Carta a dos desconocidas দুজন অচেনা মানুষকে লেখা চিঠি / Octavio Paz ওক্তাভিও পাস/ অনুবাদ- জয়া চৌধুরী
এখনও জানি না তোমার কী নাম। তোমাকে এত কাছের মনে হয় যে কোনো একটা নামে তোমাকে ডাকা যেন আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মত মনে হয়। যে অক্ষর সাজিয়ে আমার নাম তৈরী হয় তার সারাংশ-র চেয়ে তুমি যেন একদম আলাদা… এমনটাই টের পাই। বরং ওর নাম আমি চিনি, বড় বেশিই চিনি, এবং আমাদের মাঝখানে এক অদৃশ্য ও নমনীয় দেয়ালের মত ওই নাম কতদূর অবধি যেতে পারে তাও জানি।
এসব কিছু তোমার কাছে নিশ্চয় ধাঁধার মত লাগছে। তোমাকে ব্যাখ্যা করে বলতে চাইছি ওকে কী ভাবে চিনলাম, তোমার উপস্থিতি সম্বন্ধে কীভাবে সজাগ করেছি ওকে, এবং কেনই বা তুমি এবং ও দুজনে একই রকম আবার একরকম নয়ও বটে।
প্রথমবারের কথা মনে পড়ে না আমার। আমার সঙ্গেই জন্মেছিলে নাকী সেই প্রথম দেখা হওয়ার বিষয়টা এত পুরনো যে সেটা আমার ভেতরেই পরিণত হওয়ার এবং প্রোথিত হয় যেন, সেটুকু সময় ছিল তোমার কাছে।
আমার ভেতরে দ্রবীভূত থাকো তুমি। অন্দরের বাকীটুকুর থেকে কিচ্ছুই তোমাকে পৃথক করতে, তোমাকে স্মরণ করতে, তোমায় নতুন করে চিনতে অনুমতি দেবে না। কিন্তু নৈঃশব্দ্যের দেয়াল দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু কাল ভাবনার পথ রুদ্ধ করে রাখে। নাভি থেকে কপাল পর্যন্ত বেয়ে ওঠে এক বর্ণনাতীত তরঙ্গ। শূন্যের সে তরঙ্গ এবং সেখানেই তা থেকে যায় এক আকাঙ্ক্ষা হয়ে যা সন্তুষ্টি আনে না। একপ্রকার দণ্ডাজ্ঞা যা টলে না। এক অদৃশ্য বোধগম্যতা যা কখনও কখনও খুলে যায় আমার সামনে। অনুপস্থিতির এক বিরাট মাতৃমুখ- এক জৃম্ভণরত যোনি। আমাকে গিলে ফেলে, গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করে, এবং বহিষ্কার করে- নির্দিষ্ট সময়ে; পুনর্বারও ঠিক সেই একই সময়ে। মাথা ঘোরানো এবং বমি আমায় যা প্রতিবার নিচে ছুঁড়ে দেয়। চোখের আন্দাজ অনুযায়ী প্রতিটি কন্ঠস্বর মিনারের ওই উঁচু স্তর থেকে চেয়ে থাকে আমার দিকে, আমার নিজের চোখদুটিও তাই… সবকিছু শেষ পর্যন্ত আমাকে যা শেখানো হয়েছে যে আমি এক অনুপস্থিতি ছাড়া আর কিছুই নই। এই-ই প্রকাশিত হয়েছে আমার কাছে, এই-ই উন্মুক্ত করে দিত – কীভাবে যে বলব? - তোমার উপস্থিতি। তুমি আমার ভেতরে সেই যে অপ্রতিরোধ্য গিঁটগুলি মত বসবাস করতে তা মসৃণভাবে সরে যায় সূক্ষ্ম যান্ত্রিকতায়। এবং তুমি যদি এগিয়ে যেতে বাধা না দিয়ে থাকো, ওরা ওকে উন্মত্ত করে তোলে যতক্ষণে না এর কলকব্জা ক্ষয় হয়।
দ্বিতীয় দফাঃ একদিন তুমি আমার মাংস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলে। সাদা পোশাক পরা এক দীর্ঘকায়া স্বর্ণকেশীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে, এক ছো্ট জেটিতে সে হাসিমুখে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল। মনে পড়ে চকচকে কালো কাঠ, ধূসর জল ওর পায়ের কাছে খেলা করছিল। সেখানে বিপুল পরিমাণ মাস্তুল, পাল, নৌকো, পাখি ও সামুদ্রিক পাখিরা কিচিরমিচির করছিল। তোমার পিছু পিছু গিয়ে সেই নাম না জানা মেয়েটির কাছে গেলাম। কোনো কথা না বলে আমার হাতখানি ধরল সে। নির্জন বালুভূমিতে হাতে হাত ধরে দুজনে দৌড়েছিলাম যতক্ষণ না পাহাড়ের কাছে পৌঁছই। সমুদ্র ঘুমোচ্ছিল। ওখানে গান গাইলাম, নাচলাম। ওখানেই কোন এক ভাষায় ঈশ্বরের নিন্দা করলাম। এখন সে ভাষা ভুলে গিয়েছি। আমার বান্ধবী প্রথমে হাসছিল- পরে কাঁদতে শুরু করল। শেষে পালিয়ে গেল। প্রকৃতি আমার চ্যালেঞ্জের সামনে অত নির্মম ছিল না। সমুদ্র যখন তার হাত মুঠো করে আমায় ভয় দেখাচ্ছিল, সূর্য তখন ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সরল পথে নেমে আসছিল আমার দিকে। নক্ষত্র যখন আমার রুক্ষ মাথায় থাবা বসাল, আমায় পুড়িয়ে দিতে শুরু করল। তারপরে নিজের শৃঙ্খলা পুনস্থাপন করল। সূর্য তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল অস্তে, সমস্ত চরাচর অসম্ভব একলা হয়ে গেল। পাথরের ফাঁকে, ওই যেখানে পাখিরা তাদের ছোট্ট ছোট্ট ডিম লুকিয়ে রেখেছিল, সেখানে আমার ছাই খুঁজেছিল বান্ধবী।
সেইদিন থেকে ওর পিছু পিছু যাই আমি। (এখন বুঝি আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম)। বহু বছর পরে, অন্য কোন দেশে কোন এক মন্দিরের লাল দেয়ালগুলো গোধূলির আলোকে যখন গিলে ফেলছিল, সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে ফের ওকে দেখলাম। ওকে আটকালাম, কিন্তু আমায় ও চিনতে পারল না। যাতে ও টের না পায় তেমন এক কৌশলে নিজেকে পালটে ফেললাম ওর ছায়ায়। সেদিন থেকে ওকে ফেলে যাই নি কোথাও। বছরের পর বছর মাসের পর মাস, নৃশংস মুহূর্তগুলোয় লড়েছি, ওর ভেতরে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি আমাদের সেই প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি। ব্যর্থ চেষ্টা করেছি বোঝাতে কীভাবে ওর ভেতরে বাস করতে চেয়ে তুমি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছে আমার থেকে। সমুদ্রের ধারে আমাদের একসাথে হাঁটা, আমার বীভৎস বোকামি। তুমি আমার কাছে যতখানি ছিলে আমি ওর কাছে ঠিক ততখানি বিস্মৃতি।
জীবন খরচ করে ফেলেছি তোমাকে ভুলতে চেয়ে, তোমায় মনে করতে চেয়ে। তোমার কাছে থেকে পালাতে চেয়ে এবং তোমাকেই অনুসরণ করতে গিয়ে। যখন ছোট ছিলাম তোমাকে আবিষ্কার করেছিল সদ্য বৃষ্টি ধোঁয়া এক বাগানের ছোট্ট পুকুরে তখন যেমন ছিলাম এখনও ততখানি একলা। যখন বয়ঃসন্ধি তোমাকে দুটি ভাঙা মেঘের ফাঁকে দেখেছিলাম, এক বিকেলে ধংসের ভেতরে। তখন যেমন ছিলাম এখনও ঠিক ততখানি একলা। কিন্তু আমার নিজস্ব তুরপুনে আমি পড়ব না। অন্য শরীরে গাঁথব। অন্য কোন চোখে যা প্রসারিত এবং সংকুচিত হয়, আমাকে গ্রাস করে, আমায় অবহেলা করে, এক কালো উন্মোচন আমায় স্পন্দিত করে, জীবন্ত প্রবাল যেন, শীতল ক্ষতের মত লোভী। শরীর যেখানে হারিয়ে ফেলি শরীর, অনন্ত শরীর। কখনও যদি আমার পতন শেষ হয়, ওখানে, পতনের ওই অন্য প্রান্তে, হয়ত জীবন আমার দিকে উঁকি দেবে। এক সত্য জীবনে। যেখানে রাত কিংবা দিন কোনটাই নয়, সময় ও উসময় কিছুই নেই, স্থাবর ও জঙ্গম কোনটাই নয়, জীবনের এক ফুটন্ত প্রাণ, এক বিশুদ্ধ প্রাণ। তবে হয়ত এসব কিছুই মৃত্যুকে আহ্বান করার এক পুরনো ধরন হতে পারে। যে মৃত্যু আমার জন্মের সঙ্গেই জন্মেছিল, যা অন্য শরীরে বাস করতে আমার শরীরে ছেড়ে চলে গিয়েছে।
ঋদ্ধ হওয়ার মত পাঠ অভিজ্ঞতা। অনুবাদ প্রয়াসকে কুর্নিশ।
উত্তরমুছুনরাতে একা বসে বসে পড়ছি। দুটো বাজে প্রায়। এমন চিঠি, সংগ্রহে রাখার মত, আবার পড়ার মত।
মানুষের ধৈর্যও কমে গেছে, এমন মননশীল পত্র লেখার, পড়ার। বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে মন।