পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

শর্মিষ্টা দত্ত

                   



খোঁজ 
(১৫)

দুপুরবেলা খাওয়ার পরে ওদের ঘরের সামনে তিনতলার ছাদে বসে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ছিল শর্মিলা l টুবলুদা বেরিয়েছে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে l পরেরদিনই ইভলিনকে নিয়ে বিষ্ণুপুর যাবে, দুদিন পরে ফিরে এসে টুবলুদা একা ফিরে যাবে ইংল্যান্ডে l ইভলিন এখন এদেশে কিছুদিন থাকবে l পড়াশোনা ছাড়াও ওর নিজস্ব কিছু কাজ আছে l লাঞ্চের পর ও জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল l হঠাৎই শর্মিলা দেখল ইভলিন ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে 

--মে আই কাম ইন শর্মিলা? 

--হ্যাঁ হ্যাঁ, এসো l

--আমি আগামীকাল বিষ্ণুপুর যাবো জানো তো?  তারপর সাউথ বেঙ্গলের আরো কিছু জায়গায় যেতে হবে l আজ ফ্রি আছি l তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি l তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে l তুমি খুব সুন্দর l ইউ হ্যাভ ভেরি ব্রাইট অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট আইজ l

বেশ লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলল শর্মিলা l ইভলিন নিজেই ভারি সুন্দর l গোলাপি রং আর  নীল চোখের একটা পুতুলের মত l 

--জানো, আমি কিন্তু পিওর ব্রিটিশ নই l আমার মা ইন্ডিয়ান, বেঙ্গলি লেডি ছিলেন l তোমার মতই সুন্দরী l মা অক্সফোর্ডে ইংলিশ লিটারেচার পড়তে গিয়ে বাবাকে বিয়ে করেছিল l তারপর ওখানেই থেকে যায় l দুজনেই  লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়াত  l মাই আমাকে বেঙ্গলি শিখিয়েছিল l আমাদের বাড়িতে এখনও কিছু কিছু বেঙ্গলি কালচার মেনটেইন করা হয় l বাঙালী রান্নাও করে মা l আমি ফিশকারী খেতে খুব ভালোবাসি l মায়ের ইন্টারেস্টেই আমি ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ নিয়ে পড়েছি l

--হ্যাঁ, তুমি প্রথমদিন এসেই সবাইকে প্রণাম করেছিলে l সবাই খুব খুশি হয়েছিল l কি সুন্দর কাঁটা বেছে মাছ খেয়েছিলে ! আমরা তো খুব অবাক হয়েছিলাম l ভেবেছিলাম টুবলুদা শিখিয়েছে l আচ্ছা, তোমার মা আর কোনোদিন এদেশে আসেন নি? ওঁর নিজের বাড়ি কোথায়, কলকাতায়? 

--না, মায়ের বাড়ি ছিল বোলপুরে l শান্তিনিকেতনে পড়ত l গ্র্যান্ড পার ইচ্ছে ছিল না মা বিদেশে পড়তে যাক l গ্র্যানির ইচ্ছেতেই মা গিয়েছিল l মা অক্সফোর্ডে হায়ার স্টাডিজ করতে যাওয়ার পর আমার বাবার সঙ্গে রিলেশনশিপ হয় l আর সেটা জানতে পেরে মায়ের বাবা খুব রেগে যান l আমার গ্র্যানিকে ব্লেম করেন l সেই অশান্তিতে গ্র্যানির সাডেন ডেথ হয় l  কিন্তু তারপর থেকে মা আর তার বাবার  সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেনি l আর কোনোদিন ফেরেওনি ইন্ডিয়ায় l আমার এক মাসি ছিলেন l তার সঙ্গেও মা কোনো যোগাযোগ রাখেনি l কিন্তু মা এখনও ইন্ডিয়াকে, নিজের বাড়িটাকে মিস করে l

--তুমি যে এখানে এলে, তোমার মা কিছু বলেননি? 

একটু থেমে ইভলিন বলল 

--না, মা কিছু বলেনি l কিন্তু আমি ঠিক করেছি একবার শান্তিনিকেতন যাবোই  l মাকে জানাবো না এখন l আমি মায়ের বাড়িটা দেখব l বাড়ির অ্যাড্রেস আমি জানি, পুরোনো ফটোও দেখেছি l আমার মাসিকেও খুঁজে বার করব l দীপ মানে তোমার টুবলুদা এত কিছু জানে না l তুমি কি কখনো শান্তিনিকেতনে গিয়েছ শর্মিলা ? 

শর্মিলা মাথা নাড়ল l শান্তিনিকেতন কেন ! একবার দুদিনের জন্য দীঘার সমুদ্র ছাড়া আর কোনোদিনই কোথাও যাওয়া হয় নি ওর l 

--তুমি যাবে আমার সঙ্গে? অথবা তোমার চেনা কেউ আছে, আমাকে একটু গাইড করতে পারবে? 

--আমি আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করব l

সেদিন বিকেলে মৈত্রেয়ীকে কথাটা বলতেই ও বলল 

--আরে, আমরা তো নেক্সট উইকেই দুদিনের জন্য শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাচ্ছি l ওখানে কল্লোলদাদের একটা বাড়ি আছে l বাবা নিজে যেতে পারবে না বলে গাড়ি ঠিক করে দিয়েছে l তোদেরও নিয়ে যাবে মা বলেছে l আজকেই সন্ধ্যেবেলা তোদের বাড়ি গিয়ে কাকিমাকে বলবে ভেবেছে l কেয়ামাসিকেও বলেছে l ভালোই হল, ইভলিনও আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে l 

--কিন্তু নেক্সট উইকেই তো আমাদের রেজাল্ট বেরোবে l এখন যাবোই বা কি করে? 

--রেজাল্টের আগেই তো যাবো আমরা l অপর্ণার এখন একটু চেঞ্জ দরকার l কেয়ারাও যাবে l সবাই মিলে দুদিন একটু আনন্দ করে আসব l তাছাড়া কল্লোলের মা নীলিমাদিও আসবে আসানসোল থেকে l দেখবি কেমন ভালো মানুষ l

কাবেরীকাকিমা বললেন l 

কলকাতার রাস্তায় নতুন মারুতি ভ্যান চলতে দেখেছিল শর্মিলা l তেমনই একটা ঝকঝকে সাদা মারুতি ভ্যান ভাড়া করে পরের রবিবার ওরা শান্তিনিকেতনের পথে রওনা দিল l রাজশ্রী, অপর্ণা, মৈত্রেয়ী আর শর্মিলা ছাড়াও কেয়ামাসি, শর্বরীদি আর শম্পাও ওদের সঙ্গী l নার্সিংহোমে বলেকয়ে  দুদিনের জন্য মায়ের ছুটির ব্যবস্থা করেছে মৈনাকদা  l শুক্রবার টুবলুদা  ফিরে গেছে ইংল্যান্ডে l রবিবার বিকেলে বিষ্ণুপুর থেকে ইভলিন এসে যোগ দেবে ওদের সঙ্গে l মৈনাক কলকাতা থেকে একটা অ্যাম্বাসেডর নিয়ে ভোরবেলাতেই চলে গেছে বিষ্ণুপুর l ওখান থেকে বোলপুর পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে ওদের l বোলপুরের  ভুবনডাঙায় কল্লোলের দাদুর বাড়ি l এখন অবশ্য কেয়ারটেকার দেখাশোনা করে l দাদু মারা গেছেন l ওই বাড়িতেই ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছে কল্লোল l ও সকালেই  আসানসোল থেকে ওর মা-বাবাকে নিয়ে বোলপুর চলে আসবে l 

চারদিকে বাগানঘেরা খুব সুন্দর একটা বাংলোটাইপের মাটির দোতলা বাড়ি l কাঠের গেট পেরিয়ে লাল মোরামের রাস্তা l দুধারে নানা রংয়ের ফুলগাছ l কলকাতার বাইরে বেরিয়েই মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল l এই বাড়িতে পা দিয়ে মনটা হালকা হয়ে গেল শর্মিলার l বাড়ির পিছনদিকে ফলের বাগান l একতলা আর দোতলা মিলিয়ে মোট পাঁচটা শোবারঘর l মাটির দেওয়ালে কি অপূর্ব ম্যুরালের কাজ l দোতলার ডানদিকের ঘরে শর্মিলা, মৈত্রেয়ী আর শম্পা থাকবে l বাঁপাশের ঘরটা অনেক বড় l সেখানে দুটো ডবলবেড খাটে মা, পিসি, কেয়ামাসি আর কাবেরীকাকিমা থাকবে l মাঝের ঘরে শর্বরীদির সঙ্গে ইভলিনের থাকার ব্যবস্থা হল l নীচের একটা ঘরে কল্লোলদা  আর মৈনাকদা  থাকবে l অন্য ঘরটা কল্লোলদার মা -বাবার l বেশ একটা জমজমাট পিকনিকের মত ব্যাপার l 

দুপুরে বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই কল্লোলদার মা আর বাবা হৈহৈ করে এসে ওদের অভ্যর্থনা জানালেন l কেয়ারটেকার বংশীদার বউ রান্নাবান্না করে রেখেছিল l খাওয়াদাওয়া মিটতেই বিকেল l সেদিন আর আশ্রমে যাওয়া হল না শর্মিলাদের l খাওয়াদাওয়ার পর বাগানে বসে গল্প করতে করতেই মৈনাকদা ইভলিনকে নিয়ে চলে এল l শর্মিলারা  বুঝতে পারছিল নিছক বেড়াতে আসা ছাড়াও কাবেরীকাকিমার অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে l কল্লোলদার সঙ্গে শর্বরীদির বিয়ের সম্বন্ধ করছে কাকিমা l বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কল্লোলদার মাকে মেয়ে দেখানোও হয়ে যাবে l ওদের তিনজনের মধ্যে এই নিয়ে রীতিমত ফিসফাস শুরু হয়ে গেল l শর্বরীদিও বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা, আর যারপরনাই লজ্জাও পাচ্ছে l তারমধ্যে শম্পা আবার দিদির লেগপুল করতেও ছাড়ছে না l সব মিলিয়ে বেশ একটা মজাদার  পরিবেশ l নীলিমামাসি আর মেসোমশায়ের বেশ পছন্দ হয়েছে শর্বরীদিকে l কল্লোলদাও রাজি l অবশ্য শর্বরীদি বিএ পরীক্ষা দেওয়ার পর বিয়ে হবে l এখনও কয়েকমাস দেরি আছে l কলকাতায় ফিরে বিয়ের ডেট ঠিক করা হবে l 

পরেরদিন সকালে ওরা সবাই মিলে আশ্রম দেখতে গেল l কালোবাড়ি  থেকে সঙ্গীতভবনের দিকে এগোতেই হঠাৎ ইভলিন একজন ভদ্রমহিলাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল l অস্ফুটে বলল 

--শি ইজ লুকিং জাস্ট মাই মম l 

ভদ্রমহিলা বেশ পরিচিত মুখ l প্রায়ই টেলিভিশনে খবর পড়তে দেখা যায় l তাছাড়া উনি একজন নামকরা বাচিকশিল্পী l ওঁর সাজপোশাক, হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গি সবই অত্যন্ত রাবীন্দ্রিক আর রুচিসম্মত l শর্মিলারাও দেখেই চিনতে পারল l 
ইভলিন সটান তাঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল 

--আর ইউ সোমশুক্লা মিত্র?  

ভদ্রমহিলা একটু হকচকিয়ে তাকাতেই ইভলিন ব্যাগ থেকে ওর মায়ের ফটো বের করে ফেলেছে l 

--সোমদত্তা মিত্র ক্লার্ক l তুমি কি চিনতে পারো?  

--তু -তুমি? 

কাঁপা গলায় বললেন সোমশুক্লা l তারপর কঠিন গলায় বললেন 

--সোমদত্তা নামে আমার একজন বোন ছিল l কিন্তু এখন আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই l তুমি কি ওকে চেনো?  

-- আমি সোমদত্তার মেয়ে l তুমি আমার মাসি হও l নিজের কাজ ছাড়াও তোমাকে খুঁজব বলে ইন্ডিয়া এসেছি l দেখো, সাডেনলি খুঁজে পেয়ে গেলাম l 

--সোমা নিজেই আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেনি l ডক্টর ক্লার্ককে বিয়ে করার জন্য মা মারা গেলেন l বাবা বললেন আর কোনোদিন ওর মুখ দেখবেন না l তারপর আমাকেও ও চিঠিপত্র লেখা বন্ধ করে দিল l কোনো যোগাযোগ রাখল না l 

--মা তখন অভিমান করে ভুল ডিসিশন নিয়েছিল মাসি l এখনও সেজন্য মনে মনে কাঁদে, আমি বুঝতে পারি l মায়ের জন্যই আমি ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে ইন্টারেস্ট পেয়েছি l রিসার্চ করতে ইন্ডিয়া এসেছি l আট বছর আগে আমার বাবার ডেথ হয়েছে l মা ছাড়া আমার কেউ নেই l শি ইজ অলসো সাফারিং ফ্রম ক্যান্সার l আমি চাই লাস্ট ডেজগুলোতে মা নিজের লোকজনকে ফিরে পাক l প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না মাসি l 

--ঠিক আছে l তুমি কলকাতায় ফিরে আমার বাড়িতে এসো l তখন কথা হবে l আমার অ্যাড্রেস আর ফোন নাম্বার দিচ্ছি l 

--আর তোমাদের বাড়ি?  আমি তো মায়ের বাড়ি দেখব বলেই শান্তিনিকেতনে এলাম l 

--ওই বাড়ি আমি বিক্রি করে দিয়েছি l এখানকার প্রফেসর মিস্টার দেশপাণ্ডে ওই বাড়িতে থাকেন l  রতনপল্লীতে গিয়ে দেখে আসতে পারো l আমি এখানে এলে গেস্টহাউজেই থাকি এখন l

চোখের সামনে যেন একটা নাটকের অভিনয় দেখতে পেল শর্মিলারা l সোমশুক্লা মিত্র চক্রবর্তী চলে যাওয়ার পর ইভলিনকে নিয়ে ওরা বাড়ি ফিরল l মৈনাকদা বলল কলকাতায় ফিরেই ও ইভলিনকে ওর মাসির বাড়ি নিয়ে যাবে l ইভলিন বলল পরেরদিন শর্মিলাদের  নিয়ে রতনপল্লীতে দাদুর বাড়ি দেখতে যাবে l ওই বাড়িতে নাকি যেতেই হবে ওকে l

(চলবে )



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন