পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

শ্রাবণী সোম যশ

                                




স্বর্ণকুঠি' 



"ওরে আস্তে আস্তে বাছা  , এই আধভাঙ্গা মার্বেলের বুকে কান পাতলে আজও মলের ঝমঝম শব্দে পায়ে পায়ে ঘুরতে ইচ্ছে করে। তোদের  কাছে এখন চুন সুড়কির গাদা বৈ আর  কিছুই তো নয়। কিন্তু আমার তো সর্বস্ব। একটাই শান্তি  জায়গাটা ভালো কাজে লাগবে। এই মহীপাল গ্রামেরই ছেলে নির্মল ঠিকাদার। ওর ঠাকুর্দা ছিল নামকরা লেঠেল। তারই নরম-সরম  নাতি নির্মল। পেশায়   ঠিকাদার। ওর যখন দু বছর , গাঁজাখোর বাপটা মরলো কামবেশ্বর তলার ঝোপে সাপের কামড়ে।  বড়ো জাগ্রত শিব এই কামবেশ্বর। কামবেশ্বরের ফুল বেলপাতা দিয়েই তো আমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহানারায়ণ পাল। যেমন ধনী তেমনই গুণী জমিদার। তার নামেই তো চন্দ্রপুরের নতুন নাম হলো মহীপাল। ওরে ওরে দেখে বাপ আমার, এই জীর্ণ শরীরে এখনও ব্যথা টের পাই রে। লোকে বলে খ্যাপাটে নির্মল। নিজের মনে কথা কয়।  আমার সুখদুখের কথা তো ওই একমাত্র বোঝে। বেটা এখন কাজ পেয়ে কথায় গা করছেনা"।
- আহ থামো দিকিনি , না আছে তোমার ঐ স্বর্ণকুঠি নাম আর না আছে আগের সেই গৌরব। এখন তো লোকে ভাঙ্গাকুঠি নাম দিয়েছে তোমার । তাও এত দেমাক কিসের।
ধমকায় নির্মল। ভাঙাচোরা রাবিশ সরানোর কাজে ব্যস্ত কুলি- কামিনরা ওর আপনমনে  বকবকানি দেখে হাসে। এসব গায়ে মাখে না ও।

ছোটবেলায় মায়ের সাথে স্বর্ণকুঠির বাগানে প্রথমবার  কাঠ কুড়াতে এসে  রংচটা থামগুলোর গায়ে হাত বোলাতেই শুনতে পেয়েছিল,
- আহ ! কতদিন বাদে সেই কমলাবতীর মতো মিঠে হাতের ছোঁয়া পেলাম।
চমকে সরে এসেছিল নির্মল। খুব ভয় পেয়ে গেছিলো সেদিন। আবার পরেরদিন কি এক অদ্ভুত নেশার টানে  এসে  এই বিশাল বাড়িটার আধখসা থাম দেওয়াল জং ধরা গরাদ দরজার ইয়া পাল্লা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিল। পায়ে পায়ে লম্বা বারান্দা ছাড়িয়ে বাগানের কোণে কামবেশ্বর মন্দিরের চাতালে গিয়ে বসেছিল। পেয়ারা কাঁঠাল জামরুল আম সবেদা কি নেই ! যে যার খুশিমত পেড়ে খায়। সাপখোপ , দু চারটে হাড়গিলে শেয়াল বেঁজির রাজত্ব আছে ঠিকই তবে তাতে ও ডরায় না। পাঠশালায় ছুটি হলেই আধখামচা সোনালী রঙের  ভাঙাচোরা ঘরগুলোয় ঘোরার নেশায় ছুটে আসতো ও। মায়ের কাছে শুনেছে  আরও অনেক আগে পুরো বাড়িটাই সোনালী রঙের ছিলো। আর  একদম ওপরে একটা ছোট সোনার স্তম্ভ ছিল তাতে অনেক আলো বসানো ছিলো। সেই আলো যখন গোটা বাড়িতে ঠিকরে পড়তো সত্যিই নাকি মনে হতো সোনার বাড়ি। নামও ছিল স্বর্ণকুঠি।

পাঠশালায় ছুটি হলেই  রোজ চলে আসতো এখানে। কি করে যেন ভারি বন্ধুত্ব হয়ে গেল এই স্বর্ণকুঠির সাথে। প্রতিটি দেওয়াল কড়ি বরগার কথা শুনতো মুগ্ধ হয়ে।  শিকড় গজানো লোহা বের করা সিঁড়ির ধাপে আলতো পায়ে ভর দিয়ে পৌঁছে যেত দোতলার বিশাল হলঘরে, যেখানে ঝাড়লণ্ঠনের স্মৃতি আঁকড়ে শূন্য আংটাগুলো মূকাভিনয় করছে।   দেওয়ালের ফ্রেশকো ছিঁড়ে গজিয়ে ওঠা লতাগুল্মের বাহুডোরে ধরা দিয়েছে স্যাঁতস্যাঁতে ঐতিহ্য। আবার কখনও আগাছার ঝোপ সরিয়ে নেমে যেতো মন্দিরের নিঃঝুম গর্ভগৃহে। মুগ্ধ হয়ে শুনতো কমলাবতীর কথা স্বর্ণকুঠির জবানে,
- দুধে-আলতায় ডোবানো পায়ের ছাপ ফেলে ষোড়শী কমলাবতী এগিয়ে চললো  অন্তঃপুরে। গায়ের রং আর পায়ের ছাপ দুই  মিলেমিশে একাকার। সাথে নতুন বউয়ের গয়না,  মলের ঝমঝম শব্দ। আমার পাথুরে বুকটা জুড়িয়ে যেত ওর কোমল স্পর্শে মিঠে সুরেলা গলার স্বরে।
শুনতে শুনতে কিশোর নির্মলেরও মনে খুব সাধ হতো সেও একবারটি কমলাবতীকে ছুঁয়ে দেখবে। প্রশ্ন করতো,
- কমলাবতী কে ?
-মহানারায়নের পুত্র বীরনারায়ণ, তার যমজ পুত্র হোল প্রতাপনারায়ণ  আর প্রদীপনারায়ণ । প্রসূতিগৃহেই মোহানারায়নের স্ত্রী   রানিমা মারা গেলেন। এমনই লিখন,  তার কিছুদিনের মধ্যেই দুই ছেলেও পিতৃহারা হলো। দুই ভাইয়ের কারোরই ঝোঁক ছিলোনা জমিদারীতে। নায়েবই ওসব সামলাতেন। কমলাবতী হল ছোটছেলে প্রদীপের স্ত্রী। প্রদীপ ছিল আমুদে  দিলদরিয়া কিন্তু রাগলে চন্ডাল।  শিকারের প্রবল নেশায় মাসে অন্ততঃ সাতদিন জঙ্গলেই কাটাতেন।   জঙ্গলের মোহিনী আকর্ষণের  কাছে হার মেনেছিলো কমলাবতীর স্নিগ্ধ রূপলাবণ্য। এদিকে প্রতাপ ছিল আত্মকেন্দ্রিক ঘরমুখী কিন্তু সুরের সাধক। যেকোন বাদ্যযন্ত্র ওর আঙুলে প্রাণ পেতো। কিন্তু কিছুতেই সংসারী হতে রাজি হলেন না।
গল্প শুনতে শুনতে সড়সড় করে হয়তো সাপ চলে যেতো নির্মলের গা ঘেঁষে। হুশই  থাকতোনা ওর বাড়ি ফেরার। কতবার যে লাঠিপেটা খেয়েছে মায়ের কাছে।


ভাঙা স্বর্ণকুঠির  রাবিশ সরানোর কাজ পেয়েছে নির্মল। তারপর এই জমিতে মেয়েদের হাইস্কুল হবে। ইদানিং গ্রামের বেশ কিছু বখাটে ছেলে আস্তানা গেড়েছিলো ওই স্বর্ণকুঠিতে। নালিশ করেও লাভ হয়নি। এদ্দিনে একটা কাজের কাজ হবে। নির্মল মনে মনে ভাবে গ্রামের মেয়েগুলোকে আর ভিন গ্রামে যেতে হবে না পড়তে। ভাব
এটা সেটা ভাবতে ভাবতে  কখন যে স্বর্ণকুঠি পৌঁছে গেছে খেয়ালই করেনি। দু তিনটে করে সিঁড়ি টপকে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে দোতলায় দক্ষিনদিকের বিশাল ঘরটায় এসে দাঁড়ালো নির্মল। দেখলেই বোঝা যায় এটা প্রতাপনারায়ণের সংগীত মহল। ঘরের মেঝেজুড়ে উইযের আল্পনা।  এখনও দোয়ালের কোথাও কোথাও বাদ্যযন্ত্রের অংশবিশেষের মলিন চিত্র চোখে পড়ছে। কত অনুরণন কত সুর মুর্ছনার সাক্ষী এই ঘরের প্রতিটি কোণ ! ওমনি কানে এলো,
- সুর না সুরের অভিশাপ ! 
- অভিশাপ কেন হবে, ধনীদের ওসব বিলাসিতা তো থাকেই। কথা বলতে বলতেই কেমন দমবন্ধ লাগে নির্মলের। এতদিনের পুরোনো বাড়ি !  ওর মনের কথা যেন পড়ে ফেলে রংচটা দেওয়াল আধভাঙ্গা জানলা দরজা সবাই।
- এঘরের বাতাস তো ভারী , হাঁপিয়ে তো  উঠবেই তুমি । তার চেয়ে  বরং মন্দির চাতালে বসো। ওরা কাজ করুক ওদের মতন।
মন্দিরের শ্যাওলাধরা সিঁড়িতে বসে নির্মল উদাস হয়ে যায়। বাগানটারও  হতশ্রী দশা। ভেতর দালানের পাশে কয়েকটা পেয়ারা আর টগর গাছ টিকে আছে এখনও। দালানেই গাঁজা জুয়ার ঠেক বসছিল কয়েকমাস ধরেই।

মনটা হু হু করে নির্মলের, মনে পড়ে যায় পুরোনো কথা, কমলাবতীর কথা। তখন নেশা ধরে গেছিলো কমলাবতীর গল্প শোনার। দুপুর বিকেল যখন হোক লুকিয়ে চুরিয়ে পৌঁছে যেত স্বর্ণকুঠি, ডুবে যেত গল্পে, মুগ্ধ হয়ে শুনতো,
- কিশোরী কমলাবতী লঘুপায়ে এঘর ওঘর দালান ঘুরে বেড়াতো। সারাদিন শুনতাম  ওর মলের মিষ্টি শব্দ। বাগানে রঙিন প্রজাতির মতো ঘুরে বেড়াতো। ভারী ভালো মেয়ে। প্রতাপকে সমীহ করে একটু দূরে দূরেই থাকতো। একবার  হয়েছে কি , প্রদীপ গেছে শিকারে আর দুপুরবেলায় কমলাবতী ঘুরতে ঘুরতে প্রতাপের ঘরের সামনে যে বড় হল টা আছে ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে।  ওর সেতারের সুর মুগ্ধ হয়ে শুনছে। শুনতে শুনতে আপন খেয়ালে সুরের তালে হলময় ঘুরে ঘুরে নাচছে ঠিক যেন দেবতাকে সমর্পণ করছে ওর ভক্তি - ভালোবাসা। এরপর থেকেই রোজ ওই সুরের টানে কমলাবতী উঠে আসতো ওপরে।  কোনোদিন বাঁশি তো কোনোদিন এস্রাজ বা তবলায় বোল তুলতো প্রতাপ আপনমনে। ও টেরও পায়নি যে কমলাবতী রোজ সুর- তালের ছন্দে মেতে ওঠে। একদিন রাতের  প্রথম প্রহরে  প্রতাপ  বাজাতে বাজাতে বাঁশিটি রেখে হলে বেরিয়েই দেখলেন অপুর্ব লীলায়িত ভঙ্গিতে কমলাবতী নেচে চলেছে। যেন মীরা,  শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিবেদন করছে নিজের ভক্তি। মুগ্ধ হয়ে গেলেন প্রতাপ। বাঁশিটা নিয়ে আবার বাজাতে শুরু করলেন কমলাবতীর চারপাশে ঘুরে  ঘুরে। খোঁপা ভেঙে মেঘবর্ণ চুল লুটিয়ে পড়েছে কোমর ছাপিয়ে, স্খলিত আঁচল, পদ্মফুলের মতো মুখমণ্ডলে মুক্তোবিন্দু ঘাম। একজন সুরে মুগ্ধ আরেকজন সুষমায় ! কখন  যে সেখানে প্রদীপ ফিরে এসে দাঁড়িয়েছে দুজনের কেউই টেরও  পায়নি। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেল প্রদীপ। হাতে শিকারের দো-নলা বন্দুক। চিৎকার করে উঠলেন, এইসব রসলীলা  চলছে আমার অনুপস্থিতিতে। সম্বিৎ ফিরতেই চমকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো কমলাবতী। প্রতাপও নিজ কক্ষে ফিরতে উদ্যত কিন্তু কোনকিছুরই সুযোগ দিলো না প্রদীপ। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম ভুল হচ্ছে।  চরম ভুল। ফুলের চেয়েও নিষ্পাপ মেয়ে ও।  চিৎকার করে বলেছিলাম ওকে মেরো না। ওর যে অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। ততক্ষণে প্রতাপও নিজের ঘর থেকে বন্দুক নিয়ে এসেছে। কেউ শোনেনি আমার কথা। কেউ না। স্বর্ণকুঠির নোনা স্যাতস্যাতে দেওয়াল আরো একটু ভিজে ওঠে স্মৃতির ভারে।
- কি হলো চুপ করে গেলে কেন। বলো কি হয়েছিল সেদিন।
- যা হয়েছিল সেতো গ্রামের সবাই  জানে। প্রদীপের বন্দুকের গুলিতে লুটিয়ে পড়লো কমলাবতী। দু দুটো প্রাণ চলে  গেল একসাথে। প্রদীপকে বলার অপেক্ষায় ছিল ও। বলা হলো না। কেউ জানলো না কমলাবতী মা হতে চলেছিল। 
- হ্যাঁ জানি প্রদীপনারায়ণ বউকে মেরে দুঃখে নিজেও গুলিতে আত্মহত্যা করেছিল। তবে তার আগে প্রতাপ নারায়ণ এর মাথার খুলি দু টুকরো করে দিয়েছিল গুলিতে।
-  দুই ভাইয়ে তুমুল বচসা। দুজনের হাতেই বন্দুক। হাতিহাতিতে প্রদীপের  বন্দুকের গুলি প্রতাপের  মাথা ফুঁড়ে এসে  লাগলো আমার ছাতিতে। উফফ কি কষ্ট ! না না গুলিতে নয়, চোখের সামনে গোটা পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। এতগুলো  প্রাণ চলে গেল!  অসহায় আমি চুপ করে দেখলাম। কাউকে বাঁচাতে পারলাম না। আমার সর্বাঙ্গ  এমনভাবে জমির সাথে শক্ত করে গাঁথা ছিল আমি কিছুই করতে পারলাম না। সেইদিন থেকে চিড় ধরলো  আমার শরীরে ।

নির্মল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে বেশিরভাগ ভাঙা আবর্জনা সরিয়ে ফেলেছে ওর  লোকজন। কিন্তু এই কাজটা করে ও  একদম খুশি নয়। ওর ছোটবেলার স্বপ্নের রাজ্য এটা। শুধু ছোটবেলা কেন আজও ওর জীবনের অচ্ছেদ্য সঙ্গী এই স্বর্ণকুঠি। আজও দুজনে দুজনের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয় চাতালে। ও না করলে অন্য কেউ করবে এই কাজটা। করবে নির্মম ভাবে। তবে নির্মল ভেবেই রেখেছে মূল ফটকের সামনের প্রিয় মার্বেলের টুকরোটা ও নিজের কাছেই রাখবে। স্বর্ণকুঠির মূল দুটো স্তম্ভ আড়াআড়ি এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে গোটা বাড়ির বেশিরভাগ অংশই  তাতে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে। একেবারে ধ্বংসস্তুপ। পেয়ারা গাছের খানিকটা থেঁতলে গেছে। আর গাছ !  বাড়িটারই কিছু বাঁচলো না। এইতো দু সপ্তাহ আগেও ও কতক্ষন কাটিয়ে গেছে বাইরের দালানে। কই একবারও মনে হয়নি তো এভাবে হঠাৎ সব ধ্বংস হয়ে যাবে। স্বর্ণকুঠি নিজেও কি বুঝেছিলো শেষের সে দিন ঘনিয়ে এসেছে। স্কুলফেরত বাচ্ছাগুলো দুদ্দার ছুটে এসে পেয়ারা পাড়ছিলো। ওদের দলে মাঝে মাঝেই কমলিটাও থাকে। নির্মল দেখলেই সাবধান করতো বাচ্ছাগুলোকে, সাপখোপ আছে। মনে মনে হেসেছিল ওর মতো কমলিটারও কি স্বর্ণকুঠির নেশা ধরলো ! ওর ই তো মেয়ে। ও নিজেও তো কমলীর মতো 6 বছর বয়স থেকেই স্বর্ণকুঠিতে আসতো। পিলার দুটো সরালেই কাজ শেষ।  অদ্ভুত ব্যাপার এতবড় আর ভারী  পিলার উল্টে পড়েছে, কিন্তু টুকরো টুকরো হয়ে যায়নি। যারা সেদিন ওই ভেতর দালানে জুয়ার আসর বসিয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন আহত হয়েছে ওই পিলারের নীচে। একজনের কোমর থেকে নিম্নাঙ্গ থেঁতলে গেছে আরেকজনের হাত দুটো গুঁড়িয়ে গেছে। দুজনেই হাসপাতালে। আদৌ বাঁচবে কিনা কে জানে। পিলারগুলো ভেঙে ভেঙে সরাতে হবে। প্রথম পিলারের পর দ্বিতীয়টা একটু সরাতেই তলা থেকে একটা চ্যাপটানো জুতো আর ফ্রকের ছেঁড়া অংশ দেখা গেলো। চমকে উঠলো নির্মল, একি এত কমলির জামা জুতো। কমলি এসেছিল সেদিন এখানে ! কই বলেনি তো। থেবড়ে বসে পড়লো ও ওখানেই। কি সর্বনাশ ! যদি কমলির কিছু হতো ! যদি চাপা পড়ে যেতো পিলারের নীচে ! ও বাঁচতো না। জানতেই হবে কমলির জামা জুতো এখানে এলো কি করে । সব মজুরদের দুপুরের খাবারের ছুটি দিয়ে দিল নির্মল। আজ পুরোটা না জেনে ও কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। কমলি যে এসেছিল সেটা তো বুঝতেই পারছে। কিন্তু কই কমলি তো কিছুই বলেনি । নাহ ওকে শুনতেই হবে। চিৎকার করে ওঠে নির্মল,
- বলো বলো আমার কলমী কি করছিল এখানে।
- তোমার কলমী তো ঠিক আছে কিছু ক্ষতি তো হয়নি ওর। তাহলে আর কেন চিন্তা করছো এত। আমি কি পারি তোমার কলমীর কোনো ক্ষতি করতে !  এবার আমায় বিদায় দাও। অস্থির হয়ে ওঠে পিতার বাৎসল্য। কিছু তো ঘটেছে যেটা ও জানেনা।
- বলতেই হবে তোমাকে । এই অস্থিরতার মধ্যে আমাকে ফেলে রেখে তুমি চলে যেতে পারো না।
- বাচ্ছাগুলো রোজই আসে পেয়ারা খেতে। ডালে চড়ে লাফায় ঝাঁপায় পেয়ারা খেয়ে বাড়ি যায়। সেদিন মেঘে কালো হয়ে এসেছিল চারিদিক। কলমী একাই এসেছিল পেয়ারা পাড়তে। ভেতর দালানে তখন দুজন বসেছে তাস আর গাঁজার ছিলিম নিয়ে। কলমীকে দেখেই ওরা হাত নেড়ে ডাকলো ভেতরে।
- আহ থেমো না বলো। চুপ করে থেকো না আর। জানি খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার। সবাই ভাবে তোমার সারা শরীরে নোনা ধরেছে কিন্তু আমি জানি ওটা তোমার কান্না, চোখের জল। একটিবার একটু কষ্ট সহ্য করে বলো
- ওরা কলমীকে বললো, অনেক পেয়ারা দেবে ওদের কোলে বসলে। আমি চিৎকার করে বললাম কলমী বাড়ি যাও ঝড় উঠবে এখুনি। ওরা দুষ্টু লোক। চঞ্চল কলমী লাফাতে লাফাতে ছুটে এলো ওদের কাছে। হেসে উঠলো ওরা দুজনেই। আমি ভয় পেয়ে গেলাম ওদের কান্ড দেখে। কি করি এখন । ওরা ওর গাল টিপছে জামা তুলে ওর পাপড়ির মতো শরীরে।
- আহ চুপ করো তুমি। আমি আর শুনতে পারছিনা। তুমি আমার কেউ না। চুপ করে দেখলে তুমি। কিন্তু কমলীর কিছু হলে ব্যথা পেলে ওর মা তো বলতো আমাকে। বলো তুমি আমি সব শুনবো।
- আমি অসহায় চিৎকার করছি কেউ এগিয়ে আসছে না। কিভাবে রক্ষা করি এই পাষন্ডদের কবল থেকে। কলমীর দু হাতে দুটো পেয়ারা ধরিয়ে দিয়েছে ওরা। এবার ওরা ওর ইজের ধরে টানছে। ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো দিয়ে কলমী ওদের হাত সরিয়ে দিচ্ছে। ওরা তত মজা পাচ্ছে। ভাবছি  আবার কি সেই আগের মতোই মুক আমি দেখবো। আগেরবার তো পারিনি, মান প্রাণ কিছুই রক্ষা করতে। এবারেও কি ! কি করি। কিন্তু হুড়মুড়িয়ে ওদের গায়ে পড়লে কলমীও তো বাঁচবে না। বাবা কামবেশ্বর সহায়। প্রচন্ড ঝড়ে ধুলোয় কলমী ছিটকে পড়লো উঠোনে। ওর জামাটা ছিঁড়ে গেল ওদের হাতের টানে। সুযোগ কাজে লাগলাম আমি। এই পোড়ো জান দিয়েও ক্ষতি হতে দেব না কলমীর। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে নিজের মূল স্তম্ভ নড়িয়ে পড়লাম ওদের ওপর। ততক্ষনে কমলী ভয়ে খালি পায়েই ছুটছে বাড়ির পথে। আমি বুঝলাম আমি পেরেছি। আমি জিতে গেছি এবার। কমলিবালা না হোক কলমী রূপে তো তাকে রক্ষা কোরতে পেরেছি। আহ কি শান্তি !
আজ স্কুলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন হলো। কলমীকেও এই স্কুলেই ভর্তি করে দিয়েছে নির্মল। বিশাল গেটের ওপর সোনালী ফলকে লেখা কমলিবালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। আর শ্বেত পাথরের টুকরো টা আজও নির্মলের বাড়ির ঠাকুর ঘরের চাতালে লাগানো আছে।  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন