পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৩ জুন, ২০২১

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                                       


সপ্তম পর্বের পর 

খোঁজ 
(৮)

সেপ্টেম্বর মাসের এক  সন্ধ্যাবেলা শবনমকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল l কয়েকদিন ধরেই  শরীরটা খারাপ ছিল, সেদিন সকাল থেকেই অল্প অল্প ব্লিডিং শুরু হল l বিকেলে অপর্ণা তাকে ডক্টর বাগচীর কাছে নিয়ে গেলেন l বাড়িতেই চেম্বারের  পিছনের অংশেই তাঁর নার্সিংহোম l সেখানকার গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর সুরমা ব্যানার্জীর কাছেই এতদিন দেখানো হচ্ছিল শবনমকে l বেবির পজিশন ভালো নয়, তাই ঠিক হল পরেরদিন সকালেই সিজার করা হবে l পরেরদিন  ভোরবেলা উঠে রান্নাবান্না সেরে স্বামী, ননদ এবং মেয়ের টিফিন গুছিয়ে সবাইকে জলখাবার দিয়ে অলোকের সঙ্গে অপর্ণা চলে গেলেন নার্সিংহোমে l 
শর্মিলার এখন উঁচু ক্লাস, ডে শিফটে স্কুল l বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথেই কেয়ামাসির কাছে শর্মিলা শুনল কাম্মার মেয়ে হয়েছে l বাড়ি ফিরে দেখল ঠাম্মার মুখ অন্ধকার  l কারণটা অনুমান করতে অসুবিধে হল না শর্মিলার l ছোটবেলা থেকেই ঠাম্মার মুখে নাতি না হওয়ার আক্ষেপ শুনে এসেছে l এমনকি মায়ের যে শর্মিলার পরে একটি পুত্রসন্তান আনা উচিত ছিল, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে  সেকথা অনেকবার বলতে শুনেছে ঠাম্মাকে l কাম্মা সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর যিনি জাত্যাভিমান ভুলে "এইবার আমার বংশের বাতি আইব" বলে  আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠেছিলেন , সেই মুখে এখন নৈরাশ্যের অন্ধকার l অবশ্য যোগমায়া ছাড়া বাড়ির সকলেই খুব খুশি l অনেকদিন পরে বাড়িতে একটি সুস্থ, সুন্দর শিশু এসেছে l 

শর্মিলার আর তর সইছিল না, চটপট স্কুলড্রেস ছেড়ে ডাল আর মাছভাজা দিয়ে একটু ভাত খেয়েই পিসির সঙ্গে ছুটল নার্সিংহোমে l কাম্মার বেডের পাশে ছোট্ট বেবিকটে গোলাপী রঙের একটা ছোট্ট পুতুল ঘুমিয়ে আছে l এই প্রথম এত ছোট্ট একটা বাচ্চাকে  ছুঁয়ে দেখল শর্মিলা l তারপরেই কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল l এমন আগে কারুর প্রতি হয়নি, ও তো মা -বাবা - কাকা -পিসি এমনকি ওর বন্ধুদেরও খুব ভালোবাসে l কিন্তু অন্য সব ভালোবাসার থেকে এই অনুভূতিটা এক্কেবারে  আলাদা l এটাকেই কি স্নেহ বলে ! বড্ড কোলে নিতে  ইচ্ছে করছিল, কিন্তু মা বারণ করলেন l সিজারিয়ান বেবি, একটু বেশি সাবধানে রাখতে হবে, বাইরে থেকে এসে ওকে ধরা যাবে না l বোন বাড়িতে আসার পর ওকে দিব্যি কোলে নিতে শিখে গেল শর্মিলা l এতদিন যে পুতুলগুলো তার ভীষণ প্ৰিয় ছিল, এখন তাদের ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করে না l একটা জ্যান্ত খেলার পুতুল এখন তার বাড়িতে l এখন আর বাইরে খেলতে যেতেও ইচ্ছে করে না l বন্ধুরা বাড়িতে এলে বোনের নতুন নতুন কীর্তিকলাপ দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে l 
বোনের নাম কাম্মা রেখেছিল ইয়াসমিন l কিন্তু এ বাড়িতে ওই নাম ধোপে টিকল না l অনেক তর্কবিতর্কের পর বাবা ওর নাম রাখলেন শতরূপা l মা ডাকনাম রাখলেন মুনমুন l

রেলওয়ে  সার্ভিসের পরীক্ষায় আগেই পাশ করে প্যানেলে নাম ছিল শবনমের l মুনমুন হওয়ার বছরদেড়েক পরে নতুন চাকরিতে জয়েন করল সে l অপর্ণার কোলেই  বড় হতে লাগল মুনমুন l প্রথম বুলি ফোটার পর শর্মিলার দেখাদেখি  অপর্ণাকেই মা আর শবনমকে কাম্মা বলে ডাকতে শুরু করল l এমনিতে সে বেশ রাশভারী মানুষ, কিন্তু শর্মিলাকে দেখলেই আধো আধো বুলিতে  কলকল করে ওঠে l  হাঁটা, চলা, কথাবলা সবকিছুতেই দিদিভাইকে নকল করার চেষ্টা করে l শর্মিলা গানের রেওয়াজ করতে বসলে তাকে সেখান থেকে নড়ানো যায় না l 

এ বাড়িতে রাজশ্রীর অবস্থানটা খানিকটা অতিথির মতই l বাড়িতে যতটুকু সময় থাকেন তাতে নিজের ঘরে বসে পড়াশোনা আর টুকটাক কাজকর্ম ছাড়া বেশিরভাগ  সময়টুকু দুই ভাইঝির সঙ্গেই কাটে তাঁর l শর্মিলাকে পড়ানো আর মুনমুনের সঙ্গে খুনসুটির পর বাকি মানুষগুলোর জন্য সময় কমই থাকে l বৌদি এবং ভাইয়ের বৌয়ের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাবও রয়েছে যথেষ্ট, কিন্তু একটা অদৃশ্য দেওয়ালের আড়ালে নিজেকে ঘিরে রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন তিনি l রাজশ্রীর বিয়ে নিয়েও এ বাড়িতে ইদানিং আর কোনো আলোচনা  হয়  না l শ্যামবর্ণা হলেও রাজশ্রী যথেষ্ট সুশ্রী, উচ্চশিক্ষিতা এবং চাকরি করেন l পাত্রী হিসেবে মোটেই ফেলনা নন l আত্মীয়মহল বা পরিচিতদের মধ্যে থেকে বিয়ের সম্বন্ধ হরদম আসতেই থাকত l কিন্তু রাজশ্রী বাড়িতে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন তিনি বিয়ে করবেন না l তাই পাড়ার কেউ কেউ বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলে বা প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে সন্তর্পনে এড়িয়ে যেতেন বাড়ির সবাই l কারণটা অবশ্য কারুরই অজানা নয় l সাগরিকাদের পাড়ায়  টুবলু - বাবলুকে পড়াতেন রাজশ্রী l শুধু পড়ানোই নয়, সবরকমভাবেই ওদের দেখাশোনা করতেন l ওদের মা সর্বানী ছিলেন রাজশ্রীর স্কুলের বন্ধু l স্কুলে পড়তে পড়তে খুব  অল্পবয়েসেই  বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর l ছেলেদের জন্মের পর থেকেই  মারাত্মক অসুস্থ এবং ক্রমে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন l ওরা দুই যমজভাই, শর্মিলার থেকে বেশ খানিকটা বড় l টুবলু -বাবলুর বাবা স্বরূপ সেনগুপ্ত ছিলেন নামকরা অ্যাডভোকেট l বাড়ির সামনের দিকেই তাঁর অফিস l এই বন্ধুর স্বামীর সঙ্গেই নাকি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজশ্রী l একসময় পাড়ায় এটা একটা মুখরোচক আলোচনার বিষয়ও ছিল অবশ্য l শর্মিলাদের বাড়ির লোকজনের সামনে না বললেও কানাঘুষোয় সবই কানে আসত ওদের l উচ্চশিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী হলেও অবিবাহিত মেয়েরা  সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে মহিলাদের মাথাব্যথার কারণ l নিজেদের বাড়িতে টিভি আসার আগে অন্য বাড়িতে টিভি দেখার  আসরে  পাড়ার লোকজনের  মুখোমুখি দাঁড়াতে হত যোগমায়াকেই l কিন্তু শিক্ষিত, স্বাবলম্বী মেয়ের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার সাহস ছিল না তাঁর l মেয়ের ব্যক্তিত্বের সামনে রীতিমত কুঁকড়ে থাকতেন l তাই রাজশ্রীর সঙ্গে একটা চোরা সংঘর্ষ চলতেই থাকত তাঁর মায়ের l একটা সময়ের পর থেকে মা -মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে একটা দুর্ভেদ্য বরফের প্রাচীর তৈরী হয়ে গিয়েছিল l কেউ কারুর এলাকায় বড় একটা প্রবেশ করতেন না l টুবলু -বাবলু যখন ক্লাস টেনে পড়ে, সেসময় ওদের মা মারা গেলেন l মাধ্যমিকের পর ওদের নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলেন স্বরূপবাবু l সেবার গরমের ছুটিতে বাড়ি ফিরে টুবলু - বাবলু একদিন রাজশ্রীর সঙ্গে দেখা করতে এ বাড়িতে এল l ছোটবেলা থেকে চেনা প্ৰিয় শিক্ষিকাকে এবার ওরা মায়ের জায়গাটা দিতে চায় l রাজশ্রী প্রথমে ওদের একটু বকাবকি করলেন  l এ বয়েসে বিয়ে ! শেষ পর্যন্ত লোকজনের সন্দেহই যে সত্যি হবে ! কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা l দুজনেই লেখাপড়ায় ভালো l উচ্চমাধ্যমিকের পর হয়ত বিদেশে পড়তে চলে যাবে l তখন তো বাবা আরো একা হয়ে যাবেন l আর যে মানুষটার জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা নষ্ট করেছেন, তাঁর সন্তানদের পড়িয়েছেন, দেখাশোনা  করেছেন তাঁর  ইচ্ছের মর্যাদা দেবেন না রাজশ্রী ! দীর্ঘ আলোচনার পর রাজশ্রীকে  বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে তবে ওরা  বাড়ি ফিরল l পরেরদিনই  বিয়ের প্রস্তাবসহ স্বরূপবাবুকে নিয়ে হাজির দুই ছেলে l ঠিক হল, শর্মিলাদের  বাড়িতেই পুরোহিত ডেকে নমো নমো করে বিয়ে হবে l পরে রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হবে l রাজশ্রী বা স্বরূপ কেউই ধুমধাম করে বিয়েতে রাজি নন l বাড়ির লোকজন বিশেষত ঠাম্মার ইচ্ছে ছিল একমাত্র মেয়ের বিয়েতে আত্মীয় স্বজন আসুক, উৎসব হোক l ছোটছেলে তো সে সুযোগ দেয় নি ! কিন্তু তাঁর কথা কেই বা শোনে !  স্বরূপ ও রাজশ্রীর কয়েকজন বন্ধু এবং  বাড়ির লোকজনের উপস্থিতিতেই খুব তাড়াতাড়ি, মাত্র দিন সাতেকের মধ্যেই নিতান্ত অনাড়ম্বরভাবেই  রাজশ্রীর বিয়েটা হয়ে গেল l অপর্ণা নিজের গয়নার কিছু অংশ দিয়ে যথাসাধ্য সাজিয়ে ননদকে সাজিয়ে দিলেন l রাজশ্রী অবশ্য কিছুই নিতে চাননি l গয়না পরার শখ তাঁর কোনোকালেই ছিল না, তাছাড়া বিয়ে করবেন না বলে নিজের জন্য গয়নাগাটি কিছু গড়িয়েও রাখেননি l জমানো টাকা কিছু দিতে চেয়েছিলেন, সেটাও  কিছুতেই খরচ করতে দিলেন না অপর্ণা l

পিসি ও বাড়িতে চলে যাওয়ার পর ওই ঘরটা শর্মিলার দখলে এল l ওই ঘরে বসেই পড়াশোনা, ও ঘরেই ঘুমোনো l নিজের সঙ্গে একান্তে সময়  কাটানোর জন্য একটা নিজস্ব ঘর ! 

শর্মিলার তখন ক্লাস নাইন l আগের মতই পিসির কাছে হিউম্যানিটিস পড়লেও সায়েন্স গ্রূপের জন্য একটা কোচিং ক্লাসে ভর্তি হতে হল l সংসারে তেমন কাজকর্ম করতে না হলেও চাকরি সামলে কাম্মার আর ওকে পড়ানোর সময় ছিল না l তাছাড়া স্যান্যালস্যার বয়েজ স্কুলের টিচার এবং মাধ্যমিকের এক্সামিনার l আসলে উত্তর লেখার পদ্ধতি ঠিকঠাক শিখলে তবেই বোর্ডের পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যায় l শম্পা, সৌমিলিরাও ওই ব্যাচেই পড়ে l একসঙ্গেই মিনিবাসে করে ওরা  বেকবাগানে স্যারের বাড়ি যাতায়াত করে l এখন আর মা বা কেয়ামাসির ওদের পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না l বয়েজ স্কুলের কয়েকটা ছেলেও পড়ে ওদের ব্যাচে l কয়েকমাসের মধ্যে ধ্রুব, অর্ণব, শুভ্রকান্তিদের সঙ্গে অল্পস্বল্প বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওদের l ওদের মধ্যে শুভ্রকান্তি বয়েজ স্কুলের ফার্স্ট বয় l উচ্চমাধ্যমিকের পর সে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়বে ঠিক করে ফেলেছে l সৌমিলি আর ধ্রুবর কেমেস্ট্রি নিয়ে পড়ার ইচ্ছে l অর্ণব মেডিকেল পড়বে l সাগরিকা, শম্পা, সুদেষ্ণারা মাধ্যমিকের পরেই আর্টস পড়বে ঠিক করেছে l শম্পা ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ভালোবাসে তাই  ইংলিশ বা কম্পারেটিভ লিটারেচার নিয়ে পড়তে চায় l শর্মিলাও সাহিত্য ভালোবাসে, আবার অঙ্কও ওর পছন্দের বিষয় l অনেক ভেবেও কিছুতেই ও এখনও নিজের লক্ষ্য স্থির করতে পারেনি l ওর অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট ম্যাথমেটিক্স l সেটার জন্য একটা এক্সট্রা কোচিং দরকার l তাই শনি -রবিবার  রিজ্জুদা এলে ওকে অ্যাডিশনাল ম্যাথসটা করিয়ে দিত l কঠিন অঙ্কের উত্তর মেলাতে পারলে রিজ্জুদার  কালো মেটাল ফ্রেমের চশমার পিছনে গভীর দুটো চোখদুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত l রিজ্জুদার চোখে সেই মুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে পাবে বলেই যেন প্রাণপণে জটিল  অঙ্কের জট খুলত শর্মিলা l সারাটা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকত এই দুটো দিনের জন্য l খাতা দেওয়ানেওয়ার সময় কখনও ওর আঙুলে আঙুল ঠেকে গেলেই  বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার অনুভূতি l এভাবেই বয়ঃসন্ধিতে প্রথম পুরুষের স্পর্শে শরীরের ভিতরের  ঘুমন্ত নারীসত্ত্বাকে আবিষ্কার করতে শুরু করে প্রতিটি নারী  l 

(চলবে ) 


                       


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন