পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                 



সাইকেল

তৃতীয় পর্বের পর 

৪) 

   অভিজিতের সঙ্গে ওদের বাড়িতে পৌঁছল সামুয়েল। শহরে এসে বাইকস্ট্যান্ডে নিজের বাইক রেখে দেয় অভিজিৎ। সেই বাইকের পিছনে বসে প্রায় ঘন্টাখানেক জার্নির পর ওদের গ্রাম। এই সেই বরবরুয়া গ্রাম, ছবির মতো সবুজ ও সুন্দর। প্রথম দেখেই এই গ্রামের প্রেমে পড়ে গেল সামুয়েল। তারপর যে ওর বাড়িতেও আরেক দফা বিস্ময় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল, সে ওর ধারনার বাইরে ছিল। ওদের বাড়ির এলাকা গাছের বেড়া দেওয়া। ভেতরে কিছুটা অংশ পাকা বাড়ি, দেখলেই বোঝা যায়, নতুন তৈরি হয়েছে। আর পিছনের দিকে মাটির বাড়ি, মাটির দেওয়ালে আবার সুন্দর কল্কা, ফুল, বাঘ, হরিণের ছবি আঁকা। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। যদিও অভিজিৎ ওকে পাকা বাড়িতেই এনে তুললো। অভিজিতের ঘরেই এলো ওরা। সুন্দর, পরিপাটি, বাহুল্যবর্জিত ঘর। ঘরের একপাশে একটা খাট, আলনা, আর কাঠের চেয়ার, টেবিল। ব্যস্‌। কুলুঙ্গির মতো একটা জায়গায় আয়না টানানো রয়েছে। টেবিলে অভিজিতের ছোটবেলার ছবি একটা। দুচারটে বই। চেয়ারে বসল সামুয়েল। অভিজিতের বাবা মা এলে হাতজোড় করে প্রণাম করল ওদের সামুয়েল। অভিজিৎ জানাল, ওর এক ছোট বোন আছে, ইলেভেনে পড়ে, এখন স্কুলে সে। খুব পাজি নাকি সে! একটা সুন্দর হাসিখুশি পরিবারে এসে সামুয়েল সাতদিনের জন্য আস্তানা গাড়ল। অভিজিৎ রইল পাশের ঘরে, যে ঘর ফাঁকাই পড়ে থাকে। বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাল সামুয়েলকে ও। বাবা মায়ের ঘরের পাশেই এক চিলতে বারান্দা ঘিরে পড়ার টেবিল-চেয়ার। ওখানেই নাকি ওর বোন পড়াশুনো করে। মাছের ঝোল দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে টেনে ঘুমলো সামুয়েল। ওকে এভাবে তৃপ্তি করে খেতে দেখে অভিজিতের মাও খুব খুশি! ফলে একাত্ম হতে সামুয়েলের একটুও সময় লাগল না। বিকেলে চা দিতে এলো কাকিমা। অভিজিৎ তখন টেনে নিয়ে এলো বোনকে। রোগা, পাতলা গড়নের এক কিশোরী সে। টানা টানা চোখ, এক ঢাল কালো কোঁকড়া চুল কপাল ঢেকে রেখেছে তার। শ্যামলা মেয়েটির মুখে একটা আলগা শ্রী আছে, এটুকুই। আর রয়েছে চোখ ভর্তি বিস্ময় আর দুষ্টুমি। সামুয়েলের সামনে প্রাথমিক জড়তা কাটছিল না তার। যেহেতু ইংরেজি বলতে সে সড়গড় নয়, তাই কথাবার্তাও কিছু হল না। একটু ফিকে হাসি হেসে বসে রইল খাটের ওপর। আর অনবরত ঠ্যাঙ দুলিয়ে যেতে লাগল। চা পর্বের পর, একসময় সামুয়েল আর পারল না। বলেই ফেলল। ‘তুমি কি পা না দুলিয়ে থাকতে পার না?’ ওর কথায় হকচকিয়ে গেল সেই মেয়ে। আর অভিজিৎ হাহা করে হেসে উঠল। রাগে দাদার দিকে চোখ পাকিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল ও। ওর নাম বুলবুল। সামুয়েল জানল যে বুলবুল এক পাখির নাম। যদিও বুলবুলের একটা পোশাকি নামও আছে। শ্রীময়ী।  

     রাতে খাওয়ার সময় এক ঝলক দেখা গেল বুলবুলকে। অভিজিৎ অনেকবার ডাকল একসঙ্গে খেয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার সাড়া পাওয়া গেল না। আপন মনেই অভিজিৎ বলে উঠল, রাগ হয়েছে! এই এক রোগ ওর। এমনিতে সব ভাল, শুধু রেগে গেলেই তার মান ভাঙাতে ভীষণ সমস্যা। সামুয়েল বুঝল, একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে ও। আন্তরিক ভাবে তাই অভিজিতকে বলল, তুমি তোমার বোনকে একবার ডাক। আমি খুব লজ্জিত। ক্ষমা চাইব ওর কাছে। কিন্তু বুলবুলের আর দেখা পাওয়া গেল না। কিন্তু সে যে আশপাশেই আছে, এবং ওদের কথা কান খাড়া করে শুনছে সেও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেল একটু বাদেই। খেয়ে হাত ধুতে যাওয়ার সময় সামুয়েল শুনল, বারান্দায় এক জোড়া পায়ের শব্দ দ্রুত পালিয়ে গেল। নিজের মনেই হাসল ও। ভাবল, থাক এখন। একটু মজা নেওয়া যাক বরং! হাত ধুয়ে গিটারে সুর তুলে গান ধরল ও-

Como cada noche desperté pensando en ti

Y en mi reloj todas las horas

vi passar

Porque te vas

(প্রতি রাতের মতো, আমি জেগে উঠব, আর তোমার কথাই ভাবব…আমার ঘড়িতে দেখব সমস্ত সময় পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, কারণ তুমি চলে যাচ্ছ…) 


তুষ্টি ভট্টাচার্য

                             


দ্বিতীয় পর্বের পর 

৩) 

  খুব ভোরে উঠে পড়ে সামুয়েল। এ তার পুরনো অভ্যেস। ঘুম থেকে উঠেই সাইকেল নিয়ে কসরত করে সে। সাইকেলটাও যেন এই সময়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এইটুকু সময় শুধু তার আর সামুয়েলের। যেহেতু এই গ্রামের রাস্তার প্রায় সবটাই সমতলে, তাই চড়াই উতরাই ভাঙতে সে চলে যায় ওই দূরের পাহাড়ের দিকে। পাহাড় তো নয়, টিলার মতো। পাথুরে কিছুটা হলেও, সবুজে ঢেকে আছে এখন। পায়ে চলা পথ ধরে সামুয়েল আর তার সাইকেল সোজা উঠে যায় পাহাড়ের মাথায়। সূর্যটাও তখন পাহাড়ের মাথায় এসে হাজির হয়। এতদিনে আশেপাশের বসতির সবাই, মায় এই পথঘাট, গাছপালা, পশুপাখি, সবাই জেনে গেছে যে, এক বিদেশী ছেলের সাইকেলের শব্দে তাদের ঘুম ভাঙবে আর সেই ছেলের গলায় থাকবে ভাঙা ভাঙা অসমীয়া গানের কলি। ঠিক এই যেমন এখন যদি কেউ ওই টিলার মাথায় এসে দাঁড়ায়, শুনতে পাবে…

নিবিড় বনে যে মাতিছে যা/ যা যা দূৰণিলৈ/ হেৰুৱা সুবাসে মাতিছে যা/ সোনৰে সজাটি এৰি থৈ যা/ যা নীলিম আকাশলৈ/ সোনালী ৰদে যে মাতিছে যা/ জোনৰে জোনাকী মাতিছে যা/ যা পখী দূৰণিলৈ/ হেৰুৱা সুবাসে মাতিছে যা

 এই একটি মাত্র গান সে আয়ত্ব করেছে। এই সুর তাকে খুব টানে। অবশ্য জয়ন্ত হাজারিকার বেশ কিছু গানই ভাল লেগেছে ওর, কিন্তু ভাষা আর সুর রপ্ত করতে সময় লাগবে। আর তুলতে হবে ভূপেন হাজারিকার কিছু গান। টিলার ওপর এসে সামুয়েল কিছু ব্যায়াম করে সাইকেল নিয়ে। শরীরে আর এই সাইকেলে জং ধরতে সে দেয় না কোনোমতেই। তাকে সব সময় প্রফুল্ল রাখে সুর আর গান। কত দেশে সে গেছে, কত রকম মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, সব মানুষের মুখ যে ওর মনে থাকে, বা মনে রাখতে চায়, তাও না। কিন্তু সুর সে ভোলে না। কথা ভুলে যায় স্বাভাবিক ভাবেই, কিন্তু সুর মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। কখন যে কোন সুরে সে গুনগুনিয়ে উঠবে বা গিটারে কী যে সে বাজাবে, সেও জানে না! 

  সেদিন অভিজিতের সঙ্গে আলাপের পরদিনই ওরা আবার এক ক্যাফেতে আড্ডা দিতে বসেছিল। অভিজিৎ গরগাঁওয়ে যুবা উৎসবে ওকে নিয়ে যেতে চাইছিল, চাইছিল বলা ভুল, একরকম জোর করছিল ওকে ওখানে যাবার জন্য। খুব বেশি ভিড় সামুয়েলের ভাল লাগে না, তবু অভিজিতের উপরোধে ওকে রাজি হতে হয়েছিল সেদিন। এখন মনে হয়, সেদিন যদি ওই উৎসবে না যেত ও, এই গ্রামে আসাও হত না ওর। অথবা মণিপুর থেকে সে যদি ফেব্রুয়ারিতে আসামের শিবসাগরে না আসত, তাহলেও অভিজিতের সঙ্গে দেখা হত না। সবই বোধহয় পূর্বনির্ধারিত। নইলে কোথাকার কোন বরবরুয়া গ্রাম, আজ তার নিজের ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে! ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল সামুয়েলের মন কেড়ে নিয়েছিল। অসমীয়ার বিহু নাচগান আর সুর, তাল, ছন্দে সে খুব একাত্ম বোধ করেছিল সেদিন। আসলে তার নিজের বাসস্থান যেখানে, সেও তো এমনই এক মায়াময় দেশ। কান্ট্রিসাইডে এক বিরাট খামার রয়েছে ওদের। চাষবাস তাদের পরিবারের রক্তে। আর সুর! তাদের পরিবারের সবারই রক্তের মধ্যেই সুর দৌড়ে বেড়ায়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে মুখে হাসি লেগে থাকে স্রেফ এই অজস্র, অনর্গল গান আর সুরের জন্য। টনিকের মতো কাজ করে। 

  একটানা সাতদিন যুবা উৎসবে ভাগ নিয়েছিল ওরা। এমনও হয়েছে, নিজের গিটার নিয়ে নাচেগানে ওদের সঙ্গে মেতে উঠেছে সামুয়েল। এমন একটা প্রাণবন্ত ছেলেকে, বিদেশি হলেও কাছে টানতে কারুর দেরি হয়নি। শেষদিন অভিজিৎ আর সামুয়েল প্রচুর মদ্যপান করে একসঙ্গে। আর সেই সময়েই অভিজিতের সঙ্গে ওর গ্রামে গিয়ে কিছুদিন থাকতে চায় ও। অভিজিৎ অবাক হলেও, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। যদিও একটু কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল ওর…একজন সাহেবকে নিয়ে গিয়ে কোথায় থাকতে দেবে, কী খাওয়াবে, ওইরকম গ্রামে সাহেব কি থাকতে পারবে আদৌ…এইসব নিয়ে যখন মনে মনে ভাবছে অভিজিৎ, ভরপেট মদ খেয়েও সামুয়েল কী করে যেন ওর মনের কথা ধরতে পেরে গেছিল। নিজেই জড়ানো গলায় আশ্বাস দিয়েছিল, আমাকে নিয়ে ভেব না। এই সাইকেলে আমি কত যে দেশ ঘুরেছি, কত গ্রাম, জঙ্গল, পথঘাটে না খেয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে, জল পর্যন্ত ফুরিয়ে যেত একেক সময়ে, ফলে আমাকে নিয়ে টেনশন কর না। তোমরা যেমন ভাবে থাকবে, আমাকেও সেভাবেই রাখবে।

   তবুও দুরুদুরু বুকে সামুয়েলকে নিয়ে গ্রামে এসেছিল অভিজিৎ। ঠিক হয়েছিল সাতদিন থাকবে এখানে সামুয়েল। তারপর রওনা দেবে দেশের উদ্দেশ্যে। ততদিনে টিকিট কেটে রাখতে হবে। কারণ ওর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে।        


(ক্রমশঃ)

শৌনক দত্ত

                                       




সৃজন এই সংখ্যার কবি শৌনক দত্ত।জন্ম - ৭ ই আগষ্ট( ২১ শে শ্রাবণ ) কোচবিহারের ব্যাঙচাতরা রোড। স্কুল জীবন শুরু জেনকিন্স -এ আর সেই সময় থেকেই লেখালিখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিনের। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত।

প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ :

জল ভাঙে জলের ভেতর (২০১১)

ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ (২০১২)

ডুব সাঁতার (২০১৭)

নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ (২০১৭)

গল্প গ্রন্থ :

কারুময় খামে অচেনা প্রেম (২০১২)

শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা, ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন।

রা' প্রকাশন থেকে দুই মলাটে বন্দী হতে চলেছে তাঁর প্রবন্ধের সমাহার।


পরকীয়া

অন্য  বিছানায় শুয়ে 

সমুহ সময় 

ধাতস্থ হবার

 আগে অন্যকেউ

 মুখস্থ করে ফেলে 

নকশীকাঁথা বুনন।

বৃষ্টির নকশীকাঁথা তুমি আমাকে উপহার দেবে

আর

আমি তোমাকে উপহার দেব নিঝুম দ্বীপের শাড়ি।


কুয়াশা ভেজা রোদ,দুপুর

০৭ জানুয়ারি,২০১৮



আমার ছেলেবেলা

যে-শহরে বেড়ে ওঠা-তার ডাকটিকিট জুড়ে পাহাড়। যখন-তখন আমরা সর্ষে ফুলের গন্ধ পকেটে নিয়ে পাহাড়ে যেতাম। বড়রা যেত সমুদ্রস্নানে।তোর্ষার বাতাসে ভেসে বেড়াত তাদের অলৌকিক মেয়েবন্ধুদের শিহরণজাগানো সব ফিসফাস। ঢেউয়ের ডানায় চেপে ‘লাল দোপাট্টা’ উড়িয়ে তারা ফিরে আসতো।আমরা রঙধনু বোতাম খুলে উড়িয়ে দিতাম ঘুড়ির শৈশব।


শীত সন্ধ্যা,আশ্রম

১২ ফেব্রুয়ারি,২০১৮


আমার শরীর


তোমার সাথে কাটানো যে শরীরটা রোদ ভাঙলো ...

সে শরীর প্রতি রাতে পাহারা দিই, 

দেখি 

এক নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের দিকে দরজা খোলা

যেখানে ধ্যানী বয়স শিরার ভেতর বিশ্রাম নেয় 

অবসন্ন জাহাজ চোখে অবতরণ করলে

আমরা প্রতিবিম্বিত হই

জোছনায় বোনা লাইট হাউজে।



বেডরুম,মধ্যরাত

১২ আগষ্ট,২০১৮



নির্জনতার ডাকনাম মৃত্যু


জন্ম খুলে বসে আছে মৃত্যুর বিস্ময়,একটা প্রেমহীন আয়নায় প্রতিদিন মুখগুলো গলে যায় রোদের বিকালে মৃত ডুমুরের নীরবতায়। ক্রমশই রহস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে চিলেকোঠায় পুরোনো চিঠির বান্ডিলে শব্দের সিম্ফনি, নৈঃশব্দ্যের নিঃশ্বাস।

বল “মৃত্যু” এবং পুরো বাড়িটা জমে যায়—


পড়ন্ত বিকাল, স্টাডি

০৩ জানুয়ারি,২০১৯



হঠাৎ পাওয়া ছেলেবেলা...


রাফ খাতা ভর্তি দুপুর, সাইকেল নির্জনতা

সেই সব ছায়াপথ… সেই সব মুখরতা

হঠাৎ পাওয়া ছেলেবেলা!

ঘড়িপাড়ার পুল পেরিয়ে স্মৃতি বনের পাশ দিয়ে যে রঙ্গীন ঢালু পথ চলে গেছে, তার শেষ মাথায় সুনসান একটা ছেলেবেলা দাঁড়িয়ে । নয়নাপাড়ায় কুটুম্ব বৃষ্টি নামলে নির্জনতার বুকে জমা হওয়া সমস্ত বিষন্নতার সংগীত আমার মুখস্থ আমি তার স্বরলিপি লিখে রেখেছি জং ধরা নীল বেহালার তারে.

ফেরিওয়ালাঘুম দুপুরে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা পথের উড়নচন্ডী ধুলোয় যত হাহাকার ডুবে থাকে,সোনালী, রুপালী আধুলির ছক আঁকতে আঁকতে খুব তাচ্ছিল্যে আটকা পড়েছে আমার যাবজ্জীবন আমার ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিলের পাশে,

সে পথ আমার সমগ্র সংসার হারিয়ে ঘরের দিকে ফিরে যাওয়া......

শীতে বেডরুম ঢাকা, 

মধ্যদুপুর

০৫ জানুয়ারি,২০১৯




শীত ২০১৯



দিন গুলো অ্যাজমাটিক… নিঃশ্বাসের টানাপোড়েন। আমাদের নাগরিক জনপদে শীত আসে দূরবর্তী মফঃস্বল থেকে উলাক্রান্ত জানালায় । শীত এলো আমাদের শহরে, শীতের গল্প নিয়ে....

আমাদের ক্যালেন্ডার শীত রঙের দাগে ভরে যাচ্ছে, হিমফুল চোখে প্রতিদিন দেখি। রঙিন শিশির বিন্দু বিন্দু মুগ্ধতায় নির্বাক বায়োস্কোপে ছবি হয়ে ফোটে। অমিলিত বিচ্ছেদে তুমি শেষমেষ দুরত্বপ্রবাল।

পায়ের ছাপ হারিয়ে যেতে যেতে হলুদাক্রান্ত দুপুর গুলো বাজেয়াপ্ত । শৈতপ্রবাহ শেখায় দুই অক্ষরের মাঝে বিচ্যুতির ব্যবধান। বার বছর আগের একটা শীতার্ত প্রেম কম ভোল্টেজের আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বুকের ব্যালকনিতে, প্রায়ই। খুব উসখুস ৷ একা একা এক কাপ লাল চায়ে ঊষ্ণতার ঘ্রাণ এবং কতিপয় দৃশ্যের বিষন্ন জলরঙ,

অথচ আমার কিছুই জানা হয়না…

শুধু শুধু সারাটা শীতঘুম জুড়ে সুনীতি হাইস্কুল

পুকুর ঘাটে সবুজ পাড়ের শাড়ি পুড়ে যায়, যাচ্ছেতাই....


সন্ধ্যা,বেডরুম

০৬ জানুয়ারি,২০১৯








শহরের শীতকালীন উৎসব

___________________________

আজকের আবহাওয়ায় কোন শোক নেই ।

জাহাজ ভিড়েছে 

নাবিকের সমুদ্র ভেজা নিঃশ্বাস ঢুকে পড়ছে... শহরে, অলিতে গলিতে ।


নিশুতি যাপন… খুব অগোচরে, 

যেমন করে পড়ে থাকে ঘুমের ভেতর বহুকাল আগের আধুলি স্বপ্ন ।

কবরের নৈঃশব্দ্যে সন্ধ্যা নামছে ৷গ্রীলে ঝুলছে তরুনী বউদের রাত্রিকালীন পোষাক । 

এখানে আমার কোন উপাসনালয় নেই ।


মাঝেমধ্যেই রানিপুরম ধরে ধরে একটা সুড়ঙ্গ পথে যেতে সাধ হয়

যে পাহাড়ের নিচে রেখে এসেছি সোনারঙ ‍দুপুর, 

রাতের ডুব, কিছু ভেজা আঙুল ।


আমি বাড়ি ফিরে এসেছি... অগোচরে 

দূরে... দূরে সরে যাচ্ছে বন্দর

ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে গুটিয়ে থাকা পথের রঙ ।

মধ্যদুপুর

১৬ জানুয়ারি,২০১৯


নগর

_______

ঝুপঝাপ সন্ধ্যা নামছে

গাছ মুছে দিয়েছে

রোদের যৌবন

করিডোরের অশ্রু চেটে নেয় অন্ধ স্ট্রীট লাইট

হেঁটে যায় জ্যামিতি-বক্সের দিকে-

ঠিকানাবিহীন এক চিঠি

গতি কামড়ে ধরেছে পা

পাতায় পাতায় ভেঙে পড়ছে ঘর-বাড়ি

উটের ছায়ায় ছায়ায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে নগর।


সন্ধ্যা,নগরের পথে

২০ জানুয়ারী,২০২০


ফ্যান্টাসি

__________

পেরেক আর দেয়ালের প্রেম নিয়ে কথা ফুরালে

চুমু থেকে উড়ে যায় ঠোঁট

শপিং মলের ভেতর জ্বল জ্বল করছে

এক আকাশ তারা।

জঙ্গল সাঁতরে ফিরে এসেছে ঘুম

যুবতীরা টুপটাপ ঢুকে পড়ছে আধ খাওয়া আপেলে

পাটিগণিতের প্রস্তাব থেকে

গড়িয়ে পড়ছে ঘুঙুর।

ভোরবেলা!

নদীর শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পোড়াবাড়ির গন্ধ!


মধ্যরাত, ব্যালকনি

২৩ জানুয়ারী,২০২০



মাধুকরী হাতে নিয়ে

___________________________



পোয়াতি পালক থেকে ঝেড়ে ফেলো অতীতের সব পাণ্ডুলিপি। জানো তো-

সুতীব্র আলোও এক আজানা অন্ধকার।


যে শৈশব বন্ধু অলিন্দে সাগর হয়ে বেলাভূমি খোঁজে। তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছি পাখির শিস!আলোর ফেনিল থেকে মুছে নিয়ে বিদেহী আগুন। কুটিরের দায় মুছে সূর্যের প্রলেপ দিয়ে প্রতিদিন অন্ধকার লিখি। আর,চিরুনী জুড়ে তল্লাসী জীবন!


গোপন জ্বরের মতো পৃথিবীরও আজ স্বপ্নদোষ। ঐ দেখো,ভিক্ষার থালা থেকে শালিক খুঁটে খুঁটে খায় দিন।

চোখেতে বর্ষামঙ্গল লিখে আমার নিখোঁজ। অন্ধ চিত্রকর ক্যানভাসে হাসি ছড়িয়ে কান্না আঁকছে হাজার বছর।


আমরা জবা ফুলের মতোন মুখস্থ করেছি বিমুগ্ধ জলের ছাপ!



বাসা,মধ্যরাত

১৬ জুলাই,২০২০



রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                  


 সাইকেল 


  

প্রথম পর্বের পর 


২) 

  সামুয়েল কাঁধ ঝাঁকাল অদ্ভুত ভঙ্গি করে। যেন ও নিজেই ঠিক বুঝতে পারছে না—মন খারাপ লাগছে কিনা। এই বরবরুয়াদের গ্রামটাকে সামুয়েলের খুবই ভালো লেগে গেছে। আর সেই ভালো লাগার মাশুল গুণছে এখানে আটকে পড়ে। ভাগ্য যে এভাবে ওকে আসামের প্রত্যন্ত এক গ্রামে এনে ফেলবে, এনে ফেললেও এখানেই সাময়িক আস্তানা গড়ে দেবে ওর, কে জানত! এই বাচ্চাদুটো ওর খুব ন্যাওটা হয়ে গেছে। একজনের ক্লাস থ্রি, একজনের টু। বড়টার নাম রুবাই আর ছোটটাকে সামুয়েল ডাকে মাদাম বলে। আসলে ও সবার মুনিয়া। রুবাই ওর সাইকেলে উঠে প্যাডেলে পা পৌঁছনোর চেষ্টায় মত্ত। আর মাদাম এখন গিটারে টুংটাং করছেন। মেয়েটার তেলমাখা খোঁচা খোঁচা চুলে হাত বুলিয়ে দিল ও। আদর পেয়ে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল ও। তারপর আবার গিটারে মন দিল। যেন এই মুহূর্তে জি শার্পে গিয়ে সে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। এটুকু প্রশ্রয় ওদের দেয় সামুয়েল। শুধু এই দুটি না, আরও কয়েকজন এসে জোটে ওর কাছে। বরাবর ছোটদের পছন্দ করে ও। ওদের পালস্‌ বোঝে, আর তাই যেখানেই যাক, ছোটরা ওকে ঘিরে রাখে। এই বরবরুয়া গ্রামে এসে ওদের ভাষার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল প্রথমটা। তারপর আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে, ভাঙা ইংরেজিতে বস্তুর নাম বলে বোঝাতে পেরেছে কিছুটা। এভাবেই চলেছে দুপক্ষের ভাষা শেখার খেলা। এখন তো অসমীয়া, স্প্যানিশ আর ইংরেজির সহাবস্থানে গ্রামের বিকেলগুলো মুখর হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট স্কুলের মতো তৈরি হয়ে গেল এভাবে। ইচ্ছে থাকলে কী না হয়! 

  জুন, জুলাইয়ের এই ভরা বর্ষায় অবশ্য মাঠেঘাটে ওদের স্কুল বসতে পারে না। কারুর ঘরে, বারান্দায় মায় পরিত্যক্ত গোয়াল বা রান্নাঘরেও চলে ওদের পাঠ। আজ তিনমাস হয়ে গেল এখানে এসে। তিন মাস তো না, যেন এক যুগ! গত বছর আগস্টে স্পেন থেকে উড়ান দিয়েছিল সে জাপানের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী ছিল তার সাইকেল। সেই জাপান থেকে সাইকেলে চড়ে একে একে কোরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, মায়ানমার হয়ে মণিপুরে। তারিখটাও মনে আছে! ২৭ জানুয়ারি। কারণ আর কিছু না, সেদিন ছিল ওর জন্মদিন। বাড়িতে বাবামায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য সে এক সাইবার কাফেতে গিয়েছিল সন্ধেবেলা। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকেই জেনে গেছে সাইকেলধারী এই বিদেশী পর্যটকের কথা। অনেকেই আলাপ করছে, হাত মেলাচ্ছে, এরই মধ্যে যখন বাবামায়ের সঙ্গে ও কথা বলছিল স্কাইপে, উচ্ছাস হয়ত বেশি হয়ে পড়েছিল ওর। জন্মদিনে ওঁদের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে দূরে থাকলেও আজ এভাবে জাপান থেকে ইন্ডিয়ায় আসতে পারবে, নিজেও ভাবেনি কখনও। সেসময়েই এক যুবকের সঙ্গে চোখচোখি হয় ওর। সে নিজেই হাত বাড়িয়ে দেয় আলাপের জন্য। শিক্ষিত অসমীয়া এই যুবকের নাম অভিজিৎ বরবরুয়া। কী এক প্রাণের টানে বন্ধু হয়ে যায় ওরা খুব সহজেই।

  অভিজিতের মূল আগ্রহ ছিল ওর পর্যটনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা। আর তাই দুজনের মধ্যে ভাব হতে সময় লাগেনি। নাহ খিদে পাচ্ছে খুব। ওরা হয়ত বসে আছে ভাত নিয়ে। অভিজিতের মাকে ও কাকিমা বলে। অনেকবার বোঝানো সত্ত্বেও কাকিমা ওরা দুজনে না খেলে খায় না। এখন আর আকাশকুসুম ভেবে দেরি করলে চলবে না। উঠে পড়ল ও। পুঁচকে দুজন বিদেয় নিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। গিটারটা পিঠে ঝুলিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল ও। আর গলা দিয়ে অজান্তে বেরিয়ে এল-

Hoy en mi ventana

brilla el sol

Y el corazón se pone triste 

contemplando la ciudad

Porque te vas ……

(আজ আমার জানলায় রোদ এসে পড়েছে,/ আর মন হয়ে রয়েছে বিষণ্ণ/ এই শহরকে অভিযুক্ত করছি আমি/কারণ তুমি চলে যাচ্ছ…)  


   সূর্য এখন আর ভোরের নেই। দুপুর গড়িয়ে সে খর হয়ে উঠেছে। কেউ এ শহর ছেড়ে আপাতত চলে যেতেও পারবে না লকডাউনের কারণে। ফলে দুঃখের কিছু নেই তার। গান তো এমনিই গাওয়া। এমনিই…তার অভ্যেস। আর দুঃখ কি কিছু আছে ওর? মনখারাপ? সে সত্যিই বোঝে না এসব। সামুয়েলের মন একটা আলগা পালকের মতো ভাসতে থাকে সব সময়। তুলোর মতো পেঁজা মেঘে ঢেকে আছে এখনকার আকাশ—ঠিক এরকম। যখন খুব মেঘ করে, আকাশ কালো হয়ে আসে, সামুয়েলের খুব ভয় লাগে। মনে হয় কারুর নরম বুকে মুখ লুকিয়ে যদি বেঁচে থাকা যেত নির্ভয়ে… 

)

অরিত্র চ্যাটার্জী

                                  |



 এই সংখ্যার কবি অরিত্র চ্যাটার্জী।জন্ম ১১ এপ্রিল, ১৯৯৪।  পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার,  বর্তমানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে গবেষণারত। কবিতা লেখার সুত্রপাত স্কুল জীবনের শেষ দিকে। প্রকাশিত কবিতার বই একটি , "ঝরা পাতার সমাহার" (প্রকাশক - ৯ নং সাহিত্য পাড়া লেন, সন- ২০১৯)।


মবলগে মনোলগ

( ডিমেনশিয়া )

কে তুমি  

           জটিল জ্যামিতিতে

ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এসেছ

অনুজ্জ্বল ধ্বনির ভেতর

খসে পড়ে 

                 যৌগ অক্ষরছবি                

বিলীয়মান গেরস্তপ্রপাত

     ও সন্নিহিত মুখেদের ভিড়ে

আমি আবারো 

          গুছিয়ে নিতে ভুলে যাই 

যত ছিল বিগত দশকের স্খলন …


( পোর্ট্রেট অফ ভেনাস )

রাখা আছে নির্জন আপেল আর আমার এই শাদাটে তনুদেশ, একে তোমরা আরোহণ করবে ভাব, দড়ি ও কম্পাস সহযোগে তোমাদের এহেন নিষ্ফল অভিযান প্রতিবার উপত্যকার খাঁজে এসে থেমে যায় হায়, আর আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি কবে কেউ পেরিয়ে আসবে নীলচে ঠোঁটের সানুদেশ আর যাবতীয়  প্রজননবেলা ক্রমে বয়ে গেলে, প্রতি রাতে কিভাবে আরেকটু বেশি করে মরে যাই, ওহ্‌ মৃত্যু, সেকথা কারুক্কে বোলোনা কখনো!

কি প্রচণ্ড নির্বিকার

এই সারিসারি ধড় ও মুখোশরাশি

আমাকে লক্ষ্য করে  

পুঞ্জীভূত ধোঁয়ার আড়ালে 

অনায়াস সরিয়ে নেয় পাটাতন 

আর 

পতনোন্মুখ আমাকে 

টেনে তোলে 

আরেকটা অবাঞ্ছিত স্বপ্নের ভিতর

বিক্ষিপ্ত কিছু সত্য উদ্‌ঘাটনের হেতু আমি অবশেষে সেই ধর্মযাজকটির সন্নিকটে গেছিলাম এবং তাঁর লোল করতল স্পর্শ করে অভিবাদন জানিয়ে আমি বলতে শুরু করেছিলাম যা কিছু সত্য বলে মনে হয় সেইসব অনাকাঙ্খিত সংশয়ের কথা, পর্ণমোচীর বাগানে সেই বৃদ্ধ ধর্মযাজক আমার কথার ভেতর সহসা জানতে চেয়েছিলেন পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কিত আমার মতামত এবং আমাদের কথোপকথনের সাময়িক নীরবতা ভেদ করে সকাতরে একটি পাখি ডেকে চলেছিল এবং ধর্মযাজক চোখ বুজে সেই সকরুণ সুরের ভিতর সুখবোধ কিভাবে মানুষকে এড়িয়ে  চলেছে অনন্তকাল সে কথা বলে চলেছিলেন, এবং এমতাবস্থায়, তাঁর পশ্চাতে ডালা সাজিয়ে জনৈকা যুবতী এসে দাঁড়িয়েছিল, ধর্মযাজকের কথার ফাঁকেফাঁকে যার সুডৌল উরুদ্বয় আমি একাগ্র চিত্তে দেখেছিলাম… 

যে তুমি মনোলোভা,

                     এই আশ্চর্য নাচবুদ্ধি 

জ্যামিতিভঙ্গিমা দেখব বলে আমরা পেরোই

সাড়ে আট, সাড়ে আট কৈশোরের কাঁটাতার

আর তুমি উঠে আসো অনাবিল বিভঙ্গে 

                    কোন সামুদ্রিক পিপে হতে          

সাইরেনদের গানে দোল খাও যেন সহস্র সাপিনী

যাজকের হাঁসফাঁস, যা কিছু বীতংস তা ছুঁয়ে 

কাকে বলে রক্তাল্পতা

                    সে মুহূর্তে জেনেছি আমি


দুঃখ,

প্রতিটি ঠাণ্ডা আত্মার

অনভিপ্রেত শীতঘুম ভাঙ্গানোর  

পর্যাপ্ত বারুদের

রসদ না থাকার…


( সোয়ান সং)


‘হিপোক্রিসি ‘কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ আছে অনেক

তবু সচেতন ভাবে আমি এই শব্দটা ব্যবহার করি

‘হিপোক্রিসি’ শব্দটা ভারীবিশেষ, যেন বাটখারার মতন

যা ছুঁড়ে মারলে সামনের লোকটার কপালে লাগে

আর সেইসব আহত শ্রোতাদের থেকে তিন সেকেন্ড বেশী সময় পাওয়া যায়

বিজয়ীর মত দাঁড়িয়ে থাকার অথবা পরবর্তী শব্দসমুহ সাজানোর


মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে

তোমাদের শব্দাঘাত করা আর সময়ে পরে নেওয়া লুকনো মুখোশ

তোমাদের সুখ দুঃখ আর সত্যিই নাড়ায় না আমায়

লঘু পায় আমি পেরিয়ে যাই মাটিদেশ,নগর,বন্দর 

আর আমার পেছনে পড়ে থাকে সারিবদ্ধ সিরিয়া আর আমলাশোল

আর আমার পেছনে পড়ে থাকে শ’পাঁচেক নব্য শারুক্ষান

আর এইসব ছেড়ে আমি ফিরে যাই নিজ্স্ব সুড়ঙ্গে

যেখানে সযত্নে সাজানো একান্ত ব্যক্তিগত সমস্ত দুঃখ

যেমন করে প্রিয় ক্ষত চেটে নেয় সমস্ত কুকুর

প্রত্যেকটি বিষাদ আর প্রত্যাখ্যান জড়িয়ে আমি সুখনিদ্রা যাই

আর স্বপ্নে এই ছোট্ট দেহ, অন্ধকার কুঠুরি এই সব ছাড়িয়ে 

অনেক অনেকটা বড় হয়ে ছেয়ে থাকি তোমাদের শহরের ওপর


মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে

তোমরা যাকে ‘হিপোক্রিসি’ বল সেইসব দ্বিভাব আমার মধ্যে প্রকট

কাঁপা হাতে জনপ্রিয় শব্দ সাজাই, নিঃশব্দে চিৎকার করি 

লুটেপুটে নেই বিস্কুটের মত তোমাদের ছুঁড়ে দেওয়া সহানুভূতি

মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে

পারলে তোমাদের কথা ভেবে স্বপ্নের ভিতর একদিন ঠিক মরে যেতাম।

নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ভাবনা

১৯৬২ সালের অগাস্ট মাসে একদিন বেমালুম উবে গেল একটা লোক। 

তারপর কেটে গেল নির্ঝঞ্ঝাট সাত সাতটা বছর। তারপর একদিন আদালত তাকে ঘোষণা করে দিলে মৃত। এই নিয়ে একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেললেন জাপান দেশের লেখক কোবো আবে। অথচ যতটা নির্লিপ্ত ভাবে এতদূর বললাম আদতে কিন্তু সেরকম নয়।

একবিংশ শতাব্দীর আমি ১৯৬২-র উপন্যাস পড়ি। ক্রমশ দ্বিধাগ্রস্ত হই। হারিয়ে যাওয়া তো হামেশাই ঘটে, নিরাসক্ত আবে লেখেন,  প্রতি বছর জাপানে ফেরার হয় শয়ে’শয়ে মানুষ। বিগত ৫০ বছরে সফল ভাবে নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রক্রিয়া কি হারে জটিল হয়ে উঠেছে, এই বিষয়ে আবের সাথে আমার বিতর্ক চলে। তারপর সমীক্ষা খুঁজে দেখতে পাই ২০১৯ সালে জাপানে নিরুদ্দিষ্ট সাতাশি হাজারের সামান্য বেশি কিছু লোক। অথচ যতটা সহজে এই তথ্যটুকু লিখলাম আসলে কিন্তু তা নয়। 

ভাবি অনায়াস প্রস্থান করব, তবু জোর করে কালো পোশাকের মানুষ। বালি চাপা রেখে যেতে বলে প্রত্নচিঠি ও বিগত ছাব্বিশ বছরের স্মারকসমূহ। বালিয়াড়ির ওপার থেকে দিকনির্দেশ করে সাতাশি হাজার নিরুদ্দিষ্ট হাত।  সাতাশি হাজারের ভিড়ে আরও একজন হয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ-ই মনে পড়ে, এখন আমার নিরুদ্দেশের জন্য অপেক্ষা করে নেই আর কোন লেখক, ঔপন্যাসিক।

দূর থেকে দেখতে আমার সচরাচর বেশ ভাল লাগে।

রাস্তায় পরিচিতদের দেখলে আমি ইদানীং নিজে  থেকে ডাকি না; 

তাদের আত্মমগ্নতা উপভোগ করি

দেখেছি বৃষ্টির ফোঁটা কি সহজ প্রকারে পুকুরের জলে লীন হয়; হাত বাড়িয়ে 

সেই  পরিণতিতে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করে না আমার, 

মনে আছে প্রিয় নারীরা যখন মৃদু হেসে এক এক করে তলিয়ে যাচ্ছিল 

তাদের চিৎকার করে বাধা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি

এখন আমার গলায় কোন আওয়াজ নেই…

প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে , শেষ বসন্তের এক বিকেলবেলায় আমার জন্ম হয়েছিল । অদ্ভুত কিছু নয়, তবু একটা ডুবন্ত সূর্য আর রাশি রাশি নিরুদ্দিষ্ট পাখিদের  নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে খানখান করে একটি সদ্যোজাত শিশু কাঁদছে;  এ দৃশ্যের কল্পনা আমায় আজও অভিভূত করে …

রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                       


সাইকেল 


১) 

  সাইকেলটা সামনের গাছে ঠেস দিয়ে রাখা।  উলটোদিকে অন্য এক গাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে এক যুবক। দুধারে সবুজ ধানক্ষেতে দোলা লেগেছে আচমকাই। একটা ঠান্ডা ভিজে হাওয়া এসে দুলিয়ে দিয়ে গেল সেই যুবকের মনও। গ্রাম বলতে যা ছবি আমাদের চোখের সামনে এসে যায়, অবিকল সেরকমই একটা পিকচার পোস্টকার্ডের ছবি তার চোখের সামনে। খেতের মাঝখান থেকে একফালি পাকা, বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে দুদিকে।  কোথাও কোনো বাড়তি আবর্জনা নেই এই গ্রামে। যখন তখন বর্ষা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই উত্তর পূর্ব সীমান্ত এলাকার গ্রামে। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা দূরেই, ফলে এই অঞ্চলে তেমন জল জমে না। কাদা জমে পিচ্ছিল হয়ে ওঠে না চারদিক। আর সবুজ যে এত ঘন, নরম আর মোলায়েম হতে পারে এই ছেলেটির তেমন জানা ছিল না আগে। ছোটো ছোটো বাড়িগুলোর বেশিরভাগই পাকা, খড়ের বা টিনের চালে ছাওয়া, নয়ত পাকা ছাদ। ছাদের মাথায় লাউ, কুমড়ো শাক শনশন করে বেড়ে উঠছে এই তেজী হাওয়ায়। যুবক এখন লাউশাক, কুমড়ো শাকের ঘন্ট খেতে শিখেছে, খেতে শিখেছে ভাত, ডাল আর নদীর মাছও। সাইকেল এসবের সাক্ষী। ওর দিকে চোখ গেল তার। সাইকেলটা যেন চোখ মটকে কী একটা ইঙ্গিত করল ওকে। একটু কি আরক্ত হল যুবকের মুখ? সাদা রঙে তামাটে ছোপ পড়লেও তার টকটকে গালে লজ্জার ছাপ। লজ্জা পাওয়ার যে সহজাত বোধ, সেও কি এখানে এসে সে শিখে ফেলল এই ক’মাসে? 

অলস বসার ভঙ্গী ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এবারে সোজা হয়ে বসল সে। পাশে রাখা গিটারে টুংটাং বোল তুলতে গিয়েও থেমে গেল।  তারপর আবার দ্বিধা নিয়ে সুর তুলল, গেয়ে উঠল দু কলি- 

No puede ser

no soy yo

me pesa tanto el corazón

por no ser de hielo cuando el cielo me pide paciencia

  আর সেই সময়েই যেন মাটি ফুঁড়ে দুটি শিশু হাজির হল ওর সামনে। ওদের দেখে গান থামাল সে। কিন্তু শিশুদুটি সমস্বরে বলে উঠল, আবার গাও, আবার গাও। মানে কী এই গানের?

  সে এখন মোটামুটি বোঝে ওদের ভাষা। নিজের ক্ষমতায় যেটুকু কুললো, তাতে বলল, ‘মানে? মানে জেনে কী করবি তোরা? গানের সুরই হল সব। আর কথারও প্রয়োজন আছে বৈকি! তবে তার মানে যেমন খুশি ধরে নিলেই হবে। ওই যে আকাশ দেখছিস, ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে—কেন তোমার মন এত ভারি হয়ে আছে আজ? আমি ওকে বললাম—না, না এ আমি নয়, আমি হতেই পারে না। অন্য কেউ, যার মনে বরফ জমেছে, সে আমি নয়, অন্য কেউ, অন্য কেউ……’

এক ক্ষুদে কোলের কাছে ঘেঁষে এল যুবকের। ‘তোমার কি মন খারাপ করছে দেশের জন্য?’  


(ক্রমশঃ)

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়

                                                     



এই সংখ্যার কবি সমিধ গাঙ্গুলি। ইতিহাসে  স্নাতকোত্তর হওয়ার পর আপাতত  সরকারি চাকুরে।পেশাগত সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময় ইতিহাস আর কবিতা নিয়েই কাটে।কবিতা সংক্রান্ত যে-কোনো আলোচনায় নিবিড় শ্রোতার ভূমিকায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগে।

আর ছুটিছাটায় পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়াটা সোনামুগের

সঙ্গে আলুপোস্তর মতই অবশ্যম্ভাবী।



সুষুপ্তির জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে 

----------------------------------------------



১.

তার বিহনে পাগলাঝাঁপ ছুটি

দিনের শুরু, নিছক বাড়ি ফেরা

মহুয়াভীরু দাওয়ায় খুনসুটি

রোদে মিশছে পাহাড়বালকেরা


ভাল্লাগেনা বিরহী বিস্কুট

চুমুর আগে ঠোঁটের গলে যাওয়া

তোমার হাতে অচেনা মনছুট

আমার কাছে ধুলোর মত হাওয়া


আস্কারার জামায় মোছা ঘাম

সন্ধ্যেবেলা লুকিয়ে বাড়ি ফেরা

মেঘলা হ'লে পায়রা ওড়াতাম

রোদ শেখাত বিষাদপালকেরা...



২.

বাস্তুহারা বিগত সংসার

ইস্ত্রিহীন উঠোনে তানপুরা

আদায় করা ম্যাপের অধিকার

অভিনয়ের শর্ত আনকোরা


লাগাম যদি আগুনে বশ থাকে

শৌখিনতা কাহারবায় বুঁদ

শান্ত চাঁদ ঘুমোলে মৌচাকে

ঢিলের কাছে ব্যর্থতার সুদ


আগলে রাখা বেহুঁশ ক্যাথিটার

ঘোলাটে হয় বধির কানকোরা

আদায় জানে লাভের অধিকার

শিরদাঁড়ার শর্ত আনকোরা...



৩.

ক্যাকোফোনির বেহাগে আংরাখা

মগজরঙা হ্রদয় কাঁদে না

গুমটি। মাঠ। সদ্যোজাত পাখা।

মেজাজী ধোঁয়া জীবন বাঁধে না


দশমিকের বাঁ পাশে রাখা বিষ

দেরাজ খোলে আনপাড়ার ঠেকে

মেহফিলের মাহুত আনুবিস

পূর্বাভাস বুঝিয়ে সংক্ষেপে


উঠে দাঁড়ায়। প্রজাতিহীন চাকা

হেঁচকি তোলে নরম ছাঁদে না

দিঘি।বাগান। মেদুর। পটে আঁকা।

মাসকাবারি জীবন সাধে না...



৪.

শিশুআঙুল মগ্নতাকে ছুঁলে

খিচুড়িভোগে অনাদি তরী বাওয়া

গৃহপালিত জাবনা খুঁড়ে তুলে

জরুরী ছিলো তোমার কাছে যাওয়া


শুকনো চোখা মরসুমের দাঁড়ে

চশমাওয়ালা গর্জনের চাষ

নুনছালের শীলিত টংকারে

মাখানো ঝরা পাতার নির্যাস


অক্ষরের উলটো বাহুমূলে

মন্ত্রপূত অন্ধ হতে চাওয়া

কাফের,তবু ভেজা আগুন ছুঁলে

জরুরী হয় তোমার কাছে যাওয়া...



৫.

এবং থাকো গোপন শিরাপথে।

মজা পেলেই গুছিয়ে নাও খাট

ধর্ম লেখে যে যার প্রিয় গতে

মানুষ পাওয়া ভীষণ ঝঞ্জাট


এবং থাকো মোহিনী বিদ্যায়।

কেতাবী রুচি তোমার পরাধীন

ডুবতে পারো যে কোনো বন্যায়

প্রস্তাবনা পাঠাবে মরফিন


এবং দ্যাখো মাকাল,প্রতি বাঁকে

হাওয়াই চটি।চালাকি,রাজপাট।

বর্ম পেলে যে যার মতো থাকে

মানুষ হওয়া নোংরা ঝঞ্জাট...



৬.

যেমন কাঁচাকথন ভাতে পাই

লোহাকরুণ আংড়াভাসাতেই

জড়তা ভাঙে বন্ধুদের ছাই

এখনো আছি বাংলাভাষাতেই


মোরগঝুঁটি দোলানো বাস্কেট

বুড়ো হওয়ার দু-মুঠো নষ্টামি

হিয়ার মাঝে জিয়ল সংকেত

শোনো,তোমায় বলতে চাই আমি


জর্দা যদি পানের কিংখাবে

তুমিও শুধু সর্বনাশাতেই

সে-সব ব্যথা কালকে ভাবা যাবে

আজকে থাকি বাংলাভাষাতেই...



৭.

চোখের পাশে তাগড়া আস্তিন

গোটালে তুমি প্রেমিক হতে পারো?

চমৎকার আহত আস্তিক

মাংস নয় আবেগ দিয়ে মারো


জেহাদি পথ,বাঁধাকপির ক্ষেত

সীমানা ঘেরা যৌথ পরিবার

কথকতার বাক্সে রাখা বেত

বড় হলেই বলবে "জমি ছাড়"


আবহমান গোমড়া বাস্তিল

আবহাওয়ায় রসদ পেলে আরও

তিনভাঁজের ব্যহত আস্তিন

চাবুকে নয় পাঁজরে পিষে মারো...



৮.

ফিরতি নায়ে তোমার দেখা পাই

বাঁশরী যদি ভালোবাসায় ধরো

সভ্যতার নিহিত খাইখাই

অফুরবেলা ছিলিম টেনে মরো


বসেই থাকো চৌকাঠের দলে

তন্ত্রে আনো মহাদেবীর ছাঁচ

অপরিমিত বিশ্বাসের মলে

প্রাদেশিকতা রপ্ত করে নাচ


জলের দেহে খাস্তা জমি পেলে

সুজাত রাগ তুমিই সম্বরো

পাকস্থলী নির্বাসনে গেলে

দ্বিধালবণ ধোঁয়ায় কেশে মরো...



৯.

মেধা এখন বিষয়ভিত্তিক

কোন সোহাগে কটা বলদ জোটে

প্রশ্নমালা হাসলে ফিকফিক

অনধিকারচর্চা মজা লোটে


তুমিও প্রভু আমার মতো বেঁচে

থাকতে করো রেশন মঞ্জুর

বিশ্বাসীরা কবেই মিলিয়েছে

বুকে হাঁটার তর্ক কিছুদূর


আগাম কোনো ধৈর্য নেই মোটে

ডিগ্রী বশবর্তী হবে ঠিক

স্বভাবে তবু পঙ্গপাল জোটে

কারণ মেধা বিষয়ভিত্তিক... 



১০.

চারুপথ ভুলে যাও ক্রিসেনথিমাম

অ আ ক খ অভ্যাস পাঁশুটে হাওয়ায়

দেহপট সনে মাখো সুবচনী ঘাম

পাথেয় ফুরোতে পারে এটুকু চাওয়ায়


তুমি হবে বর্ণনা অতীতের মতো

ভজনালয়ের পাশে পাহাড়ি মাতাল

ওজনে সমান রেখো হিসেবের ক্ষত

মগজের ভাতঘুমে নিশুতি আকাল


কামিনী অঙ্গ তবু ভাঙে উদুখল

বসন্তে একা বীজগাণিতিক ট্রাম

তোমার বিশদে চেয়ে বসলে অতল

পোশাকটা ধুয়ে নিও ক্রিসেনথিমাম...