পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।

                               
                      




ডাক--  ১

লোকালয় থেকে অনেক দূরে, এমন একটা পাহাড়ি গ্রামের মধ্যে, এইরকম নির্জন জায়গায়, এমন একটা ঝাঁ চকচকে ডাকবাংলো থাকতে পারে এটা বিশ্বাস করতেই পারছিল না নিশীথ। এবারের ট্যুরটা নিয়ে বেরোনোর সময়, নতুন এলাকায় যাচ্ছে বলেই ওর বস বলেছিলেন, ‘যাও, ঘুরে এসো। থাকা খাওয়ার কোন ঝামেলা নেই। গাড়ি সাথেই রাখবে। ওটা নিয়েই কাজের সাথে ঘুরে বেড়াতেও পারবে। একটা অদ্ভুত সুন্দর ডাকবাংলো আছে ওখানে। রান্না করে দেওয়ার লোকও আছে। তবে একটা কথা বলে রাখি। রাতে বাইরের বারান্দায় বসে রাতের শোভা দেখার অভ্যাসটা ওখানে থাকাকালীন বন্ধ রেখো। রাতে বাইরে বেরোবে না কিছুতেই’।

এমনিতে একটু চুপচাপ হলেও নিশীথ, ঠাট্টা করতে ছাড়ল না। বসকে ও দাদা বলেই ডাকে। খুব মজাদার মানুষ। বলতে গেলে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন উনি। তাই বলল, ‘রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি যে রায়দা। ভূত টুত আছে নাকি? আমার আবার ভূত দেখার শখ সেই ছোটবেলা থেকেই। তাছাড়া গাড়ির ড্রাইভার, কেয়ারটেকার এরাও তো থাকবে। এতো লোকের মধ্যে ভূত আসবেই বা কি করে?’

নবীন রায় হটাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘নিশীথ, আমি যেটা বললাম সেটাই কোরো। আমি তোমাকে কারণ বলব না, কিন্তু ওখানে সত্যিই রাতে বাইরে বের হয়ো না। জায়গাটার সব ভালো, তুমি দেখতেই পাবে কিন্তু কিছু একটা ব্যাপার আছে যেটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। প্লীজ, ডোন্ট টেক এনি রিস্ক’।

ট্রেন থেকে নামার পর, বাসে উঠে চারদিকের শোভা দেখে মোহিত হয়ে গেছিল নিশীথ। ছোট ছোট পাহাড়, তারপর আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। গায়ে মেঘের চাদর, মাথায় তুষারের ঝলকানি। ঘন সবুজ বনানীর মাঝখান দিয়ে একে বেঁকে যাওয়া পথ। এক রূপকথার রাজ্য মনে হচ্ছে। রায়দা ফোন করে দিয়েছিলেন। একটা মোটামুটি চলনসই মারুতি এস্টিম গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল অল্পবয়সী ড্রাইভার। 

বাস থেকে নামতেই এগিয়ে এসে সেলাম ঠুকে বলল, ‘ম্যায় তুষার হুঁ সাব। তুষার গুরুং। রায়সাব নে ফোন কিয়ে থে। আজসে ম্যায় আপকে সাথই রহেঙ্গে। বলিয়ে কাঁহা জায়েঙ্গে সাব’। পিছনের সিটে নিজের ব্যাগ রেখে, তুষারের পাশেই বসেছিল নিশীথ। ‘চলো কুছ কাম খতম কর লুঁ পহেলে। তব ইয়ে জ্যাগাকা মজা লেনেকা ওয়াক্ত থোড়া জ্যাদা মিল জায়েগা। বহুত বড়িয়া ইলাকা হ্যাঁয়’।

তুষার একটু গর্বের সাথেই সায় দিল ওর কথায়। এগিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে ওই পথ ধরে। পরের চারঘন্টা নানা ডীলারের সাথে দেখা করে, তাদেরকে বুঝিয়ে কোম্পানীর নতুন প্রোডাক্টের অর্ডার নিয়ে নিজের কাজ অনেকটাই সেরে ফেলল নিশীথ। তুষারকে সাথে নিয়েই একটা ছোট হোটেলে লাঞ্চও করে নিল। তুষার প্রথমে না না করলেও শেষে নিশীথের জোরাজুরিতে রাজি হল খেতে। এবার নিশীথ বলল, ‘রাতমে বো ডাকবাংলা মেঁ রহেঙ্গে। তুমভী রহোগে না? ঘর মেঁ ফোন করকে বাতা দো’।

তুষার হটাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘ইধার অচ্ছে হোটেল ভী হ্যাঁয় সাব। ডাকবাংলা তো বহুত দূর হোগা। এহি কোই হোটেল মে রুক যাইয়ে না সাব’। ওর মুখের ভাবটা দেখে একটু চমকে গেল নিশীথ।

‘সুনা হ্যাঁয় উস ডাকবাংলা মেঁ ভূত হ্যাঁয়। সহি সুনা কেয়া? তুম কুছ জানতে হো?’ তুষার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এইসে কুছ ম্যায় খুদ দেখা নহি। লেকিন বো ডাকবাংলা আচ্ছা নহি হ্যাঁয় সাব। দো তিন আদমি গায়েব হো চুকে থে উস ডাকবাংলা সে। কুছ পতা নহি চলা উনলোগোকা’।

নিশীথ বলল। ‘এক কাম করেঙ্গে, হাম দোনো একহি ঘর মে রহেঙ্গে। তব তো কোই প্রবলেম নহি হোগা। আরে চলো ইয়ার। ইতনে ডরনে কা কেয়া হ্যাঁয়? বো ভূত উত কুছ নহি হ্যাঁয়’। তুষার দুজনে একজায়গায় থাকার কথায় খানিক ভরসা পেলেও ওর মুখে আর হাসি ফিরে এলনা।

ম্যানেজার কাম কেয়ারটেকার কাম কুক, বীরবাহাদুরের কৃপায় পরোটা, আচার ও দেশিমুর্গীর ঝোল দিয়ে ডিনার সেরে বাইরে বসতে চেয়েছিল নিশীথ। বীরবাহাদুর আর তুষার একযোগে মানা করায়, কিছুক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে শুয়ে পড়েছিল ও। আগের রাতের লম্বা ট্রেন জার্নী ও সারাদিন ঘুরে কাজ করায় ঘুমও চলে এসেছিল যথারীতি। 

রাত তখন কত জানেনা, বাইরে থেকে দরজায় কেউ আলতো করে আঘাত করায় ঘুম ভেঙে গেছিল। দরজাটা খুলবে কি খুলবে না ভেবেও খুলে দিয়েছিল। এক বিরাট চমকে ঘুম উবে গেছিল মুহুর্তে। এখানে এইসময় এতরাতে শুভাকে দেখার পর যা হওয়া উচিৎ তাই হল নিশীথের। ‘আমি ভেতরে আসবনা, বললেও আসবনা। আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি। চলো’। চাপা গলায় কথাকটা বলে হাত বাড়িয়ে দিল শুভা। এই শুভা মানে শুভাঙ্গী এমনভাবে একদিন ওকে ডাকবে এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে মনটাকে বুড়িয়ে দিয়েছিল নিশীথ। ধীরে ধীরে নিজেকে নামিয়ে এনেছিল ওর আকাঙ্ক্ষার মেঘমোড়া আকাশ থেকে। 

কোনকিছু না ভেবে ও এগিয়ে গেল। পায়ে ঘরে পরার স্লিপারটাই ছিল। বাংলো থেকে রাস্তায় নেমে, যেদিক থেকে এসেছিল ঠিক তাঁর উল্টোদিকের রাস্তায় এগোল শুভা। বাইরের ঠান্ডার জন্যই কিনা, শুভার হাতটা ওর হাতের মধ্যে হটাৎ ঠাণ্ডা লাগল। রাস্তাটা ক্রমশ উঁচুতে উঠছে। বেশ অনেকটাই। একটা সমতল জায়গায় পৌঁছে শুভা বলল, ‘ওই সেতুর ওপারে আমার বাড়ি। কতদিন ধরে একা একা তোমার অপেক্ষায় কাটাচ্ছি আমি। আমি জানতাম তুমি আসবেই এখানে, একদিন, কোন একদিন আসতেই হবে তোমায়। আজ দুপুরে খবর পেলাম তোমার আসার, একটু কাজ ছিল বলে দেরী হয়ে গেল, নয়তো আগেই আসতাম। চলো, অনেক কথা জমে আছে তোমায় বলার জন্য’। 

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ওরা, পথ ছেড়ে উঠে পড়ল কাঠ লোহা দিয়ে বানানো সেতুটার ওপরে। অদ্ভুত সেতু একটা, ক্রমশ ওপর দিকে উঠে গেছে, একটু অস্বাভাবিকভাবেই। ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া বয়ে আসছে অনেকদূর থেকে, সোনা যাচ্ছে একটা অদ্ভুত আওয়াজও। সে আওয়াজ নদীর স্রোতের হয়ে পারে, হতে পারে ফণা তুলে ফুঁসতে থাকা সাগরের ঢেউয়েরও। যত ওপরের দিকে যাচ্ছে ওরা সেতুটার, ততোই বাড়ছে সেই আওয়াজ, একই সাথে সেতুটা হটাৎ করে অনেকটা সরু হতে শুরু করেছে। দুজনে পাশাপাশি চলতেও অসুবিধে হচ্ছে। এত কাছে এসে শুভা কখনো হাঁটে নি ওর সাথে আগে, হয়তো তাইই এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ হচ্ছিল নিশীথের।

নিজের অস্বস্তি চেপে উঁকি মেরে দেখতে গেল নিচের দিকে। টের পেল, শুভার হাতটা আর শক্ত হয়ে চেপে বসেছে ওর হাতের সাথে। এতোটাই যে রীতিমত ব্যথা করছে হাতে। একটা ফিসফিসে স্বরে শুভা বলল, ‘একদম নিচের দিকে তাকিওনা। আমি জানি তুমি এমন উঁচু জায়গায় উঠতে ভালবাসো না, আরেকটু পথ এগোলেই এই সেতু নেমে যাবে নিচের দিকে। অনেক অনেক নীচে। তুমি ভাবতেও পারবেনা এত নীচে কিভাবে পৌঁছে গেলে তুমি। সেখানেই আমি থাকি। আমার আধপোড়া বাড়িতে’।
 
এবার সত্যিই চমকালো নিশীথ। এই আধপোড়া বাড়ির কথা কানে আসতেই একটা অদ্ভুত পোড়া গন্ধ ভেসে এল ওর নাকে। এটা পোড়া সিগারেট, কাগজ বা অন্য কোন ধোঁয়ার গন্ধ নয়। মানুষের চামড়া পোড়া গন্ধ। এই গন্ধের সাথে ওর পরিচয় আগে অনেকবার হয়েছে। নিজেরজন, পরেরজনদের শরীর কাঁধে বয়ে নিয়ে গিয়ে পাঁজা করা কাঠের নীচে শুইয়ে জ্বলতে দেখার সাথে সাথে এই গন্ধের অভিজ্ঞতাও ছুঁয়ে গেছে অন্তরাত্মাকে। 

শেষপর্যন্ত ওরা পৌঁছল, সেতুর একদম মধ্যিখানে। এবার তা নেমে গেছে অতল খাদের দিকে। ঠিক সেই মুহুর্তেই তীব্র শীষের মতো একটা আওয়াজ কানে এল নিশীথের, সাথে অনেক দূর থেকে দ্রুত গতিতে ছুটে আসা রেলগাড়ির শব্দের মতো এক আওয়াজ। আকাশ ছোঁয়া বিশাল এক জলের প্রাচীর দূর থেকে ছুটে আসছে সেতুর দিকে, সেতুটা তখন প্রায় পাঁচ ছয় তলা বাড়ির সমান উঁচু, ঠিক ততোটাই উঁচু ঢেউটা। ভয়ে শিউরে উঠল নিশীথ।

ওর শিউরে ওঠা দেখে অদ্ভুতভাবে খিলখিল করে হেসে উঠল শুভা। ‘দ্যাখো নিশীথ, আমার পোড়া শরীরের জ্বালা নিভানোর জন্য কতো জল আসছে এখন কিন্তু আমার গায়ে আগুন লাগার পর, বাড়িতে আগুন লাগানোর পর আমাকে এই সেতুর ওপরে ছুটে আসতে দেখেছিল নিচের নদীটা, একটুও জল পাইনি আমি সেই জ্বালা মেটানোর জন্য। আজ সব মিটবে। এখান থেকে নীচে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব তোমায়। ভয় নেই ডুবলে দেখবে, আগুনের জ্বালার মতো কষ্ট হয়না। তারপর আমরা দুজনে আদি অনন্ত কালের জন্য একসাথে থাকব’।

আচমকা একটানে শুভার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছন ফিরে দৌড়োতে শুরু করল নিশীথ। কি এক অমোঘ টানে, মাঝপথে গিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, শুভা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে, জলের আওয়াজের সাথে সাথে ওর করুণ গলার আওয়াজ ভেসে আসছে, ‘ফিরে এসো নিশীথ। আমি আর তোমাকে ডাকতে যেতে পারব না। এভাবে আমাকে ফেলে চলে যেওনা, ফিরে এসো, প্লীজ ফিরে এসো......’

ঠিক সেই সময়েই জলের দেওয়ালটা সেতুর ওপরে আছড়ে পড়ল। কোমর থেকে নিচের অংশ ভিজে গেল নিশীথের। দৌড়তে দৌড়তে আরেকবার পিছনে দেখল ও। সেতুর মাথার দিকটা আর নেই, বাকী অংশও ভাঙছে, ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। নিজের গতি বাড়িয়ে সেতুর শেষপ্রান্তে গিয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিল ও শক্ত পাথুরে জমিতে। আর চারদিক অন্ধকার হয়ে এল ওর।

নিশীথ টের পেল, কেউ ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে। বেশ জোরে জোরেই। চোখ খুলতেই দেখল তুষারের ভয়ার্ত দৃষ্টি, একটা হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে বারান্দায়, তার মানে কারেন্ট চলে গেছে। সেই অল্প আলোতে তুষারের ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখটা দেখেই ওর মনে পড়ে গেল সবকথা। ‘কাঁহা চলে গয়ে থে সাব? ম্যায় অচানক নিদসে জাগ গয়া আউর দেখা কি দরয়াজা খুলা হ্যাঁয়। বাহার আনেকে পহেলেই কারেন্ট চলা গয়া। ম্যায় পহেলেসেই ইসে জ্বলাকে রাখখে থে। চৌকিদার বোলে থে মুঝে। বহুত ডর লগ রহা থা মুঝে, লেকিন ফির বাহার আয়ে তো দেখা কি আপ ইস বারান্দা মে শো রহে হ্যাঁয়। ক্যায়া হুয়া থা সাব, কাঁহা গয়ে থে আপ, ইহা ক্যায়সে আ গয়ে আপ?’

নিশীথ জানত না কি জবাব দেবে। গোটা ব্যাপারটাকে একটা দুঃস্বপ্নের কথা বলে ভাববে মনে করতেই ও টের পেল ওর পাজামা জবজবে ভেজা। কেমন করে? কিভাবে হল? বাইরে এর মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে এমন কোন চিহ্নও তো নেই। তুষারের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল ও। পাজামা জলে ভেজা, গায়ে চাপানো পাঞ্জাবীটা ঘামে ভেজা, ওর বুকটা এখনো হাপরের মতো উঠছে নামছে। কোন রকমে ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল ওরা।
 
একদম সঙ্গে সঙ্গেই আলো জ্বলে উঠল। ও তুষারকে বলল, ‘ইয়ে পাঙ্খা থোড়া চলা দো ভাই। পাতা নহি কিউ, মুঝে বহুত গর্মি মেহসুস হো রহা হ্যাঁয়’।

তুষার চোখ বড়বড় করে গোটা ব্যাপার দেখছিল। সাথে সাথেই পাখা চালিয়ে দিল। ব্যাগ থেকে আরেকটা পাজামা বের করে, বাথরুমে গিয়ে বদলে নিল নিশীথ। তারপর তুষারের এগিয়ে দেওয়া জলের গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে শেষ করল জলটা। নিজের বিছানায় বসে টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে সময় দেখল। রাত সাড়ে তিনটে। ওর বর্তমান অবস্থায় ঘুমোনোর কথা ভাবতেই পারছে না ও। দেখল, তুষারের চোখেও ঘুমের রেশ নেই আর। একটা সিগারেট ধরিয়ে, বলল, ‘মুঝে বাতাও তুষার, কেয়া হুয়া থা ইধার? কিঁউ ইস ডাকবাংলা মে কোই রাত মে বাহার নহি বৈঠ সকতে? ইয়ে জাননা বহুত জরুরি হ্যাঁয় মেরে লিয়ে। কিউ জরুরি হ্যাঁয় বো ম্যায় তুমে বাদ মে বতাউঙ্গা’।

তুষার একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘কেয়া বোলু সাব। এক সাব, বো ফরেস্ট অফিসার থে, আয়ে থে ইধার আপনা বিবি কো লেকর। বো নদীয়া কে উস পাড় ঔর এক ডাকবাংলা থা, বহি রহেতে থে দোনো। আপ কো সায়েদ পতা নহি, পাঁচ সাল পহেলে ইধার কা হালত বহুত বিগড়ে গয়ে থে। ফরেস্ট মে কুছ আতঙ্কবাদী নে পনহা লিয়ে থে। পিছে বালা পাহাড় কে পিছে কুছ হী দূর পর নেপাল কি বর্ডার হ্যাঁয়। উন লোগো নেপাল কি আতঙ্কবাদী কে সাথ মিলকে না জানে কেয়া কুছ নহি কিয়া। বো অফিসার সাব পুলিশ লে কর সবকো জঙ্গল সে মার ভগায়া থা। ফির এক রাত মে, রাত কিউ শাম মে বো লোগ আয়ে ঔর উসকো গোলি মার দি। উসকা বিবি আপনা পতি কা বন্দুক লে কর দো আতঙ্কবাদী কো মার গিরায়া। লেকিন উন লোগো নে বাংলা মে আগ লগা দি, থোড়ি দেড় মে মেমসাব ভী আগ কি লপেট মে আ গয়ী থী। ঘর সে নিকল নে কে বাদ বো ব্রীজ কে উপর সে নদী মে কুঁদি থি লেকিন পানি জ্যাদা নহি থা, নদী মে। ওহী দম তোড় দী মেমসাব ভী’।

তুষার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বোতল থেকে জল খেল, তারপর বলল, ‘ব্যস সাব, উসি দিন সে মেমসাব না জানে কিসে ঢুন্ডনে কে লিয়ে রাত মে আনা জানা শুরু কর দি। তিন চার আদমি ইস বাংলা সে গায়েব হো চুকে থে। উন লোগ চৌকিদারকা বাত নহি মানি, রাত মে বাহার বৈঠে পি রহে থে, ব্যস অচানক চলে গয়ে, বহুত ঢুন্ডা গয়া লেকিন উন লোগোকা লাশ তক নহি মিলা। এক কো তো চৌকিদার খুদ দেখা কিসি জেনানা কে সাথ জাঁতে হুয়ে’। আতঙ্কে কেঁপে উঠল তুষার। পাখাটা চলতে থাকায় ঘরের ভেতরটা এখন বেশ ঠান্ডাও হয়ে গেছে। 

উঠে গিয়ে ফ্যানের সুইচ অফফ করে দিল নিশীথ। ও ফিরে এসে বিছানায় বসতে, তুষার জিজ্ঞেস করল, ‘সাব এক বাত পুছনা চাহতা হুঁ, কেয়া আপ ভী উসি মেমসাবকে সাথ হী নিকল চুকে থে? লেকিন আপ ক্যায়সে বাপস আয়ে? বো তো কিসিকো নহি ছোড়তি, ম্যায় অচানক দেখা কি আপ বেড মে নহি হ্যাঁয়, দরওয়াজা ভি খুলা হ্যাঁয়। মেরা তো দম নিকল গয়া। বাহার জানে কা সাহস ভী নহি হো রহা থা। ফির সিঁড়ি পে কুছ গিরনে কা আওয়াজ শুনা তো ম্যায় ঘর সে নিকল আয়া ঔর দেখা কি আপ উহা শোয়ে হুয়ে হ্যাঁয়। পাজামা পুরা গিলা ঔর আপকা সেন্স ভী নহি হ্যাঁয়। । কাঁহা গয়ে থে আপ, কিসকে সাথ গয়ে থে?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনের ভেতরে কথাগুলো গুছিয়ে নিল, নিশীথ। কি বলবে? এই অচেনা, অজানা সদ্য আলাপ হওয়া একালের হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো একটা বাচ্চা ছেলেকে। সে অর্থে নিশীথ যে বহু প্রাচীন তা নয় কিন্তু মনের দিক থেকে ওর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার যে তুষারের চেয়ে অনেক বেশি ভরা। শুধু একটাই সান্তনা। এই অঞ্চলের, এই প্রকৃতির ছোঁয়ায় মানুষ বলেই বোধহয়, তুষার ওর বয়সী শহুরে ছেলেদের চেয়ে অনেকটাই বেশি নির্মল, স্বচ্ছ। এখন ওর সামনে একরাশ কৌতূহল চোখে নিয়ে বসে আছে, ওর এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শোনার আশায়।

নিজেও একটু গলা ভিজিয়ে নিল নিশীথ। ‘দেখো ভাই, ইয়ে বাত তুম কিসিসে নহি কহেনা। ম্যায় শোনে কে সাথ সাথ নিঁদ আ গয়া থা। অচানক শুনা কিসিনে দরওয়াজা খটখটায়া, ম্যায় সোচা চৌকিদার হোঙ্গে, লেকিন খুলনে কে বাদ জিসকো দেখা, ম্যায় চমক গয়া থা। বো মেরা বহুত করিবি দোস্ত থি। পতা নহি কিঁউ মেরা বিবি হোতে হোতে নহি হুয়ি। দুসরে কিসিকে সাথে শাদী হো গয়া উসকী। ম্যায় তব গুজরাত মে থা। বাপস আনে কে বাদ পতা চলা কি বো মুঝসে মিলনে কে লিয়ে আয়ী থী। উসকী পিতাজী কা দেহান্ত হোনেকে বাদ মা কে সাথ আপনি মামাকে ঘর মে রহতি থী দোনো। শাদী উন লোগোনেই দিয়া থা। ব্যস ফির কভি মিলে নহি’।

‘আজ ইতনে দিনোঁ কে বাদ উসে দেখকর ম্যায় হয়রাণ হো চুকে থে। যব বো মুঝে আপনা সাথে জানে কে বাত কহিঁ তো ম্যায় বিনা কুছ সোচ সমঝ কর, উসকে সাথ চলা পড়ে থে। লেকিন বো মুঝে এক ব্রীজ কে পাশ লে গয়ী। ম্যায় দেখা কি বো ব্রীজ বহুত উঁচা হ্যাঁয়। একদম পাঁচ ছে মঞ্জিলা মকান জ্যাসা উঁচা ঔর যব হামদোনো সবসে উঁচে জ্যাগা পর পৌঁছা তো দেখা এক বহুত উঁচা পানী কা দীবার দূর সে আ রহা থা। লগভগ ব্রীজ সমান উঁচা। উন পল পর উনহোনে কহিঁ কি বো আগ সে যব জ্বল রহী থি তব নদী মে ইতনা পানী নহী থা। আজ অচ্ছাই হুয়া পানী মে ডুবকে ম্যায় অগড় মর যাঁউ তো জিন্দেগী ভর দোনো এক সাথ রহেঙ্গে। ম্যায় ঔর এক পল দের না করতে হুয়ে বাপস আনে কে লিয়ে দৌড় লগাই। দেখা কি বো ব্রীজ টুটনে লগা, পানী মেরা পাজামা গিলা কর দিয়া। ব্যস উসকে বাদ কুছ ইয়াদ নহি থা। ফির দেখা তুম মুঝে উঠানে কা কৌশিস কর রহে হো’।

‘অভী এক চিজ মুঝে বাতাও তুষার, অগড় ইয়ে এক সপনা হী থা তো মেরা পাজামা গিলা ক্যায়সে হো গয়া? ঔর বো বদবু জো ঊনকে সাথ জাঁতে হুয়ে বার বার ঘুমকে আয়া, যেইসে শমশান মে কোই আদমি জ্বল রহা হ্যাঁয়, বো অভী ভী গয়া নহি। কেইসে হুয়া ইয়ে সব? এক বাত কহেনা চাহতা হু তুমহে। কাল সুবে হাম দোনো পয়দল চলেঙ্গে, নদীয়া কি উস পাড়, জানাই হোগা মুঝে। মুঝে দেখনা হ্যাঁয় কাঁহা রহতি থি বো? কেয়া হ্যাঁয় উস জ্বলে হুয়ে বাংলা মে? এক দুসরা চিজ ম্যায়নে মহেসুস কিয়া আজ, বো দুবারা কিসিকো ঢুন্ডেনে কে লিয়ে নহি আয়েগী আজকে বাদ। আজ বো খুদ কহিঁ থী মুঝে’।

তুষার ওর সাথে যাবেনা, এমনকিছু বলল না, সব শোনার পর ওর মুখেচোখে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠল, তা ভয়ের নয় বরং এক সহমর্মীতার, দুঃখের। হয়তো মেনে নিতে পারছিল না শুভাঙ্গীর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু, ঘটনার শেষটুকুকে। নিদ্রাহীন চোখে ওরা দুজনে অপেক্ষায় রইল রাত কেটে বেরিয়ে আসা আরেকটা ভোরের জন্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন