,
গুর্জরদের দেশ গুজরাট ভ্রমণের টুকরো গল্প
------------------------------
চেনা-জানা আত্মীয়-বন্ধুর গণ্ডীতে আমাদের পরিবারের পরিচিতি "বেড়ানোবাজ" বলে। দু-এক দিনের ছুটি পেলেও আমরা সপরিবারে কাছেপিঠে পাড়ি জমাই রুকস্যাকে একসেট জামাকাপড়, রাতপোশাক, টয়লেট্রিজ পুরে মোটরসাইকেলে বা গাড়িতে অথবা কৌলিন্যহীন কোনও প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সফরে। ভ্রমণের নির্ভেজাল আনন্দ আর কিছুতে পাই না। কতবড় দেশ আমাদের, এমনকি নিজের রাজ্যটি পর্যন্ত! সর্বত্র ঘুরতে চাই, কিন্তু জানি না একজীবনে আমাদের বৃহৎ দেশের সব আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব কিনা। তাই আমরা একটা পন্থা নিয়েছি। লম্বা অর্থাৎ সাতদিনের বেশি ছুটিতে ভারতবর্ষের নির্বাচিত জায়গায়, এবং ছোট ছুটিতে নিজরাজ্যের জেলায়-জেলায় ছড়ানো-ছেটানো দ্রষ্টব্য জায়গায় বেড়াবো। বেড়ানোর জায়গার অভাব না থাকলেও আর্থিক সঙ্গতি ও সময়ের যথেষ্ট অভাব আছে। সুতরাং, দীর্ঘ গবেষণায় গোটা তিনেক ট্যুরিস্ট গাইড গুলে খেয়ে তবে প্রত্যেকটা ভ্রমণসূচী তৈরি করি।
গত ২০১৫-এর শেষ থেকে আমি বেশ অসুস্থ হয়েছিলাম। তাই সেবার বড়দিনের ছুটি এবং ২০১৬-এর দোলযাত্রা ও গরমের ছুটিতে কোথাও যাওয়া হয়নি। অগত্যা পুজোর ছুটিই ভরসা। ঘরে ও কাজে মন টিকছে না, বেরোতেই হবে, অথচ শরীরও সঙ্গ দিচ্ছে না যে ভোরবেলায় উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের টিকিট রিজার্ভেশন করব, বা অনলাইন পোর্টাল খুলে হোটেল খুঁজবো, গাড়ি বুক করব। বেড়াতে যাবার চূড়ান্ত আগ্রহে প্রায় ভাটা পড়েছে, এমতাবস্থায় খবরের কাগজের ভ্রমণসংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের পাতাটি নতুন দরজা খুলে দিল... আরে, এতো বিরাট সুযোগ। নিজেকে কোনো হ্যাপা পোহাতেই হবে না। টাকার বিনিময়ে দায়িত্ব মুক্তির সুন্দর ব্যবস্থা। তবে কিনা ঐ ছিট কিনে অর্ডার দিয়ে নিজের মাপে বানানো পোশাক আর রেডিমেড পোশাকের যেমন ফারাক, তেমনটা থাকবেই। অত ভাবলে বেড়ানো বাতিল।
সুতরাং, পারিবারিক আলোচনায় মনঃস্থির করে ফোন করলাম ট্র্যাভেলিং এজেন্সিতে। কলকাতায় মাঝারি মাপের পুরনো সংস্থা। সুনামও যথেষ্ট... সেটা একদিন তাদের অফিসে গিয়ে যাচাই করে এলেন কর্তামশাই। ওদের সব ট্যুরের সব সিট পুরো ভর্তি তখন... পুজোর ছুটি তো! কেবলমাত্র গুজরাট ট্যুরের তিনটি সিট ফাঁকা, তবে যাওয়া-আসার টিকিট নিয়ে একটু সমস্যা আছে। একটাই ডেইলি ট্রেন আমেদাবাদ যাতায়াতের। যাওয়ার টিকিটটা এখান থেকে ওঁরা যদিওবা তৎকালে করিয়ে দিতে পারবেন, কিন্তু ফেরার ট্রেনের ঝুঁকি নিতে পারবেন না। মালিক ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন, "আসলে ভারতের পর্যটন মানচিত্রে গুজরাট
একদম দুয়োরানী। খুব বেশি ট্যুরিস্টের গুজরাট নিয়ে বিশেষ ইন্টারেস্ট নেই। তাই প্রতিবারই গুজরাট ট্রিপে দু-চারটে সিট ফাঁকা নিয়েই আমরা ট্যুরটা করাতে বাধ্য হই। তবে আপনারা একটা কাজ করতে পারেন, যাওয়াটা ট্রেনে চলুন, ফেরাটা ফ্লাইটে ফিরুন। এসি টু-টায়ারের থেকে সামান্যই বেশি খরচ।"
কর্তামশাই এককথায় রাজি হয়ে অ্যাডভান্স দিয়ে বুকিং সেরে ট্যুর শিডিউলের ব্রোশিওর নিয়ে চলে এলেন। এবারে ঐ ব্রোশিওরে লেখা সব জায়গাগুলো খুঁজে-খুঁজে ট্যুরিস্ট গাইডে পড়ে দেখে নিলাম। সঙ্গে পড়ে নিলাম গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটুকুও। আফশোস হল আগে যাইনি বলে। তবে আমার কন্যারত্ন একটু অখুশি... বন্ধুদের কাছে শুনেছে গুজরাটে বুড়োবুড়িরা যায় তীর্থ করতে। গিয়েই দেখা যাক না... বলে ওকে আশ্বস্ত করলাম।
যথারীতি যথাসময়ে হাওড়া স্টেশনের নিউ কমপ্লেক্স থেকে ট্রেনে চড়লাম... আমেদাবাদ এক্সপ্রেসের এসি টু-টায়ারে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে যথেষ্টই গরম। গুজরাটেও এইসময়ে গরমের আধিক্য। সামান্য লেটে মধ্যরাত পার করে আমেদাবাদ এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করল। আমাদের কামরায় ট্র্যাভেল এজেন্টের ট্যুরিস্ট দলের আর কেউ নেই। বাকিরা এসি থ্রি-তে। স্টেশনে দেখেই বুঝেছি যে তারা পূর্বপরিচিত। তবে গোড়া থেকেই বোধহয় একটা বিভাজন তৈরি হল। এটা অবশ্য স্পষ্ট হবে আরও পরে। যাইহোক, আমাদের ট্যুর অপারেটর কিন্তু দায়িত্ববান ও যত্নশীল। তাদের তরফ থেকে কোনও ত্রুটি ট্যুরের শেষদিন অবধি আমরা পাইনি। কর্তামশাই বললেন, "আমরা তো নিজেরা নিজেরাই ট্যুর করে অভ্যস্ত, সঙ্গের বাকি ট্যুরিস্টদের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেই ভালো। নইলে বেড়ানো মাটি... পুরো সতেরো দিন।" ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। দু'রাত্রি ট্রেনে অবস্থান। তৃতীয়দিনে দুপুর দেড়টা নাগাদ ট্রেন আমেদাবাদ পৌঁছল। ট্যুর অপারেটরের পিছনে কুলিরা রেলের লম্বা ট্রলিতে সবাইয়ের লাগেজপত্র চাপিয়ে, একদম পিছনে ট্যুরিস্টরা। স্টেশন থেকে বেরোতেই স্টেশন চত্বরেই ট্র্যাভেল এজেন্সির এসি বাস দাঁড়িয়ে। বাসেই আপাতত হোটেল, মিনিট কয়েকের পথ। এই বাসেই আজ সন্ধ্যায় ও আগামী পনেরোদিন আমরা ঘুরে বেড়াব গুর্জরদের দেশে। ট্র্যাভেল এজেন্টের সঙ্গে ট্যুর করার মস্ত সুবিধা হল, কোনো ব্যাপারেই মাথা ঘামাতে হয় না নিজেদের। টাকা দিয়ে দায়টা এজেন্টের কাঁধে দিব্য ট্রান্সফার করে বহাল তবিয়তে ঝামেলাবিহীন ঘোরাফেরা খাওয়াদাওয়া ঘুমানো। অত বেলায় হোটেলে পৌঁছে স্নান খাওয়া সমাপনান্তে একটি নিটোল ঘুম হল ঘন্টা দুয়েকের।
সন্ধ্যায় ট্যুর অপারেটর দরজা নক করে জাগিয়ে চা-পকোড়া খাইয়ে আধঘন্টা সময় দিল তৈরি হবার। কাছেই একটি অ্যামিউজমেন্ট পার্ক আছে। দেখেই শপিং কমপ্লেক্সে যাওয়া। শুনলাম প্রত্যেক স্পটেই সন্ধ্যার দিকে শপিং হবে। খুব নাকি বৈচিত্র্যময় সম্ভার শাড়ি, ড্রেস মেটেরিয়াল, গুজরাটের আঞ্চলিক আর্ট অ্যাণ্ড ক্রাফটের। আমরা অত শপিং-শৌখিন নই। যাওয়ার পথে তিন দরওয়াজা দেখে আমরা অ্যামিউজমেন্ট পার্কে রয়ে গেলাম। খুব সুন্দর পরিবেশ। মাঝখানে বিশাল লেকটি ঘিরে বিস্তর আয়োজন। নানানরকম রাইড এবং মনোরঞ্জনের বিপুল ব্যবস্থা। খাওয়াদাওয়ারও হরেক মেলা। ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে আমরা পায়ে-পায়ে হেঁটে আমেদাবাদ শহর দেখতে দেখতে হোটেলে ফিরলাম। তেমনই বলেছিলাম ট্যুর অপারেটরকে। আমেদাবাদ শহরের ট্রাফিকের অব্যবস্থা বেশ চোখে লাগল। কলকাতায় রোড-রুল মেনে যারা অভ্যস্ত তাদের চোখে অবশ্যই পীড়াদায়ক যত্রতত্র যেমনতেমন চলা গাড়িঘোড়া।
রাতের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হোটেলের রুফটপে। দলের সবাই আগেই পৌঁছেছিল। আমরা সবার শেষে উঠতে উঠতে একটা গোলযোগ শুনতে পেলাম। উষ্ণ বাক্যবিনিময়। ছাতে পৌঁছে গোলমালের সারাংশটি বুঝে ভারি অস্বস্তিতে পড়লাম। আমাদের ঘরকে কেন্দ্র করে গোলমাল। ট্যুর অপারেটর নাকি বেছে-বেছে সবচেয়ে ভালো ঘরটা আমাদের জন্য বরাদ্দ করেছে। নইলে বাকি সকলের ডাবল-বেডেড ঘর তিনতলায়, আমাদের কেন দোতলায় থ্রি-বেডেড ঘর দেওয়া হল। সবারই সঙ্গে ছেলেমেয়ে আছে। বেচারা ট্যুর অপারেটর কিছুতেই বোঝাতে পারল না যে ঘর কলকাতা থেকেই কোম্পানি বুক করেছে। আমাদের মেয়ে যেহেতু অ্যাডাল্ট সেই কারণেই তার জন্য আলাদা বেড আমরা কলকাতা থেকেই অ্যারেঞ্জ করতে বলেছি বাড়তি পেমেন্ট করে। আমরা চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে এলাম। নিজেরা ঝামেলা পোহাতে না চাওয়ার ফেরে প্রথমেই এমন ঝঞ্ঝাট কাম্য ছিল না। এরপর থেকে প্রতিদিনই অবশ্য আমার কর্তামশাই হোটেলে চেক-ইন করে হোটেলের বুকিং লিস্ট অন্যদের দেখিয়ে তবে চাবি হাতে নিতেন। তবে ঝামেলা পিছু ছাড়ল না। এরপর আমাদের একদিনও সামনে বসতে দেবে না বলে সবাইয়ের শরীর খারাপ হতে লাগল, এবং বাসের সিটের রোটেশনটাও মানা হল না। আমরা ট্যুর অপারেটরকে তুচ্ছ ব্যাপারে কথা বাড়াতে মানা করেছিলাম। পুরো পনেরোদিনই আমরা বাসের পেছনের সিটে বসেই ঘুরেছি। অসুবিধে হয়নি, কারণ এসির ঠাণ্ডা ওখানেই সবচেয়ে বেশি।
আসল ভ্রমণের দ্বিতীয় সকালে বাসের সিটে পা তুলে আরাম করে বসলাম। গন্তব্য ভুজ। আমেদাবাদ থেকে চারশো কিলোমিটারেরও বেশি পথ। চায়ের পরে সকাল সাতটায় বাস ছেড়ে সারাদিন চলবে। ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ সব তৈরি করে প্যাক করে নিয়েছে। পথেই কোনও সুবিধামতো জায়গায় বাস দাঁড় করিয়ে খাওয়া ও টয়লেট সেরে নেওয়া হবে। জনপদ ছাড়াতেই দীর্ঘ পথের দু'ধারে শুনশান ক্ষেত... সয়াবিন চাষের। শুনলাম তুলো আর চিনাবাদামের চাষও হয়। ফাঁকা মাঠে বড়ো বড়ো চৌখুপি কাটা। তাতে সমুদ্রের লোনা জল ঢুকে শুকিয়ে সাদা পাথরের মতো নুনের চাঙর জমে আছে। ভারতবর্ষের নুনের চাহিদার অন্যতম জোগানদার গুজরাট। পথের পাশে দিগন্তবিস্তৃত বিলের জমা জলে লম্বা ঠ্যাং লম্বা ঠোঁটের ফ্লেমিংগোর ঝাঁক হেঁটে-হেঁটে খুঁটে-খুঁটে পোকামাকড়, ছোটমাছ, ব্যাং-ট্যাং খাচ্ছে বোধহয়। দুপুর গড়ানো তেরছা রোদে চোখ ঝলসে উঠছে সারি সারি দাঁড়ানো বিশালাকার উইণ্ডমিলের তিনখানা ঘুরন্ত ব্লেডে। এত দীর্ঘ যাত্রায় মাঝেমাঝে চোখ লেগে আসছে। ঢুলুঢুলু চোখ মেলে রুক্ষতার রূপ দেখছি। শেষবিকেলে ভুজের শহরসীমায় পৌঁছনো গেল।
ভুজ বললেই সেই ২০০১-এর ২৬শে জানুয়ারির বিধ্বংসী ভূমিকম্পের কথাই প্রথম মনে আসে। ছোট হলেও শহরটি আধুনিক ও পুরাতনের মেলবন্ধনে সুসজ্জিত। গুজরাটে সন্ধ্যা নামে অনেক দেরি করে। তাই হোটেলে লাগেজ রেখে চা-স্ন্যাক্স খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পায়ে হেঁটে শহর দেখতে। টুকটুক করে পৌঁছে গেলাম শহরের উত্তরের লেকটির পাড়ে। প্রবল জলাভাবে লেকটি প্রায় শুকনো। তবে সান্ধ্য রোশনাইয়ের অভাব নেই। আলোকসজ্জায় সেজে উঠেছে লেকের পার্শ্ববর্তী আয়না মহল, প্রাগ মহল এবং আরো ঐতিহাসিক নিদর্শন। পরেরদিন দেখার কথা আমাদের। লেকের পাড়ের সাজানো বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে আবার চললাম শহরের পথে হেঁটে স্থানীয় দোকানপাট, লোকজন দেখতে দেখতে। শহর বেশ বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন জনজাতির বাস। অতিথিপরায়ণ, আলাপি ও হাসিমুখ দোকানদার।
ডিনারের পরে পরেরদিনের প্রোগ্রাম জানিয়ে দেওয়া হল। সকালে চা-ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে চড়ে শহর দর্শন শুরু। একে একে দেখা হল রাও লাক্ষা প্রাসাদ, দরবার-হল, আয়না মহল, ফুবারা, রং মহল, হিরা মহল ইত্যাদি। দেখা হলো প্রতি প্রাসাদেরই মিউজিয়ামগুলি। শুনে অবাক হলাম আয়না মহলের নির্মাণ ব্যয় সেই অষ্টাদশ শতকেই দুই লক্ষ পাউন্ড। আমাদের হাতে মাপা সময়, তাই ইচ্ছে থাকলেও কোথাওই বেশি সময় নেওয়া যায়নি। পরবর্তী চলা স্বামী নারায়ন মন্দির দর্শনে। পথে বহু দ্রষ্টব্য বাস থেকেই চোখে পড়েছে। সময়াভাবে নামা যায়নি।
হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরেই আধঘন্টার ব্যবধানে আবার যাত্রা শুরু। এবারে গন্তব্য আদিবাসী অধ্যুষিত লিটল রণ অফ কচ্ছ। মরুভূমি ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থল যেন। কচ্ছ উপসাগরে তিনদিক ঘেরা উপদ্বীপ কাথিয়াবাড় ও ভুজ। এত রুক্ষতা সর্বত্র, অথচ সুদূর অতীতে নাকি এখানেই সিন্ধু নদ বইত। আসলে রণ অফ কচ্ছ মানে লোনা জলের বিল, দুটি ভাগে বিভক্ত... লিটল রণ এবং গ্রেট রণ। ভেতরে বাস যাবে না। উটের গাড়িতে যাওয়া যেতে পারে একমাত্র। ওখানে ভাড়া পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় সরকারি পারমিট নিয়ে ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে আমরা লিটল রণের বুকে ঢুকলাম পায়ে হেঁটেই, তবে রাস্তাটি বাঁধানো। ফেব্রুয়ারি মার্চের কচ্ছ ফেস্টিভ্যালে অগণিত দেশী-বিদেশী পর্যটকের সুবিধার্থেই। জায়গাটা ভারতীয় মিলিটারির নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় মোড়া। কারণ এই রণ নামের নুনের সাগর পেরোলেই থর মরুভূমির ওপারেই পাকিস্তান। ধূ-ধূ নজরে আসছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের জলসীমা। দুই দেশের মৎস্যজীবী নৌকাই রণে বিচরণরত। অবশ্য নিরাপত্তা আইন অমান্য করলেই আটক। শুনলাম আর কিছুদিন পরেই নাকি এই নুনের সাগর জমে সাদা বরফ-পাথরের মতো হয়ে যাবে... এর নামই সল্ট ডেজার্ট। স্থানীয় কাথিয়াবাড়ি আর্টের পসরা সাজিয়ে বসা তরুণটি জানায় যে পূর্ণিমার রাতে নাকি সেখানে হুর-পরীরা নাচা-গানা খেলাধুলা করে। বিশ্বাস ও জনশ্রুতি মিলে মিশে একাকার হয়ে রূপকথার জন্ম হয়েছে। তবে আমাদের ভাগ্যে সেই নয়নাভিরাম সল্ট ডেজার্ট দেখা না জুটলেও, দিগন্তবিস্তৃত কালচে নীল আরব সাগরের কচ্ছ উপসাগরে এক অনির্বচনীয় সূর্যাস্ত দেখেই ফিরলাম। ফেরার পথে রাস্তার ধারের এক কাথিয়াবাড়ি বৃদ্ধ দম্পতির ছোট্ট তাঁবু খাটানো ঘুপচি দোকানে চা ও ডাল-বড়া জাতীয় সুস্বাদু এক স্ন্যাকস্ খাওয়া হল। হোটেলে ফিরতে বেশ রাত। নুনের সাগরের হাওয়ায় সর্বাঙ্গ চ্যাটচেটে। স্নান ও ডিনার সেরে ঘুমোতে হবে তাড়াতাড়ি।
পরদিন লম্বা জার্নি। গন্তব্য দ্বারকা। পথশোভা কমবেশি ভুজযাত্রাপথের মতোই। পথেই ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, বৈকালিক চা-টা। সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছলাম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকাভূমিতে। সামান্য জলযোগ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম গোমতী নদীতীরবর্তী দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের সন্ধ্যারতি দর্শনে। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাগ, জুতো, মোবাইল, ক্যামেরা... যথাসর্বস্ব জমা রেখে টোকেন নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। অকথ্য ভিড় ডিঙিয়ে ভগবান দর্শন সেরে বেরিয়ে এলাম গোমতী তীরে। ঘাটের সবকটা সিঁড়ি ডুবে গেছে গোমতীর গর্জনরত ছলছলে জলে। স্থানীয়দের মুখে শোনা গেল এই জল সব সাগরে ফিরে যাবে ভোর হওয়ার আগেই। গোমতীর বুক শুকনো হয়ে যাবে। আবার পরের সন্ধ্যায় গোমতী মাইয়া আসবে দ্বারকাধীশের চরণস্পর্শ করতে। আবার লোকশ্রুতি!
আদতে জোয়ার-ভাঁটার খেলা... তাইবলে এমন? সত্যি পরেরদিন ভোরে ছ'টা নাগাদ (সূর্যোদয়ের তখনও বিস্তর দেরি) গোমতী তীরে গিয়ে অবাক। কোথায় নদী? শুকনো নদীখাতের বালিয়াড়িতে ছোট-বড়ো পাথরের চাঁই বুকে নিয়ে আরব সাগরমুখী চাতকনয়না গোমতী অপেক্ষা করে আছে সন্ধ্যার। একবর্ণও মিথ্যে বলেনি সহজ সরল স্থানীয় মানুষেরা। এখানেও সেই বিশ্বাস।
সকালে গোমতীর সাগরসঙ্গমস্থল ঘুরে আরেকবার দ্বারকাধীশের মন্দির দর্শন করে চা-জলখাবারান্তে চললাম ভেট দ্বারকা। হোটেল থেকে বাসযাত্রায় ওখা। বাস রইল দাঁড়িয়ে ফেরার অপেক্ষায়। আমরা চললাম ওখা থেকে ফেরিতে ভেট দ্বারকা। গুর্জর ভাষায় বেট মানে দ্বীপ, আর জনশ্রুতি যে ঐস্থানেই শ্রীকৃষ্ণ বাল্যসখা সুদামার হাত থেকে ভেট গ্রহণ করেছিলেন... তাই ভেট দ্বারকা। নামে কী আসে যায়? আসল তো আরব সাগরের বুকে যাতায়াতে দশ-বারো কিলোমিটারের পথে মিনিট ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মনোহরণকারী জলবিহার। ইতিহাস আর লোকশ্রুতি মিলেমিশে একাকার ভেট দ্বারকায়। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষজন ও দোকানপাটে জমজমাট ভেট দ্বারকা। শ্রীকৃষ্ণ এখানে রণছোড়জী। তাঁর মন্দির ছাড়াও আছে রাধারাণী, রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী ও দেবকী মাতার বিগ্রহ ও মন্দির। ছবিতোলা নিষিদ্ধ। কয়েকঘন্টা ঘুরে বেড়িয়ে ফেরিতে আবার ওখা এবং সেখান থেকে বাসে চলা দ্বারকা অভিমুখে। ফিরতি পথেও কয়েকটি মন্দির পড়েছে। সঙ্গীরা নেমেছেন। গরমের অত্যাধিক্যে আমি নামিনি। হোটেলে ফিরে বেলা গড়িয়ে লাঞ্চ ও ভাতঘুম সেরে সন্ধ্যায় দ্বারকায় সামান্য কেনাকাটা সারলাম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামকীর্তন সহযোগে সন্ধ্যারতি দেখলাম।
পরেরদিন সকালে চা-ব্রেকফাস্ট সেরে বাস ছুটল সোমনাথের উদ্দেশ্যে। পথে প্রভাসতীর্থ এবং পোরবন্দরে মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান ও পবিত্র ভিটায় মিউজিয়াম পরিদর্শন হল। পথিমধ্যেই দর্শন হল সুদামা মন্দির ও পোরবন্দর পোর্ট। সোমনাথ পৌঁছতে প্রায় বিকেল। হোটেলে পৌঁছে স্নান ও চা-স্ন্যাকস্ অন্তে চললাম সোমনাথ দর্শনে। এখানেও ফোটোগ্রাফি মানা। জুতো, ব্যাগ, মোবাইল কাউন্টারে জমা দিয়ে ঢুকতে হল মন্দির চত্বরে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর। ঠাসাঠাসি ভিড় ঠেলে লাইন দিয়ে সোমনাথজী দর্শন হল, পূজান্তে প্রসাদ নেওয়া এবং আরতি দেখাও হল। যাঁরা ভিড় ঠেলতে অনাগ্রহী বা অপারগ, তাঁদের জন্য মন্দির প্রাঙ্গনে অনেকগুলি জায়ান্ট-স্ক্রিন বসানো। দর্শন ওতেও হতে পারে। মন্দির প্রাঙ্গনে আলোর সুব্যবস্থায় চারিদিকে ঘুরে দেখতে কোনো অসুবিধা নেই। অপরূপ মন্দির প্রাঙ্গনের শেষেই আরব সাগর সগর্জনে ঢেউ ভেঙে যেন অতীত ইতিহাস শোনাতে চাইছে। আরও দু-এক দিন থাকার ইচ্ছে হচ্ছিল, বিশেষতঃ মনোরম সূর্যাস্তের শোভাটির কারণে, কিন্তু আমরা বাঁধা রুটিনে চলছি যে, উপায় নেই।
পরদিন ভোরে চা-ব্রেকফাস্ট সেরে বাস ছুটল দিউয়ের পথে। প্রায় নব্বই কিলোমিটার। দিউ পৌঁছে গেলাম ঘন্টা দুই-আড়াইতে। তবে একটা কথা অনস্বীকার্য যে গুজরাটের রাস্তাঘাট খুব মসৃণ, তাই পথচলাও সুগম। পর্তুগিজ উপনিবেশ দিউ। ছোট্ট শহর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সাজানো গোছানো। বাড়িঘর ও শহরশৈলী দেখে মনে হবে একটুকরো পর্তুগাল। পৌঁছেই দেখা হল দিউ দুর্গ, আর কয়েকটি খাঁড়িমুখ। লাঞ্চের পরে সেন্ট পলস ও সেন্ট ফ্রান্সিস দুর্গ, সিটি ওয়াল, ঘন্টা গেট, গুপ্ত প্রয়াগ এবং কয়েকটি সমুদ্রতট। সান্ধ্য চা-স্ন্যাকস্ পর্বশেষে গেলাম দিউ বাজারে... কেনাকাটা হল নামমাত্র দামে রকমারি বিদেশি চকলেট-ক্যাণ্ডি, হ্যাণ্ডব্যাগ, কাজুবাদাম ও মশলাপাতি। পরেরদিনটা বরাদ্দ ছিল সমুদ্রস্নান এবং দিউয়ের স্থানীয় কুইজিনে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে গ্র্যান্ড ফিস্টের ব্যবস্থা। সন্ধ্যেটা পায়ে হেঁটে পর্তুগিজ উপনিবেশের অলিতে-গলিতে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো। বেশ লেগেছিল এই সান্ধ্যভ্রমণ।
পরেরদিন ভোরে চা-ব্রেকফাস্ট পর্বান্তে বাস ছুটল সোজা গির অরণ্যের পথে। বড়জোর ঘন্টা দেড়েক পৌঁছতে, স্থানীয়দের কথায় শাসন গির... বাস থেমেছিল ডাব খাওয়াতে। শুনলাম ক'দিন আগে নাকি এক সিংহ সারারাত এটিএমের দরজায় বসে ছিল। বেশ কথা! নির্ঘাৎ গুজব! তবে হোটেলের সামনে বাস দাঁড়াতেই দেখি বাঁ-দিকে এক এটিএম খুপরি। কী মনে হল... হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম পথে শোনা সিংহের গল্পটি। ছিপিক করে গুঠখার রস ফেলে ভাঙা হিন্দিতে জানাল যে হ্যাঁ, ওটাই সেই এটিএম। আক্কেল গুড়ুম... রাতে ঘুমের দফারফা হবে। তবে লাঞ্চ টাইম হয়েছে এবং লাঞ্চের পরেই গির অভয়ারণ্যের জাঙ্গল সাফারির বুকিং আছে। ঝড়ের গতিতে স্নান-খাওয়া সেরে তৈরি হয়ে বাসে চড়ে গির রিজার্ভ ফরেস্টের অফিসের সামনে লাইন দিলাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পুরোটা কাঁচঘেরা বাসে ওঠার। ভেতরে বসে কাঁচের বাইরে জঙ্গল ও পশুরাজ দর্শন হল। কিছু হরিণ, সম্বর, নীলগাই, কিছু চেনা অচেনা পাখি এবং সংগ্রহশালাটিও দেখা হল, তবে মনটি ভরল না। আমাদের খুঁতখুঁতুনি দেখে আমাদের বাসের ড্রাইভার ভাই বাতলাল যে কোর ফরেস্টে যাওয়া যেতে পারে, খুব ভোরে, তবে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আগাম পারমিশন চাই। ঐ কাগজ না দেখালে গার্ডরা ভেতরে ট্যুরিস্ট যাওয়ার নির্দিষ্ট জায়গা অব্দি যেতে দেবে না। ভোরবেলা তিনটেয় রওনা হতে হবে, সাফারির জন্য আলাদা জিপে। গিরে আবার হুডখোলা জিপসি অ্যালাউড নয়। ট্যুর অপারেটর একটু গাঁইগুঁই করছিল, কারণ কোর ফরেস্ট ট্রিপে ইনক্লুডেড নয়। যদি কিছু বিপদ-আপদ হয়! এইপ্রথম দেখলাম ট্রিপের সব ক'জন ট্যুরিস্ট সহমত হল, গিরে এসে কোর ফরেস্ট না দেখেই চলে যাব? সুতরাং, ড্রাইভার ভাইয়ের চেনা-পরিচিতি নির্ভর করে কোর ফরেস্ট সাফারির সরকারি পারমিশন এবং সেভেন সিটার চারখানা জিপও জোগাড় হয়ে গেল রাতারাতি। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। রাত দুটোয় উঠে তৈরি হতে হবে। তিনটেয় জিপ ছাড়বে। সঙ্গে প্যাকিং করা ব্রেকফাস্ট আর ফ্লাস্ক ভর্তি চা থাকবে। সূর্যোদয়ের অনেকটা আগেই পৌঁছতে হবে ডিপ কোরে... নইলে পশুরাজের দেখা মিলবে না। আমাদের হোটেল থেকে এন্ট্রিপয়েন্ট বেশ দূরে। ঢুলতে ঢুলতে চললাম। চারিদিকে ঘন অন্ধকার। রাস্তার দু'ধারে বেশ ঘন জঙ্গল। ডে-ব্রেকিং শুরু হতেই রাস্তার ধারের জঙ্গলে অনেকগুলো গাছের পেছনে দেখি দাঁড়িয়ে একপাল নীলগাই... কান নাড়িয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছে বোধহয়। তারপর গাড়িগুলো মাঝারি স্পিডে চলতে শুরু করল। নানারকম হরিণ এবং বাঁদর দেখলাম। ময়ূর, বুনো খরগোশ, রকমারি পাখি দেখলাম। হঠাৎ রাস্তা ক্রস করে লোমশ এক প্রাণী এত দ্রুতগতিতে ছুটল, বুঝলাম না শেয়াল না বনবেড়াল নাকি হায়েনা। এরপর একজায়গায় গেটে ফরেস্ট গার্ডদের পারমিট দেখিয়ে ঢুকতে হল। ওটাই আসল কোর ফরেস্ট। গার্ডরা দাঁড়িয়ে থেকে জিপের সব কাঁচ মুড়িয়ে বন্ধ করাল। ড্রাইভারদের গাড়ির স্পিড লিমিট এবং ফেরার টাইমও বলে দিল। গাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। ইঞ্জিনের আওয়াজ বন্ধ করে। আমাদের গাড়িটা একদম সামনে। সাফারির গাড়ির চাকার ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে জিপ। দু'ধারে মানুষ সমান উঁচু ঘাসবন... সাভানা গ্রাসল্যাণ্ড। এখানটাই সিংহের চারণভূমি। মাঝেমাঝে ময়ূর রাস্তা আটকাচ্ছে। সরলে আবার চলা। হঠাৎ কাঁচা ভিজেমাটিতে বড়-বড় থাবার ছাপ। পরপর... অনেকগুলো। জিপ দাঁড়িয়ে পড়ল। এখানেই আছে পশুরাজ। ডানদিকে বাঁ-দিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে সবাই তাকিয়ে। হলদেটে হয়ে যাওয়া শুকনো ঘাসবনের মাঝবরাবর সপরিবারে পশুরাজ চলেছে মানুষ নামক নাছোড়বান্দা জন্তুদের এড়াতে। পেছনটা দেখলাম তাদের। আরও কিছুদূর এগোতেই দেখি সশাবক এক সিংহিনী রাস্তা পেরিয়ে ঘাসজঙ্গলের এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে জিপটি দেখেই দ্রুত মিলিয়ে গেল সাভানা ঘাসের আড়ালে। মনে শান্তি। এমন ন্যাচারাল হ্যাবিটেটে সিংহ দেখা, আর কোথায় রিজার্ভ ফরেস্টের পোষা হাড় জিরজিরে আফিমখোরের মতো ঝিমন্ত সিংহ দেখা! কোনও তুলনা চলে? মানুষ প্রাণীটি কলবল না করে থাকতে পারে না। আমরাও বন্ধ জিপে বসে কলকলাচ্ছি, ড্রাইভার ছোকরা ঠোঁটে আঙুল রাখল, "শ্-শ্-শ্-শ্-শ্!" ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি ঘাসের আড়ালে এক গর্ভিণী হরিণ শাবক প্রসব করছে। কী দুর্লভ দৃশ্য! আর কী চাই? মা হরিণ শাবককে চাটতে শুরু করেছে, এদিকে রোদও চড়ে উঠেছে। একটি ছোট নদী সামনেই, ঐ পর্যন্ত যাবার পারমিশন আমাদের। নদীর এপারে বেশ চওড়া মাঠ। গাড়ি ঘোরানো হল। এবারে ফিরতি পথ। ড্রাইভার জানাল আর পশু দেখা যাবে না। ওরা এবার ছায়াতলে বিশ্রাম নেবে। আবার সূর্যাস্তের আগে জল খেতে বেরোবে। গাড়ি এখানে ইঞ্জিনে শব্দ না করেই চলার কথা। এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছি, যদি ভাগ্যক্রমে আরোকিছু দেখা যায়। নিরাশ হলাম না শম্বুকগতিতে গড়ানো জিপ গোঁত্তা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। শিশু ও অ্যাডাল্ট সাইজের মাঝামাঝি এক চিতা দাঁত খিঁচিয়ে বিরক্তি দেখিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। অল্প খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল চলন্ত খাঁচাবন্দি মানুষগুলোকে। তারপর নিজের পথ ধরল। ড্রাইভার বলল যে ভারি খতরনাক প্রাণি এই চিতা। প্রথমে সামনে থেকে সরে গিয়ে লুকোয়, তারপর ঝটিতি বেরিয়ে পেছনদিক থেকে আক্রমণ করে। অনেকবার জিপে লাফিয়েছে গাছের মগডাল থেকে বলে শুনেছে। যাকগে, আমাদের তেমন সমস্যা হয়নি। গিরের কোর ফরেস্ট সাফারি করে প্রফুল্লচিত্তে হোটেলে ফিরে লাঞ্চ করলাম।
লাঞ্চের পরই বাস ছাড়ল জুনাগড়ের উদ্দেশ্যে। খুব বেশি পথ নয়। আড়াইটে নাগাদ জুনাগড় ফোর্টের গেটে বাস আমাদের নামিয়ে গেল শহরের নির্দিষ্ট পার্কিং লটে। আমরা পরিদর্শন করলাম জুনাগড় ফোর্ট। নবম শতাব্দীতে উপারকোট পাহাড়ে রাজপুত রাজাদের তৈরি ফোর্ট। তবে ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিষ্টপূর্ব তিনশোর আশেপাশে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর তৈরি এবং সংস্কারসাধন হয় নবম শতাব্দীতে রাজপুত রাজাদের আমলে। জুনাগড় নামটিরও উৎপত্তি "জীর্ণা দুর্গ" অর্থাৎ পুরাতন দুর্গ বা গড় থেকে... দিনেকালে মুখেমুখে জুনাগড়। দীর্ঘ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী জুনাগড়। দুর্গের অন্যতম আকর্ষণ নওগড় ভাভ ও আধি-চাধি ভাভ নামে প্রায় যেন অতলস্পর্শী দুই জলের কুয়া। কুয়ার গা বেয়ে ধাপে-ধাপে সিঁড়ি নেমেছে অন্ধকার গর্ভে। লোহার ঘেরার ফাঁকে ঝুঁকে তাকালেই মাথায় একটা চক্কর অবশ্যম্ভাবী। দুর্গসংলগ্ন আরেক আকর্ষণ প্রায় দেড় হাজার বছর আগেকার উপারকোট বৌদ্ধবিহার। কারুকার্যসমৃদ্ধ বৌদ্ধ গুহাগুলি দেখতে অনেক নীচ অবধি নামতে হবে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে। একদম নীচে না পৌঁছলে বোঝা সম্ভব নয় বৌদ্ধভিক্ষুদের ঐ অতুল কীর্তি... ওখানকার ন্যাচারাল এসির শীতলতা ভুলিয়ে দেবে জুনাগড়ের রীতিমতো উচ্চ তাপমাত্রাকে। শোনা যায় সম্রাট অশোকের কালের কিছু গুহাও আছে, তবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। রাজপুত রাজাদের প্রতিষ্ঠিত রণকদেবী মহলের উপরে গড়ে ওঠা পঞ্চদশ শতকের জামি মসজিদটি অক্ষত। দুর্গের যুদ্ধকালীন স্টোর থেকে সরবরাহ হচ্ছে বর্তমান জুনাগড় শহরের জল। দুর্গের আরেক আকর্ষণ দুটি কামান... নীলম তোপ ও কদানল। জুনাগড় দুর্গ থেকেই ভাড়াকরা দূরবীনে দেখা যায় গিরনার পাহাড়ের মন্দিরগুলিও। দুর্গ দেখতেই বেলা ফুরাল। পরবর্তী গন্তব্য সোলাপুরী মহাশ্মশান... অবশ্য ঘেরা সুন্দর বাগান দিয়ে। ওখান থেকে সামান্য এগোতেই পথের ডাইনে জুনাগড়ে আবিষ্কৃত আড়াইশো খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পালিতে লিখিত সম্রাট অশোকের শিলালিপিটি। দেখেই গা'টা শিরশির করে উঠল। ফুট বিশ-পঁচিশ উঁচু ফুট চার-পাঁচেক চওড়া একখণ্ড পাথরের গায়ে পালিতে খোদিত সম্রাট অশোকের প্রজাদের উদ্দেশ্যে চোদ্দোটি রাজ-আজ্ঞা। অতবছর আগেও এখানে মানুষ ছিল... অন্যরকম বেশে, অন্যরকম উদ্দেশ্যে! তারপর বাজেশ্বরী মন্দির। ইতিহাস আর কিম্বদন্তী জড়িয়ে-মড়িয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে প্রাচীনতম শহর জুনাগড়ের ধূলি-পাথরে। ভাবাবেগাক্রান্ত হয়ে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হোটেল পৌঁছলাম রাতের বিশ্রামের প্রয়োজনে। পরেরদিন লাঞ্চের পরে আবার লম্বা চলা। গন্তব্য আবার আমেদাবাদ শহর।
এদিন আমি সকালে বেরোইনি। পথশ্রমের ক্লান্তিতে হোটেলে রয়ে গেলাম আমি, বাকিরা সবাই জুনাগড় শহরের বাকি দ্রষ্টব্য দেখে এল, আমি ছবি দেখলাম। লাঞ্চের পরে বাস ছাড়ল। পথে দু-একটি জায়াগায় মন্দিরদর্শন হল, তবে পথশ্রমে ও গরমে আমি ভয়ঙ্কর ক্লান্ত। নেমে দেখার ক্ষমতা সঞ্চয় করতে পারিনি... তাছাড়া আমি তেমন ধর্মভীরুও নই।
বিকেলে আমেদাবাদ শহরে পৌঁছে গেলাম। স্নান, বিশ্রাম, চা-স্ন্যাকস্ সেরে বেরোলাম প্রথমদিন দেখা আমেদাবাদের সেই অ্যামিউজমেন্ট পার্কে। সন্ধ্যে কাটানোর জন্য আদর্শ। পরেরদিনে বিশ্রামের জন্য ছিল সকালটা। বিকেলে আমেদাবাদ শহর ঘোরা পায়ে হেঁটে। তার পরেরদিন সকালে চা-ব্রেকফাস্টের পরে বাস চলল আমেদাবাদের লাল দরওয়াজার দক্ষিণে সবরমতী নদীর উপরে এলিস ব্রিজ পেরিয়ে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত সবরমতী আশ্রম অভিমুখে। আশ্রমের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ চাক্ষুষ না করলে অনুধাবন করা একেবারেই অসম্ভব। সবরমতী আশ্রম পরিদর্শন সেরে চললাম গান্ধীনগর শহরপানে। গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগর বিশ্বের অন্যতম সবুজ শহর। এই শহরের নয়নলোভন সবুজের আধিক্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। গুজরাটের সব প্রশাসনিক দপ্তর, বিভিন্ন সেক্টরের অফিসগুলি, সেরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিধানসভা ভবন সবকিছু এই গান্ধীনগরেই। এছাড়াও গান্ধীনগরের অন্যতম দ্রষ্টব্য অপূর্ব অক্ষরধাম মন্দির, আর মিনি বৈষ্ণোদেবী মন্দির। আর রয়েছে এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক, তবে দুপুর-রোদে বাইরে থেকে দেখেই আমাদের গুজরাট ভ্রমণপর্বের যাত্রাবিরতি। সন্ধ্যেটি বরাদ্দ শপিং-এর জন্য। কলকাতা থেকে যাত্রা করার সতেরোতম দিনটি অতিক্রান্ত হল। রাতে গ্র্যান্ড পার্টি দিয়ে ট্র্যাভেল এজেন্ট খুব সুন্দর করে এবারকার মতো আমাদের ঝটিকা সফরে ভ্রমণ বিরতি ঘোষণা করল। দেখতে দেখতে ভ্রমণ শেষ। একটু মনখারাপ লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিল ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।
টিমের সহযাত্রীরা চলে গেল। রাতেই তাদের কলকাতা ফেরার ট্রেন। আমরা আমেদাবাদের হোটেলেই রয়ে গেলাম রাত্রিযাপনের জন্য। পরদিন খুব ভোরে আমাদের কলকাতাগামী ফ্লাইট। শেষদিনের শহর পরিভ্রমণের সময় বারবার মনে হয়েছে এত কমসময়ে গুজরাট ভ্রমণ অসম্ভব, অন্ততঃপক্ষে একমাস প্রয়োজন উল্ল্যেখযোগ্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখতে। দেখা হল যতটা, দেখা হল না তার থেকে অনেক বেশি। পরের ভোরে ফ্লাইট টেক-অফের পরে আকাশ থেকে তাকিয়ে দেখি রাতজাগা ক্লান্তিতে হলদেটে আভা ছড়ানো ভেপার ল্যাম্পের আলোয় নীচে ঘুমন্ত আমেদাবাদ শহর। তাকে বলে এলাম... আবার আসবো গুর্জরদের দেশের অবশিষ্টাংশ পরিদর্শনে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন