।। বোধন ।।
মহাষষ্ঠীর দিন, দিনের আলো থাকতে থাকতেই অফিস ছুটি হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে ওপর দিকে তাকালো নীল। নীলাকাশে পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘের ভেলা, সোনালী রোদ্দুর...। চারিদিকে মায়ের আগমনীবার্তা। শিয়ালদা স্টেশনে চত্বরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল নীল। ষ্টেশনে প্রায় আট-দশজন ঢাকিদের ঢাকের শব্দে আকাশ-বাতাস মুখরিত। প্রতি বছর বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসে ঢাকিদের দল। পুজোর কর্মকর্তারা দরদাম করে নিয়ে যায় পুজো মণ্ডপে। সম্ভবত এই ষষ্ঠীর দিনে অবশিষ্ট এই কয়েকজন ঢাকি রয়ে গেছেন, ডাকেন নি কেউ। মনপ্রাণ ঢেলে ঢাক বাজাচ্ছে্ন তাঁরা, পথচলতি যদি কোনো কর্মকর্তাদের কেউ নিয়ে যায়, সেই আশায়…। ঢাকিদের নাচের ছন্দের তালে তালে দুলছে ডাকের পেছনে রংবেরঙ পালকের কাশফুলের মতো ঝালর। ঢাকের মন কেমন করা শব্দের আবেশে নীল দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ অল্প কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল ঢাকের শব্দ। কাঠিদুটি ঢাকের একপাশে গুঁজে গামছা দিয়ে মুখ মুছে নিলেন পরিশ্রান্ত ঢাকিরা। সম্বিৎ ফিরতেই শিয়ালদা ষ্টেশনের ওঠার সিঁড়ির এক পাশে বসা সত্তর-পঁচাত্তর বয়সের এক বৃদ্ধার দিকে চোখ গেল নীলের। পরনে ময়লা সাদা কাপড়, হাতে কাপড়ের ব্যাগ, চোখে মোটা কাঁচের চশমা। বৃদ্ধাকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল নীলের। কিছু মনে করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বৃদ্ধার দিকে...। “কোথায় যাবেন মা...?”
#
বাঁকুড়া রেলকলোনির এক দেওয়ালে দু’টি কোয়াটার। একটিতে স্বপন ও তার বাবা-মা, অন্যটিতে নীল ও তার মা। নীলের যখন পাঁচ বছর বয়স, রেল-ইয়ার্ডে সান্টিঙ করানোর সময় অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান নীলের বাবা। কম্পেনসেশন গ্রাউন্ডে রেলে টিকিট কালেক্টটারের চাকরী পান নীলের মা।
সেই ছোট্ট বেলা থেকে নীল আর স্বপন ছিল জগাই-মাধাই। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই স্বপনের মাকে ‘মা’মনি’ বলে ডাকতো নীল। মা’মনির হাতের ‘মুড়ির মোয়া’ আর পোস্তর বড়া প্রিয় ছিল নীলের। স্বপনের বাড়িতে পোস্তর হলেই তার জন্য দুই পিস বরাদ্দ ছিল। সেই স্বাদ যেন এখনো অনুভব করে নীল। আবার মুড়িরমোয়া চুরি করতে গিয়ে অনেক সময় ধরা পড়ে কানমলাও খেয়েছে দুজনে, যদিও পরক্ষণে জড়িয়ে ধরে আদরও করেছেন দুই ছেলেকে। অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ মহিলা ছিলেন তিনি। কোনও দিন স্বপনের থেকে আলাদা করে দেখেন নি। বরং স্বপনের থেকে একটু বেশীই যত্ন করতেন পিতৃহারা নীলকে।
বাঁকুড়া জেলা স্কুলের ভালো ছাত্র ছিল স্বপন। উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ছিল অনেক বেশী। তবে এনিয়ে কোনোদিন কোনও সমস্যা হয়নি নীলের সাথে। হাইয়ার সেকেন্ডারিতে জেলায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল স্বপন। পাশ করেই যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। আর নীল... বাঁকুড়ার কমার্স নিয়ে ‘সম্মিলনী কলেজ’। স্বপন কলকাতায় চলে যাওয়ায় নীলকে আঁকড়ে ধরেছিলেন মামনি। নীলের মা’র নাইট ডিউটি থাকলে রাতে স্বপনকে নিয়ে নীলদের কোয়াটারে এসে শুতেন। অবশ্য নীলের মা’র তাতে সুবিধাই হত।
কয়েক বছর পর, প্রোমোশন পেয়ে স্বপনের বাবা মা’মনিকে নিয়ে চলে গেলেন আদ্রা রেলওয়ে ডিভিশনাল হেডকোয়াটারে। যাওয়ার সময় মা’মনিরকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়েছিল নীল। ট্রেন ছাড়ার সময় চোখ ভিজে যাচ্ছিল নীলের। কেঁদে ফেলেছিলেন মা’মনি। আদ্রা চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন শনিবার হলেই নীল আদ্রায় মা’মনির সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে আসতো। গ্র্যাজুয়েশনের পর নীলের মা পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায় মামার কাছে তাঁর চার্টার ফার্মে কাজ শিখবে বলে। তারপর চিঠিতে যোগাযোগ ছিল বেশ কিছুদিন। কালের নিয়ম আর পারিপার্শিক চাপে স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুনেছিল স্বপন বাবা রিটায়ার করার পর দেশবাড়ি বনগাঁর কাছে ‘গোপালনগর’ ফিরে গেছেন। স্বপন ব্যাঙ্গালোর...। নীলের মা রিটায়ার করার পর ছেলের কাছে সোনারপুর বাসায় চলে আসেন। কিন্তু সুখ বেশী দিন সহ্য না, নীলের বিয়ের কথাবার্তা চলতে না চলতেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। এই নিয়ে আপশোস ছিল নীলের...। সারা জীবন কম কষ্ট করতে হয়নি মা’কে।
বৃদ্ধাকে ধরে ট্যাক্সি বুথে কাছে নিয়ে গেল নীল। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সাবধানে বৃদ্ধাকে বসিয়ে দেয় নীল। মা’মনির শারীরিক যা অবস্থা অফিস ফিরতি ট্রেনে উঠতে পারবেন না। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে নানান প্রশ্ন সামনে আসে...। গোপালনগর থেকে মামনি এখানে কী করে? এই সময়ে? তিনি কি স্বপনের খোঁজ করছেন? তাহলে কি স্বপন কলকাতায়... কোথায়...? থাক..., এসব পরে দেখা যাবে। এখন আপাতত বাসায়......। যেতে যেতে ঝাপসা চোখে জিজ্ঞেস করলেন নীলকে; “তুমি কে বাবা? তুমি কি আমার স্বপনের বন্ধু ? আমাকে নিতে এসেছো?” নীল হেসে বললো -“ হ্যাঁ মামনি, আমি স্বপনের বন্ধু, তোমার আর এক ছেলে। আমি বাঁকুড়ার নীল। আমাকে চিনতে পারছো না মা’মনি...?”। নীলের কথা শুনে বৃদ্ধা চশমার মোটা লেন্সের মধ্যে দিয়ে ফ্যালফ্যল করে চেয়ে রইলেন তার দিকে। মনে হলো স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন তিনি। বহুদিন পর আত্মপ্রসাদ অনুভব করল নীল। খুশীতে ভরে উঠল মন। রাজপথের দু’ধারে উৎসবের আলোকসজ্জা আর ঢাকের শব্দে মায়ের আগমনী বার্তায় তখন মাতোয়ারা সন্ধ্যা..।
.....................
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন