কোল্হাপুর ডায়েরী ৩
সূর্য ওর কোম্পানির এইচ আর ডিপার্টমেন্টকে জানিয়ে রেখেছিল ওদের পৌঁছবার কথা। সেই রাতটার মতো কোম্পানির তরফ থেকে কোল্হাপুরের একটি নামী
হোটেলে দুটো রুম অ্যলটেড ছিলো যাতে এতটা জার্নি
করে এসে রাতটুকু নিশ্চিন্ত আয়াসে বিশ্রাম নিতে পারে।
হোটেলের লবিতে এইচ আর ডিপার্টমেন্টের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সব ব্যবস্থাপনা মিটিয়ে রুমে আসতে আসতে সন্ধ্যার তিমির তখন ক্রমশ নিবিড় হয়ে আসছে।
রুমে ঢুকে খানিকটা ফ্রেশ হতে না হতেই কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে রুম সার্ভিস হাজির। এতটা জার্নিতে খিদেও পেয়েছিল একটু। ছেলে এবং মেয়ে ওদের চেঞ্জ নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। আর সূর্য চেঞ্জ করে সুখশয্যায় গা এলিয়ে দিতেই নিদ্রাদেবীর করতলগত।
নতুন জায়গায় আসার আবেগে আর উত্তেজনায় মিমির ভেতরে তখন সহস্র অশ্বক্ষুরের শব্দ।
সূর্য অকাতরে ঘুমোচ্ছে। দরজাটা আলতো করে টেনে মিমি এলো পাশের ঘরে। পুত্র এবং কন্যা দুজনেই চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসেছে দাবাখেলার সরঞ্জাম নিয়ে। ওদের ব্যাকপ্যাকের সর্বক্ষণের সঙ্গী এই চেসবোর্ড। পাসটাইম হবিও বটে! খুব যখন ছোট সূর্য ই শিখিয়েছিল। এখন ফাঁক পেলেই দুই ভাইবোন খেলতে বসে পড়ে এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।
মিমি পায়ে পায়ে এগোলো ওদের ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিটার দিকে। কি নিরিবিলি শান্ত নির্জন পরিবেশ!।গার্ডেন ফেসিং ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়ে মিমি নতুন শহরের গন্ধটাকে বুকের ভেতর ভরে নেবার চেষ্টা করছিলো।
খানিকক্ষণ পরে রুমে ডিনার ও সার্ভ করে গেল। সূর্য ততক্ষণে একটা ন্যাপ নিয়ে এই ঘরে এসে বসেছে। ওদের খেলার মাঝখানে ছোটখাটো ফুটনোট ও দিয়ে চলেছে। প্রায় সবটাই মেয়ের পক্ষে আর তাই ছেলে আরো সিরিয়াস ভঙ্গীতে পরের মুভটা নিয়ে যৎপরোনাস্তি দার্শনিক হয়ে পড়ছে। ছেলের অবস্থা দেখে মিমির হাসি পেয়ে গেল।
ছেলেকে বললো-' তোর বাবার খালি পার্শিয়ালিটি। এবার
রাখ দেখি। চল্ নতুন জায়গার খাবারগুলো টেষ্ট করে দেখি। সূর্য হার্ডকোর ননভেজ। মেনুতালিকায় কোল্হাপুরী
শুখা মটন জিরা রাইস আর ভাকরি। জিরা রাইসের সাথে রসনা পরিচিতি থাকলেও বাকি দুটো নিতান্ত ই এযাবৎ
অনাস্বাদিত।
কোল্হাপুরের লোকেরা সাধারণত একটু মশলাদার খাবার পছন্দ করে। কোল্হাপুরী মাটন তার অন্যতম। এটা বানাবার বিশেষ একটা পদ্ধতি আছে। স্বাদেগন্ধে অতুলনীয় এই পদটির রন্ধনপ্রণালী পরে মিমি আয়ত্ত্ব করেছে।কোল্হাপুরী মাটনের সাথে আরো দুটো পদ পরিবেশিত হয়।
এই দুটি যথাক্রমে তাম্বড়া রসা আর পান্ডরা রসা।
রসা অর্থ হলো রস। কোল্হাপুরী রান্নায় শুকনো নারকেলের প্রচলন খুব বেশী। প্রায় সব রান্নাতেই শুকনো নারকেলের গুঁড়ো ব্যবহার করা হয়।
তাম্বড়া রসাটি তাম্রবর্ণের বা রক্তাভ। লাল লঙ্কা এর প্রধান উপকরণ। পান্ডড়া শব্দটির মারাঠি অর্থ হোলো সাদা। এর বর্ণটিও তাই সাদা। এই রসটি বানাবার মূল উপকরণ হোলো প্রধানত তিল পোষ্তদানা আর শুকনো নারকেল গুঁড়ো। এগুলি একত্রে পিষে তরল চাটনির মতো তৈরী করা হয়। অ্যাপেটাইজার বা খিদেবর্ধক হিসেবে এটি ভালো কাজ করে। আর তাম্বড়া রসা হোলো মাংসের গ্রেভি বা জলীয় অংশ। শুকনো মাংসের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও এখানে বাটারমিল্ক বা ছাঁস পরিবেশন করা হয় হজমকারক হিসাবে। এটি মিমির খুব পছন্দের পানীয় একটি।দই দিয়ে ঘোলের মতন বানিয়ে তার মধ্যে পুদিনা পাতাও ভাজা জিরেগুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে পরিবেশন করা হ য়। অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত ও পুষ্টিবর্ধক পানীয় হিসাবে এটি খুব জনপ্রিয় ও বটে। ভাকরি হলো যবের রুটি। এটিও অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত।। এই হোটেলের প্রতিটি খাবারের স্বাদ নিতে নিতে কোল্হাপুরী রন্ধনপ্রণালীর এক অনন্যতা অনুভব করছিলো মিমি যা পরবর্তীতে তাকে কোল্হাপুরী মশলার স্বকীয়তা সম্পর্কে উৎসাহী ও কৌতূহলী করে তোলে।
সবশেষে ছিলো এক বিশেষ ধরণের লঙ্কার আচার যাকে ওরা থেচা বলে। মিমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেও সূর্য বা ছেলেমেয়েরা কেউই আর মখে তুলতে পারলোনা। ওরা কেউই তেমন ঝাল খেতে অভ্যস্ত নয়।
ডিনারের পাট চুকিয়ে ছেলেমেয়েকে গুডনাইট জানিয়ে
নিজেদের ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখের পাতা জুড়ে নেমে এলো নিবিড় ঘুম।রাস্তার ধকল নতুন জায়গায় আসবার উত্তেজনা সর্বোপরি ভোজনের পারিপাট্য মিমিকে আর জেগে থাকার অবকাশ দিলোনা। রাতবালিশের নিবিড় কোমল স্নেহস্পর্শে তলিয়ে যেতে লাগলো নিশ্চিন্দিপুরীর স্বপ্নরাজ্যে।
সকালে ঘুম ভাঙলো সূর্যের ডাকে। সামনের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ন টা বাজে।পাশের বেডসাইড টেবিলে মর্নিং টি আর বিস্কিট রাখা। ওকে চোখ মেলতে দেখেই সূর্য বললো-
'মিমি আমাদের প্যাকার্স অ্যান্ড মুভার্সের গাড়ি এসে গেছে। কোম্পানির লোক ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছে আসবাবপত্র ঠিকঠাক অ্যারেঞ্জ করার জন্য।তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাষ্ট করে নাও। আমরা ফ্ল্যাটে যাবো।
সূর্য ই পাশের রুম থেকে ছেলেমেয়েকে ডেকে তুললো।ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে রেডি হয়ে আবার নতুন ঠিকানায়।
হোটেলের বেশ কাছেই নির্ধারিত ফ্ল্যাটটি। একেবারে তিনরাস্তার মোড়ে। একেবারে উল্টোদিকে বিবেকানন্দ কলেজ। কলেজ ক্যাম্পাসে স্বামী বিবেকানন্দের একটি আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত।
ফ্ল্যাটে ঢুকে মিমির মনটা আনন্দে ভরে গেল। তিনটে বেডরুম ড্রইং ডাইনিং কিচেন মিলিয়ে অনেকটাই স্পেশাস। সবচেয়ে বড় কথা বেডরুমগুলো সবকটাই রাস্তার অভিমুখী। মিমিরা পৌঁছতে পৌঁছতে কোম্পানির লোকজন ততক্ষণে ফার্নিচার মোটামুটি সেট করে ফেলেছে।কিচেনে ঢুকে দেখলো অল্পবয়েসী একটি ছেলে বাসনপত্র সব বের করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছে। নাম জানালো আশীষ। কোম্পানির পিওন। সূর্যর অফিসে লাঞ্চ পৌঁছোবার দায়িত্ব ওর তার সাথে ফাঁকে ফাঁকে ঘর গেরস্থালির কাজে সাহায্য করার জন্য ওকে নিয়োগ করা হয়েছে। মিমির অবশ্য এই ব্যাপারটা একেবারেই না পসন্দ। অফিসের বেয়ারাকে দিয়ে ঘরের কাজ করাবার একেবারেই পক্ষপাতী নয় সে। কথায় কথায় জানলো ছেলেটি কোল্হাপুরের শিবাজী ইউনিভার্সিটি থেকে মারাঠি ভাষায় এম এ পাশ করেছে!ছেলেটি ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
নম্র ভদ্র বিনয়ী ছেলেটি সহজেই সকলের মন জয় করে নিল।
ক্রমশঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন