পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

মেঘশ্রী ব্যানার্জী

                                            



বর্ষার একটি দিন"



(১)

নিজের নামটা এক্কেবারে পছন্দ নয় বর্ষার। কী ভীষণ চেনা নাম। ছোট্টবেলা থেকেই সবাই দুলে দুলে মুখস্থ করে নেয় ছয় ঋতু। তারই একটা বর্ষা। কেউ বলে না " কী সুন্দর নাম!" কেউ জিজ্ঞাসা করে না  "নামের মানে কী?" যেন নামটার কোনো গুরুত্বই নেই! অবশ্য বাবা-মা বলেন যুগে যুগে কবিদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হল গিয়ে এই বর্ষা। গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা, ঝুরি ঝুরি গান - এগুলো তো আর এমনি এমনি নয়! সাহিত্যের অঙ্গনে বর্ষার  প্রাধান্যকে তো অস্বীকার করা যায় না! এইসব সান্ত্বনা বাক্য বহুবার শুনে শুনে যে একটু স্পেশাল ফিল হয় না তা নয়, তবু বর্ষাকালটাই তার মোটেও প্রিয় নয়। বিশেষতঃ যার বাড়ির সামনে ব্যাঙে ইয়ে করলেও এক কোমর জল দাঁড়িয়ে যায়, তার নাম বর্ষা হওয়াই উচিৎ নয়, কক্ষনো নয়। 

বারান্দায় গ্রিলের ফাঁকে নাকটা ঢুকিয়ে দিয়ে কানের পাশের গোছা চুল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে পেঁচার মত মুখ করে এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিল বর্ষা। কখন বাবাই এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি,
"আজ নাই বা গেলি…"
"অসম্ভব! আজ যেতেই হবে।" 
"এত জল রাস্তায়… টোটো পাবি না, অটোও পাবি না।"
"বাস পেয়ে যাব। চিন্তা কোরো না। আজ… খুব জরুরি ক্লাস আছে"
"তাহলে চল। ঠাম্মি ভাত বেড়েছে…"
টেবিলে এসে দেখে মা খেতে শুরু করে দিয়েছে। বাবাইও বসে পড়ল। বৃষ্টির দিনে একটু সময় হাতে নিয়ে না বেরোলেই নয়। শুনতেই রোডের কাছে বাড়ি। জল জমলে রিক্সার টিকিও পাওয়া যায় না। ঠাম্মি শুধু ধোঁওয়া ওঠা ভাতই বাড়েনি সাথে ইলিশ মাছ ভাপাও বেড়েছে। এই দুর্ধর্ষ যুগলবন্দী দেখেও মনটা ভালো হল না। এত তাড়াহুড়োতে ইলিশ খাওয়া যায়? ওই যে কথায় বলে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে, তেমনই কাঁটা হল ইলিশের কলঙ্ক! মাছভাজার তেল দিয়ে অর্ধেক ভাত সাবড়ে উঠে পড়ল বর্ষা। 
"কিরে...মাছ খেলি না?" মায়ের হতবাক গলা ভেসে আসে, যেন বর্ষা নয় এতক্ষণ বিড়াল বসেছিল চেয়ারে। 
"রাত্রে খাব মা। কাঁটা বাছার সময় নেই।"
"বলবি তো.. আমি বেছে দিচ্ছি… বোস এসে"
"না মা দেরি হয়ে যাবে"
"আজ আর বেরোস নি বর্ষা। রাস্তাঘাটের অবস্থা মোটেও ভালো না…আর তোর যে জায়গায় কলেজ..." মায়ের গলায় বাবার সুর।
"আজকে যেতেই হবে। আজ বৃহস্পতিবার!" 
"বৃহস্পতিবার তো কী হয়েছে? কলেজে নিরামিষ খিচুড়ি ভোজ নাকি?"
"উফফফফ মা… "
"উফফ আবার কী? প্র্যাকটিকালও তো নেই আজ! শুধু ওই ইংলিশ ল্যাবটা আছে। ডুব মেরে দে"
উফফফফফ্! কী বিরক্তিকর! মায়ের সব মনে থাকে কবে কী ক্লাস! আজ সত্যিই কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্র্যাকটিকাল ক্লাস নেই। থিওরি ক্লাসের নোট কারুর থেকে পেলে ম্যানেজ করাই যায়…কিন্তু বর্ষাকে যে আজ যেতেই হবে! কী করে বোঝাবে মাকে? উত্তর না দিয়ে রেডি হতে শুরু করে চুপচাপ। ফার্স্ট ইয়ার। ইউনিফর্ম পরাও জরুরি। একে এই জল, তার উপর সাদা ড্রেস। ভেবে পায় না বর্ষা ইউনিফর্ম মানেই সাদা সাদা কেন? কালো লাল সবুজ বাদামী খয়েরী নয় কেন? এগুলো কী রঙ নয়? যদি নাই হবে, তাহলে বিয়ের সময় সাদা বেনারসী কেন পরে না? যত্তসব। গোটা দুনিয়াটাই গোলমেলে। আর এই যখনতখন বৃষ্টিটাও। 

(২)

যা ভেবেছিল ঠিক তাই! অটো নেই একটাও। টোটোও নেই। অবশ্য নেই বলাটা ঠিক হবে না। রোজ যাত্রী পাওয়ার জন্য মারামারি-কাড়াকাড়ি করা অটো আর টোটোগুলো আজ রাস্তার দু'ধারে জলমগ্ন হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। বাবাকে তো দুম করে বলে বসল বাস পেয়ে যাবে, কিন্তু বাস এলে তো! যদি ভুল করে এসেও পড়ে তার গতি তিনশো বছরের বুড়ো কচ্ছপকেও হার মানায়। ইসসস…. ক্লাসটা মিস হয়ে যাবে!! রাস্তা বেশ ফাঁকা। এতটাই ফাঁকা যে বাজিমাত সিনেমা হলের সামনে দিবারাত্র বদন প্রদর্শনকারী বখাটেগুলোও আজ নেই। বর্ষা একাই পাগল যে কিনা এই বৃষ্টি মাথায় করে কলেজ যাচ্ছে। বাবা-মা পই পই করে আজ বেরোতে মানা করেছিল। তবু তাকে যে আজ আসতেই হতো। কিন্তু… একটা চিন্তা মনে আসতেই পেটের ভিতর গুড়গুড় করতে লাগল। এত বিশ্রী ওয়েদারে এত তোড়জোড় করে, এত জল ভেঙে যার জন্য আকুপাকু করে কলেজে ছুটছে… সে আজ আসবে তো? মুহূর্তে  মুখটা আকাশের চেয়েও কালো করে এলো। যেকোনো মুহূর্তে ফেটে পড়বে। 

এরকমভাবে আর কতক্ষণ একটা স্ল্যাবের উপর দাঁড়িয়ে থাকা যায়? সেটাও স্টেডি নয়। ঢকঢক করছে। নিচে নেমে দাঁড়ালে হাঁটু অবধি জল। সেই সাদা জামায় কাদা কবেই লেগে গেছে শুধু 'কেনে কাদা দিলি?' বলে  চিল্লানোর উপায় নেই। পুরোটাই হয়েছে বর্ষার মর্জিতে। গোমড়া মুখে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে একটা আশার বিন্দু দেখতে পেল - বহুদূরে। বিন্দু ক্রমশঃ বড় হতে হতে সিন্ধু থুড়ি একটা রিক্সার আকার নিচ্ছে। এখনও বোঝা যাচ্ছে না রিক্সাটা খালি নাকি লোক আছে! যদি খালি থাকে আর না দাঁড়ায়? রিক্সাটা এবার বেশ কাছাকাছি এসে গেছে। চালকের চোখে সানগ্লাস। অথচ রোদ ওঠে নি। মাথা মুখ সব উত্কট গোলাপী গামছায় ঢাকা। গায়ে রেইনকোট। যদিও বৃষ্টি নেই। সিটের ওপর শ্যাওলা রঙের ত্রিপল ফেলা। চোপসানো মতো। মানে কেউ বসে নেই। বর্ষা প্রাণপণে হাত নাড়াচ্ছে, এত জোরে যে কব্জি খুলে জলে তলিয়ে গেলেও আশ্চর্য হবে না, "রিক্সা….. অ্যাই রিক্সা….আ…. আ...রে দাঁড়াও দাঁড়াও…."  নাঃ ফস করে বেরিয়ে গেল রিক্সাটা। এদিকে উত্তেজনায় বর্ষা যে কখন হাঁটু জলে নেমে পড়েছে সে নিজেও জানে না। ধুর ধুর ধুর ধুর…! বুকের ওপর ব্যাগপ্যাকটা চেপে স্ল্যাবে ফিরে যাবে না এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে ভাবতে ভাবতে দেখে উল্টোদিক থেকে একটা রিক্সা আসছে। এমনিতেই উল্টোদিকের রিক্সাগুলো দাঁড়াতে চায় না, তার উপর এত জল। ও মা! রিক্সাটা তো ওর দিকেই আসছে… আগের রিক্সাটাই না? যেটা এইমাত্র বর্ষাকে ডিচ করে বেরিয়ে গেল? হ্যাঁ ওইটাই তো! চালকের মাথায় সেই গোলাপি গামছা... রিক্সাটা জমা জলে ঢেউ তুলে এক্কেবারে বর্ষার সামনে এসে থামল, যেন পক্ষীরাজ নিয়ে রাজপুত্তুর।  
"আমার নাম রিক্সা নয়…" হকচকিয়ে যায় বর্ষা! এবার থেকে প্রত্যেকটা রিক্সাকে ডাকার আগে ওদের নাম-ধাম জেনে নিয়ে ডাকতে হবে নাকি! 
"আমি পাল...সুশীল পাল!"
এইরকম জেমস বন্ড মার্কা পরিচয় পর্বে বর্ষার নিচের চোয়াল একহাত ঝুলে পড়তে না পড়তেই ধেয়ে এলো পরের প্রশ্ন
"তুমি চশমা পরোনি কেন?"
এই বর্ষায় ছাতা নেই কেন বা রেইনকোট নেই কেন - এসব প্রশ্নের একটা জাস্টিফিকেশন আছে, কিন্তু চশমা? লোকটা কী পাগল? রিক্সাটা ছেড়ে দেবে? কিন্তু আধ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে এই অগতির গতি পালবাবুকে পেয়েও ছেড়ে দেওয়াটা কী ঠিক হবে? আশেপাশে যতদূর পারা যায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে আর কোনো খড়কুটো না পেয়ে অগত্যা জিজ্ঞাসা করে বর্ষা 
"কলেজ যাবে?"
"নাঃ! এই বয়সে আর…"
"উফফফফ্ লিলুয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, যাবে?"
"ও হ্যাঁ! যাব তো। দেখেই বুঝেছি তুমি কলেজেই যাবে। তাই তো ফিরে এলাম…"
বর্ষা বোঝে না যে সে কী দেখে বুঝল! ব্যাগপ্যাক না উইনিফর্ম! আর কথা না বাড়িয়ে ঘাড় ঝুঁকিয়ে ত্রিপল সরিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। রাজ্যের নোংরা ত্রিপলে। বোঁটকা গন্ধ! এই সময়েই আরেকটা গন্ধ ধক করে নাকে এল। এইবার লোকটার এলোমেলো কথার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। মদ্যপ ব্যাটা। এমনিদিনে হলে এই রিক্সায় কিছুতেই চড়ত না বর্ষা। কিন্তু আজ….
"কত নেবে?"
"যা খুশি দিও.." মানেই পরে গিয়ে ঝামেলা করবে। যাক গে যা হয় হবে… ভাড়াটা নেমেই ঠিক করবে না হয়। তবু কলেজের কাছে নামলে চারটে লোকজনের মাঝে বল ভরসা। 

পালবাবু প্যাডেলে চাপ দিয়েই গান ধরেছেন, "জানা অজানা পথে চলেছি…." 
মোবাইলটা চেইন থেকে বের করে টাইম দেখে বর্ষা। এখনও সময় আছে। ক্লাসটা ধরা গেলেও যেতে পারে। আচ্ছা, যাজ্ঞসেনী কি এসে গেছে এতক্ষণে? আলবাত এসে গেছে। আর ফার্স্ট বেঞ্চে থাবা গেড়ে বসেছে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। শুধু বৃষ্টি কেন! ভূমিকম্প হলেও অর্জুন স্যারের ক্লাস মিস করবে না। দরকার পড়লে হেলিকপ্টারে করে কলেজের ছাতে নামবে! বড়লোকদের সবই ভালো। নামটাও কী ভালো! যাজ্ঞসেনী! নাম শুনে অর্জুন স্যার শুদ্ধুও ইম্প্রেসড! বলেছেন "হোয়াট আ বিউটিফুল নেম!" তারপর থেকে যাজ্ঞসেনীর মাটিতে পা পড়ে না! হায় রে! বর্ষারও যদি অমন সুন্দর একটা ভারিক্কি নাম থাকত! সকালের মনখারাপটা আবার নতুন করে ফিরে এল। 

এই অর্জুনস্যার হলেন কলেজের তামাম ছাত্রী-বাহিনীর ক্রাশ আর ছাত্রদলের হিংসার পাত্র! উনি ক্লাসে ঢুকলে ছাত্রীরা চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। ক্লাস শুরু হলে মনে হয় আজ সারাটাদিন যেন পিরিয়ড শেষের বেল না বাজে! তার চেয়েও বড় কথা হল, স্যার পড়াতে পড়াতে একটাও বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন না। এমন কী ক্লাসের বাইরেও না! কতবার স্যারকে একটু দেখার আশায়, একটু কথা বলার জন্য অঙ্ক নিয়ে মেয়েরা স্টাফরুমে গেছে টিফিনের সময়… কিন্তু স্যার তখনও অনর্গল ইংলিশে পড়া বুঝিয়ে গেছেন! এ হেন অর্জুন স্যারের জন্যই তো আজ ঘোলা জল কোমরে করে আর দুর্যোগ মাথায় করে কলেজ পানে ধেয়ে চলা।

আসলে হয়েছে কী উনি একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। আজকে সেটা জমা দেওয়ার শেষ দিন। মেক্যানিক্সের অঙ্কগুলো সব সহজ হয় না। রীতিমত মাথা ঘামিয়ে, বই ঘেঁটে, নেটে খুঁজে নামাতে হয়। বর্ষা এক সপ্তাহ ধরে দিনরাত এক করে সবকটা প্রবলেম সলভ করেছে। যেন ফার্স্ট সেমিস্টারে আর কোনো বিষয় পড়ার দরকারই নেই! ওদিকে বিরোধীপক্ষও জোর কদমে লেগে আছে। অর্জুন স্যারের টাস্ক বলে কথা! কবে, কিভাবে বর্ষা আর যাজ্ঞসেনীর মধ্যে এই সুপ্ত প্রতিযোগিতা শুরু হল তা বলা মুস্কিল! তবে অর্জুন স্যারের ক্লাস থাকলে একদিন যাজ্ঞসেনী দশ মিনিট আগে আসে তো পরেরদিন বর্ষা কুড়ি মিনিট আগে। ফার্স্ট বেঞ্চের দখল নেওয়াটা খুব জরুরি। আজ সকাল অবধিও গোপনসূত্রে খবর পেয়েছে যাজ্ঞসেনী সবকটা প্রবলেম সল্ভ করতে পারে নি। ব্ব্যাস! আর কী চাই? এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? এমনিতেই ওদের রেশারেশিতে শুধুমাত্র নামের জন্য বর্ষা এক গোল খেয়ে বসে আছে। 

"এক লড়কি ভিগিভাগি সি.." কানে আসতেই বর্ষা নড়েচড়ে বসল। জামাটা হাঁটুর নিচে টেনে দিয়ে ব্যাগপ্যাকটা বুকে জড়িয়ে ভুরু কুঁচকে পালবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা আর গান পেল না! ইতর কোথাকার! কলেজ পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই! এইখানে রাস্তাটা এমনিতেই নরক-গুলজার! বসুন্ধরা এখানে ধনধান্যে নয় খানাখন্দে ভরা। রাস্তায় পিচ-সুরকি যাই ঢালা হোক না কেন দু'দিন পরেই দাঁত বেরিয়ে ছিরকুটি হয়ে যায়। রিক্সা ক্রমাগত দোদুল দোলে দুলছে। যেন থইথই জলে টাইটানিক! আর জলের রঙ তো মনে রাখার মত! এ জলকে এক কথায়  ঘোলা বা নোংরা বলা যাবে না। এর একটা বিশেষত্ব আছে। দুই পাশে সারি সারি কারখানার মাল-মশলাগুলোও দিব্যি মিলেমিশে গিয়ে কালো জলের উপর একটা চকচকে গাঢ় হলুদ আস্তরণ ফেলেছে! রঙটা প্রাতঃকালীন একটি বিশেষ বর্জ্য পদার্থের কথা মনে পড়ায়! গা'টা গুলিয়ে উঠল বর্ষার! 

কোনো কোনো কারখানার সাটার অর্ধেক তোলা। লম্বা লম্বা লোহার রডের স্তূপ উবুচুবু হয়ে পিঠ দেখাচ্ছে আইসবার্গের মত। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা সাইকেল আসছে যাচ্ছে। পিছন থেকে একটা রুটের বাস হর্ন দিচ্ছে। ইসসসস... বাসটা সেই এলো অথচ এত দেরিতে। পিছনে বাস আসছে না অ্যানাকোন্ডা তাতে চালকের কোনো হেলদোল নেই। রিক্সাটা এক্কেবারে রাস্তার মাঝখন দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে শামুকের গতিতে এগোচ্ছে। পালবাবু বোধহয় কোনো এক যাত্রাপালা থেকে রিক্সা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আজই সেই পালার যত গান উজাড় করে দিয়ে দম নেবেন। !  "বাস আসছে তো, সাইড করো… হর্ন দিচ্ছে শুনছ না?" একটু থামল গান। বাস আসায় ভারি বিরক্ত। যে রাজপথ আজ তার নামে লিখে দেওয়া হয়েছিল তাতে বাসের ভাগ বসানোটা পালরাজার পছন্দ হল না। তড়াক করে সিট থেকে জলে লাফিয়ে পড়ে প্রবল চেষ্টায় গোঁত্তা খেতে খেতে রিক্সাটা টেনে রাস্তার ধারে নিয়ে গেল। বাসটা রাস্তা খালি পেয়ে হুঙ্কার দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। পিছনে ফেলে গেল হলুদ রঙের বড় বড় ঢেউ, যেগুলো রিক্সার মধ্যে এসে জলকেলি খেলতে  লাগল। পাশের একটা ভজনালয় থেকে হরে-কৃষ্ণ হরে-রামো ভেসে আসছে। তার সামনেই ডাঁই হয়ে পড়ে থাকা ভোজন উচ্ছিষ্ট, শালপাতা ভেসে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। সুশীল পাল তিনকোণা সিটে বসেই এবার ভক্তিরসে ডুব দিল, "আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল…" আবেগে ভেসে গিয়ে দুটো হাত হ্যান্ডল ছেড়ে যেইনা কপালে জড়ো হল অমনি প্যাডেলটাও পা ফস্কে গেল! আর রিক্সাটাও টাল সামলাতে না পেরে খেয়ে ওঁত পেতে থাকা  জলমগ্ন গর্তে এপাং ওপাং ঝপাং স্টাইলে উল্টে গেল - যেন ভাসান হওয়া প্রতিমা!

বর্ষা কিছু টের পাওয়ার আগেই বুঝল সে প্রথমে সামনের দিকে তারপরেই বাঁ-পাশে হেলে পড়েছে। যে জল হাঁটু অবধি ছুঁয়ে গেছে বলে ঘেন্নায় কুঁকড়ে ছিল, সেই পিঙ্গল জল থেকে কোনোমতে শুধু মুন্ডুটা বেরিয়ে আছে! বিপদের এখানেই শেষ নয়, সুশীল পাল বিপদ বুঝে উল্টোদিকে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। ফলতঃ গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে রিক্সাটা ঝপাং করে বর্ষার ঘাড়ে এসে পড়ল। চারিদিকে একটা হই-হই রব, "এই ধর ধর তোল তোল"। রিক্সাটা ধীরে ধীরে সোজা হলে পরে বর্ষা কারুর একটা হাত ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটাও ভিজে সপসপ করছে। টপ্টপ করে জল গড়াচ্ছে। মানে এসাইন্মেন্টটাও…. ইসসসসস!
"দিদি আপনার লাগে নি তো?" 
"দিদি হাসপাতালে যাবেন?"
"দিদি ও দিদি…."
"না না… আমি কলেজ যাবো।"
লোকজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল… এই অবস্থায় কলেজ? লজ্জায় মাটিতে  মিশে যাচ্ছে বর্ষা! এই অবস্থায় কলেজে যাবেই বা কি করে? এই রিক্সায়? এইভাবে কোনোদিন সেন্টার অফ এট্রাকশন হতে হবে জন্মেও ভাবেনি! ভিড়টাই ত্রাতা হয়ে চটপট বাকি ব্যবস্থা করে ফেলল। কিশোর কুমারের রেপ্লিকাকে চল্লিশ টাকায় বিদেয় করল বর্ষা। সে ব্যাটা শুকনো মুখে আমতা আমতা করে বলেছিল বটে, "আমিই পৌঁছে দিচ্ছি না হয়… আর ক'টা টাকা…" লোকজনের হস্তক্ষেপে পালবাবু পালিয়ে বাঁচল। আরেকটা রিক্সা জোগাড় করে অবশেষে তারাই কলেজে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করল।

(৩)

কলেজে গিয়ে যদিও আর বিশেষ কোনো লাভ নেই। অর্জুন স্যারের ক্লাস এতক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। অ্যাসাইনমেন্টটা ব্যাগে ছিল। নির্ঘাত আধডোবা লেড়ো বিস্কুটের মত দশা এখন তার! তবু পায়ে পায়ে এগোলো। বৃন্দাবন চত্বর আজ ধূ ধূ! নাঃ যতই জল জমুক রাস্তায়, কলেজে তার লেশ মাত্র নেই। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। দু'একটা স্টুডেন্ট ওঠানামা করছে আর ওকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। ভিজে জামাটা পরে খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল বর্ষার। এতক্ষণের ঝুটঝামেলায় জামাটা গায়েই অনেকটা শুকিয়ে গেছে। তবু গা ঘিনঘিনে করছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে ক্লাসের ভিতর উঁকি মারল । গোটা দশ বারোজন বসে আছে। বেশিরভাগই হোস্টেলের। নাঃ যাজ্ঞসেনীকে দেখতে পেল না। আসেনি? না বাইরে গেছে? ক্লাসে আর ঢুকলো না বর্ষা। স্টাফরুমের দিকে এগোলো। অর্জুন স্যার ঘরে নেই। এসেছেন তো? কোনো স্যার বা ম্যামকে জিজ্ঞাসা করে দেখবে? নাঃ থাক! আসলে কারুর নজরে এই দশায় পড়তে চাইছে না।  অ্যাসাইনমেন্টের পাতা দুটো ইতিমধ্যে ব্যাগ থেকে বের করে হাতে নিয়েছে। একদম নষ্ট হয়ে যায় নি। স্যাঁতস্যাঁত করছে কাগজটা। অর্জুন স্যার অনেক সময়ই ল্যাবে থাকেন। বর্ষাদের ফার্স্ট ইয়ারে মেকানিক্সের ল্যাব নেই। কিন্তু সিনিয়রদের আছে। একবার গিয়ে দেখবে? 

এই বিল্ডিং থেকে নেমে একটা মাঠ আর তার লাগোয়া ক্যান্টিন, "খেলে খান নয়তো যান"। ক্যান্টিন দেখেই সকালের ইলিশমাছের কথা মনে পড়ে গেল। ল্যাবে উঁকি মারতেই দেখা পেল অর্জুন স্যারের। রাজকীয় মহিমায় চেয়ার আলোকিত করে কিসব খাতা চেক করছেন। ওদের এসাইনমেন্ট পেপার নাকি?
"স্যার আসব?" 
ঘাড় ঘোরালেন অর্জুন স্যার। একটু অবাক। ফার্স্ট ইয়াররা ল্যাবে তো আসে না। 
"কাম ইন"
খুবই সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে টেবিলের ওপারে এসে দাঁড়ালো বর্ষা।
"হোয়াট হ্যাপেনড টু ইউ?"
"প...পড়ে গেছি।"
একবার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বললেন, "হোয়্যার? ইন দ্য ক্যাম্পাস?"
"নো স্যার। ইন দ্য রোড। রিক্সা থেকে জলে পড়ে গেছি।"
"জিসাস! আর য়ু হার্ট?"
বর্ষার মনে পড়ছে না ব্যথা আছে কিনা! ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে স্যারের এই কনসার্নটুকু। টেবিলের একপাশটা খুঁটতে খুঁটতে মাথা দু'দিকে নাড়ায়। অ্যাসাইনমেন্টটা এগিয়ে ধরে।
"ইউ কেম টু সাবমিট দিস? রিয়েলি?"
স্যারের গলায় বকুনির আভাস। ঘাড় নাড়ে বর্ষা।
"হোয়াই ইউ ডিডন'ট রিটার্ন হোম? ইউ রিয়েলি ডিডন'ট হ্যাভ টু কাম দিস ফার ফর দ্য এসাইনমেন্ট...ইট কুড ওয়েট!" স্যারের গলা চড়ছে।
অভিমানে মুখটা থমথম করছে বর্ষার। ইট কুড ওয়েট? সত্যি? সকাল থেকে একের পর এক অবশ্যম্ভাবী অনুচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ইলিশ ছেড়ে, বাবা-মার কথা অমান্য করে, জলে ডিগবাজি খেয়ে ছুটে এসেছে শুধুমাত্র যে স্যারের অ্যাসাইনমেন্টটা জমা দিতে, সেই তিনিই কিনা বলছেন না আসলেও চলত? বর্ষার নাম না হয় যাজ্ঞসেনীর মত সুন্দর না,  কিন্তু ওর সিন্সিয়ারিটি ওর কমিটমেন্ট নিয়ে স্যারের কিচ্ছু বলার নেই? ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ম্যামও নিজের কাজ ফেলে এদিকে তাকিয়ে আছেন। সকাল থেকে সহ্য করা সমস্ত অভিমান, লজ্জা, অপমান ঝরঝর করে ঝরে পড়ল। একটু ঘাবড়ে গেলেন স্যার। 
"আরে… কাঁদছ কেন? বোসো বোসো" একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন "পরীক্ষা তো নয় যে অ্যাটেন্ড করতেই হবে!"
চোখের জল তবু বাঁধ মানছে না। আধভেজা ওড়না দিয়ে চোখ মুছেই চলেছে। "আজ তো একজনও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয় নি। একদিন দেরিতে দিলে কী ক্ষতি ছিল?"
ম্যামও উঠে এসেছেন এই টেবিলের কাছে 
"জল খাবে একটু?" 
জল খেতে খেতে একটু ধাতস্ত হল বর্ষা। কান্না থামল। স্যার ততক্ষণে স্যাঁতস্যাঁতে পাতাগুলো যত্ন করে টেবিলের উপর বিছিয়ে পেপারওয়েট চাপা দিচ্ছেন। হঠাৎ বর্ষার খুব ভালো লাগতে শুরু করল। 
"থ্যাঙ্কিউ ম্যাম। থ্যাঙ্কিউ স্যার…" বলে উঠে দাঁড়ালো। 
অর্জুন স্যার বললেন, "এরকম আর কোরো না  বুঝলে?"
মাথা একপাশে হেলাল "আসছি স্যার" 
"একা একা যেতে পারবে?"
"পারব" গলা বুজে এসেছে। 
"ফিরবে কিসে?"
"বাস চলছে"
"সাবধানে যেও।" একটু ইতস্তত করে বললেন, "বাড়ি ফিরে খবর দিও পারলে। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছ তো?"

"দেব…" ল্যাব থেকে বেরিয়ে এল বর্ষা। কী সুন্দর বৃষ্টিভেজা দিন। ডান পায়ে একটা ব্যথা টের পাচ্ছে হাঁটতে গেলে। তবু মনটা খুব খুশি খুশি। হেঁটে তো নয় মনে মনে প্রায় উড়তে উড়তে কলেজের বাইরে চলে এলো। আবারও রিক্সা নিতে হবে। না হয় নেবে! না হয় আবারও পড়ে যাবে! ইসসস…. সুশীল পালকে আরও কুড়িটাকা বেশি দেওয়া উচিৎ ছিল। মনে মনে আক্ষেপ করে শেষে একটা ধন্যবাদই দিয়ে ফেলল তাকে। আজকে তার জন্যই যাজ্ঞসেনীকে একগোল দিয়েছে বর্ষা। না না,  অ্যাসাইনমেন্ট জমা করেছে সেটা কোনো বড় কথা নয়… আজ না হয় কাল সকলেই জমা দেবে। বর্ষার আজ এক পরম প্রাপ্তি হল, যেটা যাজ্ঞসেনীর কোনোদিন হবে না। আজ অর্জুন স্যার ওর সাথে, শুধুমাত্র ওর সাথে বাংলায় কথা বলেছেন! আচ্ছা, মেসেঞ্জারে যখন বর্ষা জানাবে ও বাড়ি পৌঁছে গেছে… স্যার কি উত্তর দেবেন? কোন ভাষায় দেবেন? বাংলা? 

৪টি মন্তব্য: