পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

নন্দিনী পাল




দোলাচল


বাগানের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে আছেন পারুলদেবী। গাছটার নীচে বেড়ালটা তার ছো্ট ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বসে আছে, পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে। পারুলদেবী চুলের বেশীরভাগটাই সাদা, ঝাপসা চোখের দৃষ্টি বেশীদূর পৌঁছয় না। আগে বিকেল হলে সবাই জড়ো হতেন পার্কে। গল্পগুজব, একে অন্যের সুখ দুঃখের খোঁজ খবর নেওয়া, সময় কেটে যেত বেশ। কিন্তু যখন থেকে করোনা রোগটা শুরু হয়েছে, তখন থেকে পার্কে যাওয়া বন্ধ। যে যার ঘরের ছোট খুপড়িতে একা একা সারাদিন বসে থাকা। সময়তো কাটে না। ছেলেটার জন্য মন কেমন করে পারুলের। সুদূর আমেরিকায় থাকে, অনেক বছর হল। কত্তা গত হবার পর নিয়ে গেছিল সে দেশে। খুব সুন্দর দেশ, শুধু সারাদিন কথা বলার লোক নেই। ছেলে বৌ অফিস বেরিয়ে গেলে এটা সেটা রান্না করে সময় কাটাতেন। তখন বয়সও কম ছিল। শরীরটা নড়বড়ে হতে ছেলে বলল এখানে দেখাশুনার লোক পাওয়া যাবে না। অগত্যা কলকাতার বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই মিলল। তখন রাতে অফিস থেকে ফিরলে ছেলেটার সাথে দুচারটে কথা হত। এখন প্রতি হপ্তায় ফোনে কথা হয়। গত দুসপ্তাহ ছেলেটা ফোন করেনি। কাজের মেয়ে স্বপ্না বলছিল রোগটা নাকি বিদেশেও ছড়িয়েছে। অনেক লোক মারা যাচ্ছে। সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে ঘরে। মেলামেশা নাকি বন্ধ। অজানা আশংকায় মনটা উতলা হয়।ছেলেটা কেমন রইল কে জানে, বৌমা, নাতি- নাতনি।দেওয়ালে টাঙানো ভগবানের ফটোটার দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করেন –ওদের ভালো রেখো। বেড়াল ছানাগুলো মায়ের সাথে খেলায় মেতেছে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন-সন্তানরা মায়ের আঁচলের তলায় থাকে না চিরকাল। একদিন না একদিন ছায়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নিজেদের জগতে। ঐ বেড়ালছানাগুলোও মাকে ছেড়ে একদিন চলে যাবে।
বাগানে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে স্বপ্না চেঁচিয়ে বলে – জান তো মাসি সেই নীলিমা মাসিকে আজ হসপিটালে নিয়ে গেল। কয়েকদিন জ্বর কাশি হচ্ছিল আজ সকাল থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল।মনে হয় ওই রোগটাই হয়েছে। বাঁচবে কিনা কে জানে!
-ওর ছেলে মেয়েকে খবর দিয়েছে।   
-কেয়ার সেন্টার থেকে ওদেরকে আসার জন্য বলবে বলছিল। হসপিটাল থেকে বলছে এই লকডাউনে আসবে কি করে। তাছাড়া হসপিটালে তো আর দেখা করতে দেবে না। এ রোগে কাউকে নাকি দেখা করতে দেয় না। হয় সেরে বাড়ি ফেরো নয়তো একেবারে চলে যাও পৃথিবী ছেড়ে। সাবধানে থেকো সব।
   নীলিমা তার বন্ধু। ওর ছেলেমেয়েরাও বাইরে থাকে। পারুল আগে ভাবতেন কি জানি মৃত্যুসজ্জায় ছেলের হাতের জল পাবেন কিনা।এতদূরে থাকে, ঠিকসময়ে না পৌঁছলে ছেলের হাতের আগুনও হয়তো জুটবে না। আজ সব সংশয় মিটে গেল। ছেলেটা মনে মনে কষ্ট পাবে না। তারও মনে কোন আক্ষেপ থাকবে না। নীলিমার মত যেতে পারলেও শান্তি।
পাশের ঘর থেকে হঠাৎ কান্নার আওয়াজ পেয়ে ছুটে যান পারুল। এই হোমে থাকে রমা। অশীতিপর বৃদ্ধার মেয়ে দিল্লীর হাসপাতালে মারা গেছে করোনায়। সন্তান হারানোর দুঃখে কাতর বৃদ্ধার চোখের জল বাঁধ মানছে না।পারুলের মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘর মুখো হন।ফোনটা বাজছে। চোখ বন্ধ করে ভগবানকে ডাকতে থাকেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন