পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                                            


এণেস্থেশিয়া (পর্ব ১) 



'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ' থুড়ি রাষ্ট্রীয় স্কন্ধকাটা কিছুর শেষ সম্মিলিত বৃহদায়তন (অজৈব) হত্যা উৎসবে যত সৈন্য সরাসরি নিহত হয়েছিল (একমাত্র যুদ্ধই সেই অভিধান যেখানে 'শহীদ' শব্দটি 'মাইনে করা মুরগি'র 'এক কথায় প্রকাশ' হিসাবে ব্যাকরণসম্মত) তার থেকে অনেক বেশী সংখ্যায় মারা গিয়েছিলো ১৮৪৬ সালের আগে এণেস্থেশিয়ার আবিষ্কার না হওয়ায়। সজ্ঞানে আহত হাত-পা কেটে বাদ দেওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেনি পেটের তাগিদে বেয়নেট বয়ে বেড়ানো অধিকাংশ মানুষ। যখন তা আবিষ্কার হয়ে গেলো, একটা মানুষ ঘোরে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় সঠিক টের পেলনা পরের জন্মদিনটা যে শরীরে আসবে তা নিয়ে সে মাতৃগর্ভ থেকে প্রথম আলো ছোঁয়নি। যখন অবশ দশা কাটলো, জানলো দ্বিতীয়বার জন্ম হয়েছে তার যেখানে তার নামের সঙ্গে পদবীর অধিক গাঢ়তা নিয়ে অবস্থান করবে 'প্রতিবন্ধী' শব্দটি। এই জাতীয় নশ্বর পুনর্জন্মের কথা ব্রাহ্মণ্যবাদের কোনো শাস্ত্রে বা পুরাণে উল্লেখ নেই কেন? এও তো 'দ্বিজ'। যদি বলো, উত্তরণ অর্থে ছাড়া এই শব্দের ব্যবহার হয় না, তাহলেও তো প্রশ্ন, কে নির্ধারণ করলো প্রিভিলেজড থেকে আরেকটু প্রিভিলেজড হয়ে ওঠা অবনমন নয়? আচ্ছা সে অন্য প্রসঙ্গ। এত গুলিয়ে যায় আসলেই মেয়েটার, জন্মইস্তক এই রকমই, খেই হারিয়ে যায়, পুরনো উলের বলের গিঁট তার সবই, একটা খুলতে গিয়ে আরেকটায় স্নায়ু জড়িয়ে যায়। 


তো, কী কথা হচ্ছিল? এনেস্থেশিয়া। আচ্ছা, এই যে বছরের প্রথম বৃষ্টি, বৈশাখের ২১ তারিখে, কালবৈশাখী'হীন অতিমারিধ্বস্ত প্রাচীন মফস্বলে, যেখানে চৈত্র কাব্যসম্ভব সর্বনাশ তো দূর, একফোঁটা অন্ধকারও নামায়নি সূর্য থেকে, তাও কি এণেস্থেশিয়া কোন? পোর্টিকোয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ভাবার পর মেয়েটার ভিতরে বিদ্যুত ঝলসালো সদ্য। তার সামনে কিছু এম্বুলেন্স, গাড়ি পার্ক করা, অভিজাত নার্সিং হোমে যেমনটি দেখানো হয় আর কী সিনেমা সিরিয়ালে আর কেণ্নোর মত অজস্র বিড়াল ও কুকুর, যাদের দেখানো হয় না, টি আর পি কমবে বলে। বিনোদনের দায় কি বাস্তব বেসাতির? মেয়েটা একটু সচেতন হলো এবার, সিউডো লকডাউনের প্রভাবে আশেপাশের দোকান, যাদের এনসিলিয়ারি ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়ে থাকে, ধুঁকে ধুঁকে ভিজছে। তার মনে পড়ল মূলত ভিজতে চেয়েই সে পোর্টিকোয় এসে দাঁড়িয়েছিলো প্রথমে, সে চাওয়ায় জোর দেওয়ার কথা তারপর ভুলে গেছে। তার বাবা তিনতলার কেবিনে ক্যনুলা নিয়ে শুয়ে আছে এই মুহূর্তে। এককালের দোর্দন্ডপ্রতাপ বাঙালি উদ্যোগপতি, স্বাভিমানি, নৈতিক শুচিতা রক্ষায় আজীবন কঠোর, গোল্ড মেডেলিস্ট অঙ্কের অধ্যাপক, লড়াকু লাল ছাত্রনেতা (যিনি মানতে পারেননা তার একমাত্র সন্তান বিশ্বাস করে, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম নামের পার্টিটা যারা করে তারা কখনো মার্কস পড়েনি, উই কি আর মানে বুঝে বই এর পাতা কেটে পটি করে?)


আরেকবার মন দিয়ে এনেস্থেশিয়া ভাবতে গিয়ে মেয়েটা বুঝল পুরাতন ব্যাধির মত তার আবার ম্যাকেন্দো মনে পড়ছে। "অরেলিয়েনো, ইটস রেনিং ইন ম্যাকেন্দো"। তার কে আছে যাকে এটা এই মুহূর্তে ফোন করে বলা যায়? নার্সিংহোমের পাশে চার্চ, চূড়ার দিকে তাকিয়ে ক্রাইস্টের নম্বরটা খানিক হাতড়ানোর পর তার রিপুরা জানান দিল, বহুজনেরই প্রার্থিত এই কল। ঠিক এই সময়টায় সে বৃষ্টিকে গুরুত্ব দিতে চাইল অধিক অথবা এও হতে পারে বৃষ্টিই তাকে নির্বাচন করলো। পোর্টিকো ছেড়ে আকাশের নিচে দাঁড়ানোয় এক একটা জলবিন্দু একেকজনের স্মৃতিচারন দিল তাকে। শিহরণ তাকে কোনোদিন মুগ্ধবোধের পাঠ দেয়নি, আজও দিল না। গোধুলিয়ায় প্রথম যে নওল কিশোরটি বিশ্বনাথের গলিফেরতা তাকে এসে বলেছিলো "ম্যায় এক বাত পুঁছ সকতা হুঁ ক্যায়া?" থেকে বিদেশী সেই নীলা চোখের ছেলেটি, যে শেষমেষ তার আত্মজার নামের ভিতর দিয়ে মেয়েটাকে ধরে রাখতে চেয়েছে, অথবা গতকাল রাতে যে সেন্সিটিভ সেলেবটি তার পোস্টকে ভাইরাল করেছে, যে সাহিত্যিক তুলোর মত তাকে আগলে রাখতে চায় জীবনভোর, এছাড়াও যারা তাকে বলে উঠতে না পেরে অলিখিত এক অস্বীকার চুক্তির নৈ:শব্দ্যের সম্মানে বিশ্বাসী হতে বাধ্য হয়েছে, যারা তাকে বুঝতে চেয়ে না পেরে আক্রোশী হয়ে উঠেছে, আরও বহু নাম, বহু মায়া, বহু ঘ্রাণ, অজস্র অজস্র জলবিন্দুর অজুহাতে তাকে উন্মাদ করে দিয়ে গেলো। সে জানলো, সলিচিউডের এনেস্থেশিয়া মাথায়, বুকে আর শরীরে নিয়ে সে জন্মেছে, এই জন্মে সেই নর্সিসিজমকে অতিক্রম করতে পারে এমন পুরুষ এখনো তার গ্রীবা আর পদ্মনালকে একাকার করে দিতে সামনে এসে দাঁড়ায়নি। তিরিশটি বর্ষার আগুন তাকে ভিজাতে ভিজাতে আরও অলীক ও অপ্রতিরোধ্য ধোঁয়ার আবরণ দিয়েছে মাত্র, ভূ-গর্ভের প্লেট যেভাবে অতি ধীরে সরে, সংঘাতের তীব্র প্রার্থনা পুষে।

চিত্রঋণ- অন্তর্জাল 

৪টি মন্তব্য:

  1. এ আমি কী পড়লাম!!! এ লেখা কেমন করে লেখা যায়!!! এ তো লেখা নয়, চিকুর। চোখ ধাঁধান আলোয় কালো আকাশের পেট চিরে ছুরি চালানো। পরের পর্ব কবে?

    উত্তরমুছুন
  2. অনেকদিন পর এমন লেখা পড়লাম। পরেরটার অপেক্ষায়।

    উত্তরমুছুন
  3. অনেক অনেক দিন এই লেখা মনে থাকবে, বিষয় যেমন তেমনি লেখা, খুব ভালো

    উত্তরমুছুন
  4. কি বলবো!সত্যিই এই মননগদ্যের প্রশংসা করার যোগ্যতাও নেই।তবু..আগেও বলেছি আবারও বললাম
    নিজস্ব শব্দতন্ত্র দিয়ে পেলব অথচ নির্মমভাবে ক্লীশে বোধগুলোকে গুলোকে শাসন করার এই ক্ষমতা বিস্মিত করে,আমি অতি সাধারণ (আমার মতই)কোনো মানুষ এ পাঠ করে নিশ্চই উজ্জীবিত হবে।ধন্যবাদ,এভাবে সমৃদ্ধ করবার জন্য।

    উত্তরমুছুন