পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০২১

অমিতাভ সরকার

                 




বেজন্মা ( একাদশ পর্বের পর)

দেখতে দেখতে কেটে গেছে পাঁচ পাঁচটা বছর…। রাজ্যে ঘটে গেছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে রাবেয়াদের বাড়ি পার্টি অফিসে পরিবর্তিত হয়েছে। কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী এখন পঞ্চায়েত প্রধান, তবে অন্য রঙের ছাতার তলে। সব শুনে কৃষাণ আর কোনও উদ্যোগ নেয় নি সম্পত্তি ফিরে পাবার আশায়। ইতিমধ্যে শামসুদ্দিনের আব্বা দেখা করে আশির্বাদ করে গেছে দুজনকে।


অপারেশনের পর কৃষাণের পা আর আগের জায়গায় ফিরে আসে নি। হাঁটার জন্য আজীবন সঙ্গী হয়েছে ‘ক্র্যাচ’। এই পাঁচটা বছরে পালটে গেছে অনেক কিছু। পুরনো আন্দুল স্টেশন নতুন চকচকে হয়েছে। অসুস্থ সিংজী খুব একটা ধাবায় আসতে পারেন না। রাবেয়ার মা গত হয়েছেন বছর দুয়েক হলো। এখন সিংজী-বিদ্যা, কৃষাণ-রাবেয়া মিলে এক সঙ্গেই থাকে। কৃষাণ কাশ্মীর থেকে ফিরতেই সিংজীর ধাবার দায়িত্ব দিয়েছেন। ফোর্স থেকে এককালীন টাকা পেয়ে ধাবাকে নতুন ভাবে সাজিয়েছে কৃষাণ। আগের মত দড়ির খাটিয়া পালটে চেয়ার-টেবিল এসেছে। কৃষাণের আগ্রহে বিল্লু, শ্যাম, নান্টা ধাবার কাজে যুক্ত হয়েছে। চেয়েছিল সকলে মিলে ধাবার দায়িত্ব নিতে। কিন্তু মানিকদাকে অনেক অনুরোধ করেও ধাবায় যুক্ত করা যায় নি। অবশ্য মানিকদা প্রতিদিন কাজ সেরে ফেরার সময় ধাবায় কিছুক্ষণ সকলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যায়। রাবেয়া বি.এ পাশ করে কাছেই একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায়। বিল্লু আব্বা হয়েছে বছর তিনেক হলো। ছেলে রাবেয়ার স্কুলেই পড়ে। মানিকদার ছেলে হাইয়ার সেকেন্ডারীর পর আর পড়তে চাইলো না। তাই মানিকদা এক নিত্যযাত্রী ভদ্রলোককে অনেক অনুরোধ করে হাওড়ায় কারখানায় ঢুকিয়েছে।         

#        

‘কৃষাণ’দা… কৃষান’দা…’ ধাবার কাজকর্মে তদারকি করতে করতে ঘুরে তাকায় কৃষাণ। চীৎকার করতে করতে দৌড়চ্ছে শ্যাম। তাকে দৌড়তে দেখে কৃষাণ বাইরে বেরিয়ে রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ায়। 

“কৃষাণ’দা…, স্টেশনের…, স্টেশনের…” উত্তেজনায় হাঁপায় শ্যাম। কৃষাণ গ্লাসে জল এগিয়ে দেয়। এক চুমুকে শেষ করে শ্যাম।

“এবার বল কী হয়েছে? স্টেশনের কাছে কী…”   

“বাজারে যাওয়ার সময় দেখলাম…! স্টেশনের বেঞ্চে একটা বাচ্চা…, কে যেন ফেলে দিয়ে গেছে…!!  

“সেকি!! বেঁচে আছে ?     

“এখনো বেঁচে আছে… দেখে এলাম”! কৃষাণের মনে পড়ে যায় তার নিজের কথা। এমনি করেই হয়তো তাকেও ফেলে দিয়ে গিয়েছিল কোনও এক কুন্তিমা। মূহুর্তে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ডান হাতে ক্র্যাচ নিয়ে দু’দিক দিয়ে আসা বাস, লরি পেরিয়ে হাইরোড ধরে ছুটতে থাকে কৃষাণ। তাকে ওই ভাবে রাস্তা পার হতে দেখে চারপাশের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সোরগোল শুনে ধাবার কর্মচারীরাও বেরিয়ে আসে। বিল্লু, নান্টা ছুটে যায় কৃষাণকে লক্ষ্য করে।           

চারপাশের জটলা সরিয়ে শিশুটির কাছে যায় কৃষাণ, একটা তোয়ালে মোড়া শিশুটি হাত-পা নাড়ছে তখনও। শ্যাম কাছের চায়ের দোকান থেকে একটা গ্লাসে দুধ আর চামচ নিয়ে আসে। সকলে মিলে পরম যত্নে আস্তে আস্তে দুধ খাওয়ায় শিশুটিকে। চোখবন্ধ অবস্থায় হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় শিশুটি। কৃষাণ শিশুটির হাতে আলতো চুমু খেয়ে সাবধানে কোলে তুলে নেয় শিশুটিকে।       

সেখান থেকে জিআরপি, থানা-পুলিশ করে, অনেক রাতে শিশুটিকে নিজের করে পায় কৃষাণ। ডান হাতে ক্র্যাচটা নিয়ে বাঁহাত দিয়ে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে কৃষাণের সারা মুখে। ইতিমধ্যে খবরটা চারপাশে চাউড় হয়ে যায়…। 

এদিকে রাত বারোটায় কৃষাণ ঘরে না ফেরায় রাবেয়া ধাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। সব শুনে ধাবার একজনকে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিয়ে স্টেশনের এগিয়ে যায়। স্টেশনের কাছাকাছি এসে দূর থেকে কৃষাণকে শ্যাম আর নান্টাকে সঙ্গে আসতে দেখতে পায়। কাছাকাছি আসতে রাবেয়াকে দেখে কৃষাণ শিশুর মতো হেসে ফেলে। মনে হলো যেন, বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত মহার্ঘ সম্পদ তার হাতে এসেছে। রাবেয়া কাছে আসতে এগিয়ে দেয় তার দিকে। ‘এই নাও, তোমার জন্য…। তোমার অনেক দিনের ইচ্ছে…’। তার কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে সকলে। রাবেয়া দুহাত বাড়িয়ে বুকের কাছে সাপটে ধরে কপালে আলতো চুমু দিয়ে ফিসিফিয়ে বলে; “আমার ছোট্ট কৃষাণী”! 

কৃষাণ ক্র্যাচটা শ্যামের হাতে দিয়ে রাবেয়ার কাঁধ ধরে। কৃষাণীকে নিয়ে এগিয়ে যায় তাদের গন্তব্যের দিকে। ঘন কালো আকাশ একটু একটু করে পালটাচ্ছে নিজেকে। ভোর হতে আর নেই বাকী।।       

শুরু হলো ছোট্ট কৃষাণীকে নিয়ে আর এক গল্প ……… 


(সমাপ্ত) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন