পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

সমর্পিতা ঘটক


 

জল ঘুরে যায়, জল ঘুরে যায় নিখিলবিশ্বচরাচরে --

আমার ঘরে, তোমার ঘরে !


আটপৌরে লাল পাড় সস্তা কোরা রঙের সিন্থেটিক শাড়ি পরনে। উপরের বাঁদিকের

হাতটিতে ফাটল ধরেছে। তিনজন কোনোরকমে ভ্যান থেকে নামিয়ে কয়েকপাক ঘুরিয়ে

ফেলে দিল জলে, ফেলার আগেই খসে পড়ল বাঁ হাতটি, ঘাটের কাছটিতেই হাঁটু ভাঙা জলে

মুখ গুঁজে পড়লেন মা কালী। শরীরে অযত্নের ছাপ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি ভেসে যেতে

চেয়েছিলেন আগেই, এক বছরের অপেক্ষা সুখকর ছিল না হয়তো। কে জানে জলের কাছে

পৌঁছতে নিয়মের বেড়াজাল ডিঙোতে হয় কতখানি! পুজোর দিন সকালে পুরনো মূর্তি ভাসান

দেওয়াই প্রথা হয়তো এদের কিংবা পড়ে গিয়েছিল কোনও বাধা! তিনটে লোক এসে

ভাসিয়ে দিল শ্যামলা মূর্তিখানি। বাদ্যি, বাড়তি জমায়েত, নাচন, জয়ধ্বনি কিছুই ছিলনা

সেদিন। সোনালি খাঁড়া জলের ওপরে জেগে ছিল তখনও। দুপুরের রোদে কচুরিপানার আড়াল

থেকে ঝিলিক দিচ্ছিল সোনালি রঙ। রুপোলি আঁশ ওদিকের ঘাটে রঙ ছড়ায় রোদে তাপে

পুড়ে যাওয়া তাম্রলিপ্ত মুখে। অনে্কক্ষণের অপেক্ষায় চারা গিলেছে মাঝারি কাতলা।

বঁড়শির টান সামলে নিতে শিকারি জানে বিলক্ষণ। জমা করে দিনের সঞ্চয়, জলের গল্পে

যোগ বিয়োগ মিলে যায় নিরন্তর।

মেয়েদের পায়ের পাতা ছুঁয়ে থাকে জল। বিলি কেটে দিয়ে যায় বারবার। স্বচ্ছ পরতের

তলায় নুড়ি, পাথর আর রঙিন নেল-পালিশ মোহজন্ম নেয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের রঙচঙে

পৃথিবীর মতো। সেখানে গল্পরা টুকরো হয়ে যায়। গোল গোল বুদবুদ উর্ধ্বমুখী। লাল,

নীল, হলুদ, কমলা সদস্যরা সংখ্যায় বাড়ে কমে কিন্তু অগভীর মেক বিলিভ জগতে

সম্পর্কের আঠায় বাঁধেনা নোঙর। কাচের দেওয়ালে ঠুকরে মরে, গুমরে মরে তাজুর মতন।

চোখধাঁধানো বিপুল ওই শপিংমলের কাচের দরজায় চোখ লাগিয়ে যেমন চেয়ে থাকে তাজু।

মলের পাশের গলিতে চায়ের দোকানে গ্লাস ধোয়ার কাজ করে সে। এক এক দিন দোকান

খোলার নির্ধারিত সময়ের আগে এসে পড়ে আর ধাঁ করে চলে যায় মলের কাছে। দরজার

গায়ে নাক ঠেকিয়ে দেখে, কত মানুষ উঠছে, নামছে, ঝলমল করছে সবকিছু স্বর্গের

মতো, কাচে বাষ্প জমে যায় আর নাকে কফির গন্ধ আসে। থমকে যায় বাকি সব।

মাছগুলোও কাচের ওপার থেকে গন্ধ শোঁকে মানুষের। কিন্তু ছুঁতে পারে না।


মন কেবল সেঁধিয়ে যায় অতলে। মুখ বন্ধ ঝাঁপি সে উপুড় করে দেয় নদীর কাছে, যে নদীতে

যত গল্প জমা হয় সেখানে তত নুড়ি পাথর। ধূসর, শ্যাওলা, মেটে, হলদেটে, আকাশি,

সবজে, সাদাটে নুড়ি সব গোপন অক্ষর। যে কথা কেউ জানে না সে কথা নদী জানে।

কতবার উপুড় করেছি নিজেকে তিস্তার কাছে, তোর্সার কাছেও। তিস্তা এখন মরা সোঁতা,

ওর হাতে, পায়ে বেড়ি পরিয়েছে হর্তাকর্তা মাথারা। ও গুমরে থাকে, স্থির আয়নার মতো।

যেন হারিয়ে যাওয়া সেই সবুজ শাড়িটা! যার খোঁজ কেউ করেনি, কোনোদিন। তবে একদিন

ও ফুঁসে উঠবেই, ভাসিয়ে দেবে চরাচর। মন্ত্র পড়ে আনবে হরপা বান, ছটফটে দুষ্টু হয়ে

ফিরে আসবে আবার! লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে পথ চলত ও অচেনা পথিকের সঙ্গে আর কত

গল্প... অনর্গল হই হই। রাফটিং করতে গিয়ে উলটে যদি পড়ত কেউ অমনি হেসে উঠত

হাততালি দিয়ে। কিন্তু আমরা বাঁচাতে পারি না উচ্ছলতা। থাকতে দিই না তাকে তার মতো

করে। মরা সোঁতা হয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করি, তারপর যখন টলে যায় নিজেদের

অস্তিত্ব, তখন বাঁচাও বাঁচাও হাহাকার। আন্দোলন। কমিটি। অনশন।

নাকানিচোবানি, লোনা গল্প, মাথার ওপরে ঢেউ, উজিয়ে থাকা শ্বাসমূল ভাসিয়ে নিয়ে নিয়ে

যেতে পারে সে। এগিয়ে আসে হৃৎপিন্ড অবধি দামাল প্রেমিকের মতো আর টেনে নিয়ে

যায় জমে থাকা জঞ্জাল। আর প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় ঝিনুকে ঝিনুকে। প্রত্যুত্তর।

কুড়িয়ে নিয়ে আসি রেশমি বটুয়ায়। প্রেমিকের চিঠি। সংকেত আর কবিতা তাতে। কান

পাতলেই শুনতে পাবে ডাক। আকুলি বিকুলি মন। বালি আর আঁশটে গন্ধ রয়ে যায়

অনেকদিন যতদিন না আবার নতুন গল্প নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বালিরেখা পথে।

কিন্তু যাদের নৌকা আটকে গেছে পাঁকে কিংবা হারিয়ে ফেলেছে নোঙর খোলার কৌশল,

যারা সহজে পৌঁছতে পারে না জলের কাছে, তারা অপেক্ষা করে আষাঢ়ে দুপুরের, যখন

আকাশ ভেঙে নামবে মেঘমল্লার আর উত্তর কলকাতার গলিপথগুলো হয়ে উঠবে আস্ত

এক একটা নদী, ওরা এক দৌড়ে চৌকাঠ পেরিয়ে নৌকা ভাসিয়ে দেবে জলে। এ গলি, ও

গলি হয়ে সে নৌকা ঠিক পৌঁছে যাবে গঙ্গায়। ঝুরি বট ধরে ডাঙার গল্প শোনাবে নাবাল

মন, সোঁদা জীবন সহজ হয়ে থাকতে জানে সেইখানে।

গ্রিলের বাইরে হাত বাড়িয়ে বিন্দু জল দিয়ে মেয়েটি আঁকবে কপালে টিপ, গাইবে

ভাটিয়ালি গান, তারা জানে তাদের পোষা নদী শুকনো দিনেও সে গান শুনতে পায়। প্রত্যেক

মেয়েই জানে কিভাবে নদীকে পোষ মানাতে হয়। তারপর এপ্রিল মাসের খটখটে দুপুরেও

পিচ কালো রাস্তায় তাদের ছেড়ে দিতে হয়, তারা বয়ে যায় শহর জুড়ে, আবার ফিরেও


আসে মেয়েটির কাছে। খুব প্রিয় বন্ধুকে সে মেয়ে দেখায় পোষা নদী, জানলার বাইরে হাত

গলিয়ে জল ছিটিয়ে দেয় বন্ধুর মুখে। তারপর অনেকেই বায়না করে সে নদী দেখতে চেয়ে।

মেয়ে দেখায় না সবাইকে। দেখাতে নেই যে! যাদের তৃষ্ণা নেই তেমন, শুকনো হরীতকীর

মতো মন, তারা ওকে পাগল ভাববে! সেদিন পাঁচ তলার বারান্দা থেকে হাত নীচু করে ছুঁয়ে

এল ঢেউ, যেমন করে নৌকা থেকে খানিক হেলে পড়ে ছুঁয়ে দেখি জল! ঠিক তেমন... কেউ

বিশ্বাস করবে?

যারা নদী পোষে তারাও ভাবে এক একদিন, কি হবে একবুক তৃষ্ণা নিয়ে? এই আকুলি

বিকুলি, এই হাহাকার, হাসান-হোসেন দশা, কারবালা মাঠের খাঁ খাঁ বালিয়াড়ি বয়ে নিয়ে

কতদূর যাবে তারা? কত দিন কথা শুনবে পোষ্য নদী? তারপর? কেবলই খুঁড়ে যেতে হবে

বালি? ভয় হয়।


“সারা দুপুর খরায় তোমার ধান পুড়েছে।

বিকেলবেলা

হঠাৎ শুরু উথালপাথাল জলের খেলা।

জল ঘুরে যায়, জল ঘুরে যায় নিখিলবিশ্বচরাচরে --

আমার ঘরে, তোমার ঘরে !”

-নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


বৃষ্টিবিহীন ধান কেটে নেওয়া তপ্ত খর বুক স্নাত হয় কবির কথায়। দুহাতে জল কেটে

ডুব দেয় অতলে। নীলচে রঙের সাবমেরিন হয়ে যায় সে। আর ভুলে যায় ডাঙার গল্প।


এসো এসো হে তৃষ্ণার জল



৩টি মন্তব্য: