পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

                                                                     


ফিরে দেখা এক বর্ষার দিন....


সকালে খুব তাড়াতাড়ি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অফিসে গেলেও মনটা অস্থির, মেঘলা হয়েছিল দীপের।

বাড়িতে আবারো সেই একই কারণে ঝামেলা। কাল রাতেও রাগে, দুঃখে কিছু খায়নি, সকালেও নয়।

ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেবে ভেবেছিল কিন্তু মাসের শেষে পকেটের অবস্থাও সুবিধার নয়।

নিজের টেবিলে বসে ব্যাগ থেকে ঘরে নিয়ে যাওয়া কাগজপত্রের বোঝা বের করে বসল। তাড়াতাড়ি এই

কাজগুলো সেরে ফেললেই বেরিয়ে পড়তে পারবে। ওর সহকর্মী বোধহয় মুখ দেখেই কিছু আঁচ করেছিল।

উঠে এসে বলল, ‘চল একটু চা খেয়ে আসি আগে। আজও না খেয়ে এসেছিস, তাইনা?’

‘না না খেয়েই এসেছি, তবে চল চায়ে তো আপত্তি করার কিছু নেই’। ব্যাগটা ড্রয়ারের নিচে ঢুকিয়ে

উঠেছিল দীপ। ক্যান্টিনে বসার পর শুধু চা নয়, সাথে বাটার টোস্টের অর্ডারও দিয়েছিল রীতা। বাধা

দেওয়ায় বলেছিল, ‘আমি তো খেয়ে আসি নি, একা একা খাবো নাকি। দুটোমাত্র টোস্ট খেতে পারবি না।

সবসময় এমন না না করিস কেন বুঝিনা বাপু’।


কথা বাড়ালো না দীপ। চুপচাপ টোস্টদুটো খেয়ে চায়ে চুমুক দিল। ওকে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি

চুপচাপ দেখে রীতা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে তোর আজকে মুড ঠিক নেই মনে হচ্ছে। এলি কিসে

অফিসে? অটোতে না রিকশায়?’


‘নাঃরে, হেঁটেই এসেছি। আর মুড আমার ঠিকই আছে আসলে সবকিছু তো একসাথে ঠিক রাখা যায়না।

একটা ঠিক হলে আরেকটা বিগড়ে যায়। জীবনটা সবসময় যে আমার মর্জী মতো চলবে তা তো আর

হওয়ার নয়। সকলে সেই ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। বাদ দে এসব কথা। চল আমি হাতের কাজ শেষ করে

একটু আগে বেরিয়ে যাব আজকে’।


রীতার মুখটা ম্লান হয়ে গেল দীপের কথা শুনে। এতো ভালো একটা ছেলে অথচ জীবন সত্যিই ওর সাথ

দেয়না কখনোই। যখন যা করবে বলে ভাবে তার উল্টোটাই হয়। এতো মেধাবী অথচ সাধারন মানসিকতার

মানুষ। নিজের কথা ভাবেই না তেমন করে, শুধু কিভাবে সংসার আরেকটু সামলে নেবে সেই চেষ্টাই করে

যায়। অথচ ওকে কেউ বুঝতে পারেনা, চায়ও না বুঝতে। রীতা চেষ্টার ত্রুটি রাখেনা। একমাত্র ওই

বোঝে দীপের ভেতরকার যন্ত্রণা। দীপ জানে সেটা, সেজন্যই একমাত্র ওর সামনেই খানিক স্বচ্ছন্দ

বোধ করে।


‘তুই যাবি কোথায়, কলেজে? তোর তো পরীক্ষাও চলে এল সামনে। আজ কি আছে, ক্লাস তো করিস না,

তাহলে?’ রীতার প্রশ্নের উত্তরে, দীপ বলল, ‘পরীক্ষার ফী জমা দিতে হবে। কালকেই শেষদিন।

পরীক্ষাটা না দিতে পারলে হবেই না। আমি একবার যদি না বসি তবে আর এ জীবনে আমার গ্রাজুয়েশন

করা হবেনা। কাল অনেক কষ্টে টাকা যোগাড় করেছি। ভালো লাগেনা আর এভাবে চলতে, তাছাড়া আজ

সব চুকিয়ে আসব....’। কথাটা শেষ না করেই চুপ করে গেল দীপ।


অফিস থেকে বেরোনোর আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বর্ষা এসে গেছে। এই অঞ্চলে, একসময়, নিজের

ছোটবেলায় দশ পনেরো কুড়িদিন ধরেও টানা বৃষ্টি হতে দেখেছে দীপ। এখন তেমন হয়না এটাই রক্ষা।

ওর নিজের কোন ছাতা নেই, নেই অনেক কিছুই, সব কথা সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়না একমাত্র

রীতা ছাড়া। মাথার ওপর থেকে ছাতটাই সরে গেছিল যেদিন সেদিন থেকেই এমন একটা অসম পরিস্থিতির

সাথে নিয়ম করে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।


শুধু নিজের জন্য হলে একটা কথা, আজ আরেকজনকে নিয়েও ভাবতে হয়। আর পেরে উঠছে না দীপ।

আজ খুলে বলতেই হবে শ্রাবণীকে সব কথা। ওকে বলতেই হবে, এমন আঘাটায় আটকে থাকা নৌকায়

উঠলে কখনো কোন তীরেই পৌঁছতে পারবেনা ও। ভালবাসার সমস্ত রঙ দেখতে দেখতে ফিকে হয়ে যাবে।

সংশয়, অভাবের সাথে কদিন মানিয়ে চলতে পারবে ও। এমন অভ্যেস তো নেই। নেই সেই অবস্থাও। ওর

জন্য একটা আলোয় ভরা জীবন অপেক্ষা করছে। যেখানে সামান্য একটা মোম আলাদা করে কেনার

ক্ষমতাও নেই দীপের। ওর নাম দীপ হলেও তা যে জ্বালানী ছাড়া, এটা সহ্য করার জন্য, একটা

অন্ধকার ভবিষ্যৎ কিভাবে দেবে ওকে?


বাস রাস্তায় বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হল, ভাবনাগুলোও এইসব সময়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে

মনে। ঝিরঝির করে হয়ে যাওয়া অবিশ্রাম বৃষ্টিতে ভিজে গেল ওর একমাথা চুল, ঝাপসা হয়ে এল চশমার

কাঁচ। অটোগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে কিন্তু এদের ভাড়া বেশি। বাসে আটআনা দিলেই যাওয়া যায়।

হোক দেরী। ওর তাড়া নেই।


কলেজের গেটের সামনে পৌঁছনোর আগেই চোখ পড়েছিল দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শ্রাবণীর

দিকে। বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও, ওদের কথা কতটা শুনছে কেজানে। দৃষ্টি তো রাস্তার দিকে।

অপেক্ষায় আছে কখন দীপের দেখা পাওয়া যায়। অফিসে ঢুকে পরীক্ষার ফী টা জমা দিল দীপ আগে।

তারপর হিসেব করে দেখল পকেটে এখন টাকা সাতেক মতো আছে। আজকের দিনটা কাটানো যাবে। কাল

কে দেখেছে? এখন দীপ যে প্রতিদিনের জন্য জ্বলে, বেঁচে থাকে। ওর কথায় রেগে যায় শ্রাবণী। কিন্তু

বোঝেনা যে দীপ যেটা ভাবে সেটাই বলে। বানিয়ে বলার অভ্যেস আগেও ছিল না, নতুন করে শিখতেও

চায়না আর।


দোতলার সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় দেখল শ্রাবণী নেমে আসছে, একাই। মাঝপথে থেমে গেল দীপ। হাসার

চেষ্টা করলেও সেটা হাসি হল কিনা জানেনা। ‘কোথায় যাবে আজ? সোজা বাড়ি নাকি এদিক সেদিক

ঘুরবে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু’।


শ্রাবণীর দৃষ্টি ওর ভেতরকার অনেককিছু পড়ে নিল। আজ দীপের মন ভালো নেই এটাও পরিষ্কার হয়ে

গেল ওর সামনে। রোজ যে বাড়ি যাওয়া থেকে বিরত করায় আজ সে বাড়ি যেতে বলছে মানে কিছু তো

গণ্ডগোল আছে। ভেতরটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে এল শ্রাবণীর। বেশ কদিন ধরেই ও একটা ঝড়ের

অপেক্ষায় রয়েছে। জানে একটা কিছু আসবে। সেটা দীপের তরফ থেকেই হোক বা অন্যকোন জায়গা

থেকে। ওদের এই স্বপ্ন দেখার অধিকারটাকে ভেঙ্গেচুরে খানখান করে দেওয়ার ইচ্ছে শানানোর

মানুষও যে কম নেই। আজ দীপকে বড্ড অস্থির দেখাচ্ছে, আপাত শান্ত, যেকোন বিপদে মাথা ঠান্ডা

রাখা দীপ তো এটা নয়। কি হয়েছে ওর?


বেরিয়ে পড়ল দুজনে, ওই শিপশিপে বৃষ্টির মধ্যেই। কলেজ থেকে বেরিয়ে, বিশাল মাঠটা পেরিয়ে যাওয়ার

রাস্তায় দীপকে নিজের ছোট্ট ছাতার নিচে ডাকল শ্রাবণী। ‘শুধু শুধু ভিজছ কেন? ছাতাটা মাথায় থাকলে

মাথাটা অন্তত ভিজবে না’।


দীপ হাসল, ‘আমাকে তো জানোই তুমি। আমার ভালোলাগে বৃষ্টি ভিজতে। ভালোলাগে রোদে পুড়তে। আমার

কিছুই হবেনা। আমার কিছু হতে নেই। আমি ক্রমশ মানুষ থেকে যন্ত্রমানুষ হয়ে যাচ্ছি এটা বেশ বুঝতে

পারি এখন। কোনদিকে যাবে বল তো? চলো আজ বরং নদীটাকে দেখে আসি। বর্ষার জলে কতোটা পুষ্ট

হল দেখি চলো’।


চেনা অচেনা রাস্তা ধরে প্রায় গ্রাম্য রাস্তার শেষে, একসময় পৌঁছে গেছিল নদীবাঁধের কাছে। তারপর

সেই বাঁধ ধরেই রওনা দিল দুজনে। বেশ খানিকটা পথ গাছপালায় ভরা, শুরুতে। বাঁধের নিচের দিকে থাকা

বাড়িগুলোর জানলা দিয়ে দুএকজনের উঁকিঝুঁকিও নজরে এলো বারকয়েক। বেশ বেড়েছে নদীর জল।

অনেকটাই। খানিক দূরে যাওয়ার পর বাড়িগুলো চলে গেল দূরে, এবার পথ অনেকটাই ভালো। শহরের

কাছাকাছি এলে যেমনটা হয়।


‘একটা ছাতা নিয়ে তো বেরোতে পারো। ছোট একটা ছাতা তো তোমার ব্যাগেই ধরে যায়। এভাবে ভেজাটা

ঠিক না’। শ্রাবণীর গলায় অনুযোগের সুর। দীপ বলল, ‘ঘরে গোনাগুনতি ছাতা। আমি তার থেকে একটা

নিয়ে বেরোলে বাকিদের অসুবিধে হবে। আর আমার নিজের বলতে কি আছে? তুমি তো জানো, এই জামা

প্যান্ট যা পরে আছি, এটাও অন্য কারুর। ভাগ্যিস আমার সেই আত্মীয় তার শখে, ঘন ঘন পোশাক

পোশাক বদলায়, একে তাকে না বিলিয়ে, সেগুলো আমাকে দিয়ে দেয়, তা না হলে কি করতাম কে জানে’।


কিছুক্ষন চুপ করে পথ চলার পর আবার কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি ঝমঝম করে শুরু হল বৃষ্টি।

সেইসাথে মেঘের গর্জন। তাড়াতাড়ি একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল দুজনে। এবার একটু

কাছাকাছি বলে হাত ধরে ওর অর্ধেক শরীর ছাতার নিচে টেনে নিল শ্রাবণী। বিকট শব্দে একটা বাজ

পড়ল দূরে। ভয়ে শিউরে উঠে দীপের আরো কাছে ঘেঁষে এল ও। গাছের পাতাগুলো থেকেও বড় বড় ফোঁটায়

জল ঝরছে তখন।


দীপ বলল, ‘আমি অনেক ভেবেছি এই কদিন ধরে। আমি আজো জানিনা যে চক্রব্যূহে আমাকে ঢুকতে

হয়েছে সেখানে তোমার জন্য একটা আলাদা জায়গা আমি আদৌ বানাতে পারব কিনা। তুমি বৈভবের

মধ্যে না থাকলেও অভাবের মধ্যে থাকো না। হয়তো অন্য কোনখানে তুমি আরো বেশী সুখী জীবন পাবে।

এভাবে কদিন পথ চলতে পারব জানিনা। একদিন অভাব অনটন ইত্যাদিরা এতো বেশি শক্তিশালী হয়ে

যাবে, ভালোবাসা পালাবার রাস্তা খুঁজবে। আমার সাথে জড়িয়ে গেলে সে রাস্তাও খুঁজে পাবেনা তুমি। আমি

তোমার জায়গায় কাউকে বসাবো না এটা কথা দিতে পারি। এই কথার নড়চড় হবেনা আমার জীবদ্দশায়।

কিন্তু তোমায় আমি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে চাই। আজ এখুনি কিছু বলতে হবেনা। আজ

সারারাত ভাবো। বারবার ভাবো আমি যে কথাগুলো বলছি সেগুলো। একসময় আমাকে জানিও তোমার মত’।


ওদের এইসব কথার মাঝে, কখন বৃষ্টির জোর কমেছে এটা টেরও পায়নি দীপ, শ্রাবণীও। তখন

বারিধারা নেমেছে শ্রাবণীর দুচোখ দিয়ে, অবিরাম। ছাতার ওপরে থাকা ওর হাতটাতে চাপ দিল দীপ।

‘কেঁদো না। আমি তোমার চোখের জল সহ্য করতে পারিনা। আমি যা বলছি এটাই বাস্তব, আমরা যে পথে

এগোচ্ছি সেটা একটা সুখস্বপ্নের মতো হয়তো মনের এককোণে থেকে যাবে আমাদের দুজনেরই কিন্তু

আমি অন্তত এটা জেনে খুশি হবো, তুমি ভালো আছো, সুখে আছো। চলো এগোই আমরা। বড্ড খিদে পেয়ে

গেছে, এখানে কিছু পাবো কিনা কে জানে’।


বাঁধের রাস্তা ধরে খানিকটা গিয়ে শ্মশানঘাট। তার আগেই একটা সুঁড়ি পথ ধরে নিচে নেমে এলো দুজনে।

কয়েকটা দোকান রয়েছে। একটা ছোট চা, মিস্টির দোকানও আছে। একদিকের ঝাঁপ ফেলা। দোকানী

ভারাক্রান্ত মুখে কাউন্টারের বদলে, উনোনের পাশেই বসা। আজ খদ্দের জুটবে কি জুটবেনা তাই

হয়তো ভাবছে বসে। দীপ জিজ্ঞেস করল, ‘চা হবে দাদা? খাবার কিছু আছে কি?’


উনি আগুনের আঁচ পোয়াতে পোয়াতেই বললেন, ‘শিঙাড়া ভেজেছি এই একটু আগেই, এখনো গরম আছে। চা

হবে। একটু বসতে হবে। জলটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে’। ভেতরে ঢুকে কাঠের বেঞ্চে বসল দুজনে। এতক্ষনে

ব্যাগের চেনটা খুলে সিগারেটের প্যাকেট বের করল দীপ। ভেতরে ছিল বলে এখনো সুস্থ আছে

সিগারেটগুলো। দেশলাই দিয়ে ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিল। শ্রাবণীর হাতে ঘড়ি আছে। কটা বাজে

জিজ্ঞেস করায় বলল, ‘সোয়া তিনটে’। গলাটা ভার শোনালো ওর।


দীপ বলল, ‘চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ি চলো। আজ আর হেঁটে ফিরব না। স্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে নিই বরং।

তোমাকে যা বললাম তা আমার মনের কথা। অনেক ভেবেছি আমি। কালও সারারাত ধরে এইসব নিয়েই

ভেবেছি। আমার সামনে যে আর কোনো পথ খোলা নেই শ্রাবণী। হয়তো ভবিষ্যতে খুলেও যেতে পারে

কিন্তু সেদিনের জন্য অপেক্ষা করার কোন উপায় তো নেই। আমার তো অফুরন্ত সময় কিন্তু তুমি?

তোমাকে, তোমার বাড়ির সবাই কি দেবে সে সময়? মনে হয় দেবে না। আজকের আমি যে জায়গায়

দাঁড়িয়ে, সেখানে তোমাকে আমি কি দিতে পারব বলতে পারো?’


‘আমি জানিনা। আমি কিছুই জানিনা। তবে একটা কথা জানি, সেই ছোটবেলা থেকেই আমি তোমাকে ছাড়া

আর কারুর কথা ভাবিনি কখনো। ভাবতেও পারব না। যদি তুমি আমাকে এরপরও বল অন্য কিছু ভাবতে

তবে অনেকগুলো পথ খোলা আছে আমার কাছে। আমি জীবন কাটাতে হলে তোমার সাথেই কাটাবো, না

হলে জোর করে আমাকে অন্য কোথাও কেউই পাঠাতে পারবে না। তুমি ভাবার জন্য অনেক সময় দিচ্ছো

আমাকে। দরকার নেই সে সময়ের। আমার কথা আমি এখনি জানিয়ে দিলাম তোমাকে। দীপ আমরা তো

কোর্টে, রেজেস্ট্রী করে বিয়ে করে ফেলতে পারি। তাহলে আমাদের দুজনকে আর কেউ আলাদা করতে

পারবে না। তখন আমাদের সময় দিতেই হবে সকলেরই’। একটা আশার আলো যেন জ্বলে উঠলো ওর

মুখে।


‘পারি তো ঠিকই কিন্তু তারপর? সেটাকেও যদি মান্যতা না দেয় কেউ? আসলে আমি চাইনা তুমি তোমার

বাবামায়ের মনে দুঃখ দাও। আমার এখন যেটুকু ক্ষমতা তাতে যে সংসারের হাল ধরে আছি সেটাই

ঠিকমতো চলছে না। তারসাথে তোমার জীবনটাকে জড়িয়ে নেওয়ার মতো দুঃসাহস আমার নেই শ্রাবণী।

তার চেয়ে দুরত্বটাকে বাড়িয়ে নেওয়াটাই ভালো হবে,’ কথা বন্ধ করল দীপ। চায়ের দোকানের ভদ্রলোক

একটা ট্রেতে করে দু গ্লাস চা আর প্লেটে শিঙাড়া নিয়ে এসে ওদের সামনের টেবিলে রাখলেন।


দু এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন সামনে তারপর বললেন, ‘কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা বলব?’ একটু

অবাক হয়ে গেল ওরা দুজনেই। ‘হ্যাঁ, বলুন, কি বলবেন’। শান্ত গলায় দীপ বলল।


‘এতটুকু দোকান আমার, তাই ইচ্ছে না থাকলেও দুএকটা কথা কানে চলে আসবেই। আমি আপনাদের

আগেও দেখেছি, এই রাস্তায় হেঁটে যেতে, কলেজের কাছেও। আমার বাড়ি ওদিকেই। বাড়িতে গিয়ে আমার

বৌকে আপনাদের কথাও বলেছি, দুএকবার। আমি নিজেও একসময় পড়তাম ওই কলেজেই। অনেক স্বপ্ন

দেখতাম। গরিবের ঘরে আমাদের মতো মানুষ যেমন স্বপ্ন দেখে, তেমন সব স্বপ্নই। আমার বৌ আমার

সাথেই পড়ত। এমন একটা টানাপড়েন আমাদের জীবনেও এসেছিল। আমি নিজের অক্ষমতা জানিয়ে সরে

আসতে চেয়েছিলাম আমার বান্ধবীর জীবন থেকে, ঠিক আপনার মতো করে কথাগুলো বলেই। সে রাজী

হয়নি। আমার সাথে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে চেয়েছিল’। চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক।


ওনার দৃষ্টি দীপ শ্রাবণীকে ছাড়িয়ে, খোলা একফালি জানালা দিয়ে বাঁধের ওপরে একনাগাড়ে ঝরতে থাকা

মৃদু বৃষ্টিফোঁটাগুলোর সাথে হারিয়ে গেছিল, অতীতের সেই দিনগুলোতে হয়তো। ‘একদিন বাড়ি ছেড়ে এক

কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। এখান থেকে অনেকটা দূরের এক মন্দিরে বিয়ে করে, ওকে বাড়িতে নিয়ে

এসেছিলাম আমি। শুরুতে একটু ঝামেলা যে পোয়াতে হয়নি তা নয়, কিন্তু আমার মা খুব তাড়াতাড়িই

মানিয়ে নিয়েছিল ওর সাথে। পড়াশুনোর মাঝে সামান্য কিছু কাঠের ব্যবসা করতাম। বলতে বাধা নেই,

চোরাই কাঠের ব্যবসাই ছিল সেটা। সামান্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম সেখান থেকে। বৌ প্রথমেই আমার

সেই ব্যবসা বন্ধ করিয়ে দিল। বলেছিল, ওর কাছেও কিছু টাকা জমানো আছে সেটা দিয়ে অন্যকোন

ব্যবসা করতে’।


‘খুব ভালো খাবারদাবার তৈরি করতে পারে বলেই, বলেছিল, এমন একটা দোকান খুলতে। প্রথমে ভাড়ায়

দোকানটা নিয়ে শুরু করলাম ব্যবসা। এই শিঙাড়া, চপ, নানারকমের পিঠে ইত্যাদি আমার বৌ, মা মিলে

বাড়িতেই তৈরি করে দেয়। আমি এখানে এনে ভাজি শুধু। আজকের এই দুর্যোগের দিনেও, দিনের শেষে

কিচ্ছু পড়ে থাকবেনা। সব বিক্রি হয়ে যাবে। বৌ বাড়িতে বেশ কিছু বাচ্চাদের পড়ায়। সেখান থেকেও আয়

হয়। শাড়িতে সুতোর কাজ, ফেব্রিকের কাজ ইত্যাদিও করে। তারপর একদিন এই দোকানটাকে কিনে

নিতেও পেরেছি। ভাঙ্গাচোরা কাঠের বাড়িতে দেওয়াল গেঁথে চেহারাও পালটে দিয়েছি। একটা বোন ছিল,

তার বিয়ে দিয়েছি। অথচ এগুলো করতে পারব এমনটা স্বপ্নেও ভাবিও নি কখনো’।


‘আপনি তো সরকারী চাকরি করেন, আজ যে অবস্থায় আছেন, কাল কিন্তু আর তা থাকবেনা। নিজেকে

গুছিয়ে নিতে পারবেন। তাই বলছি, কিছু মনে করবেন না যেন, দিদিভাই যা বলছেন সেটাকেই মানুন। একটা

সম্পর্ক ভেঙে দিতে, কয়েকটা মুহূর্ত লাগে, গড়ে তোলার জন্য সারাটা জীবন তো আছেই আপনাদের

সামনে। আমার শ্বশুরবাড়ি প্রথম অবস্থায় রাগ করলেও পরে সেটা পড়ে গেছে। আজ প্রয়োজনে

আমাকেই ডেকে পাঠান ওরা, ভরসাও করেন’।


‘আমি বলছি, আপনি দিদিভাইয়ের পরামর্শটা মেনে নিন। একটা আইনি বন্ধনে জড়িয়ে যান দুজনে যাতে

ইচ্ছে করলেই ওনাকে আপনার থেকে দূরে কেউ না সরিয়ে দিতে পারে। সেটা একটা ইনস্যুরেন্স হয়ে

থাক না। আপনারা সময় সুযোগ বুঝে বলবেন সে কথা। দরকার না হলে বলবেন না। কিন্তু নিজেদের

মধ্যে কোন দুরত্ব ভুল করেও তৈরি করবেন না। আমার অনুরোধ এটা’। উনি খানিকটা লজ্জা পেয়েই

বললেন, ‘দেখুন কান্ড আপনাদের চা তো একদম ঠান্ডা হয়ে গেল। দাঁড়ান একটু গরম করে দিই’। চায়ের

গ্লাসদুটো হাতে নিয়ে চলে গেলেন উনি উনোনের সামনে।


দীপ তাকালো শ্রাবণীর দিকে। এক অদ্ভুত আলোর রেখায় ঝলমল করছে ওর মুখ। এই ভদ্রলোকের

কথা যেন ওদের নিজেদের কথাই, ঠিক এমনটা তো দীপ নিজেও ভাবছিল ওনার কথা শোনার সময় আজ

শ্রাবণীকে এই কথাগুলো যে কিভাবে বলেছে তা একমাত্র ও নিজেই জানে। বর্ষার অবিরাম ধারা ধুইয়ে

দিচ্ছিল ওর মুখ তাই শ্রাবণী বুঝতে পারে নি। সবটুকু বৃষ্টির মিষ্টি জলের ধারা নয়, তাতে মিশে ছিল


চোখের লোনা জলও। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েছিল একদৃষ্টে। বুঝে নিতে চাইছিল একে অপরের

গভীরতা। ভদ্রলোক আবারো চায়ের গ্লাস নিয়ে এলেন। এবার একটা বাড়তি গ্লাসও এনেছেন, নিজের

জন্য।


ওদের থেকে একটু দূরের একটা বেঞ্চে বসে বললেন, ‘আমি জানি আপনারা আমার আপনাদের বিষয়ে

কথা বলায় বিরক্ত হননি। আমি যা বলেছি তা আমার মনের কথা, অভিজ্ঞতার কথা। আপনারা সেই ভুল

করতে যাবেন না, যেটার জন্য একদিন পস্তাতে হয়। আমিও করতে যাচ্ছিলাম। আমরা ছেলেরা বোধহয়

এমনধারাই হই। সঙ্গীকে কষ্ট না দেওয়ার বাসনায় দূরে সরে যেতে চাই, অথচ জেনেবুঝে সেই কষ্টই

দিয়ে ফেলি। দিদিভাইদের মতো মেয়েরা যে একটা মস্তবড় বল হয়ে পাশে দাঁড়াতে পারে এমনটা ভাবিই

না। আপনি দাদা, নিজের ধারণা বদলান। সময় সব ঠিক করে দেয়। সময়ের চেয়ে বেশি শক্তি কারুর নেই।

শুধু দাঁতেদাঁত চেপে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আরেকটা কথা, বিয়ের সময় আমাকে এই ঘটকালির

জন্য নেমন্তন্ন করতে ভুললে চলবে না কিন্তু’।


চায়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দুজনেই হেসে উঠল ওনার কথায়। শিঙাড়াটা সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর

বানিয়েছেন ওনার স্ত্রী। খাওয়া শেষ করে টাকা দেবার জন্য পকেটে হাত দিতে যেতেই, ভদ্রলোক হাত

জোর করে বললেন, ‘আমার দোকানে আজ প্রথম এসেছেন আপনারা, আমার কথায় যদি দুটো জীবন

একসাথে মিলে যায় তবে সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা হবে। আজ আমি কোনো দাম নেবোনা। এরপর

আপনারা দুজনে স্বামীস্ত্রী হয়ে যেদিন আসবেন সেদিন উসুল করে নেব। কথা দিচ্ছি আমি’।


খানিকটা হতবাক হয়ে গেল ওরা দুজনেই। দীপ ভদ্রলোকের হাতটা চেপে ধরল। ‘একটা মস্তবড় ভাঙনের

হাত থেকে আপনি বাঁচালেন আমাদের। আমি নিজেও চাইনি ওকে দূরে সরিয়ে দিতে। অভাব যেটার ছিল তা

হল নিজের প্রতি আস্থার। আপনি সেটা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন আজ। আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনার

কাছে’।


শ্রাবণের অবিশ্রাম ধারা থেমে গিয়ে, পশ্চিম আকাশে মেঘের ফাঁকে বেরিয়ে এসেছে টুকটুকে লাল রঙের

সুর্য। রাস্তায় জমে যাওয়া জলে, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইনের চকচকে লোহার পাতে, গাছগুলোর

ভেজা পাতায় ছড়িয়ে পড়েছে সেই রক্তিম আভা। দুজনে পা বাড়ালো বাসস্ট্যান্ডের দিকে। কিছুদূর গিয়ে

দুজনেই একবার ফিরে তাকালো। ভদ্রলোক দোকানের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। উনিও হাত নাড়লেন

ওদের দিকে।


দীপ বলল, ‘আমার এখন একটাই কাজ হবে, নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নেওয়া। তোমাকে আমার কাছে

আনতে গেলে যেটুকু দরকার সেভাবে সাজিয়ে নেওয়া সবকিছু। তুমি পারবে তো সব মানিয়ে নিতে,

শ্রাবণী?’


শ্রাবণী হাত বাড়িয়ে দীপের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। ‘একবার সুযোগ তো পেতে দাও। আমি সব

ঠিক করে নেব। ঠিক হয়ে যাবে আমার বাড়িও। সময় লাগবে একটু হয়তো, কিন্তু হবেই। আমি জানি।

বিশ্বাস করি। তুমি আমার ওপরে ভরসা করতে পারো’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন