পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                 



সাইকেল

তৃতীয় পর্বের পর 

৪) 

   অভিজিতের সঙ্গে ওদের বাড়িতে পৌঁছল সামুয়েল। শহরে এসে বাইকস্ট্যান্ডে নিজের বাইক রেখে দেয় অভিজিৎ। সেই বাইকের পিছনে বসে প্রায় ঘন্টাখানেক জার্নির পর ওদের গ্রাম। এই সেই বরবরুয়া গ্রাম, ছবির মতো সবুজ ও সুন্দর। প্রথম দেখেই এই গ্রামের প্রেমে পড়ে গেল সামুয়েল। তারপর যে ওর বাড়িতেও আরেক দফা বিস্ময় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল, সে ওর ধারনার বাইরে ছিল। ওদের বাড়ির এলাকা গাছের বেড়া দেওয়া। ভেতরে কিছুটা অংশ পাকা বাড়ি, দেখলেই বোঝা যায়, নতুন তৈরি হয়েছে। আর পিছনের দিকে মাটির বাড়ি, মাটির দেওয়ালে আবার সুন্দর কল্কা, ফুল, বাঘ, হরিণের ছবি আঁকা। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। যদিও অভিজিৎ ওকে পাকা বাড়িতেই এনে তুললো। অভিজিতের ঘরেই এলো ওরা। সুন্দর, পরিপাটি, বাহুল্যবর্জিত ঘর। ঘরের একপাশে একটা খাট, আলনা, আর কাঠের চেয়ার, টেবিল। ব্যস্‌। কুলুঙ্গির মতো একটা জায়গায় আয়না টানানো রয়েছে। টেবিলে অভিজিতের ছোটবেলার ছবি একটা। দুচারটে বই। চেয়ারে বসল সামুয়েল। অভিজিতের বাবা মা এলে হাতজোড় করে প্রণাম করল ওদের সামুয়েল। অভিজিৎ জানাল, ওর এক ছোট বোন আছে, ইলেভেনে পড়ে, এখন স্কুলে সে। খুব পাজি নাকি সে! একটা সুন্দর হাসিখুশি পরিবারে এসে সামুয়েল সাতদিনের জন্য আস্তানা গাড়ল। অভিজিৎ রইল পাশের ঘরে, যে ঘর ফাঁকাই পড়ে থাকে। বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাল সামুয়েলকে ও। বাবা মায়ের ঘরের পাশেই এক চিলতে বারান্দা ঘিরে পড়ার টেবিল-চেয়ার। ওখানেই নাকি ওর বোন পড়াশুনো করে। মাছের ঝোল দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে টেনে ঘুমলো সামুয়েল। ওকে এভাবে তৃপ্তি করে খেতে দেখে অভিজিতের মাও খুব খুশি! ফলে একাত্ম হতে সামুয়েলের একটুও সময় লাগল না। বিকেলে চা দিতে এলো কাকিমা। অভিজিৎ তখন টেনে নিয়ে এলো বোনকে। রোগা, পাতলা গড়নের এক কিশোরী সে। টানা টানা চোখ, এক ঢাল কালো কোঁকড়া চুল কপাল ঢেকে রেখেছে তার। শ্যামলা মেয়েটির মুখে একটা আলগা শ্রী আছে, এটুকুই। আর রয়েছে চোখ ভর্তি বিস্ময় আর দুষ্টুমি। সামুয়েলের সামনে প্রাথমিক জড়তা কাটছিল না তার। যেহেতু ইংরেজি বলতে সে সড়গড় নয়, তাই কথাবার্তাও কিছু হল না। একটু ফিকে হাসি হেসে বসে রইল খাটের ওপর। আর অনবরত ঠ্যাঙ দুলিয়ে যেতে লাগল। চা পর্বের পর, একসময় সামুয়েল আর পারল না। বলেই ফেলল। ‘তুমি কি পা না দুলিয়ে থাকতে পার না?’ ওর কথায় হকচকিয়ে গেল সেই মেয়ে। আর অভিজিৎ হাহা করে হেসে উঠল। রাগে দাদার দিকে চোখ পাকিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল ও। ওর নাম বুলবুল। সামুয়েল জানল যে বুলবুল এক পাখির নাম। যদিও বুলবুলের একটা পোশাকি নামও আছে। শ্রীময়ী।  

     রাতে খাওয়ার সময় এক ঝলক দেখা গেল বুলবুলকে। অভিজিৎ অনেকবার ডাকল একসঙ্গে খেয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার সাড়া পাওয়া গেল না। আপন মনেই অভিজিৎ বলে উঠল, রাগ হয়েছে! এই এক রোগ ওর। এমনিতে সব ভাল, শুধু রেগে গেলেই তার মান ভাঙাতে ভীষণ সমস্যা। সামুয়েল বুঝল, একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে ও। আন্তরিক ভাবে তাই অভিজিতকে বলল, তুমি তোমার বোনকে একবার ডাক। আমি খুব লজ্জিত। ক্ষমা চাইব ওর কাছে। কিন্তু বুলবুলের আর দেখা পাওয়া গেল না। কিন্তু সে যে আশপাশেই আছে, এবং ওদের কথা কান খাড়া করে শুনছে সেও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেল একটু বাদেই। খেয়ে হাত ধুতে যাওয়ার সময় সামুয়েল শুনল, বারান্দায় এক জোড়া পায়ের শব্দ দ্রুত পালিয়ে গেল। নিজের মনেই হাসল ও। ভাবল, থাক এখন। একটু মজা নেওয়া যাক বরং! হাত ধুয়ে গিটারে সুর তুলে গান ধরল ও-

Como cada noche desperté pensando en ti

Y en mi reloj todas las horas

vi passar

Porque te vas

(প্রতি রাতের মতো, আমি জেগে উঠব, আর তোমার কথাই ভাবব…আমার ঘড়িতে দেখব সমস্ত সময় পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, কারণ তুমি চলে যাচ্ছ…) 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন