পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                                    


সেলেনা




--"দিদি, আকাশে কী রে? ক্রাইস্টকে মিস করছিস নাকি? সত্যি বলবি।


--"বলতে পারিস শিশু, উন্মাদ আর নেশারু এই তিনশ্রেণী ছাড়া কার উচ্চারণে শুদ্ধ সত্য সমাহিত থাকে? এখানে তুই অবশ্যই আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করবি 'সত্য' বলতে কী বুঝি সেও জানি সুতরাং ভেঙেই বলছি, আমি উল্লেখ করছি 'শুদ্ধ' বলে একটি শব্দ যার কাছাকাছি ব্যাখ্যার শব্দ হলো আনবায়াসড, প্রভাবঅদুষ্ট। এ যেন ঠিক এন্টিইনকামবেন্সি। সরকারকে নির্বাচিত করছি না কোনোবারেই, বাকি কোনো পক্ষ যাতে শাসনভার না পায় তাকে সুনিশ্চিত করছি। বিরাট আয়রনি। যাই হোক, বড় বেশী জড়িয়ে যাচ্ছে। দাঁড়া পেগটা শেষ করি। "


ক্যামেরা আবিষ্কার না হলে যে কোনো প্রাণ বা জড়ের বিবর্তনজনিত প্রতিটি রূপেরই যে নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, এত সহজে ধরা পড়তো না। হালিশহরের প্রায় ভগ্ন তিনমহলার চিলেকোঠায় বসে এইসব বলতে বলতে ভাবছিলো স্বধা। সে আর ভাই। শৈবলিনীর দুই সন্তান। স্বধা দৌহিত্রী আর শুভ পৌত্র। যদিও শুভ তার দিদির ঠিক পাঁচ বছর পর প্রথম সূর্য মেখেছে কিন্তু সে পার্থক্য নিতান্তই সংখ্যা মাত্র হয়ে থেকে গেছে তাদের ব্রীজে। অথচ তাদের দেখা হয় তিন চার বছর পর পর অবশ্য ছোটবেলায় বছরে বার তুই তিনেক করেই হতো। শুভর বাবা কর্মসূত্রে বরাবরই বাইরে বাইরে অতএব অপত্যও পরিযায়ী ইচ্ছে বা অনিচ্ছায়। নাড়ি, রক্ত ইত্যাদি অর্বাচীন আলাপ দূরে রাখলে বলা যায় ওয়েভ যদি কানেক্ট করে, কোনো টানেরই সংজ্ঞা লাগে না।


দুই ভাইবোনেরই জন্ম ইস্তক অসীম আকর্ষণ ভাঙা আলসে জুড়ে প্রাগৈতিহাসিক অশ্বত্থের ছায়াঘেরা এই বাড়ির প্রতিটা বন্ধ, তালাভাঙা, অব্যবহৃত ঘর, কুঠুরি, ভূপৃষ্ঠের রেপ্লিকার মত ছাদ আর আগাছাময় আদিম বৃক্ষসবুজ উঠোন বাগানের গর্ভ চিরে গঙ্গায় নেমে যাওয়া সিঁড়ির প্রতিটি বাঁকে। অনন্তের এক টুকরো বোধ হয় অজ্ঞাতে বা জ্ঞাতার্থেই ছেড়ে রেখে গিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা এই ভিটেতে। মাটি আর শ্যাওলার মধ্যে মিশে বাঁচতে বাঁচতে শিকড় হয়ে যাওয়া বাস্তুসাপ'দের মতো তারই গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে আজও আনাচ কানাচে। যে পায় সে পায়। অজস্র অখ্যাত কাহিনীরা গেঁথে আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নব্বই দশকে শৈশব কাটানো ছেলে মেয়েরাই সম্ভবত শেষ প্রজন্ম যারা দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ গ্রীষ্মে টানা একমাস ছুটির অপেক্ষা কী জানতো, জাম আর জামরুলের পার্থক্য গুগল সার্চ না করে বলতে পারতো, দুপুরে খেয়ে উঠে মাদুরের আলস্যে ঠ্যাং ছড়িয়ে ঠাম্মা দিম্মার পিতলের পানবাটার উপর সাম্রাজ্য বিস্তার করতো আর চোখ লেগে এলে বুরাতিনো- টকাই -গোগোল -টিনটিন -সাবুর সঙ্গে ঘুমের মধ্যে টই টই চষে বেরাতো। স্বধার হটাত করেই একটা লাইন মনে পড়ে গেলো "বয়স হচ্ছে বলেই বোধ হয় হাঁটতে হাঁটতে একলা লাগে"। হেসে উঠলো। শুভ না তাকিয়েই বলে উঠলো-


--"মনে পড়ছে না রে দিদি? তুই আর আমি তো সিওর ছিলাম কুয়োতলার ইঁটের পাঁজাটার নিচে গুপ্তধন আছে। কুয়োটা সুড়ঙ্গ। নাহলে ওভাবে পরিত্যক্ত বদনাম দিয়ে ফেলে রাখবে কেন দুটোকেই। উপরে আবার রাশি রাশি গাছ। নিশ্চয়ই বর্গীদের কাজ। "



এবার দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল, অট্ট সে হাসি। যেভাবে শৈবলিনী প্রতি সেকেন্ডে দশ বছর বেশী আয়ু পেতেন এই হাসি দেখে কোনো এক অতীতে, তার হয়ে এই প্রাচীন অট্টালিকা আজ সেই দায়িত্ব পালন করলো। 


--"সত্য...
    নয়?

সেদিন সেই মুহূর্তে ঐ বিশ্বাস আমাদের সত্য ছিলো শুভ। আজ যা নিয়ে আমরা হাসছি, তাকিয়ে দ্যাখ, চাঁদ গলে মিশে যাচ্ছে সেই ইঁটেরই পাঁজায়। ফিরে যা আমাদের শৈশবে। দ্যাখ দুটো বাচ্চার বিশ্বাস আগলে কীভাবে আজও যক্ষ হয়ে আছে ভগ্নস্তূপ। একি তার সত্য নয়? তুই আমি পেরিয়ে এসেছি। সে আগলে আছে বিশ্বাস। আমাদের আগেও, আমাদের পরেও, নিয়তির মতো। যদি এ সত্য না হয় তাহলে তুই আমি মিথ্যে, এই ছাদ মিথ্যে, চাঁদ মিথ্যে। "



--" দিদি, তোর লেখাতেও চাঁদ, কথাতেও চাঁদ। এতো কী পাস বল তো? আমি প্রশ্নই করছি রে। আহত হোস না আবার শুভটাও "এট টু ব্রুট" হয়ে গেলো বলে। আমি জানতে চাইছি। তোর কিছু থাক না থাক, নাক তো গণ্ডার। কেউ প্রশ্ন করলেই বিদ্ধ হোস আমি জানি। ভাবিস ব্যাখ্যা চাইছে তোর আপাত দুর্বোধ্যতার। আরও গুটিয়ে ফেলিস নিজের ভিতর নিজেকে। ফলে জানা হয়না। "

--"তুই তো জ্যাভেরিয়ান, লুনার এক্লিপ্সের বাংলা জানিস? "


--"এমন করে ঠুকিস যেন তুই কারমেলার নোস। চন্দ্রগ্রহণ জানবো না কেন? "

শুভর এবার রাগ উঠছিল। বরাবর এইরকমই থেকে গেলো দিদিটা তার। কোনো কথার সহজ উত্তর দিতেই জানেনা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সাতকাণ্ড না করলে চলে না, বাড়াবাড়ি যত।

--"গুড। এবার তাহলে লুনাটিকের বাংলা বল। "


--"দ্যাখ দিদি, তোকে বলতে হবে না। উত্তর দিবি না বলে আমায় র‌্যাপিড ফায়ার করবি জানলে তোকে জিজ্ঞাসা করতাম না। লুনাটিক হলো তোর মতো লোকেরা বুঝলি? তুই, আস্ত পাগল। "


--"আজ লিভেট খাচ্ছিস। কাল ফিডিচ খাবো আমরা, ওকে? গ্লেন সেগমেন্টে খেতে হলে ফিডিচ বেস্ট। তোর গিফ্ট ধরে নে। না বুঝেই একদম ঠিকঠাক নিজের উত্তর নিজেই দিয়ে ফেলেছিস বলে পাবি। "


--"মানে? "


--" ইংরাজি, বাংলা, স্প্যনিশ, ফ্রেঞ্চ, এসব খোলস ছেড়ে বেরিয়ে একটু ভিতরে ঢোক শুভ। ভাষা, সে যেটাই হোক, প্রত্যেকের মোকাম এক। আত্তিকরণ বলে একটা শব্দ আছে কেন ভুলে যাস? ভাষার আত্মা যদি ছুঁতে পারিস কোনো মানুষেরই কখনো প্রয়োজন হবে না তোর ভাষা সংক্রান্ত কিছুর উত্তর পেতে। লুনা হলেন রোমান চন্দ্রদেবী। লুনার আর লুনাটিক দুটো শব্দই এসেছে লাতিন শব্দ এই 'লুনা' থেকেই। অক্সফোর্ড বলছে চন্দ্রাহত'রাই লুনাটিক। চাঁদের বিভিন্ন ও প্রতিটি দশার প্রভাব যাদের স্নায়ুতে অভ্রান্ত তরঙ্গ তোলে, ফলে তরল জ্যোৎস্নার মত দাহ্য অনুভূতিপ্রবণতা বহন করতে হয় জনমভোর, তাদেরই তোরা নাম দিস পাগল। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন যাদের বিশ্বাস একটি নির্দিষ্ট সত্যের বিন্দুতে এসে স্থির হয়ে গেছে, উন্মত্ত দ্রুততায় উদ্দেশ্য জেনে না জেনে ধাবমান সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে সমঝোতা করতে পারেনা যারা তাদের সেই বিশ্বাসের সত্য বা সত্যের বিশ্বাসকে, ভারসাম্য তারাই হারায় আর উপাধি পায় 'মানসিক ভারসাম্যহীন'। ভেবে দ্যাখ যে কোনো দিক আর সবদিক থেকে বিচারেই একমাত্র উন্মাদই সৎ কারণ সে যাকে সত্য বলে জানে তার উপরে বিশ্বাস হারাতে ব্যর্থ হয়। অথচ তার সত্যকে পাগলামি বলে দুনিয়া হাসাহাসি করে যেমন আমরা হাসলাম একটু আগে ইঁটের পাঁজাকে নিয়ে আমাদের অতীতের সত্যকে আগলে রেখেছে সন্তর্পণে বলে। 


গিরগিটি আত্মরক্ষার্থে যা করে, সফল মানুষ তা করে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন সমারোহে তৃপ্তিসাধনের অজুহাতে। সফল ও সুস্থ কিছু হৃদিহীন দৈত্য মহা গৌরবে এগিয়ে নিয়ে চলে পচে গলে যাওয়া একটা সভ্যতার লাশ যেখানে সংবেদন শব্দ এক পাপ। এখানে কৃতী রিপোর্টার জোম্যাটোয় বিরিয়ানি অর্ডার করে এসি কিউবিকলে বসেন বন্যা পরবর্তী অনাহারে মৃত্যুর আবেগী খতিয়ান লিখতে আর প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর ঘড়ি দেখেন ডেলিভারি বয় দেরী করলে খিস্তি মেরে পেমেন্ট না দিয়ে ভাগাবেন বলে। এটা এমন সময় যেখানে প্রতিবন্ধী সংস্থা থেকে মাউন্টেন ট্রেকারের জন্য সংবর্ধনা প্রত্যাশিত থাকে। আত্মোন্মাদ পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিবরণ দেন বিলাস উদযাপনের, তাকিয়ে দেখেন না শ্রোতার সঙ্গে হুইলচেয়ার আছে কিনা। ব্যাক্তিগত উল্লাস, ব্যাক্তিগত অর্জনের যথার্থ সঙ্গত দাবী করা হয় উপেক্ষিত ও অক্ষম সত্ত্বাদের থেকে। এই নৃশংসতা আমায় শীতল করে ভয়ে। অথচ এদের মধ্যে সাধারণ অধিকাংশই নয়। মেধাবী, সৃষ্টিশীল বহু শুধু তাদের চৈতন্যে ধরা দেয়না যা আমি পাচ্ছি তার আনন্দ যে পায়নি সহস্র ইচ্ছেতেও, পাবেনা কখনো, তার থেকে চাই কী করে? সক্ষম মানুষের নির্লজ্জ প্রদর্শনী আমায় আতঙ্ক দেয়। শোন শুভ, আমি ঘৃণা পুষি সুস্থতার জন্য, বিতৃষ্ণা বরাদ্দ রাখি স্বাভাবিকতার জন্য। প্রতিটি সুস্থ সক্ষম সফল লোক এক একজন ধৃতরাষ্ট্র। 

আমার অহং আসে যখন আমায় কেউ উন্মাদ বলে সনাক্ত করে। আমি শান্তি পাই। বুঝি চাঁদ ছুঁলে কেন কেঁপে উঠি। "লোটাস ঈটার" পড়েছিস তো? নাহলে পড়ে নিস। "


--"দিদি, বড় অচেনা লাগছে তোকে, চুপ কর প্লিজ। "


--"ভয় পাচ্ছিস ভাই? চন্দ্রের সব কলঙ্ক প্রতিটি চন্দ্রাহত অভিশাপ নামে তাদের যাপনে বহন করে, চিনতে শেখ। গুরু পূর্ণিমায় জন্মালি তুই, যেদিন ইডেনে ভারত হিরো কাপ জিতলো, আর ক্ষত হলো আমার। এও কি সত্য নয়? "


গঙ্গা, অশ্বত্থ, প্রাচীন প্রাসাদ ভেসে যেতে লাগলো নিস্তব্ধতা আর জোনাক স্রোতে। শুভকে অদ্ভুত মনখারাপের রাগিণীরা ঘিরে ধরলো ক্রমে। কেন কথা বলতে বাধ্য করিয়ে কোনোদিন দিদিকে মাঝপথে না থামিয়ে সে পারলো না? যে সামনে বসে থাকলে তার মনে হয় আলো ঠিকরাচ্ছে, কেন তার অনায়াস অধিকারে থাকা প্রবল অন্ধকারের তল পেলো না? অথচ দুই ই সত্য। তাহলে কি প্রতিটি সত্য'ই তাই? হিরণ্ময় রহস্যাবৃত বহুমুখী এক কালখণ্ড মাত্র? 


চিত্রঋণ - পারমিতা চক্রবর্তী


৪টি মন্তব্য:

  1. Khub valo... uponyas likhun ekdin onek pathok paben.lekhar hat khub valo...

    উত্তরমুছুন
  2. বলতে পারিস শিশু, উন্মাদ আর নেশারু এই তিনশ্রেণী ছাড়া কার উচ্চারণে শুদ্ধ সত্য সমাহিত থাকে? --- কেমন করে যে লিখলে কে জানে-- !!!!

    উত্তরমুছুন
  3. এই লেখাগুলো কত কতদিন যে অন্য আর কোনোকিছুই ভাবতে দেবে না,শুধু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে কে জানে...খুব ভালো

    উত্তরমুছুন