পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

কৌশিক চক্রবর্ত্তী


মাটি
কৌশিক চক্রবর্ত্তী 

স্থান নাটোর। গাছ-গাছালি ও অসংখ্য সরোবরের মাঝে এক মনোরম রাজপ্রাঙ্গন। যেখানে পাখি রোজ গেয়ে যায় ভোরের ব্রহ্মসংগীত। মানুষেরা পেট ভরে দুমুঠো খেয়ে চর্চা করে সংগীতের। এদিকে দরবারে রোজ চলে অপরাধীর সুবিচার। হ্যাঁ, বিচারটা নিঃসন্দেহে সু, কারণ পর্দায় আড়ালে যিনি বিচারকের আসনে বসে শাস্তি শোনান অপরাধীকে তিনি বিচক্ষণ ও সুশাসক। আইনের অন্ধত্বে নয়, অপরাধীর প্রতিটি অপরাধের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবেই তিনি দরবারে মন্ত্রী দয়ারাম রায়কে দিয়ে পড়ে শোনান সাজা। বাংলার মসনদে নবাব আলিবর্দী খাঁ। মুর্শিদাবাদ থেকে সারা বাংলা বিহার উড়িষ্যা শাসন করেন তিনি। এমনই একদিন নাটোরের দরবারে বিচারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে তিন অপরাধী। প্রথম জন ব্যভিচারী, দ্বিতীয়জন দাঙ্গাবাজ আর তৃতীয়জন চোর। প্রতিজনের অপরাধ শোনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণের পরে রানী প্রস্তুত করলেন তাদের সাজার খসড়া। পর্দার পিছন থেকেই হাত বাড়িয়ে পৌঁছে দিলেন বিশ্বস্ত মন্ত্রী দয়ারামের হাতে। অনুগত অথচ বিচক্ষণ অবিভাবকের মত তা পড়ে দেখলেন তিনি৷ বিচারপদ্ধতি দেখেশুনে রীতিমতো অবাক হলেন। গ্রামবাসী অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে বিচার শোনবার জন্য। পড়ে শোনালেন দয়ারাম। প্রথম জন সম্ভ্রান্ত কুলীন কায়স্থ ব্যক্তির ছেলে, অথচ ব্যভিচারী। দ্বিতীয় জন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ঘরের বেয়াড়া ছেলে। এই দুজনেই ভীষণ কড়া ধমক আর নিন্দার পর পেলেন বেকসুর খালাস। আর তৃতীয় জন নাপিতের ছেলে। তাঁর সাজা ছয়মাস কারাবাস। সাজা শুনে গ্রামবাসীদের মধ্যেও কানাঘুষো। কিন্তু ধর্মের প্রতিমূর্তি রানীমার উপর কথা বলে সাধ্য কার। অর্থাৎ ফিসফিসানিই সার। সন্তুষ্ট নয় দয়ারামও। সোজা একদিন জিজ্ঞাসা করে বসলেন রানীকে। 'এ তোমার কেমন বিচার মা?'
রানী হেসে বলেন 'দেখোই না, এখন এর উত্তর দেব না, সময়ে বুঝবে।'
কেটে গেল ছয়মাস। হঠাৎ দরবারে পিছমোড়া করে ধরে বেঁধে নিয়ে আসা হল এক ব্যক্তিকে। অভিযোগ চুরির। ব্যক্তির মুখ দেখেই চিনতে পারলেন সকলে। চোর আর কেউ না, সদ্য সাজা থেকে মুক্তি পাওয়া সেই নাপিতের বেটা। ছাড়া পেয়েই আবার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে৷ রানীমা দয়ারামকে বললেন বাকি দুই ব্যক্তির বর্তমান অবস্থান সম্বন্ধে খোঁজ নিতে। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল। খুব তাড়াতাড়ি খবরও এসে গেল দরবারে। রানীর আদেশ পাবার পরে চর বললেন, 
'রানীমা, বিচারের পরেরদিনই প্রথম ব্যক্তি ঘৃণায়, লজ্জায় আত্মঘাতী হয়েছেন। দ্বিতীয়জন নিজের পাপকাজ শুধরে নিয়েছেন এবং ফিরে গেছেন শাস্ত্র পড়াশোনায়।'
রানীর বিচারপদ্ধতিতে নিস্তব্ধতা নেমে এলো সভায়। অবাক দৃষ্টিতে একবার পর্দার ওপাশ থেকেই বয়সে ছোট রানীমার পায়ে হাত দিয়ে মনে মনে প্রণাম করে নিলেন দয়ারাম। তিনি বললেন 'সকলকে এক বিচারে শোধরানো যায় না। কাউকে অল্প ভৎসনা করলেই সে শোধরায় আবার কেউ স্বভাবদোষে হাজার শাস্তির পরেও জন্মজন্মান্তরেও বদলায় না।'
দয়ারাম বললেন 'হ্যাঁ মা, এই নাপতের বেটা ছয়মাস শাস্তি পেয়েও বদলায় নি। এই হতভাগা স্বভাবচোর। চুরিই ওর পেশা। ওর জন্য কয়েদবাসই উপযুক্ত শাস্তি।'
বিচারের সময় অপরাধীর পারিপার্শ্বিকতা আর মানসিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে তবেই সাজা শোনানো তাঁর রাজ্যের নিয়ম। তিনি অর্ধবঙ্গেশ্বরী। রাজশাহী নাটোরের মহারানী স্বর্গীয় রাজা রামকান্তের মহিষী রানী ভবানী। বিয়ের আগের নাম গৌরী। রূপে গুণে স্বয়ং অন্নপূর্ণা। নাটোর, রাজশাহী, বগুরা, রংপুর, যশোর, কুষ্টিয়া থেকে মালদা, বীরভূম পর্যন্ত তাঁর বিশাল এস্টেট। লোকে কেন তাঁকে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বলবেন না? মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে প্রতি বছর প্রায় সাত লক্ষ সিক্কা টাকায় রাজস্ব জমা পড়ে তাঁর কল্যানে। সারা বাংলায় এত বড় এস্টেট ও এত বিশাল অংকের খাজনা আর একজনও জমিদার দেন বলে জানা নেই। নবাবও খুশি। মাত্র ৩২ বছর বয়সে স্বামী রামকান্তের মৃত্যুর পর নিজে সনদপত্র সমেত সমস্ত জমিদারি স্বয়ং তুলে দিয়েছেন রানীর হাতে। বিশাল এস্টেটের চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর তাঁর। কোন অঞ্চলে প্রজাদের জলকষ্ট, সেখানে খুঁড়ে দেন একাধিক পুকুর ও জলাশয়। খাদ্যের অভাব ঘোচাতে পাঠান অগাধ শস্য। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে যখন হাহাকার করতে করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে মানুষ, তখন তিনিই নিয়ম করে প্রায় প্রতিটি পরগনায় একনাগাড়ে জুগিয়েছিলেন সাহায্য। কখনো খাদ্য, কখনো বস্ত্র দিয়ে প্রজাদের দিকে মায়ের মত বাড়িয়ে দিয়েছেন আশীর্বাদের হাত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠছে তারা। রানীর একমাত্র কন্যা সাতরাজার ধন তারাসুন্দরী৷ দুই পুত্রের জন্মের পরে পরেই মৃত্যু। তারপরই কোল আলো করে এই তারার জন্ম। রাজা রামকান্তও চোখে হারাতেন একমাত্র মেয়েকে। সাত বছরের বিজোড় বয়সে নাটোর রাজবংশের একমাত্র নক্ষত্র তারার বিয়ের ঠিক করলেন রানীমা। পাত্র রাজসাহীর খাজুরা গ্রামের সম্ভ্রান্ত লাহিড়ী বাড়ির উজ্জ্বল তরুণ। বিয়েও হয়ে গেল রমরম করে। নাটোর রাজকন্যার বিয়ে বলে কথা। ঢাক ঢোলের বাদ্যে মেয়ের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন মা ভবানী। কিন্তু মেয়ের কপালে সুখ সইল কই৷ বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই সব অন্ধকার করে বিধবা হল তারা। আবার লোকলস্কর দিয়ে নিজের মেয়েকে বাপের ঘরেই নিয়ে এলেন রানী। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, 'আজ থেকে নিজের ঘরেই থাক মা। আজ থেকে তোকে নিয়েই সমস্ত তীর্থে তীর্থে ঘুরব।' 
এই সেই বঙ্গেশ্বরী, যাঁর ছোঁয়ায় নিজের রাজপাট থেকে আপামর বাংলা, সবকিছুই পরশ পাথরের মত সোনা হয়ে যায়। যাঁর কল্যানে বাংলা থেকে সুদূর কাশী পর্যন্ত তীর্থযাত্রার সুবিধার জন্য নিমেষে তৈরি করা হয় রাস্তা। দিকে দিকে তৈরি হয় অজস্র মন্দির। কাশীতে ভবানীশ্বরী মন্দির তার মধ্যেই একটি। কিন্তু মেয়ের যন্ত্রণা তাঁর যে আর সহ্য হয় না। একরত্তি মেয়ের বৈধব্য তাঁকে তিলে তিলে হত্যা করে প্রতিদিন। অবশেষে উপায়হীন রানী সিদ্ধান্ত নেন নাটোর ও রাজপাট ত্যাগ করবার। ছেড়ে যাবেন অকূল সম্পত্তি। কিন্তু রক্ষা হবে কিকরে। অগত্যাই একদিন দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণকে সমস্ত এস্টেট বুঝিয়ে রানী চড়ে বসলেন নৌকায়। গঙ্গার তীরবর্তী কোনও জায়গা পছন্দ করে আজ থেকে বাকি জীবনটা থাকবেন তিনি। জায়গাও মিলে গেল খাসা। আজিমগঞ্জের কাছে বড়নগর গ্রাম। সেখানেই রয়েছে নাটোর এস্টেটের এক ঠাকুরবাড়ি। রানী ও তারাসুন্দরী উঠলেন সেখানেই। রাজ্যপাট ছেড়ে সে এক সাধিকার জীবন। প্রায় ৫০ বছরের বিশাল রাজত্ব হেলায় ছেড়ে রানী মন দিলেন ধর্মকর্মে। সঙ্গী তাঁর তারাসুন্দরী। এদিকে রানীমার অবর্তমানে রাজধানী নাটোরের অবস্থা শ্রীহীন। রামকৃষ্ণ মেতে থাকেন আধ্যাত্মিক সাধনায়। তাঁর বিন্দুমাত্র মন নেই রাজকার্যে। এভাবেই চলছিল কিছুদিন। স্বভাবতই এস্টেটের দিকে চোখ পড়লো সদ্য ভারতবর্ষের ক্ষমতা বুঝে নেওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। হঠাৎ ধেয়ে আসা বাজপাখির মত রানী ভবানীহীন নাটোরে উড়ে এলো শমন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের চিঠি। নিলামে উঠবে এস্টেট। বিক্রি হয়ে যাবে অর্ধবঙ্গেশ্বরীর প্রাণের রাজসাহী৷ নিজের শক্তিবলে রাজ্য আগলানোর জন্য আজ আর নেই কেউ। নেই রানীর মমতার হাতও। নেই বিদেশীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও৷ পাল্টে গেছে বাংলার শাসকের চরিত্রও। নবাব পরিণত হয়েছেন হেস্টিংসের কাঠের পুতুলে। মাসে মাসে মাইনেভোগী কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নন তিনি। সুতরাং কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। নাটোরের অকূল সম্পত্তি ভাগ হল। অংশীদার হলেন অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বড়নগরে মাটি থেকেই একমুঠো ছাই সরিয়ে অর্ধবঙ্গেশ্বরী হাসলেন মনে মনে। নিজের অজান্তেই গেয়ে উঠলেন ছেলেবেলায় গাওয়া সেই গান -
'মাগো আর কতকাল এ ভব যন্ত্রণা 
যাতায়াত ক্লেশ         হবে নাকি শেষ
জনমে জনমে আর যে পারি না।।'


(চিত্রে- নাটোর রাজবাড়ী) 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন