পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

অমিতাভ সরকার

                                            





বেজন্মা ( পঞ্চম  পর্বের পর )


 রান্না ঘরে ঢুকে কৃষাণ দেখে, বড় কাঠের পিড়ি পাতা, সামনে চকচকে কাঁসার গ্লাসে জল। ভদ্রমহিলার কথায় বসে পড়ে পিঁড়িতে। ঝকঝকে কাঁসার থালায় সাজানো ভাত, শাক, ডাল, দু’রকম ভাজা, কুঁচো মাছের টক আর মুরগীর মাংস। 

“বিশেষ কিছু করতে পারি নি, বাড়িতে যা ছিল, তাই দিলাম”। একসঙ্গে খাবারের এত পদ কোনোদিন দেখেনি কৃষাণ।  

“পিসিমা, এত খাবার…!! এত খাবার খেতে পারে কেউ…! আবার মাংস করেছেন কেন?    

“বাড়িতে যা ছিল, তাই দিয়েছি তোমাকে”। ভদ্রমহিলার কথায় সায় দেয় রাবেয়া। 

“ঠিক বলেছো মা, খাওয়া দাওয়া না করলে আমাদের রক্ষা করবে কে?” রাবেয়ার কথায় তাকায় কৃষাণ। পাশে একটা ছোট পিঁড়িতে বসে বাতাস করে রাবেয়া। সামনে বসে কৃষাণের খাওয়ার তদারকি করেন ভদ্রমহিলা। খাওয়ার পর শোওয়ার ঘরে ফিরে আসে কৃষাণ। রাবেয়া বিছানার চাদর, ঠিক দেয়।  

“এবারে একটু জিরিয়ে নিন। আমরা খেয়ে আসছি” 

একটু পরে খাওয়া সেরে ফিরে আসে রাবেয়া। বিছানার সামনে চেয়ার নিয়ে তাদের সামরিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তাদের প্রশিক্ষণ, থাকার ব্যবস্থা, ডিউটি… কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ফিরে আসে। তাই দেখে কৃষাণ উঠে পড়ে।   

“এবার আমি যাই পিসিমা। বেলা পড়ে এলো”।   

“এখনি যাবে? আজ থেকে গেলে ভালো হতো। আমাদের বাড়িতে তো আত্মীয়স্বজন কেউ আসে না…”। 

“হ্যাঁ পিসিমা, ফিরতে হবে, একটু অসুবিধা আছে। আগামীকাল ফেরার পথে দেখা করে যাব”। বারান্দায় রাখা মোড়ায় বসে জুতো পরে নেয় কৃষাণ। 

“রাবেয়া, দাদাকে এগিয়ে দিয়ে আয়”। রাবেয়া বারান্দা থেকে সাইকেল নামায়। একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাবেয়াই প্রথম কথা বলে…।  

“আচ্ছা কৃষাণ’দা, লাভপুরে এসে প্রথমে আমাদের বাড়িতেই এসেছেন, কোথাও যান নি? কত লোক বেড়াতে আসে এখানে!”  

“আজই এসেছি সকালে, লজ থেকে সোজা তোমাদের বাড়ি। তোমাদের জন্যই তো এখানে আসা…। 

“তা বললে হয়, কতকিছু দেখার আছে এখানে। সাহিত্যিক তারাশঙ্করের বাড়ি, কোপাই নদীর হাঁসুলিবাঁক, ‘ফুল্লরা’ শক্তিপীঠ…। জানেন, লাভপুরে তেলেভাজা খুব বিখ্যাত! বাকুলমোড় আসতেই কৃষাণকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে উধাও হয়ে যায় রাবেয়া। হঠাৎ এভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়াতে খুব অবাক হয়ে যায় কৃষাণ কিছুটা বিরক্তও …। ভাবতে ভাবতেই হাতে দুটি খবরের কাগজের ঠোঙা নিয়ে ফিরে আসে রাবেয়া।      

“এই নিন কৃষাণ’দা আলুর চপ আর পেঁয়াজি। খেয়ে দেখুন, এমন তেলেভাজা খান নি কোনোদিন”। হাসতে হাসতে আলতো করে কামড় দেয় পেঁয়াজিতে। কৃষাণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে…।  

“ইস…, অনেকগুলি টাকা খরচ হয়ে গেল তোমার। আগে জানলে, আমি খাওয়াতাম”।

“পরেরবার খাওয়াবেন। আজ প্রথম দিন, আমি খাওয়ালাম। নিজের রোজগার করা পয়সা মশাই”। রাবেয়ার উচ্ছলতা দেখে ভালো লাগে কৃষাণের। পরক্ষণেই চুপ করে যায় রাবেয়া।  

“জানেন, আমাদের বাড়িতে কোনোদিন কেউ আসে নি। সবাই বাংলাদেশে, আমরা শুধু পড়ে আছি এখানে। আব্বুও আমাদের ছেড়ে চলে গেল, আম্মাও চলে যাবে একদিন”। রাবেয়ার কথা শুনে কৃষাণেরও মন ভারি হয়ে যায়। কথা বলতে বলতে সামলে নেয় সামলে নেয় নিজেকে।  

“আপনি এসেছেন, তাই একটু…। এই শুনুন, সামনেই ফুল্লরা মায়ের মন্দির…, যাবেন?”  

 “তোমার দেরী হয়ে যাবে না? তাছাড়া পিসিমাও চিন্তা করবেন”।   

“ও কিচ্ছু হবে না, চলুন তো…।”। অসংকোচে কৃষাণের হাত ধরে রাবেয়া…।    

“কৃষাণদা আপনাকে সবাই দেখছে…। ভাবছে এই ছুটকীটার সঙ্গে এই হ্যান্ডস্যামটিকে…” হাঁটতে হাঁটতে চাপাস্বরে বলে রাবেয়া। কৃষাণ হো হো করে হেসে ওঠায় আশেপাশের লোকজন তাকাতে চুপ করে যায়।   

“কী যে বলো… ভাবছে, এই কেলটেটা এলো কোথা থেকে”!    

“দূর, আপনার মতো স্মার্ট, লম্বা, হ্যান্ডস্যাম কেউ আছে নাকি এখানে?” কথা বলতে বলতে ফুল্লরা মন্দিরের দিকে এগোয় তারা। পথে পরিচিত অনেকেই জিজ্ঞাসা করে কৃষাণকে দেখে। রাবেয়া হেসে দাদা বলে পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের সঙ্গে।     


লোকালয় থেকে দূরে চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা ছায়াময় পরিবেশে কাঁকুড়ে মাটির টিলার ওপর ফুল্লরা মন্দির। একপাশে মহাশ্মশান, নীচে উত্তরমুখী কোপাই নদী। 

“কিরে রাবেয়া, এদিকে…”। প্রবেশ পথের তোরণ পেরোতেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাদের। মন্দিরের ম্যানেজার, রাবেয়াদের গ্রামে থাকেন। রাবেয়া তাকে দেখে এগিয়ে যায়। 

“কাকু, ইনি আমার দাদার বন্ধু। মিলিটারীতে আছেন। আমি নিয়ে এলাম দর্শন করাতে। কৃষাণ হাত জোড় করে নিজের পরিচয় দেয়।    

“আমার নাম কৃষাণ, বিএসএফ-এ আছি। আজই এসেছি রাবেয়াদের খোঁজ নিতে। রাবেয়ার চাচাতো দাদা আমার সঙ্গে কাজ করে”।  

“খুব ভালো করেছেন। দর্শন করে যান, খুব জাগ্রত দেবী। মনবাঞ্ছা যদি কিছু থাকে মানত করে যান। মেলা ছাড়া রাবেয়া তো এদিকে খুব একটা আসে না, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম…। মাঘী পূর্ণিমায় বড় মেলা হয় এখানে…। চলুন আপনাকে ঘুরে দেখাই”। ভদ্রলোক তাদের নিয়ে মন্দিরের সামনের চত্তরে নিয়ে আসেন।         

“পুরাণের মত অনুযায়ী এই স্থানে সতীর নীচের ঠোঁট পড়েছিল। দেবী এখানে ‘ফুল্লরা’ নামে পূজিতা হন”। কৃষাণ মন্দিরের সামনে দরজায় এসে দাঁড়ায়। মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। একটি কচ্ছপের আকৃতির শীলাখন্ড, শীলাখণ্ডের ওপরে তেল-সিঁদুর, জবাফুল, বেলপাতা। সেই শিলাখণ্ডের চারপাশে কয়েকজন মহিলা বসে পুজোর আয়োজন করছেন। 

ভদ্রলোক হাঁটতে হাঁটতে তাদের একটি বড় দিঘির কাছে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক জানালেন, দিঘির নাম দেবীদহ। কথিত আছে রামের অকাল বোধনের সময় হনুমান এই দিঘি থেকেই ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন। বীরভূমের প্রচন্ড দাবদহে যখন চারিদিকের জলাশয় যখন শুকিয়ে যায়, এই দিঘির জল একই রকম থাকে। তখন আশপাশের বহু মানুষের ভরসা এই দিঘী”। বিদায় নেবার সময় ভদ্রলোক পরেরবারে পরিবারের সকলকে নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। তাদের অতিথি নিবাসের কথা জানিয়ে মোবাইল নম্বর লিখে নিতে বলেন কৃষাণকে।       

( ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন