পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

শ্রাবণী সোম যশ



 

ছিন্নবীণার সুর 

তৃষা অমৃতা আর সোহিনী তিন ফেসবুক ফ্রেন্ড আজ প্রথমবার মিট করবে। এতদিন ফোন whatsapp এ চলছিল ভালোই। সোহিনী uk থেকে এসে আটকে গেছে বাড়িতে। অনলাইনে কাজ চলছে ঠিকই তবু হাজার সমস্যা। কিছুদিন যাবৎ তৃষাও খুব ডিস্টার্ব বছরখানেক আগেই ওর হাজব্যান্ড মারা গেছে।  তাই  ঠিক হয়েছে গাড়ি নিয়ে তিন বন্ধু বেরিয়ে পড়বে। পুরুলিয়ায় অমৃতাদের গ্রামের বাড়িতে দুটো দিন একটু হৈচৈ করা এই আর কি। প্ল্যান তো ওদের অন্যরকমই  ছিল প্রথমে,  গোয়া বা কোভালাম গিয়ে বিন্দাস মস্তি করার। কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে সেটা তো সম্ভবই নয়। অমৃতার গাড়িতেই যাবে। প্রথমে তৃষাকে তুলে তারপর সোহিনী কে নিয়ে সোজা হাইওয়ে ধরবে। 

তৃষা গাড়িতে উঠেই অমৃতাকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে হেসে কেঁদে পুরো জমজমাট একটা সিন করলো। অমৃতা যত বোঝায়, ওরে থাম থাম কে শোনে কার কথা। এই পর্ব শেষ হতে না হতেই সোহিনী উঠে পড়ল। সোহিনী বরাবরের মতোই সংযত কিন্তু চোখে খুশির ঝিলিক,  দুই বন্ধুকে প্রথম ছুঁতে পারার আবেগে। প্রথম চাক্ষুষ করার আবেগ কমতেই দুই বন্ধু পড়লো অমৃতাকে নিয়ে। 'উফফ ক্যায়া হুসন, ক্যায়া জলয়া'। নামী মডেল অমৃতা, ওকে দেখলেই চোখ আটকে যায় ওর সাজানো গোছানো শরীরে। সোহিনীও জিন্স আর টপে টিপটপ। তৃষার চেহারায়  বরং বয়সের তুলনায় কিছুটা ভারিক্কি ভাব। নিঃসন্তান তৃষা কিছুদিন আগে স্বামীকে হারিয়ে খানিকটা এলোমেলোও বটে। সোহিনী এখনও বিয়েই করেনি। নিজের কর্মজগতে চূড়ান্ত সফল। অমৃতার প্রেমিক ওর অপেক্ষায়। এই মুহূর্তে করোনাকে সাক্ষী রেখে বিয়ের পরিকল্পনা নেই।  

পুরুলিয়ায় পৌঁছে চান খাওয়া সেরে তিনজনে জমিয়ে আড্ডায় বসলো। ছিমছাম পাকা দোতলা বাড়ি অমৃতাদের। ছোট্ট একটা বাগান যেটা এই মুহূর্তে অযত্নে আগাছায় ভর্তি। উঠোনটা পেরিয়ে মাটির দেড় তলা আরেকটা বাড়ি । আপাতত সেখানে ওদের পুরোনো চাষি নেলকো আর ওর বউ থাকে। তারাই ওদের রান্নাবান্না করে রেখেছে। আজকের অমৃতা যদিও এই পরিবেশ এই বাড়িতে একেবারেই বেমানান তবুও এখানে পৌঁছে থেকেই ও সেই আগের কিশোরিবেলায় ফিরে গেছে। চোখমুখের এই উচ্ছলতার অনেকটাই হারিয়ে গেছিল ওর পালিশ করা সৌন্দর্যের আড়ালে। সূর্যের তেজ একটু কমতেই তিন বন্ধু বেরিয়ে পড়লো ঘুরতে। খোলা মাঠ শ্রাবণের আকাশ দেখে গুনগুন করে গান ধরলো তৃষা। থামতেই সোহিনী বলে উঠলো, " এত মিষ্টি গলা তোর ! থামলি কেন রে"। ততক্ষণে ওরা কংসাবতীর ধারে এসে পৌঁছেছে। বর্ষার জলে পূর্ণ যুবতী কংসাবতী, রূপের দেমাকে দুপাশের তীর,  গজিয়ে ওঠা গাছ গাছালিকে উপেক্ষা করে স্পর্ধা ভরে এগিয়ে চলেছে। তৃষা ছুট্টে গিয়ে নদীর ধারে মোটা একটা গাছের গুঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসেই গলা ছেড়ে গান ধরলো , 'ওগো নদী আপনবেগে পাগলপারা'। অমৃতা আর সোহিনীও গুটি গুটি পায়ে গিয়ে প্রকান্ড গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে বসলো। তৃষা গান শেষ করেই ওদের দিকে ফিরে বললো, 
- এই যে ম্যাডামরা, আপনারা এবারে একটু পেট খুলুন তো। অমৃতা তুই শুরু কর। আজ তোর প্রেমিকের কথা শুনবো।  
পড়ন্ত সূর্যের আভা এসে পড়েছে জলে। সেই লালিমায় ভিজে অমৃতাকে নবীন কিশোরীর মতো লাগছিলো। কচি ঘাসের ডগা ছিড়ে দাঁতে চিবাতে চিবাতে নদীর বেগে হারিয়ে ফেললো নিজেকে। 
- তখন মাধ্যমিকের পর ছুটি চলছে।  আমাদের বাড়ি থেকে দু তিনটে বাড়ি পরেই বুবান দাদাদের বাড়ি। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে বুবান দাদা। ও  আমাকে ইলেভেনের অংক দেখিয়ে দিত। এন্ট্রান্স পরীক্ষার পর তখন ছুটি চলছে ওর ও ।  রেজাল্টের অপেক্ষায় দিন গোনা। একদিন দুপুরে আমি বুবান দাদাদের বাড়ি গেলাম যে অংকগুলো পারিনি সেগুলো দেখিয়ে নিতে। 
- ওহ তার মানে তোর সেই স্কুল লাইফের প্রেম। এত পুরোনো চাল রে ! 
ফোড়ন কাটলো সোহিনী। কিছুই কানে গেল না অমৃতার। অমৃতা তখন ফিরে গেছে ষোল বছরে।
- নীচের তলায় এঘর-ওঘর খুঁজছি কেই নেই। বুবান দার মা কেও দেখতে পেলাম না। মাসি মাসি করে ডাকতে ডাকতে দোতলায় উঠলাম। নাহ, কারোর সাড়া নেই। খাতা বই বুকে চেপে ধরে  চলে যাবো বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি , বাসন পড়ার শব্দ। ফিরে গিয়ে দেখি বুবান দার হাত থেকে জলভর্তি গ্লাস পড়ে গেছে। মেঝেভর্তি জল। বুবান দার চোখ লাল। গায়ে জ্বর। মাসি গেছে ডাক্তার কাকুর সাথে কথা বলে ওষুধ আনতে। একগ্লাস জল এনে বুবান দাকে দিলাম। বললাম, আজ তো তাহলে অংক হবেনা পরে আসবো। চলে যাবো বলে পিছন ফিরেছি বুবান দা হাত টা ধরে টানলো,  একদম ওর বুকের কাছে। জানিস, ওর জ্বরতপ্ত নিঃশ্বাসে আমার গাল গলা বুক পুড়ে যাচ্ছিল। জিভ আলজিভ বেয়ে তেষ্টা পেয়ে গেছিলো ভীষন। আমার একটুও  ইচ্ছে করছিল না ওকে বুকের কাছ থেকে সরতে, ওকে ছেড়ে বাড়ি যেতে। আমি চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম ওর উষ্ণ গভীর স্পর্শের। আমার সব তেষ্টা বুবান দা নিজের ঠোঁট দুটো দিয়ে শুষে নিয়েছিল। নিস্তব্ধ দুপুরে ফ্যান এর হাওয়ায় কেবল আমার অংক খাতার পাতা ওড়ার শব্দ। সেই প্রথম বুঝলাম শরীর মানে মন্দির। আঙুলের ডগা ছুঁয়ে শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় উৎসবের মাদল।  নদীর ভরা কোটালে পূর্ণ  অবগাহনের তৃপ্তি আমার অঙ্গে অঙ্গে। আমি তখন  শরীরী শিশিরের স্পর্শসুখে বিভোর ভোরবেলার একমুঠো জুঁই। বুবান দা, আমি যে তোমায় এতটা ভালোবাসি আমি নিজেও কি ছাই জানতাম ! 
অমৃতার দুচোখে টলটলে প্রেম।
 - তারপর কি হলো বলবি তো। এই বুবান দাই কি তোর এখনকার... 
কলকল করে উঠলো তৃষা। একই প্রশ্ন সোহিনীর চোখেও। 
- তার আর পর হলো কই ! বুবান দা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাদবপুরে চলে গেল, সাথে মাসিকেও নিয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই জমি বাড়ি বিক্রি করে পাকাপাকি কলকাতায় চলে গেল ওরা। আর কিছু খোঁজ পাই নি রে। 
আফসোসে  ভেঙে পড়ল তৃষা সোহিনী।  সোহিনী বললো, 
- এরকমই বোধহয় ঘটে জীবনে। 
সন্ধ্যের অন্ধকার গায়ে মেখে তিনজন ফিরে এলো কংসাবতীকে একা রেখে।

বাড়ি ফিরেই অমৃতা আবার স্বমূর্তি ধারণ করেছে। পাকা গিন্নির মতো ওদের খাওয়ার শোবার ব্যবস্থায় লেগে পড়েছে।  চা মুড়ি নিয়ে বসে এবার অমৃতা চেপে ধরেছে ওদের দুজনকে। 
- আমি তো ডায়েরীর পাতা খুলে তোদের পড়ালাম এবার তোরা  নিজেদের বেড়ালগুলো ঝুলি থেকে বের কর তো সোনা। 
আড়মোড়া ভেঙে বুকে বালিশ নিয়ে পা নাচতে নাচতে তৃষা বললো ,
 - আমার জীবনে  তো পেরেম, সরবে নীরবে কোনোভাবেই এলো না রে। যা কিছু ওই একমাত্র বরের সাথে। সোহিনী তুই এত সুন্দরী, হাই প্রোফাইল জব তোর পিছনে নিশ্চয়ই বিশাল লাইন। আজ অবধি কে কে তোমাতে দিওয়ানা হয়েছে শুনি একটু। 
হেসেই উড়িয়ে দেয় সোহিনী।
 - কাজের চাপে প্রেম যে কোন ফোল্ডারে রেখেছি আর কি যে তার পাসওয়ার্ড বেমালুম ভুলে হজম করে ফেলেছি। তার চেয়ে বরং তৃষা তোর বিয়ের গল্প বল তো। শুনি। 
অমৃতাও হই হই করে ওঠে, 
- বল বল। আমিও  বিয়ের আগে একটু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিই। 
উঠে গিয়ে ঘরের সব জনলাগুলো খুলে দিলো তৃষা। আজ পূর্ণিমা। মেঘ সরে গিয়ে ঝলমলে চাঁদ এসে লুটিয়ে পড়েছে  মেঝেয় পাতা মাদুরে। আলোটা নিভিয়ে দিয়ে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে গান ধরলো , 'ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে কাছে দূরে ...'
 - পাড়ার পুজোয় প্রতিবছর ফাংশান হতো। এই গানটা দিয়েই শুরু করেছিলাম সেবার। গান গাওয়া শেষ করে স্টেজ থেকে নামতেই বাবা বললো, এনারা কাকুলিয়ার ওদিকে থাকেন। ঠাকুর দেখতে এসে তোর গান শুনে দাঁড়িয়ে গেছেন। প্রণাম করলাম হাসিমুখ মাসিমাকে। সাথে ছিল ওনার একমাত্র ছেলে বাবা মায়ের সাথে গল্প চলার ফাঁকেই আমি কেটে পড়লাম বন্ধুদের সাথে ঘুরতে । লক্ষ্মী পুজোর পরই  ফোনটা  এলো বাড়িতে।  আমাকে ওনার  পুত্রবধু করতে চান।  তিন মাস পরেই ছেলে আমেরিকায় চলে যাবে, তাই তার আগেই বিয়ে দিতে হবে। বিয়ের পরে বউকেও  নিয়ে যাবে। এরকম সুপাত্র তায় আবার যেচে এসেছে !  বাবা - মা হতে চাঁদ পেলো জানিস। 
- আহা তুই বুঝি কিছু কম ! মাযেদের ওই স্বভাব পরের ছেলে সবসময়ই  ভালো।
রাগ দেখালো  অমৃতা।
- বিয়ে আর পাসপোর্ট- ভিসার প্রস্তুতি একসাথে চললো। বিয়ের দশ দিনের মাথায় নীল আমেরিকা চলে গেল আর তার একমাস পরে আমিও চেনা জগৎ ছেড়ে অচেনা দেশে অচেনা একটা মানুষের কাছে গিয়ে উঠলাম। তিন বছরের এসাইনমেন্ট ছিল নীলের।  সেটা শেষ হতেই নতুন একটা প্রজেক্ট হেড করে ওকে তখন অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর কথা চলছে। নীল ব্যস্ত থাকতো সবসময়। ভীষণ ব্যাস্ত কাজ  নিয়ে। সফলতার আকাঙ্খায় ও মত্ত। এদিকে শাশুড়ি মা একা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমিও আর পেরে উঠছিলাম না ওই উইকেন্ড পার্টি আর গোটা সপ্তাহ মুখবুজে গৃহবন্দী থাকতে। একটা বাচ্চা চাইছিলাম ভীষণ ভাবে। নীলের আপত্তিও ছিল না, সমর্থন ও না। সুযোগ টা করে দিলেন শাশুড়ি মা। অজ্ঞান হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হলেন। নীল বুঝলো এক্ষুনি অস্ট্রেলিয়া যাবার সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। খুশির পালকে  ভর করে ফিরে এলাম প্রাণের শহর কলকাতায়। এবারে আমার বদলে শাশুড়িমাই  আব্দার শুরু করলেন, 'বয়স হয়েছে কবে আছি কবে নেই' নাতি নাতনীর মুখ দেখতে সাধ ওনার। এত বাচ্ছা ভালোবাসি আমি নীলের ছোটবেলার ছবি গুলো সব বাঁধিয়ে রেখেছি আমার ঘরের দেওয়ালে। বাচ্ছা হচ্ছেনা বলে যখন চিকিৎসা চলছিল,  শাশুড়ি মা ওগুলো আমায় দিয়েছিলেন।  রোজ ওগুলো দেখতাম বলে নীল যে কত রাগাতো আমাকে ! 'আসল নীল কে ছেড়ে তুমি যে বালক নীল কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে।  যা করার তো আমাকেই করতে হবে। তোমার ঐ ছবির নীলের কিছু ক্ষমতাই নেই'। এমনই কপাল দেখ, এ ডাক্তার সে ডাক্তার করেও বিয়ের পাঁচ বছর পেরিয়েও কোল খালি রয়ে গেল। শাশুড়ি মাও  চলে গেলেন কমাস বাদেই। আর এখন তো নীল ও আমাকে একা করে দিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিলো। 
বলতে বলতেই গাল ভিজে গেল তৃষার। সোহিনী আর অমৃতা এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

নেলকোর বউয়ের হাতে পরিপাটি করে সাজানো গোছানো  খাবার টেবিল দেখে অমৃতা খুব খুশি। সবাই মিলে জমিয়ে খেয়ে উঠতেই সোহিনী বায়না জুড়লো জ্যোৎস্না রাতে ছাদে  গিয়ে বসবে।  মাদুর , কুশন সব নিয়ে গিয়ে ছাদে বসার ব্যবস্থা করে দিলো নেলকো। ঝুপসি ঝুপসি কালচে গাছগুলো কেবল জেগেছিল ওদের সাথে। মফস্বল এলাকা, রাত এগারোটাতেই বেশ নিঃঝুম। তৃষার সঙ্গগুনেই হয়তো সোহিনীও গুনগুন করতে শুরু করলো। আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে..। অমৃতা ঝুপ করে সোহিনীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বললো, 
-  ফ্লাইট চালু হলেই তো তুই চলে যাবি সেই কোন সুদূরে।  মনের ভিতর ডুব দিয়ে, মণি মানিক্য যা আছে বিলিয়ে দিয়ে যা বন্ধুদের। দেখবি বাঁচার আনন্দ অনেক বেড়ে যাবে। 
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গিন্নিগিরি করে উঠলো তৃষা, 
- সেইতো, অত দূরে একলাটি পড়ে থাকিস , চাইলেও কেউ যেতে পারবো না সৌ। মনের ভার ঝেড়ে ফেল।
তৃষার কথায় দুজনেই হেসে ফেললো। 
সোহিনী বললো,
- ভেবেইছিলাম তোদের বলবো আমার ছেঁড়া কাঁথার গল্প। ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে সবাই সবাইকে ভালোমতোই চিনে গেছি। বন্ধুত্ব না হলেও মুখ দেখেই বলে দিতে পারতাম কোন ডিপার্টমেন্ট। সেই সময় শুধু ফার্স্ট ইয়ার নয় গোটা কলেজেই জাদু খুব ফেমাস। 
- জাদু? সে আবার কে ? 
তৃষার প্রশ্ন।
- ওকে সবাই জাদু বলেই  ডাকতো। এত ভালো সফ্টওয়্যার প্রোগ্রামিং করতো ! সিনিয়াররাও ফিদা। সবাই বলতো ও জাদু জানে। আমিও করতাম তবে জাদু মানে অঞ্জনের থেকে ভালো নয়। বন্ধুত্ব থেকে কখন যে সম্পর্কটা অন্যদিকে গড়িয়ে গেল কেউ খেয়ালই করিনি। ফাইনাল ইয়ারে ক্যাম্পাসিং হলো। জাদু আর আমি দুজনেই একই কোম্পানী তে জব পেলাম। পোস্টিং তখনও কনফার্ম নয়। দুজনেই খুব ঠাকুর ভক্ত হয়ে গেলাম। ইশ ঠাকুর যেন একই জায়গায় পোস্টিং হয়, নিদেনপক্ষে কাছাকাছি।
 - ওরে ঢপবাজ তুই যে এদ্দিন বলতিস তুই ঈশ্বরে বিশ্বাস করিস না। দেখলি, সত্যিটা কেমন বেরিয়ে গেল। 
খিল্লি করলো অমৃতা। ওর কথায় হেসে ফেললো সোহিনী। 
 - না রে সত্যিই মানিনা। তখন তো জাদুকে কাছে পাবার নেশায় স্বার্থের ভক্তি। শেষরক্ষা হলো। দুজনেই নয়ডায় পোস্টিং পেলাম। উফফ, সেদিন যে আমরা কি খুশি হয়েছিলাম!  এরপর তো সময় জলের চেয়েও দ্রুত গড়াতে লাগলো। আমি একজনের বাড়িতে pg তে থাকতাম।  ইচ্ছে করেই এটা নিয়েছিলাম নতুন জায়গায় কতকটা সেফ হবে ভেবে। জাদু একটা ফ্ল্যাটে  একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকতো। আমি প্রায়ই যেতাম  জাদুর কাছে। মাস ছয়েক পরে,  একটা প্রজেক্টে ওই অফিসেরই চারজন মিলে কাজ করছিলাম আমরা। কানাঘুষোয় আগেই শুনেছিলাম এই চারজনের কোনো  দু জনকে কোম্পানী বাইরে পাঠাবে। জাদুর টা কনফার্ম ছিলাম, কারণ ওর মতো প্রোগ্রামিং ওখানেও কেউ পারতো না। 

কথার মাঝখানে হঠাৎ সোহিনী উঠে জল খেতে গেল। আর চাঁদ ততক্ষণে মাঝ আকাশে এসে বসেছে ওদের সঙ্গ দেবার জন্যে। সোহিনী আসতেই ওরা আবার মুগ্ধ শ্রোতার ভূমিকায়।
- প্রেজেন্টেশনের পরের দিন শনিবার। আমি গেলাম জাদুর কাছে। সেদিন অনেক গল্প আলোচনার মাঝে মূল বিষয় ছিল এবারে আমরা বিয়েটা সেরে ফেলবো। খুব এক্সপেক্ট করছিলাম দুজন একসাথেই  বাইরে যাবো। আর তার আগেই বিয়েটা সেরে নেব।  জানিস, সেটাও ছিল শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যা।  কথায় কথায় সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামলো। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। জাদু বায়না ধরলো ওর কাছে রাতটা থেকে যেতে। ওকে বারণ করার বা ফিরিয়ে দেবার কোনো ইচ্ছেই সেদিন ছিল না আমার। ঝোড়ো হাওয়া ঝাপ্টা মারছিল ষোল তলার কাঁচের সার্শীতে। বাইরে অঝোরে ভাঙছে আকাশ আর ভেতরে বাঁধ ভাঙছে প্লাবন। প্রকৃতির দাপটকে অগ্রাহ্য করে জ্বলন্ত দুটো দেশলাই কাঠি নিমেষেই দাবানল ডেকে আনলো সেই রাতে। নিজেকে নিঃস্ব করে জ্বালিয়ে পূর্ণতা পেতে চেয়েছিলাম ওর ভালোবাসায়। নিঃস্ব আমি, সিক্ত আমি ভাসতে ভাসতে চরম সুখের মোহনায় গিয়ে ঠাঁই পেলাম। তান্ডবের শেষ অংক সেরে প্রকৃতি আবার হেসে উঠেছে আপন খেয়ালে। আমিও পুরুষ স্পর্শে প্রকৃতি হবার মাধুর্য্যে পল্লবিত হলাম নতুন করে। 
সোহিনী চুপ করে যেতেই তৃষা বললো,
 - তোর কষ্ট হলে তোকে আর কিছু বলতে হবেনা সৌ। চল আমরা বরং অন্য গল্প করি1।
অমৃতা সোহিনীকে কোল পেতে দিলো । ওর কোলে মাথা রেখে তৃষার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে সোহিনী বলতে শুরু করলো নতুন অধ্যায়ের কথা।
- এর ঠিক দুদিন পরেই জানতে পারলাম  কোম্পানী আপাতত একজনকেই UK পাঠাবে।  আর সেটা হলো সোহিনী দত্ত। অদ্ভুত পরিস্থিতি জানিস, জাদু নয় আমার নাম সিলেক্ট হয়েছে। এটা মেনে নিতে যতটা কষ্ট জাদুর হয়েছিল, আমার হয়েছিল অনেক বেশী। আমাদের সব পরিকল্পনা আতান্তরে পড়লো। আমি জাদুকে ছেড়ে যেতেও চাইছিলাম না আবার সুযোগটা হাতছাড়া হোক এটাও  চাইছিলাম না। জাদুই বুঝিয়েছিলো পরের আসাইমেন্টে নিশ্চয়ই ওর নাম থাকবে। কাজেই এখন সুযোগ হাতছাড়া করলে পরে মুশকিল হবে।  অথচ,  যাবার দিন দশেক আগে হঠাৎই জাদু ভীষণরকম অবুঝ হয়ে গেল। আমাকে কিছুতেই যেতে দেবে না। বলতে লাগলো আমরা দুজনে এখানেই খুব ভালো থাকবো। এদিকে আমি ততদিনে যাবার জন্য মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমার পক্ষে আর পিছিয়ে আসা সম্ভব ছিল না কিছুতেই। কদিনের মধ্যেই  সব ছেড়ে জাদুকে ছেড়ে পাড়ি দিলাম। ওখানে গিয়ে সেটল হওয়া, নতুন কাজ বোঝার ব্যস্ততায় জাদুর সাথে কথা হলেও গল্প হতো না। আমি ফোন না করলে জাদু করতো না। uk এর নতুন জীবনে কিছুটা অভ্যস্ত হতে, খেয়াল হলো গত মাসে আমি পিরিয়ড মিস করেছি। এক মিশ্র অনুভূতি হয়েছিল তখন। জাদুকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল। সন্ধ্যাবেলায় কাজ থেকে ফিরেই ফোন করেছিলাম খবরটা দেব বলে। একটা অস্বস্তি কাজ করছিল ভেতরে ভেতরে । সেদিন অনেকবার ফোন করা সত্বেও ফোন তোলেনি ও। পরেরদিন ও নিজেই ফোন করেছিল। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জানিয়েছিল, ওই কোম্পানী রিজাইন করে ও নতুন কোম্পানী জয়েন করেছে ।  সামনের মাসেই ওর বিয়ে। এই লং ডিস্ট্যান্স রিলেশন ওর পক্ষে বিয়ারেবল নয়। প্রেগনেন্সির খবরটা আর দিতে ইচ্ছে হয়নি জানিস। মনে হয়েছিল,  এই মুহূর্তে এই খবরটা দেবার অর্থ আমাকে বিয়ে করতে চাপ সৃষ্টি করা ওকে। মনকে রাজী করাতে পারিনি কিছুতেই। সেদিন তাপাঙ্ক মাইনাসে নেমে গেছিলো। গরম দেশের নরম মেয়েটা, সেদিন একটু উষ্ণতা কুড়োনোর আশায় কুঁকড়ে গেছিলো।  
- জীবন তো থেমে থাকে না রে । তুই কেন নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস।
পরম মমতায় হাত রাখে ওর হাতে অমৃতা।
- কষ্ট নয় রে অমু। নিজেকে এখন অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছি। যদি কখনও কারোর প্রতি সেভাবে সাড়া পাই ভেতর থেকে..
কথার মাঝেই সোহিনীর মোবাইল টা বেজে ওঠে । এদিক ওদিক কুশনের নীচে খুঁজতে খুঁজতে থেমে গিয়েও আবার বেজে ওঠে।  ফোনটা  নিয়ে সোহিনী কে দিতে গিয়ে তৃষা দেখে স্ক্রিনে একটা ছেলের মুখ। চমকে ওঠে ও।  অবিকল ছোটবেলার নীল। বলেও ফেলে, 
- কি অদ্ভুত এ যেন কিশোর  নীল। হতভম্ব সোহিনী কিছু বুঝতে না পেরে বলে,  
- হোয়াট ? নীল ? ইউ মীন নীলাঞ্জন ?  ও আমার ছেলে,  সমুদ্র। আমার আর জাদুর ভালোবাসার সন্তান। 
ততক্ষণে অমৃতারও চোখ পড়েছে ছবিটায়। ও অস্ফুট বলে,
- বুবান দা ! নীল মানে ... নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী। 
অমৃতার কথায় দুজনেই চমকে বলে,  
- তুই ওকে চিনিস ? 
বলেই ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকায়। বুঝতে পারে অমৃতার বুবান দা তৃষার নীল আর সোহিনীর জাদু একই মানুষ।  তিন নারীই কখনো না কখনো ভালোবাসার সোপান বেয়ে মানুষটিকে ছুঁয়ে আলোর ফানুস উড়িয়েছে জীবনে। ভালোবাসা বোধহয় এভাবেই উজ্জীবিত হবার আকাঙ্খায় বিন্দু হয়ে বেঁচে থাকে অন্তরে। মোবাইলটা  বাজতেই থাকে ক্রমাগত। তিনজনেই অধীর হয়ে হাত বাড়ায় মোবাইলটার দিকে।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন