পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

রোহিণী ধর্মপাল

                             

গৌরী ধর্মপালঃ বড় যখন ছোট হয় 

গৌরী ধর্মপাল। বাইরে যেমন, ভেতরে ঠিক তেমনটি। এ কিন্তু বড় সহজ নয়। ভেতরের সুরের সঙ্গে বাইরের সুরটিকে মেলানো। অত্মরাত্মার সঙ্গে বহিরঙ্গকে এক করে দেওয়া। দুই ক্ষেত্রেই শুধু এ সম্ভব। শিশু হলে অথবা ঋষি হলে। ভেবে দেখুন, শিশু আর ঋষির মধ্যে কতগুলি সাদৃশ্য আছে। শিশু সহজ সরল। যতক্ষণ না সমাজ তাকে জটিলতা কলুষতা শেখাচ্ছে। শিশুকে মিথ্যা বলতে আমরাই শেখাই কিন্তু। শিশু তার কল্পনার প্রসার ঘটায়। সেই কল্পনাকে মিথ্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে মস্ত ভুল হবে। শিশুর কাছে ওই কল্পনাই সত্যি। মনস্তত্ত্বে একটা দুর্দান্ত তত্ত্ব আছে। সর্বপ্রাণবাদ। এও কিন্তু ভারতীয় দর্শনেরই তত্ত্ব যেন; তবে তখন তা বড়দের তত্ত্ব। কিন্তু ছোটদের এই তত্ত্ব আর বড়দের দার্শনিক ভারিক্কি তত্ত্বের মূল ধারণাটি এক। আর তা হল, সব কিছুর মধ্যেই প্রাণ আছে। তা জীব হোক বা জড়। আর ছোটদের মধ্যে কিভাবে এই তত্ত্বটি কাজ করে? আপনাদের মধ্যে কে কে ভাবেন নি বলুন তো, যে চাঁদমামা আপনাকেই ভালোবেসে আপনার সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় যায়? হিসেব কষতে আমার সুবিধা হবে। অঙ্কে কাঁচা তো! কে কে ভেবেছেন বললে সংখ্যাটা এত বেড়ে যাবে যে গুণে উঠতে হাঁপিয়ে যাব! কারণ সারা পৃথিবীর শিশুরা চাঁদ নিয়ে ঘুরেফিরে এমনটাই ভাবে! বড় হওয়ার পরেও, একটু চিন্তা করুন, টানা বৃষ্টির পর রোদ উঠলে মনে মনে ভাবি, আমার জন্যেই এই আলো! আবার খুব কাজের দিনে অবিরল বৃষ্টিপাতে মনে ভাবনা আসে, আজ এত দরকারি দিনটা! আজকেই বৃষ্টি শুরু হল এমন! ঘুরেফিরে কিন্তু নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে আমরা বড়রাও যুক্ত করে দি! শুধু বাইরে বলি না। সচেতন মনে জানি, এ নেহাতই বোকা বোকা। সবাই শুনলে হাসবে! শিশু এসব ভাবনদারির তোয়াক্কা করে না। সে হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, কী মজা কী মজা! আমিও যাচ্ছি, চাঁদমামাও যাচ্ছে। ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল, প্রতি স্টেশনে ট্রেন থামার পর, ভেতরে থেকে ট্রেনের জানলাতে যে ধাক্কাটা আমি দিই, তাতেই আবার ট্রেন চলে! নিজের বিপুল শক্তি সম্পর্কে গর্ববোধ হতো না, কারণ ওটাই স্বাভাবিক ছিল! আমি না ঠেললে ট্রেন চলবে কী করে!!!
আমার বিশ্বাস, আপনাদের অনেকেই ছোটকালে এমন শক্তিধর ছিলেন! ছোটদের শক্তিশালী হতে গায়ে জোর লাগে না! মনের সারল্য দিয়েই  ডানায়ালা পরীরা তাদের সঙ্গে কথা বলে যায়, পক্ষীরাজ ঘোড়া তাদের পিঠে চাপিয়ে তেপান্তরের মাঠে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সঙ্গে দেখা করিয়ে আনে, ভাঁটার মত চোখ আর মূলোর মত দাঁত নিয়ে রাক্ষসেরা ভয় দেখায়! এ যদি মিথ্যা হয়, তবে এ মিথ্যা বড় মোহময়, বড় মধুর! কিন্তু গৌরীর এই সারল্য আজীবন ছিল! নয়ত এমন লিখলেন কি করে ----" কারিগর বানায় সব আজব আজব জিনিষ--
পিঁপড়েদের পায়ের নূপুর--
     সারাদিন আসবে যাবে
      ঝুমঝুম শব্দ হবে।
প্রজাপতি পাখার ঢাকা --
     সারা বছর রোদে জলে
      রঙ যেন না জ্বলে গলে।
ঘাসপোকা-পুকির ওড়না--
   আহা, ওরা বড্ড লাজুক 
   ওড়নায় মাথাটি ঢেকে
           সহজে চলুক ফিরুক।"
আর এসব বানাতে কারিগরের কি কি লাগে? গৌরী লিখছেন, 
       "নীল মাকড়সার জাল
সন্ধে মেয়ের এলোচুলে                              জোছনা জরির জাল।
       টাটকা দুধের ফেনা
ঝরছে ঝরুক ঝরছে ঝরুক 
ধান-শিশিরের কণা।
মেঘডম্বর কু  য়া  শা
শিমুলতলার তুলো।
ঘাসের বনে কে ছড়ালি রাঙা রোদের গুঁড়ো ।
   শিরীষ ফুলের রোঁয়া 
   পুজোবাড়ির ধোঁয়া 
    উড়াল পাখির পালক। 
     ভোরের হাওয়ার ঝলক।
   শোলার পঙ্খী শোলার ফুল সুখু মেয়ের রুখু চুল--এই সব।"
 
শিশু-মন ছাড়া রোদের গুঁড়ো জোছনা জরির জাল মেঘডম্বর কুয়াশা কি দেখা যায়? রাজকন্যা চাইলেই কি হাওয়ার মত হালকা আর রোদের মত শাড়ি, বৃষ্টি-রিমঝিম নূপুর আর সুরসুড়ি পাতার ঘন্টি লাগানো শুঁড় তোলা কাশ-ফুরফুরে জুতো বানাতে পারার মত কারিগর নির্মাণ করা যায়?

ঠিক একই রকম সৎ সহজ হলেন ঋষিও। সৎ চিৎ আনন্দ, এই দিয়ে তাঁর অন্তরাত্মার আকাশ গড়া। ঋষি কে? না যিনি সত্যবাক্। যিনি জ্ঞান ও সংসারের পারে চলে যান। জ্ঞানের পারে যাওয়া মানে কি? অর্থাৎ তুমি জেনেছ। অথচ জানার জন্য যে অহম্ হওয়ার কথা, সেটি হয় নি। হবেই বা কি করে! যে জানে, যে জেনেছে, সে এও বুঝে গেছে যে সেই সর্বশক্তিমান আর তুমি এক। যে ঈশ্বরের সাধনা ভজনা করে সবাই, যাঁর কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে; আর তুমি, একটা সাধারণ ময়লা মত, কোণের দিকে একটু ছেঁড়া মত, রান্না করছ বা আপিস করছ; আসলে এক! তখন আর অহম্ টি থাকে না। না জানলেই যত বড় বড় কথা আসে। নিজের সম্পর্কে বড় বড় ভাবনা আসে। যিনি জেনেছেন, তিনি সমাহিত হয়ে যান।
আর সংসারের পারে যাওয়া? শুনতে সহজ কিন্তু বড়ই দুরূহ। ঝগড়া ক্ষমতার লড়াই জটিলতা ঈর্ষা লোভ সব গিজগিজ করতে থাকে তো মনের মধ্যে! সেই সব নোংরা কাদা ঠেলে ক'জন পারে সেই গভীর অন্ধকারের পথ পেরিয়ে যেতে?
এই অন্ধকারটিকে আবার অন্ধকার বলে চেনা কঠিন। এই বাইরেটা চকচকে চোখ ধাঁধানো আলোতে আপাদমস্তক মোড়া। ভেতরটা ঢনঢনে। কিন্তু ঋষি যিনি, তাঁর মনের মধ্যে টিমটিম করে জ্বলে প্রাণের প্রদীপ। সেই স্বল্প আলো দিয়ে তিনি বুঝে যান কোনটি অবিদ্যার আলো, কোনটি বিদ্যার আলো। গৌরী ছিলেন এমন এক ঋষি। সেই বেদের যুগের ঋষিদের মতোই। জ্ঞানের গরিমায় যেন বাক্, প্রতিবাদের তেজে যেন গার্গী, গৃহকর্মে সন্তান প্রতিপালনে যেন কাত্যায়নী। সবেতে খুশি। কোনো চাহিদা নেই। লোভ নেই। ঈর্ষা নেই। আড়ম্বর নেই। বাইরের সাজ নেই। যত মধু যত স্নেহ মায়া দিয়ে হৃদয়টি এদিকে সোনায় মোড়া। এমন মানুষই তো শিশুদের জন্য লিখতে পারেন অনায়াসে। এমন লেখনী না হলে শিশুদের জন্য ভালবাসার গল্প লেখা যায়? এই পৃথিবীর মাটিতে বড় হওয়া চাঁদনি আর আকাশের চাঁদের প্রেমের গল্প?
" শুধু একেকদিন পূর্ণিমার রাতে চাঁদের সাধ যায় চাঁদনীকে নিয়ে পাড়ি দিতে, সেই চাঁদ-দূরে দুটি রূপোলি মাছের মত নীল জোছনার শায়রে ভাসতে ভাসতে। ভুবন-মা বলেন, যাস নেরে, যাস নে। চাঁদ তবু যায়। অমনি মায়ের বুক টনটন করে ওঠে। শিরায় শিরায় টান ধরে।
বুকের সাগর উঠাল পাথাল করে। বট শিমুল দেবদারুর মাথা পর্যন্ত গিয়ে আটকে যায় চাঁদ। ভুবন -মা বাড়িয়ে ধরেন তাঁর অলখ রশির মই। তাই বেয়ে তারা নেমে আসে। একজোড়া চাঁদ ৷ চাঁদ আর চাঁদনী।" (চাঁদনি)

 



৫টি মন্তব্য:

  1. কত সরলভাবে লেখা। আর কী সুন্দর!

    উত্তরমুছুন
  2. এই রকম লেখাগুলো দিয়েই ভরে ছিল আমার শৈশব আর কৈশোর।

    উত্তরমুছুন
  3. বড়ো ভালো লিখেছেন।মন ছুঁয়ে গেলো।ওঁকে বরাবর খুব শ্রদ্ধা করি একজন জ্ঞান তপস্বী হিসাবে।আজ ওঁর লেখা ছড়া পড়ে বুঝলাম কি গভীর জীবনবোধ আর চিন্তার উৎকর্ষ ছিল মানুষটির

    উত্তরমুছুন