাউনবেরি নামক ঘোড়ার গাড়ি সেকালে খুবই জনপ্রিয় ছিল | আসতে আসতে সাবেকি পালকির জায়গায় সাহেবদের জন্য দামি আর কর্মচারীদের জন্য সাদামাটা ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয় | নানান নামের এই সব ঘোড়ার গাড়ি| চেরট,ফিটন,ল্যান্ডো, টমটম,এক্কা গাড়ি যাকে হয়তো ছ্যাকড়া গাড়ি বলা হয়| “এক্কা গাড়ি ঐ ছুটেছে ঐ দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে”---আধুনিক কলকাতার রাস্তায় যা আজ অতীত |
এখনো আমরা কথায় কথায় বলি রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার খুব চাপ | সেই ঘোড়ায় টানা জুড়িগাড়ির কথা কে না জানে?? কিন্তু পাথুরিয়াঘাটার যদু মল্লিকের নাতি মন্মথ মল্লিকের ট্রটিং গাড়ি টানতো দুটো জেব্রা | তাঁর আস্তাবলে ঘোড়া নেই তা নয় নিজের আভিজাত্য জাহির করতে বলা যায় বড়োলোকি খেয়াল চরিতার্থ করার জন্যই তিনি আলিপুর পশুশালা থেকে ছ হাজার টাকায় দুটি জেব্রা আনান| তাকে ট্রেনিং দিয়ে গাড়ি টানাবার উপযুক্ত করানো হয় | সালটা খুব দূরেরও নয় 1935 এর ঘটনা | কলকাতার রাস্তায় সেদিন মহা ধুমধামের মধ্যে দিয়ে জেব্রা টানা সেই গাড়ি ছোটে, মহানগরের রাস্তায় তা দেখার জন্য ভিড় উবচে পড়ে| হয়তো সেখান থেকেই পরবর্তীকালে জেব্রা ক্রসিংয়ের সূত্রপাত |
এই জেট গতির যুগে ভাবলে অবাক লাগে, দেড়শো বছর আগে বিবেকানন্দের মাতা ভুবনমোহিনী দেবী শিশু বিবেকানন্দকে নিয়ে কলকাতা থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে যাচ্ছেন স্বামীর কাছে গরুর গাড়িতে চেপে |
সালটা 1873 এর 24শে ফেব্রুয়ারী সে এক বিস্ময়কর মজার দিন | ঐ দিন ব্রিটিশ সরকার ঠিক করেছে পণ্য সরবরাহের সুবিধের জন্য ট্রাম চালাবে |ইংলিশম্যান পত্রিকার খবর অনুযায়ী ওই দিন মাল নয় সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে মানুষই ট্রামে চেপে বসে | তা বসলে হবে কি! গাড়ি তো মোটেই এগোয় না| অস্ট্রেলিয়া থেকে তেজি ঘোড়া আমদানি করা হয়েছে, তাসত্ত্বেও ট্রাম একচুল নড়ে না | এদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে শিয়ালদা স্টেশন ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর লোক টিকিট কেটে ট্রামে চেপে বসেছে| সেদিন থেকেই কোম্পানি বুঝে গেছে এই ভূতের বোঝা বয়ে নিয়ে যেতে হবে| যত না লোক ট্রামে চড়েছে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে সেদিনের মজা দেখার জন্য | ইংলিশম্যান পত্রিকায় সেদিন যারা ট্রামে চড়তে পারেনি তাদের দুঃখের কোথাও বর্ণনা করা হয়েছিল |
ইতিহাসে আছে ঠাকুর বাড়ির মেয়ে বৌরা হ্যাটকোট পরে ঘোড়ায় চড়ে ময়দানে হওয়া খেতে বেরোতেন | রাস্তা দিয়ে তাদের যেতে দেখে চিতপুরের অঞ্চলে বাড়ির মহিলারা জানলার কপাট বন্ধ করে দিতো ঝটাস ঝটাস| সেযুগের প্রেক্ষিতে ওই দৃশ্য দেখাও ছিল মহাপাপ| জানতে পারলে স্বামী গঙ্গাজলি হবে | কিন্তু ঘটনাটা মোটেই মিথ্যে নয় | জ্যোতিরীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী কাদম্বরীদেবীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ময়দানে বৈকালিক ভ্রমণে বার হতেন |
সেইসময় গগনেন্দ্রনাথতার কন্যাকে স্বয়ং ঘোড়ায় চড়া শিখিয়ে ছিলেন | এই ঘোড়সওয়ারীদের দের হাওয়া লাগে পটুয়া পাড়াতেও| সে পাড়ার মেয়েরা দেখে পোটো তার হাতের মুন্সিয়ানায় বানিয়েছে ঘোড়ায় চড়া এক নারী | তখন তারা বলাবলি করে এ নিশ্চই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের পট | তা দেখে কেউ কেউ হিংসায় মুখ বেঁকালো, কেউ আবার তার স্বামীর কাছে বায়না জুড়লো ওরকম একটা পট কেনার | কিন্তু এ ছবি কোথায় যেন মুক্তির আলোকবর্তিকা স্বরূপ | হয়তো এভাবেই অন্দরমহলের খিলটা ধীরে ধীরে খুলে যায় প্রবেশ করে এক ঝলক টাটকা বাতাস |
সব যুগেই যারা সময়ের থেকে এগিয়েছিলেন তাদেরকে সমসাময়িক সময়ের অনেক নিন্দা সমালোচনার ঝড় সামলে এগোতে হয় যার সুফল ভোগ করে পরবর্তী প্রজন্ম |
ভাগ্গিস তাঁরা সমসাময়িক নারী সমাজের জড়তা কাটিয়ে সম্মুখের ঐ বাঁধনছেঁড়া রাস্তায় পা ফেলেছিলেন | যে পথ অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে আজকের নারী| সেই জয়যাত্রার পথ ধরেই আমার প্রিয় শহর কলকাতারও অগ্রগতি | আজও সে ক্রমাগত নিজেকে ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে | তাইতো এ নগর চির যৌবনা, চির নবীনা | চলায় তার ক্লান্তি নেই | তার এই বিরামহীন চলার সাক্ষী হয়ে আছে সেই সময়ের মাইলফলক সভ্যতার চাকা| চাকা আবিষ্কার যেমন একটা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় তেমনি কোনো শহরকেও অগ্রগতির সোপানে আরোহন করতেও সাহায্য করে ||
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। ধারাবাহিক ভাবে এলে ভাল হয়।
উত্তরমুছুন