পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

পৌলমী দেব


মাতৃত্ব


বিয়ের পর এই বাড়িতে যেদিন প্রথম পা দিয়েছিলো,সেদিন সবার সাথে আলাপ করানো হলো,শুধু একজন ছাড়া।কয়েকজনের সাথে পরিচয় অবশ্য সম্বন্ধ দেখতে বা তত্ব দিতে যাওয়ার সময়।বিয়ের দিন এতো ভিড়ে কোনো আত্মীয়কেই তেমন ভাবে মনে থাকার কথা নয়।কালরাত্রির দিন পিসি-শাশুড়ির সাথে একঘরে শুয়ে একটু ইতঃস্তত করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো ঝুমুর,পিসিমণি ওই ছেলেটা কে ছিলো?
পিসি-শাশুড়ি বললো,কোন ছেলেটা?
--ওই,সন্ধেবেলা যাকে সবাই তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে গেলো আমার ঘর থেকে? 
পিসি-শাশুড়ি মুখটা করুণ করে বললো,ওটা তোমার ছোট দেওর বৌমা।কি কপাল দেখো,জন্ম থেকেই ছেলেটা বোবা আর কালা।বৌদিরও কপাল!এতো গুলো সুস্থ সন্তানের পরে বেশি বয়সে এমন এক ছেলের জন্ম দিলো।সবই ভগবানের ইচ্ছা মা!
-ওকে সবাই বকছিলো কেন?ঝুমুরের বিস্ময় তখনো কাটেনি।
-শুধু বোবা কালা হলেও না হয় কথা ছিলো।বাচ্চুটা মাঝে মধ্যে এমন পাগলামি করে বসে যে ঘর বন্ধ করে রাখতে হয়।কখন কাকে মেরে ধরে বসবে কে জানে!
--পাগল?ঝুমুর একটু চিন্তিত সুরে বললো।
ঝুমুরের ভীত মুখ দেখে পিসি বলল,পাগল নয় বৌমা।ছেলেটা এমনিতে খুবই ভালো।কারোর থেকে তেমন ভালোবাসা পায়না তো,তাই কষ্ট থেকে কখনও সখনও হয়তো…..
ঝুমুর প্রথম প্রথম সত্যিই ভয় পেতো বাচ্চুকে।ওর দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো যেন,নতুন মানুষ বলেই বোধহয়।কিন্তু ঝুমুরের বুকের ভিতরটা হিম হয়ে যেতো ওর চোখের দিকে তাকালে।ডাইনিং টেবিলে সবাই একসাথে খেলেও বাচ্চুকে কখনও দেখেনি।ওর ঘরে রোজ খাবার দিয়ে আসার কাজ বংশীদারই ছিল।ছেলের অসুখে বংশীদা দেশে যাওয়ায় পর একদিন ঝুমুর প্রায় জোর করেই খাবার নিয়ে গেলো বাচ্চুর ঘরে।একটা বল নিয়ে খাটের উপর বসে নিজের মনে খেলছিলো,ওকে দেখে মুখে সামান্য হাসি ফুটলো।এরপর থেকে মাঝে মাঝেই খাবার নিয়ে যেতো ঝুমুর।ভয়টাও আস্তে আস্তে কেটে গেলো।একদিন খাবার দিতে গিয়ে দেখলো কম্বলে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে বাচ্চু।কম্বল সরিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখলো বেশ জ্বর।থার্মোমিটার আনতে যাচ্ছিলো,হঠাৎ আঁচলে টান পড়তে দেখলো বাচ্চু করুণ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।সেইদিন থেকে কেমন যেন একটা অপত্য স্নেহ পড়ে গেলো বাচ্চুর উপর।বাচ্চুও বড় বৌদির হাতে ছাড়া আর কারুর হাতে খেতোনা।মাঝে মাঝে ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েও পড়তো।
তন্ময় যদিও ঝুমুরের বাচ্চুকে নিয়ে এই 'আদিখ্যেতা' একদম পছন্দ করতো না।মাঝে মাঝেই বলতো,তোমাকে এতো করতে কে বলেছে?পাগল ছেলে,কখন কি করে বসবে কে জানে! 
মুখে কিছু না বললেও,হাবেভাবে বিরক্তি প্রকাশ করতো ঝুমুর।কোনো কোনো দিন রেগেমেগে বলেও দিয়েছে,ওকে একদম পাগল বলবে না।অনেকের থেকে সুস্থ।কোনোদিনও গেছ ছেলেটার কাছে?ভালোবাসার কাঙাল ও।একটু ভালোবাসা পেলেই হয়তো....।
বাচ্চুর প্রতি এই অপত্য স্নেহ নিয়ে শুধু তন্ময় না,বাড়ির প্রত্যেকে,এমনকি শাশুড়ি পর্যন্ত সাবধান করেছে।বাচ্চুর কথা উঠলেই ঝুমুর এড়িয়ে গেছে।ও জানে সন্তান কখনো মায়ের ক্ষতি করে না।না হোক সে গর্ভধারিণী।
          সুখবরটা আন্দাজ করছিল,আজ ডাক্তারের কাছে গিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলো।মনের মধ্যে টাটকা বাতাস বয়ে গেলো ঝুমুরের।একটা মেয়ের এর চেয়ে সুখের মুহূর্ত আর কি হতে পারে।গাড়িতে উঠেই আচমকা ঝুমুরের গালে চুমু খেলো তন্ময়।
-আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।
-কি হচ্ছে কি?লজ্জা পেলো ঝুমুর।
কথাটা ছড়িয়ে পড়তেই বাড়িতে খুশির জোয়ার উঠলো। অনেকদিন পর বাড়িতে বাচ্চা আসছে,স্বভাবতই সকলে ভীষণ খুশি।ঝুমুরের যত্নআত্তিও বেড়ে গেলো খুব।প্রথম বেশ কিছুদিন আমিষের গন্ধ নাকে গেলেই কেমন অস্বস্তি হতো।তাছাড়াও সব সময় একটা বমি বমি ভাব,দুর্বলতা।বিছানায় শুয়েই থাকতো বেশিটা সময়।অনেকদিন বাচ্চুর কাছেও যাওয়া হয়নি।ওকে দেখতে না পেয়ে,নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ হয়েছে বাচ্চুর।বংশীদার থেকে নিয়মিত খবর নেয় ঝুমুর।একদিন বংশীদা এসে বলল,দাদাবাবু সকাল থেকে কিচ্ছু খাচ্ছেনা।দুধের গেলাস নিয়ে গেলাম,এমন ছুড়ে মারলো।একটু হলেই আমার মাথায় লাগতো।এখনো ভাত নিয়ে গেলাম,খেলোনা।আমার হয়েছে যত জ্বালা!
ঝুমুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললো,তুমি ওর খাবারটা উপরে দিয়ে এসো বংশীদা।আমি যাচ্ছি।
-তুমি এই শরীর নিয়ে যাবে বৌদিমণি? কর্তামা জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না।
-কাউকে কিছু বলতে হবে না তোমাকে,ঝুমুর নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।মাথাটা একটু টলছিল,সেটা উপেক্ষা করেই বাচ্চুর ঘরে গেলো।
উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছিলো বাচ্চু।ঝুমুর এগিয়ে এসে পিঠের উপর হাত রেখে ডাকলো,বাচ্চু।এই পরিচিত স্পর্শের জন্যই বোধহয় অপেক্ষা করছিল বাচ্চু।চকিতে উঠে বসে প্রথমে কিছুক্ষণ ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝুমুরের দিকে।সামান্য সময়,তারপরেই মুখে খুশির রঙ ফুটিয়ে দু’হাত দিয়ে জাপ্টে ধরলো বৌদিকে।ঝুমুরের পেটে চাপ পড়তেই বাচ্চুর হাত দুটো সামান্য ঠেলে ইশারায় বললো,আয় ভাত খাবি আয়।
বাচ্চু কি বুঝলো কে জানে!খাট থেকে সাথে সাথেই নেমে এলো।ঝুমুরের ভারি পেট নিয়ে কষ্ট হয়।উঠতে বসতে সময় লাগে।ধীরে সুস্থে বংশীদার রেখে যাওয়া ভাতের থালা হাতে নিতেই দেখলো বাচ্চু কেমন অবাক হয়ে তার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে।সম্পূর্ন অচেনা চোখের ভাষা।ঝুমুরের একটু অস্বস্তি হলো।তবু ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে ভাতের থালা রেখে বাচ্চুর হাতটা আলতো করে নিজের পেটের উপর রেখে ইশারায় বললো,এই বাড়িতে নতুন একজন আসছে।দেখ,দেখ! 
আচমকাই বাচ্চুর মুখটা আবার কালো হয়ে এলো।এক ঝটকায় ঝুমুরের হাতটা সরিয়ে উল্টোদিকে মুখ করে আবার শুয়ে পড়লো।ঝুমুরের রাগ হলো খুব।অসুস্থ শরীরে কত হ্যাপা সামলানো যায়!মনে মনে বললো,খেতে হবে না যা।তোর জন্য বংশীদাই ভালো।মন খারাপ ও হলো।মুখ ভার করে সবে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়েছে,আচমকাই আঁচলে টান পড়লো।শাড়িতে পা বেঁধে নিচে পড়তে পড়তে চোখে অন্ধকার দেখলো।তারপর আর কিছু মনে নেই। 
জ্ঞান ফিরতেই ঝুমুর দেখলো মাথার কাছে স্বামী,শাশুড়ি আর বড় ননদ উদ্বিগ্ন মুখে বসে।ডাক্তার বলে গিয়েছেন,ভয়ের কিছু নেই।ছোট্ট একটা অপারেশন করলেই চলবে।ঝুমুরের কম বয়েস,মা হওয়ার সুযোগ আবার আসবে।
ছ'মাস ধরে লালন করা স্বপ্নটা বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফেরার পর বিস্তর কথা শুনতে হলো ওকে অসাবধানতার জন্য।বাচ্চু এসে দু একবার ওর ঘরের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে গেছে।ঝুমুর দেখেও ডাকেনি।ঘটনার আকস্মিকতা ওকে স্তব্ধ করে দিয়েছে একেবারে। 
     দিনকয়েক বাদে একটু সুস্থ হয়ে বাচ্চুর ঘরে ঢুকতেই দেখলো ঘরের ভিতর বাচ্চু থমথমে মুখে বসে।ওকে দেখে অপরাধীর মতো মুখ করে সরে বসলো। এই কয়েকদিনের মনের ঢেউ এর ওঠানামা যেন কিছুটা শান্ত হলো ওর মায়া মাখানো চোখ দুটো দেখে। স্বেচ্ছা বাঁধ ভেঙে পড়লো মুহূর্তেই।দু’চোখ ভরে জল এলো ঝুমুরের।
- এত অভিমান তোর?ও এলে তোর ভালোবাসা কমে যাবে ভেবেছিলি?ওইভাবে কেউ আঁচল টেনে ধরে,যদি মরে যেতাম? পাগল ছেলে আমার!
  বাচ্চু কি বুঝলো কে জানে,মুখে অদ্ভুত একটা শব্দ করে ডুকরে কেঁদে উঠে সর্বশক্তি দিয়ে আরো জোরে জাপ্টে ধরলো ঝুমুরকে।

1 টি মন্তব্য: