আঁধার
ট্রেন এসে দাঁড়ালো যখন রাত দশটা বেজে গেছে। কুন্দতলীস্টেশনে রাত দশটা মানে, মনে হবে মাঝরাত।
তারপরে,সেই রাত যদি মাঘ মাসের এমন হাড় কাঁপানো শীতের রাত হয়! আসলে,
সারা দুনিয়ার ভোল বদলে যাবে,কিন্তু কুন্দতলী রয়ে যাবে সেই নবাব সিরাজদৌল্লার আমলেই। মুর্শিদাবাদ জেলার এই জায়গাটা নবাব আমলে বিখ্যাত ছিল। ঘসেটি বেগমের প্রিয় জায়গা এটি। নিজের পছন্দ মতো মহল বানিয়ে, খানা পিনা, মৌজ মস্তি করতেন প্রচুর। সে এক সুন্দর সময় ছিল বটে কুন্দতলীর! লোকের মুখে মুখে এখনো সেই সমস্ত গল্প ঘুরে বেড়ায়। তবে এখন সে জায়গার হতশ্রী দশা। নদী মজে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঘসেটি বেগমের সাধের বিলাস মহল এখন ভূতনী মহল বলা যায়। চারিদিকে আগাছা। বড় বড় তেঁতুল বট এই সব গাছ। রাস্তা ঘাট ভাঙাচোরা। মাঝে মাঝে দু এক দল টুরিস্ট আসে। তবে খুব কম। মুর্শিদাবাদে কী কম জায়গা আছে যে লোক মরতে কুন্দতলী আসবে? গাঁ এখন দরিদ্র। হতশ্রী দশা। তবু, দু এক ঘর হিন্দু মুসলমান যে আছে, পরস্পর মিলে মিশে ভাৱভালোবাসা করেই আছে। সুখে দুখে, শীতে গ্রীষ্মে একে অন্যের ভরসা হয়ে বেঁচে আছে।
এই যেমন আজকের কথাই যদি ধরি। শীতের মাস। কুন্দতলী থেকে ট্রেনে বাসে চেপে কেউ যাবে সেই কলকাতা থেকে ওষুধ আনতে? আসতে তো রাত হবেই জানা কথা।। পরিশ্রমের ক্লান্তি আর পয়সা খরচের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু, কুন্দতলীর মানুষেরা আলাদা। এক জন আরেক জনের জন্য জান কবুল করে দেবে।
গাঁয়ের মাথা ছিদামখুড়ো যখন, নিজামুদ্দিন কে ডেকে বললেন," বাবা। তুমি ছাড়া তো কাউরে দেহিনা। গাঁয়ে ওই তো সরকারী বেকার হাসপাতাল। সেখানে আজ দুদিন হলো, আনাথা মেয়েটা ভর্তি। বাপ নাই ।মা নাই। শ্বশুর বাড়ী থেকে ফাইল্যা দিয়া গেছে। বলে কিনা কুষ্ঠ। বাবা নিজাম। ডাক্তার টা খারাপ না। ওষুধ নাই, তো কী করে বেচারা। বাবা। গাঁয়ে তুমি হাড্ডাগাদ্দা জোয়ান। তোমারে ছাড়া আর কারেই বা কই?"
তা নিজামুদ্দিন আপত্তি করার ছেলেই নয়। সেই একমাত্র যে এক আধবার কলকাতা যায়। সেও অবিশ্যি কদাচিৎ।। তাদের এই কয় ঘরের , গাঁয়েই মরণ ,গাঁয়েই জনম-- দরকার কী কলকাতা যাবার? তবে কিনা ,ফুলমণি গাঁয়ের মেয়ে আর ছোটবেলাতেই বাপ মা মারা যায়। ওলাওঠায় মরণ ! তাকে ঠেকানোর সাধ্য কার? একরত্তি মেয়ে ফুলমণিকে বুকে করে আপন করে নিলো গাঁয়ের লোক। চোখের মণি হয়ে বড় হয়েছে। একটু এদিক ওদিক হলেই ফুলুর ঠোঁট ফুলে যাবে। আর যত জ্যেঠু, চাচা, ফুফা, পিসী সব ঝাঁপিয়ে পড়বে। কুন্দতলী এমনই প্রেমময় এক গাঁ।
নদী শুকনো তো কী আছে? বিজলী বাতি নেই তো কী আছে? ভাঙা রাস্তা তো কী আছে? দুঃখ দারিদ্র আছে তো কী আছে? কুন্দতলীর এই দশঘর হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে আপন ভাব যে ভালোবাসা আছে, তার জোরে তারা টিঁকে নেই ,বেঁচে আছে। হাসি আনন্দে ভরে আছে।
*
নিজের মনে এই সব ভাবতে ভাবতে সাবধানে পথ চলছিল নিজাম। না ভেবে তো উপায় নেই। ইস্টিশন থেকে গাঁ পর্যন্ত হেঁটে অনেক খানি যেতে হবে। আলো নেই। শীত পড়েছে খুব আজকে। সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো কায়দা হলো নিজের সঙ্গে গল্প করা। ওষুধ টা ঝোলার মধ্যে রাখা। ফুলির ওষুধ। আহা! ডাক্তার বললো কুষ্ঠ নাকি হয়নি ফুলির ? ওর বর খারাপ চরিত্রের। বরের থেকে খারাপ রোগ হয়েছে ফুলির। এত করে ছেলে দেখে ভালোঘর দেখে ভিন গাঁয়ে বিয়ে হলো ফুলির। সে ছেলের ভেতরে ভেতরে যে এই রোগ , কী করে জানবে মানুষ? রক্ত গরম হয়ে যায় নিজামের। সেও তো ভাই ফুলির? হিন্দু মুসলমান বিভেদ তারা মানেনি কোনোদিন । মানবেও না। আহা! অষুধ টা পড়লে যন্ত্রণা টা যদি কমে একটু ফুলির।
*
উফ! জব্বর শীত পড়েছে আজ। অন্ধকার রাত, গাঢ় কুয়াশায় আরো যেন ভয়ঙ্কর লাগে। চেনা রাস্তা। চোখে সাতপুরু কাপড় বেঁধে দিলেও চলে যাবে নিজাম। তবু কেমন ভয় ভয় করে তার। মরা নদীর উপর থেকে ঠান্ডা বাতাসের ঘূর্ণী ঘুরে বেড়ায় একটা। মুখে চোখে ছুরির মতো বেঁধে তা। নিজাম জোরে ঠোক্কর খায় একটা। সামলে ধরে ওষুধের ঝোলা। সাবধানে পার হতে হবে সামনের মাঠটা। বড়ো খোলা মাঠ। গাঁয়ের গরু চরে বেড়ায়। বল নিয়ে খেলে বেড়ায় ছেলেরা। শিশির ভেজা মাঠ। পায়ের কমদামী চটি ভিজে ওঠে। টর্চের বালাই নেই। চোখ টাকেই তীব্র করে চলে নিজাম। সবুজ মাঠ, শীতের কুয়াশায় কালো চাদরে মোড়া মনে হয়। দূর পর্যন্ত কেমন অদ্ভুত রহস্যময়তা। নিজামুদ্দিন কেমন ঘাবড়ে যায় হঠাৎ। তার শরীরে একটা অস্বস্তি জাগতে থাকে। কেউ কী আছে তার পেছনে? ধুর। সে কী ভূতের ভয় পাচ্ছে নাকি? ধুর। মনের জোর বাড়িয়ে জোর কদমে হাঁটে। ছিদাম খুড়ো গাঁয়ের মাথা। তিনি তার উপরে ভরসা করেছেন। এর পরে আর কোনো কথা হবে না। আর যাকে মানা করুক , ছিদাম খুড়োকে মানা করবে না, নিজাম। করতেই পারবে না। দুদিন পরে এই খুড়োকে -- -- নিজের মনে একটু মিচকে হাসলো সে।
*
মাথার উপরে প্রচন্ড জোরে লাঠির বাড়িটাতে ছিটকে ঘাষের উপরে মুখ থুবড়ে পড়লো নিজাম।। পরপর আরো জোর বাড়ী। নিষ্প্রাণ দেহটাকে ,পা দিয়ে ঠেলে হিস হিস করে উঠলো ছিদাম খুড়ো," বামন হয়ে চাঁদে হাত? শালা সুমুন্দির পো। তোদের সাথে মিশি বলে, আমার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবি? এতবার সাবধান করেছি। শুনলি না। মর এখন।" থু থু করে থুতু ফেলে, ঝোলা থেকে ওষুধ বার করে,অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ছিদাম।। গাঁয়ে বললেই হবে,ওষুধ তাকে পৌঁছে দিয়ে নিজাম মাঠের দিকে চলে গিয়েছিল। তারপর তিনি আর কিছু জানেন না। গাঁয়ের মাথা তিনি। সমাজ রক্ষার দায়িত্ব তো তাকেই নিতে হবে।
কুন্দতলী ঘসেটি বেগমের প্রিয় জায়গা ছিল। তিনি ভালোবাসতেন জগৎশেঠ কে। এই খানে গড়েছিলেন তাঁর প্রিয় এক প্রেমের মহল। শায়েরী লিখতেন সুন্দরী বেগম। সিরাজ জানতে পেরে গুঁড়িয়ে দেয় সেই মহল। দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জলে কুন্দতলীকে বিদায় জানিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে যায় ঘসেটি।
অন্ধকার আর ইতিহাস এক রকমই থাকে। বদলে যায় শুধু তারিখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন